রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি
নলিনী
আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে মুদ্রিত

RBVBMS 438

১২৯০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ (১২৯০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহ) মাসে স্বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সাথে ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। এই বিবাহের বাসর-উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ নাথ 'বিবাহ-উৎসব' নাটক এচনা করেছিলেন। এতে অভিনয় করেছিলেন বাড়ির মেয়েরা। এই নাটকটি সফলভাবে অভিনীত হওয়ায়, উৎসাহিত হয়ে- 'নলিনী' নামে একটি যৌথ নাটক রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর 'রবিজীবনী' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে [ বিশ্বভারতী। পঞ্চম সংস্করণ।  শ্রাবণ ১৪১৫। পৃষ্ঠা: ১৯৩-৯৪] লিখেছেন-

'...যৌথ-রচনা বিবাহ-উৎসবের সাফল্যে উৎসাহিত হইয়া তরুণ তরুণীরা স্থির করিলেন নাটকের রচয়িতা হইবেন অভিনেতারা স্বয়ং। সেইজন্য মোটামুটিভাবে একটা প্লট খাড়া করিয়া অভিনয়ের অংশ নিজেদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়া হইল । একজন নিজ অংশ লিখিয়া দিলে অপরজন তাঁহার অংশ লিখিবেন, এইরূপে অভিনেতা-লেখকদের হাতে-হাতে ঘুরিয়া একটা জিনিস খাড়া হইল বটে, তবে তাহাকে সাহিত্য নাম দেওয়া যায় না। নাটক রচনায় এভাবে বারোয়ারী সমবায়-পদ্ধতিতে নিষ্পন্ন হয় না। শেষকালে রবীন্দ্রনাথকেই সেই খসড়াকে ছাঁটিয়া কাটিয়া একটা চলনসই নাটক খাড়া করিতে হইল । নাটকখানির নাম রাখা হইল 'নলিনী'।... ইহাই তাঁহার প্রথম গদ্য-নাটক।
[ইন্দিরাদেবীর দানকৃত পাণ্ডুলিপি]
এই নাটকটি রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের পূর্বে লিখিত 'ভগ্নহৃদয়'-এর কাহিনির উপর ভিত্তি করে। এই নাটকে দুটি পুরুষ চরিত্র ছিল- নীরদ ও নবীন। চারটি স্ত্রীচরিত্র ছিল- নলিনী, ফুলি, প্রতিবেশিনী ও নীরজা।

নাটকটি রচিত হওয়ার পর মঞ্চস্থ হয় নি। কারণ ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ (১৯ এপ্রিল ১৮৮৪) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। ইন্দিরাদেবী তাঁর-কৃত খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি বিশ্বভারতীতে দান করেছিলেন। পাণ্ডুলিপি ৯৩এ (৪৩৮)। ১২৯১ বঙ্গাব্দে নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকা-অনুযায়ী গ্রন্থটির প্রকাশকাল পাওয়া যায় ১০ মে ১৮৮৪ (শনিবার ২৯ বৈশাখ)। ইন্দিরা দেবীর প্রদত্ত নলিনী-র একটি খণ্ডিত পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে রবীন্দ্রভবন সংরক্ষিত আছে। সংখ্য 93A।  প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রচিত 'রবিজীবনী'র দ্বিতীয় খণ্ডে [পৃষ্ঠা ১৯৮] এ বিষয়ে লিখেছেন-
'পাণ্ডুলিপির প্রথম ও শেষাংশ মিলিয়ে মাত্র পাঁচটি পাতা [১০ পৃষ্ঠা] পাওয়া গিয়েছে মধ্যবর্তী অনুমানিক চার [৮ পৃষ্ঠা] বা তদধিক স্খলিত। উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম তিনটি পাতা [পৃ 1-6] সম্পূর্ণ বর্জন-চিহ্নাঙ্কিত, এর 1-2 পৃষ্ঠার কিয়দংশে সম্ভবত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে কয়েকটি সংলাপ রয়েছে এবং 4 পৃষ্ঠায় মেয়েলি হস্তাক্ষরে [কানাই সামস্তের অনুমান, হাতের লেখা সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর] দুটি সংলাপ লিখিত হয়েছিল, 1-6 পৃষ্ঠার বাকি অংশ এবং 7-20 পৃষ্ঠার সবটাই রবীন্দ্রনাথের লেখা । জ্যোতিরিন্ত্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উভয়েই নলিনীর সংলাপ লিখেছেন, সুতরাং অভিনেতারা নিজের অংশ নিজের হাতে লিখবেন এমন পরিকল্পনা নিয়ে রচনা যদি শুরু হয়েও থাকে প্রথম থেকেই সেই পদ্ধতি অনুসৃত হয় নি । হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলিতে প্রতিবেশিনী ও নীরজা চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে কোন্‌ রীতি গ্রহণ করা হয়েছিল বলা সম্ভব নয়, কিন্তু নবীনের সংলাপ যে রবীন্দ্রনাথই লিখেছিলেন তার প্রমাণ পাণ্ডুলিপির প্রথমাংশেই আছে। হয়তো এইরূপ বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে প্রথমে পুরো নাটকটিই লিখিত হয়, পরে তার সবটুকু কেটে দিয়ে সেই খসড়ার ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ একাই সেটিকে মুদ্রণযোগ্য রূপ দেন। 7-10 পৃষ্ঠাতে সামান্যই কাটাকুটি আছে, “এই অংশে মুদ্রিত গ্রন্থ প্রায় সর্বথা পাণ্ডুলিপির অনুরূপ'- এই তথ্য থেকে মনে হয় এগুলি প্রেসকপিরই অংশ ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যৌথ নাটক লেখার পরিকল্পনা হলেও ঠিক আক্ষরিকভাবে অভিনেতা-লেখকদের 'হাতে-হাতে ঘুরিয়া একটা জিনিস খাড়া' হয় নি, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রধান লেখক এবং সেইজন্য নাটকটি তাঁর নামেই মুদ্রিত হয়, মানময়ী বা বিবাহ-উৎসব-এর মতো রচয়িতার নাম ছাড়াই প্রকাশিত হয় নি। আমাদের ধারণা, নীরদ, ফুলি ও নলিনী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবী ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মনোনীত হয়েছিলেন। এরূপ অনুমানের কারণ, সংগীতকুশলতার জন্য জ্ঞানদানন্দিনীর কোনো খ্যাতির কথা শোনা যায় নি এবং সেই জন্যেই নলিনীর মনের কথা গানের মাধ্যমে বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ফুলি-রূপিণী বালিকা ইন্দিরাকে | অনুমান করা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হয়তো নবীন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হন, নীরজা চরিত্রের সম্ভাব্য অভিনেত্রীর নাম হয়তো-বা কাদম্বরী দেবী।'

প্রথম সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত গানের সূচি।

১. হা, কে বলে দেবে সে  [তথ্য]
      প্রথম দৃশ্য। নীরদের গানি  
২. ও কেন ভালোবাসা জানাতে আসে
       প্রথম দৃশ্য। ফুলির গান। [তথ্য]

৩. ভালোবাসিলে যদি সে ভালো না বাসে [তথ্য]
       প্রথম দৃশ্য। নবীনের গান।
৪. মনে রয়ে গেল মনের কথা [তথ্য]
        প্রথম দৃশ্য। ফুলির গান।

পাণ্ডুলিপির নবম [9] পৃষ্ঠায় পঞ্চম দৃশ্যে একটি গান পাওয়া যায়।  মুদ্রিত গ্রন্থে গানটি পরিত্যক্ত হয়েছে ।
         নীরদের গান:  দেখে যা, দেখে যা [প্রেম-৩৭৭] [তথ্য]

নাটকটি অভিনয়ের জন্য রচিত হলেও কাদম্বরী দেবীর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তা সম্ভব হয় নি। ববীন্দ্রভারতী সংগ্রহশালায় রক্ষিত নাটকটির একটি মুদ্রিত কপিতে* রবীন্দ্রনাথ-কৃত সংযোজন-পরিবর্ধন দেখে মনে হয়, পরবর্তীকালে এটি আর-একবার অভিনয়ের কথা ভাবা হয়েছিল। পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠায় কিছু অতিরিক্ত সংলাপ যোগ করা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ এতে কয়েকটি গান সংযোজিত করেন। এই তথ্য পাওয়া যায় প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী দ্বিতীয় খণ্ডে। এই গানগুলো হলো-

১. কেন রে চাস ফিরে ফিরে [নাট্যগীতি-৩৬] [তথ্য]
প্রথম দৃশ্যে নীরদের গান
২. গেল গো- ফিরিল না [প্রেম-৩৯৩] [তথ্য]
প্রথম দৃশ্যে নীরদের গান
৩. কেহ কারো মন বোঝে না [প্রেম-৩৯২] [তথ্য]
দ্বিতীয় দৃশ্যে নবীনের গান
৪. দেখে যা, দেখে যা [প্রেম-৩৭৭] [তথ্য]
তৃতীয় দৃশ্যে নীরদ ও নীরজার গান । এই গানটি নলিনী-র পাণ্ডলিপিতে পঞ্চম দৃশ্যে নীরদের গান হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল, কিন্ত মুদ্রিত গ্রন্থে গানটি নেই ।

8. ধীরে ধীরে প্রাণে আমার [নাট্যগীতি-২৯] [তথ্য]
তৃতীয় দৃশ্যে নীরদের গান।
৫. দুঃখের মিলন টুটিবার নয় [মায়ার খেলা] [তথ্য]
তৃতীয় দৃশ্যে নীরদের গান

৬. ঐ বুঝি [সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে] [প্রেম-১৪৪] [তথ্য]।
পঞ্চম দৃশ্যে; নীরদের গান

৭. কিছু তো হল না [নাট্যগীতি-১৫] [তথ্য]
পঞ্চম দৃশ্যে নীরজার গান

৮. কেন এলি রে, ভালোবাসিলি [মায়ার খেলা] [তথ্য]
ষষ্ঠ দৃশ্যের বর্ধিত অংশ। নবীনের গান।