যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম
কাজী নজরুল ইসলামের রচিত রাগ-ভিত্তিক গীতি-আলেখ্য

লুপ্ত রাগের পুনরুদ্ধার এবং তার প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় 'হারামণি' নামক একটি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায়। এই অনুষ্ঠানটি অনিমিয়ত হলেও ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে নজরুলের অসুস্থ হওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত। এরই মাঝে সম্প্রচারিত হয়েছিল উদাসী ভৈরব, নব রাগমালিকা, সারঙ্গ রঙ্গ,  'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' ইত্যাদি অনুষ্ঠান। এসব গবেষণার ভিতরে 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

বেতার জগৎ-এর ১১শ বর্ষ ১২শ সংখ্যার অনুষ্ঠানসূচীতে [পৃষ্ঠা ৬৫০-৬৫১] এই গীতি-আলেখ্যটি সম্পরকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো-

যাম যোজনায় "কড়ি মা"
প্রচার: ২২ জুন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ (শনিবার ৮ আষাঢ় ১৩৪৭)। কলকাতা কেন্দ্র। সান্ধ্য অনুষ্ঠান ৬.৫৫-৭.৪৪ মিনিট।

[সারাদিনের প্রহরগুলিকে এক একটি যাম বলে। একটি যামের পর আর একটি যাম যখন আরম্ভ হয়- তখনকার রাগগুলির প্রতি অভিনিবেশপূর্ব্বক দৃষ্টিপাত করলে কড়ি মধ্যমের প্রভাব স্বতই পরিলক্ষিত হবে। সকাল থেকে সমস্ত দিবারাত্রির যাম-যোজনার কড়ি মধ্যমের কৃতিত্ব প্রকাশ করা হবে ললিত, টোড়ি, গৌড় সারঙ্গ, মুলতান, পূরবী ছায়ানট, বেহাগ ও পরজ এই আটটি রাগের ভিতর দিয়ে।]

রচনা ও সংগঠনা: কবি কাজি নজরুল ইসলাম
যন্ত্র-সঙ্গীত-যোজনা: যন্ত্রী সংঘ
বর্ণনা: প্রশান্ত মিত্র
সঙ্গীতাংশে: চিত্তরঞ্জন রায়, শৈল দেবী ও ইলা ঘোষ

নজরুল ইসলামের পাণ্ডুলিপি:
কলকাতা বেতারের জন্য লিখিত এই গীতি-আলেখ্যটির পাণ্ডুলিপি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা অল-ইন্ডিয়া রেডিওর কাগজপত্রের ভিতর থেকে এই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন নজরুল সঙ্গীত গবেষক আসাদুল হক। কলকাতা বেতারের জন্য লিখিত এই গীতি-আলেখ্যটির পাণ্ডুলিপি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। এ বিষয়ে তিনি তাঁর 'নজরুল যখন বেতারে' (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৯, পৃষ্ঠ: ১৫৩) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-

'...এই অপ্রকাশিত গীতি-আলেখ্যটি আমি কুড়িয়ে পাই কলকাতার রাস্তার পাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা কিছু অল্-ইন্ডিয়া রেডিওর কাগজ পত্রের মধ্যে। গীতি-আলেখ্যটি নজরুলের হাতে লেখা আট পাতায় সমাপ্ত।'

            [মূল পাণ্ডুলিপি]
            [পাণ্ডুলিপি অনুসরণে বর্ণবিন্যাস-কৃত পাঠা]

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রহর
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মতে- রাগ-পরিবেশনার ক্ষেত্রে দিনের বিভিন্ন সময় এবং ঋতু বৈচিত্র্যের প্রভাব রয়েছে। ভারতীয় সঙ্গীতঋষিরা দিবারাত্রির বিভাজিত অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন প্রহর বা যাম নামক সময় একক। এই এককটি তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র থেকে। উল্লেখ্য, প্রাচীন ভারতের রাজদরবারে, ধাতব ঘণ্টায় বা ঢাকে প্রহার করেযাম (আধুনিক তিন ঘন্টার সমতুল্য সময়) ঘোষণা করা হতো। ধারণা করা হয়, প্রহার থেকে প্রহর শব্দটি গৃহীত হয়েছিল। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত 'বঙ্গীয় শব্দকোষে' প্রহর শব্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন– 'যামঢক্কাদিবাদন-কাল'। অর্থাৎ যাম নিরুপণে ঢাকবাদনের সময়। অনেকের মতে, রাজবাড়িতে তিন ঘণ্টা পর পর ঢাক বাজিয়ে সময় ঘোষণা করা হতো, এই সময় প্রহরারত প্রহরীদের দল বদল হতো। সেই কারণে যাম ঘোষণার সময়-একক হিসেবে প্রহর নামটি প্রচলিত হয়েছিল।

ভারতীয় সময় পরিমাপক একক
২৪ সেকেন্ড= ১ পল
৬০ পল= ১ দণ্ড= ২৪ মিনিট
সাড়ে সাত দণ্ড (৭৷৷৹)=১ প্রহর=১ যাম= ৩ ঘণ্টা
৮ প্রহর= ১ দিন =২৪ ঘণ্টা
ভারতীয় সঙ্গীতঋষিরা প্রহরের পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে প্রাকৃতি পরিবেশগত পরিবর্তনের বিষয়টি অনুভব করেছিলেন। তাঁরা এটাও ভেবেছিলেন যে প্রহর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনোগত দশারও পরিবর্তন হয়। সুতরাং প্রকৃতির সাথে মানবমনের অনুভবের সমন্বয় করার জন্য, ভারতীয় সঙ্গীতগুরুরা প্রহরভিত্তিক রাগের শ্রেণিকরণ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এই সূত্রে প্রহরভিত্তিক রাগ তালিকাও তাঁরা প্রণয়ন করেছিলেন।

যামযোজনায় কড়ি মধ্যম ব্যবহারে নজরুলের ভাবনা
প্রহরভিত্তিক রাগগুলোর একপ্রান্তে থাকে প্রহরের সূচনার রাগ, কিছু থাকে প্রহর শেষের রাগ। সূচনা ও শেষের রাগগুলোর ভিতরে থাকে দুই প্রহরে সন্ধি-প্রকাশক সুরবিন্যাসে নিবদ্ধ রাগ। প্রহরভিত্তিক রাগগুলোর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে, নজরুল ইসলাম এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, সন্ধি-প্রকাশক সুরবিন্যাসে কড়ি মধ্যমের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। এই সূত্রে তিনি মোট ৮টি রাগকে বিশেষভাবে শনাক্ত করেন এবং সেগুলো নিয়ে একটি গীতি-আলেখ্য রচনা করেন। এই গীতি-আলেখ্যটিই কোলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম' নামে সম্প্রচারিত হয়েছিল।
 

এই গীতি আলেখ্যটিতে নজরুল ইসলাম ৮টি প্রহরের জন্য ৮টি রাগকে উপস্থাপন করেছিলেন গদ্যে। এর ফাঁকে ফাঁকে তিনি ওই সকল রাগের জন্য ৮টি নিজের রচিত ও সুরারোপিত গান ব্যবহার করেছিলেন। প্রহরসন্ধি রাগ হিসেবে তিনি যে রাগগুলোকে স্থান দিয়েছিলেন, তা হলো- ললিত, টোড়ি, গৌর সারং, মুলতান, পূরবী, ছায়ানট, বেহাগ ও পরজ।

এই গীতিআলেখ্যতে নজরুল ইসলাম মধ্যমকে প্রহরভিত্তিক রাগকে 'সেতু' হিসেবে উল্লেখ করেছে। একটি প্রহরের রাগ থেকে পরবর্তী প্রহরের রাগে পৌঁছানোর জন্য নান্দনিক পরিবর্তনের যে সামঞ্জস্য থাকার প্রয়োজন, তার সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছে কড়ি মধ্যম।  তিনি এই গীতি আলেখ্যের গানগুলোতে রাগগুলোর নিটল চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন রূপকতার মধ্য দিয়ে। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি রাগের রয়েছে নিজস্ব রূপ। আবার প্রকৃতির রূপ পাল্টায় প্রহরে প্রহরে। এই উভয় রূপের সমন্বিত রূপটি ধরার চেষ্টা করেছেন এর গানগুলোর বাণী ও সুরের মায়াজালে। এক্ষেত্রে নজরুল তাঁর গানের বাণীতে নানান প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে, বাণী ও সুরে সমন্বয়ে রাগের বিমূর্তরূপকে মূর্তমান করেছেন। তাই সুর ও বাণীর নানন্দনিক অপূর্ব সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় গানগুলোতে। এই বিচারে এই গানগুলো রূপকতার আশ্রয়ে রাগের লক্ষণগীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাগসঙ্গীতের চিরাচরিত লক্ষণগীতির রূপ এতে নেই।

সুরাঙ্গের বিচারে 'যাম-যোজনায় কড়ি মধ্যম'-এর গানগুলো নিতান্তই রাগাশ্রয়ী নয়। কারণ এই গীতি-আলেখ্যে যুক্ত রাগরূপের বর্ণনার পরে ব্যবহারিক নমুনা দেখানো হয়েছে। তার চারটি গানের সাথে 'খেয়াল শুনুন' জাতীয় নির্দেশনা আছে। যেমন-

পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম রাগগুলোর পরে  কোনো পৃথক নির্দেশনা নেই। হয়তো কবি একই অনুষ্ঠানের গান হিসেবে 'খেয়াল শুনুন' জাতীয় শব্দ বার বার ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করেন নি। তাই এই গানগুলো সরাসরি খেয়ালের বন্দিশ বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রহর অনুসারে কাজী নজরুল ইসলাম যে গানগুলো লিখেছিলেন, তার তালিকা-