নজরুল-জীবনের কালানুক্রমিক সূচি
দ্বিতীয় পর্ব
১৩-১৭ বছর অতিক্রান্ত বয়স
নজরুল গবেষকদের মতে নজরুল ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর
মাসে (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩১৯ বঙ্গাব্দ) বাঙালি ক্রিশ্চান
রেলওয়ে গার্ড সাহেবের
গৃহভৃত্যের চাকরি নিয়ে
চুরুলিয়া ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য,
১৩২০ বঙ্গাব্দ ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার
২৪ মে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৩ বৎসর বয়স পূর্ণ
হয়েছিল। এই বিচারে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩১৯) ছিল নজরুলের ১৩ বৎসর ৬-৭ মাস অতিক্রান্ত বয়স।
নজরুলের ১৪ বছর অতিক্রান্ত বয়স ১৩২১ বঙ্গাব্দের
১০ই জ্যৈষ্ঠ (রবিবার
২৪ মে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ)
সম্ভবত নজরুল তাঁর ১৩ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষে বা ১৪ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের
শুরুতে। নজরুল গার্ড সাহেবের
চাকরি থেকে অব্যাহতি পেয়ে আসানসোলের একটি রুটির দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন। এটি রুটির
দোকান ছিল, না নাকি রুটির তৈরির কারখানা ছিল এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে রুটির
দোকান/বেকারির মালিকের নাম নিয়ে। বিভিন্ন গ্রন্থে এই মালিকের যে নামগুলো পাওয়া যায়,
তাহলো- এম বখশ, আব্দুল ওয়াহেদ এবং এম আহাদ বখশ। আবার এই দোকানে কাজ করার জন্য তিনি
কত বেতন পেতেন, তা নিয়েও মতভেদ আছে। এই মতভেদে হলো- কারো মতে মাসিক ১ টাকা বা
মাসিক ৫টা বেতন। যেহেতু এসকল তথ্যের যথার্থ প্রমাণ নেই, তাই এ নিয়ে যুক্তিতর্ক বাদ
দেওয়া যেতে পারে।
নজরুলের ১৫ বছর অতিক্রান্ত বয়স
নজরুলের ১৬ বছর অতিক্রান্ত বয়স
প্রসাদপুরের বাংলোতে নজরুল
রেলওয়ে গার্ড সাহেব নজরুলকে শুধু
গানের জন্য সাথে নিয়েছিলেন, তা নয়। গার্ড সাহেবের বাংলোতে একজন বিশ্বস্ত গৃহভৃত্যের
প্রয়োজন ছিল। সেখানে গৃহভৃত্যের গান জানাটা ছিল বাড়তি পাওনা। উল্লেখ্য, প্রসাদপুর বর্তমান
ভারত
প্রজাতন্ত্রের
পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রদেশের
হুগলি জেলার হরিপাল সমষ্টি ব্লকের একটি গ্রাম। থেকে
গার্ড সাহেবের কর্মস্থলের দূরত্ব ছিল দেড় মাইল।
বাংলো থেকে গার্ড সাহেব অফিস করতেন পায়ে হেঁটে। ফলে গার্ড সাহেবকে প্রায়ই প্রয়োজনীয়
মালামাল বহন করে বাংলোতে আসতে হতো। প্রথম দিকে নজরুল তিনি গার্ড
সাহেবের মালামাল বহনের কাজ শুরু করেন। এছাড়া নজরুল গার্ড সাহেবে বাসা থেকে তাঁর জন্য দুপুরের খাবারও
পৌঁছে দিতেন। কোনো কোনো দিন আসানসোল থেকে গার্ড সাহেবের জন্য বিলিতি মদ আনতে হতো।
আর অবসর মুহূর্তে গার্ড সাহেবকে গান শোনাতে হতো।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর 'নজরুল-জীবনী' গ্রন্থে গার্ড সাহেবের
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পিছনে একটি অদ্ভুদ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হলো-
গার্ড সাহেব নিয়মিত মদ্যপানের আড্ডা দিতেন জংসন স্টেশানের এক ইংরেজ সাহেবের বাড়িতে।
সাথে থাকতেন সাহেবের স্ত্রী। এই স্ত্রীর পূর্বের স্বামীর ঔরসজাত একটি খোঁড়া কন্যা
ছিল। একদিন ওই মেয়ের পিতা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কন্যাপণ প্রাপ্তির আশায় মেয়েটিকে দাবি
করে বসেন। এই অবস্থায় গার্ড সাহেব এই মেয়েটিকে নজরুলের সাথে প্রসাদপুরের বাসায়
পাঠিয়ে দেন এবং মেয়ের বাবাকে জানানো হয় যে, মেয়েটি নজরুল নামের এক মুসলমান ছেলের
সাথে পালিয়েছে। গার্ড সাহেবের ভয় ছিল, মেয়ের পিতা হয়তো প্রসাদপুরের বাংলোয় খোঁজ
নিতে পারেন। যাতে মেয়েটির
পিতা নজরুলের সন্ধান না পান, তাই গার্ড সাহেব নজরুলকে ২৫
টাকা দিয়ে চিরকালের জন্য বিদায় জানান।
অরুণ বসু তাঁর 'নজরুল জীবনী' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- মাস দুয়েক
গারগডের কাছে গৃহভৃত্য হিসেবে ছিলেন। তা যদি হয়, তাহলে নজরুল গার্ড সাহেবের
চাকরি থাকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের দিকে।
১৩২০ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার
২৪ মে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের
১৪ বৎসর বয়স পূর্ণ
হয়েছিল। আর তাঁর ১৪ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২০
বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (রবিবার
২৫শে মে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ)।
এবং ১৪ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল
নজরুল-জীবনীকারদের মতে এই দোকানে কাজ পেলেও নজরুলের নিজস্ব কোনো ঘর ছিল না। তাই তিনি
দোকানের কাছাকাছি একটি তিন তলা ভবনের সিঁড়ির নিচে ঘুমাতেন। সে সময় ওই বাড়িতে কাজী রফিজ-উল্লাহ নামক এক পুলিশ
সাব-ইন্সপেক্টর এবং তার স্ত্রী শামসুন্নেসার থাকতেন।
সিঁড়ির নিচে ঘুমিয়ে থাকা বালক নজরুলের সাথে হয়তো প্রাথমিকভাবে আলাপ হয়েছিল। ক্রমে
ক্রমে নজরলের গান গাওয়ার গুণ, তাঁর সপ্রতিভ কথাবার্তা ইত্যদির মধ্য দিয়ে, তাঁর প্রতি
এই দম্পতির বিশেষ আগ্রহ জন্মেছিল। সেই সূত্রে নজরুলকে এঁরা মাসিক পাঁচ টাকা
বেতনে
গৃহভৃত্যের কাজে নিযুক্ত করেন। কাজী রফিজুল্লাহ
এবং তার স্ত্রী শামসুন্নেসার কোনো সন্তান ছিল না। তাই তাঁরা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ
করতেন। একদিন নজরুল শামসুন্নেসার কাছে স্কুলে লেখাপড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে, শামসুন্নেসা
স্বামীকে নজরুলকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য আবদার করেন। কাজী
রফিজুল্লাহের ছিল বদলীর চাকরি। ফলে নজরুলকে
কাছে রেখে বারবার বদলির চাকরিতে তাঁর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটবে, এই বিবেচনায়
রফিজুল্লাহ নজরুলকে
দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি করানোর উদ্যোগ নেন। উল্লেখ্য, সে সময়ে রফিজুল্লাহর বড় ভাই
সাখওয়াত উল্লাহ ময়মনসিংহের সিমলা নামক একটি গ্রামে বাস করতেন।
তাই তিনি একটি চিঠিসহ তাঁর ভাইয়ের কাছে পাঠান। ধারণা করা হয়, সময়টা ছিল ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে কাজী
রফিজুল্লাহের পাঠানো চিঠির সূত্রে সাখওয়াত উল্লাহ নজরুলকে ময়মনসিংহ জেলার
দরিরামপুর স্কুলে হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নজরুল তাঁর ১৪ বৎসর বয়স অতিক্রম করে ১৫ বৎসর বয়সে পদার্পণ
করেছিলেন।
১৩২১ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (রবিবার
২৪শে মে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের
১৪ বৎসর বয়স পূর্ণ
হয়েছিল। আর তাঁর ১৫ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২১
বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (সোমবার
২৫শে মে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ)।
এবং ১৫ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২২ বঙ্গাব্দের
১০ই জ্যৈষ্ঠ (সোমবার
২৪শে মে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ)।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়- নজরুল বিচুতিয়া বেপারীবাড়ির
নিকটবর্তী সুকনীবিলের পারের বটগাছের তলায় বসে বাঁশি বাজাতেন।
এই সময় নজরুলের ফ্রি স্টুডেন্টশীপের ব্যবস্থা করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। ওই বৎসর
স্কুলের একটি বিচিত্রানুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের 'দুই বিঘা জমি' এবং 'পুরাতন ভৃত্য'
কবিতা আবৃত্তি করেন।
কোনো কোনো নজরুল গবেষকদের রচনা থেকে জানা যায়, এই স্কুলে লেখাপড়া করার সময় নজরুল
কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। তবে সেসব কবিতার কোনো নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। তবে
নজরুল যদি কোনো কবিতা লিখে থাকেন, তা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ এর আগে মাত্র ১২-১৩
বৎসর বয়সে চুরুলিয়াতে লেটোগানের দলে গান রচনা, সুরারোপ ও পরিবেশনের সূত্রে লেটো
দলের ওস্তাদ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সুতরাং
দরিরামপুর স্কুলের ছাত্র থাকাকালে তাঁর পক্ষে আবেগ
তাড়িত কবিতা রচনা অসম্ভব ছিল না।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে
মাসে (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩২১ বঙ্গাব্দ) স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফিরে যান। এই পরীক্ষায় পাশ করে তিনি অষ্টম
শ্রেণিতে উন্নীত হন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে দরিরামপুর ত্যাগ করে চুরুলিয়ায়
ফিরে যান। পরে তিনি আর ওই স্কুলে ফিরে যান নি।
১৩২২ বঙ্গাব্দের ১০ই
জ্যৈষ্ঠ (সোমবার
২৪ মে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের
১৫ বৎসর বয়স পূর্ণ
হয়েছিল। আর তাঁর ১৬ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২২
বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার
২৫শে মে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ)।
এবং ১৬ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২৩ বঙ্গাব্দের
১০ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার
২৩শে মে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ)।
কিশোর নজরুল |
দরিরাম পুর ত্যাগ করে চুরুলিয়ায় আসার পর,
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বর্ধমান শহরের মেহেদীবাগান
'Albert Victor Instituion'
স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলটি নিউ স্কুল নামে বেশি পরিচিত ছিল। ১৯০১
খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় এই
স্কুলের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রধান শিক্ষক ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৫
খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
এপ্রিল মাসে সিয়ারসোল রাজ স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। বিষয়টি রফিকুল
ইসলাম উপস্থাপন করেছেন তাঁর 'নজরুল-জীবনী' গ্রন্থে ডঃ আব্দুস সামাদ-এর
উদ্ধৃতিতে।
নিউ স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে, নজরুল
রানিগঞ্জের
সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি
হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব সহজে তিনি এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযো্গ পান নি।
অবশ্য কোনো কোনো গ্রন্থাকার এই নিউ স্কুলের
বিষয়টিকে মেনে নেন নি। ফলে নজরুলের এই স্কুলের লেখাপড়া করার বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে
রয়েছে।
নজরুলের ১৭ বছর অতিক্রান্ত বয়স
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি এবং শ্রীশ পাল
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি,
ক্ষুদিরাম
বসুর
গ্রেফতারকারী নন্দলাল ব্যানার্জিকে কলকাতায় হত্যা করেন। এছাড়া
দলীয় কার্যক্রম চালানোর বিপ্লবীরা কিছু ডাকাতি করেন। এসব দলের সাথে
বিপিনবিহারী ছিলেন। পরে তিনি রাজবাড়িতে যোগাদান করেছিলেন রণেন গাঙ্গুলী ছদ্মনামে।
এই সময় হেরাসতুল্লাহ নামক ছাত্র তাঁকে ওই স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য
বিশেষভাবে সাহায্য করেন। উল্লেখ্য হেরাসতুল্লাহর এক আত্মীয় ছিল নজরুলের বন্ধু। সেই
সূত্রে তাঁর সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটেছিল। হেরাসতুল্লাহ নজরুলকে ভর্তি করার আপ্রাণ
চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর নজরুল একটি চিঠিতে হেরাসতুল্লাহকে তাঁর দুঃখের কথা
লিখে জানান। হেরাসতুল্লাহ ওই চিঠি শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে
দেখান। প্রধান শিক্ষক ওই চিঠি দেখে মুগ্ধ হন এবং নানাবিধ সুবিধাসহ নজরুলকে ওই স্কুলে
অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি
করে নেন।
উল্লেখ্য,
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ
সম্প্রসারিত হয়। সম্ভবত রানিগঞ্জে রেলস্টেশন স্থাপনে সিয়ারসোল রাজার প্রভাব ছিল। এই
রেলস্টেশন স্থাপনের পর রেলপথে কয়লা সরবরাহের জন্য রানিগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
পরিণত হয়। এই কারণে মঙ্গলপুর থেকে থান ও ডাকঘর সরিয়ে রানিগঞ্জে আনা হয়। রানিগঞ্জের
বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে, সিয়ারসোল রাজার উদ্যোগে
আসনসোল
থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত শাহি সড়কের সংস্কার করা হয়।
বর্তমানে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি জিটি রোড নামে পরিচিত।
জঙ্গল পরিবেষ্টিত এবং প্রায় দুর্গম জনবসতি হিসেবে বিবেচিত
রানিগঞ্জ
জন-সমৃদ্ধ
এলাকায় পরিণত হয়। প্রাক্তন মঙ্গলপুর থানা থেকে জীবিকার সন্ধানে
রানিগঞ্জে
চলে আসে।
স্থানীয় মানুষের শিক্ষার জন্য সিয়ারসোল রাজা, ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি উচ্চবিদ্যালয়
স্থাপন করেন। স্কুলটির নামককরণ করা হয়
Searsol Raj.H.E School
। এখানে
H.E
-এর
E
বর্ণটি কোন শব্দের সংক্ষেপ তা জানা যায় নি। স্কুলটি বর্তমান নাম সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুল।
পরবর্তী সময়ে সাধারণ এই স্কুলটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে কাজী নজরুল ইসলামের জন্য।
শিয়ারসোল
রাজ হাইস্কুলে অধ্যায়নের সময়
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়রে
সাথে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল। উল্লেখ্য,
শৈলজানন্দের
শিক্ষাজীবন শুরু হয় বোলপুর হাই স্কুলে। তার পর তিনি
ভর্তি হন উখরা এন্ট্রান্স স্কুলে। চৌদ্দো বছর বয়সে তাঁর মাতামহ তাঁকে রানিগঞ্জ হাই
স্কুলে নিয়ে যান। বছরখানেক সেখানে পড়াশোনার পর দেশের বাড়ি রূপসপুরে ফিরে আসেন।
সেখানে নাকড়াকোঁদা হাই স্কুলে ভর্তি হন। পরে তিনি ভর্তি
হয়েছিলেন রাণিগঞ্জ স্কুলে। অন্ডালে মাতামহের বাড়ির সখের
ফুলের বাগানের পাশে একটি মাটির ঘর ছিল। তার নাম ছিল ‘মোহামেডান বোর্ডিং’। কাজী
নজরুল ইসলাম থাকতেন সেই বোর্ডিং হাউসে। সেই সূত্রে নজরুলে সাথে
তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল। এই সময়ে তাঁর আরও
দুজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল।
এই সময় স্কুলের ফারসি শিক্ষক হাফিজনুরুন্নবীর কাছে তিনি উচ্চতর ফারসি ভাষা শেখা
শুরু করেন। একই সাথে এই স্কুলের সহকারী শিক্ষক সতীশচন্দ্র
কাঞ্জিলালের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের
পাঠ নেওয়া শুরু করেন। এই সময় তাঁর বিনামূল্যে হোস্টেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও
হয়েছিল।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল (মঙ্গলবার ২৯ চৈত্র ১৩২২), তিনি সিয়ারসোল রাজ
এইচ.ই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৌলবি
আব্দুল গফুরের বিদায় উপলক্ষে একটি 'বিদায়-কাব্যবাণী' রচনা করেন।
এই বছরের বাৎসরিক পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৩২৩ বঙ্গাব্দের
১০ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার ২৩শে মে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৬ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছিল।
আর তাঁর ১৭ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২৩ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ
(বুধবার ২৪শে মে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। এবং ১৭ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (বৃহস্পতিবার ২৪শে মে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ)।
একদিকের একটি জানালার পাশে ছোট একটি খাটিয়া। খাটিয়ার ওপর পরিষ্কার একটি বিছানা
পাতা। বিছানার ওপর ছোট ছোট বালিশ আর বই-খাতার ছড়াছড়ি। দেখলেই চেনা যায়-অগোছালো
কোন্ এক ছন্নছাড়া ছেলের আস্তানা।'
নজরুল এই সময়
শৈলজানন্দের
তাড়নায় পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরতে বসেছিলেন। সেদিন
শৈলজানন্দের
গাড়ির কোচম্যান মহবুব উভয়কে রক্ষা করেছিলেন। পরে নজরুল এই মহবুববের কাছে সাঁতার
শিখেছিলেন। এক সাঁওতাল মেয়ের রেলে কাটা পড়েছে শুনে
শৈলজানন্দ
ও নজরুল তা দেখতে গিয়ে, পথ-ভোলা এক ইংরেজি দম্পতির মুখোমুখি হন। এঁদের পথ বাতলে দিতে
গিয়ে এঁরা এঁদের ইংরেজি জ্ঞানের দৈন্য দশা উপলব্ধি করেন। পরে তাঁরা ইংরেজি শেখার
জন্য সাহেব নামক এক ইংরেজের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের এইভাবে ইংরেজি শেখা হয়ে উঠে
নি।
জুলাই ১৯১৬
এই বছরেই সিয়ারসোল রাজ
স্কুলের শিক্ষক হরিশঙ্কর মিশ্র বিএ মহাশয়ের বিদায় উপলক্ষে নজরুল রচনা করেছিলেন 'করুণ-বেহাগ'
শিরোনামে কবিতা রচনা করেছিলেন। এই শিক্ষকের বিদায়-অনুষ্ঠান কবে হয়েছিল, তা
সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।
এই মাসেই সিয়ারসোল রাজ
স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক ভোলানাথ কর্মকারের অবসর গ্রহণ করেন। তার বিদায় অনুষ্ঠান
হয়েছিল-
১৩ই জুলাই (বৃহস্পতিবার ২৯ আষাঢ় ১৩২৪)। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে নজরুল কবিতাকারে একটি অভিনন্দন-পত্র রচনা করেন।
এই অভিনন্দন পত্রের নাম ছিল- 'করুণ-গাথা'।
[দেখুন:
করুণ-গাথা]
[দেখুন:
করুণ বেহাগ ]
এছাড়া এই সময় পঞ্চু নামক একটি
সহাপাঠীর সাথে শৈলজানন্দ ও নজরুলের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। পঞ্চুর এয়ারগানে গুলি ভরে
এঁরা কলাবাগানে গিয়ে ব্রিটিশদের হত্যা করার খেলা করতেন। ব্রিটিশদের প্রতি
নজরুলের ঘৃণার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।
নজরুলের মনোলোকে স্বদেশপ্রেম এবং সেই সূত্রে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল
স্কুলের শিক্ষক নিবারণ ঘটকের শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণার মাধ্যমে।
নিবারণ
ঘটক ও নজরুল ইসলাম
সাধারণভাবে নজরুলের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী মনোভাব বিকাশের গুরু হিসেবে
নিবারণ ঘটকের
নাম উল্লেখ করা হয়। মূলত পরোক্ষভাবে আরও দু-তিন জন বিপ্লবী তাঁকে অনুপ্রাণিত
করেছিলেন। এঁরা হলেন-
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি,
জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ
এবং নিবারণ
ঘটকের মাসিমা
দুকড়িবালা।
মূলত ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সিয়ারজোল ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের একটি আঞ্চলিক ঘাঁটিতে পরিণত
হয়েছিল। এর পিছনে কিছু বিপ্লবী কর্মকাণ্ড জড়িত ছিল। যেমন-
জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ
হুগলির মহসিন কলেজে অধ্যাপনা করার সময়, নিবারণ
ঘটক সেখানকার ছাত্র ছিলেন। তাঁর দ্বারাই
নিবারণ বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছিলেন।
নিবারণ বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ঝাউপাড়া মাইনিং স্কুলে পাঠকালে,
তাঁর মাসিমা
দুকড়িবালার
বাড়িতে প্রায়ই তাঁর বিপ্লবী বন্ধুদের সাথে নিয়ে যেতেন। এই বাড়িতেই
দুকড়িবালার
সাথে অধ্যাপক
জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের
দেখা হয়। বিপ্লবীরা তাঁকে সম্বোধন করতেন মাস্টার মশাই। পরে
দুকড়িবালার
বিপ্লবী দলের সদস্য হয়ে যান। এঁরা বিভিন্ন সময়ে সিয়ারজোলে মিলিত হতেন।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল যখন সিয়ারজোল রাজ স্কুলের ছাত্র এবং নিবারণ
ঘটক ওই স্কুলের শিক্ষক। তাঁর দ্বারাই নজরুল বিপ্লবী
দলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার জন্য হয়তো
বিপিনবিহারী ছিলেন এবং
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি,
জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ
এবং
দুকড়িবালা
পরোক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নজরুল প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী হয়ে
ওঠার পিছনে দুটি কারণকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
নজরুলের তৎকালীন বিপ্লবী মনোভাব
উল্লেখ্য, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগষ্ট রডা কোম্পানী থেকে ৫০টি
জার্মান মসার পিস্তল ও কার্তুজ কলকাতায় পাঠানো হয়।
বিপিনবিহারীর নেতৃত্বে
বিপ্লবীরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে এই অস্ত্র লুট করে। বিপ্লবীরা এই পিস্তল ও
কার্তুজগুলো ভাগ করে, বিভিন্ন স্থানে পাঠান। এর ভিতরে ৭টি পিস্তল ও প্রয়োজনীয়
কার্তুজ দুকড়িবালা
দেবী কাছে রাখেন। এই সময় দুকড়িবালা দেবী,
নিবারণ ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের কাছ থেকে অস্ত্রচালনা শিক্ষা শেখেন।
৮ জানুয়ারি ১৯১৭ (মঙ্গলবার, ২৪ পৌষ ১৩২৪) পুলিশ দুকড়িবালা দেবীর বাড়ি থেকে এ
সকল অস্ত্র উদ্ধার করে। এই সময় সিআইডি অফিসার সুবোধ চক্রবর্তী এর সাথে জড়িতদের
নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করলে, দুকড়িবালা দেবী সমস্ত দায় নিজের উপর নেন। পুলিশী
দুকড়িবালা দেবীকে গ্রেফতার করেন। পুলিশ পরে
নিবারণ
ঘটকেও গ্রফতার করতে সক্ষম হয়।
সিয়ারজোল স্কুলের সহপাঠী
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের
'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে' গ্রন্থে থেকে কিছুটা
অনুমান করা যায়। এয়ারগান দিয়ে
গুলি ছোড়ার
খেলায়
নজরুলের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর ধনী তাঁর ধনী
বন্ধু পাঞ্চুকে অনুরোধ করে বন্দুক কিনতে বলেছিল।
শৈলজানন্দ
যখন নজরুলকে বন্দুক আনার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে নজরুল
বলেছিলেন-
'নজরুল বললে, 'ইংরেজ তাড়াতে হবে এদেশ থেকে।'
-ইংরেজ তাড়াতে হবে?
হেসেই ফেললাম কথাটা শুনে। বললাম- ইংরেজ তাড়াবে ওই এয়ারগান দিয়ে"?
পরে যখন স্থানীয় খ্রিষ্টান গোরাস্থানে গিয়ে নিশানা অনুশীলনে নজরুল যেদিন প্রথম একৃটি পেঁপের গায়ে গুলিবিদ্ধ করতে পেরে খুশিতে আত্হারা হয়ে গেলেন। 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে' গ্রন্থে শৈলজানন্দ লিখেছেন-
'সেই পেঁপে গাছটাই হলো বড়লাট।
তারপরের গাছটা ছোটলাট, তার পরেরটা ম্যাজিস্ট্রেট, তারপর এস-ডি-ও, তারপর থানার দারোগ ইত্যাদি ইত্যাদি-
বলেছিলাম, না না থানার দারোগাদের মেরো না। ওরা তো ইংরেজ নয়, ওরা বাঙালি।
নজরুল বলেছিল, হোক বাঙালী! ওরা বিশ্বাসঘাতক। একদিনে সব চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংরেজদের রাজত্বটা অচল করে দিয়ে চলে যাক না!'
রাজার গড়: [তথ্যচিত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম] |
এই বছরেই চুরুলিয়ার লোকগাঁথা অবলম্বনে তিনি
রচনা করেছিলেন 'রাজার গড়' নামক কবিতা। উল্লেখ্য পল্লীশ্রী নামক পত্রিকার 'আশ্বিন
১৩২৯ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২২)' সংখ্যায় ভগ্নস্তূপ নামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
[দেখুন:ভগ্নস্তূপ ]
সূত্র: