আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত উল্লেখযোগ্য, যুদ্ধাপরাধীর তালিকা |
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ)
ট্রাইব্যুনাল-১
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৬
ধারার বলে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের
চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি মো. নিজামুল হক এবং অন্য দুজন বিচারক ছিলেন
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদ।
ট্রাইব্যুনালের জন্য ১২-সদস্যবিশিষ্ট একটি আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছিল।
প্যানেলের চিফ প্রসিকিউটর ছিলেন গোলাম আরিফ। বাকি ১১ জন আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ
রেজাউর রহমান, গোলাম হাসনাইন, রানা দাশগুপ্ত, জহিরুল হক, নুরুল ইসলাম, সৈয়দ
হায়দার আলী, খন্দকার আবদুল মান্নান, মোশারফ হোসেন, জিয়াদ-আল-মালুম, সানজিদা
খানম ও সুলতান মাহমুদ।
ট্রাইব্যুনাল ও আইনজীবী প্যানেল গঠনের পাশাপাশি প্রাক্তন জেলা জজ ও আইন
মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবদুল মতিনের সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি
তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল একই দিনে। সংস্থার অন্য সদস্যরা ছিলেন:
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুর রহিম, সাবেক উপমহাপরিদর্শক কুতুবুর
রহমান, মেজর (অব.) এ এস এম সামসুল আরেফিন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের
(সিআইডি) অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মীর শহীদুল ইসলাম, একই বিভাগের পরিদর্শক নুরুল
ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাক খান।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ২২শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হওয়ার পর এটিএম ফজলে কবীর
প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে সরে গিয়ে দ্বিতীয়টির চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন।
এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন হাইকোর্টের বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ২০১০
খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই শুনানির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে 'ট্রাইবুনাল-১' -এর
কার্যক্রম শুরু হয়।
ট্রাইব্যুনাল-২
বিচার প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট নতুন আরেকটি
ট্রাইব্যুনাল গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সূত্রে ট্রাইবুনাল-২ প্রতিষ্ঠিত হয়
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে মার্চ। এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন প্রথম
ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। অন্য দুজন সদস্য ছিলেন
হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও প্রথম ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার
শাহিনুর ইসলাম।
ট্রাইবুনালের প্রথম বিচার
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই শুনানির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে 'ট্রাইবুনাল-১'
-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এই বিচার শুরু হয় ঢাকার পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হকের নেতৃত্বে। এঁর অপর দুই
সদস্য ছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও বিচারক এ কে এম জহির আহমেদ। প্রাথমিক
পর্যায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত
জামায়েত-ই-ইসলাম-র চার নেতা—
মতিউর রহমান নিজামী,
আলী আহসান
মোহম্মদ মুজাহিদ,
মুহাম্মদ
কামারুজ্জামান ও
আব্দুল
কাদের মোল্লা'র বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের কালপঞ্জী
২৯ জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ
অভিযুক্তদের ২রা আগষ্ট সোমবার ট্রাইব্যুনালের সামনে সশরীরে হাজির করার নির্দেশ
দেন। এই আদেশ বলে ২রা আগষ্ট অভিযুক্তদের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত
পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তদের আটক রাখার আদেশ দেয়।
৪ঠা আগষ্ট, এই আদালত রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর আদালতের কাছে
দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে গ্রেফতার করে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান।
উল্লেখ্য,
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ
রেজাউল হক চাঁদপুরী একটি মামলা করেন। এরই প্রেক্ষিতে এই বছরের ২৯ জুন তারিখে রাজধানীর
শাহীনবাগের বাসা থেকে পুলিশ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগে
বলা হয়েছিল, সাঈদী ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে।
যেহেতু
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আগেই কারাগারে ছিলেন, তাই তাঁকে ১০ই আগষ্ট
আদালতে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
১৬ই আগষ্ট, কারাবন্দী জামায়াতের দুই নেতা
আব্দুল
কাদের মোল্লা' ও
মুহাম্মদ
কামারুজ্জামান বাদী হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্বলিত সংবিধানের প্রথম
সংশোধনীর বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন।
এই রিটে তারা ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
অ্যাক্টের সাতটি ধারা ও উপ-ধারা সংবিধান পরিপন্থী বলে দাবি করেন। এই দাবির বলে
এঁরা জামায়াতের চার নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানার বৈধতাও চ্যালেঞ্জ
করেন। আবেদনে বিবাদী করা হয় আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে। বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব মিঞা ও
বিচারপতি কাজী রেজাউল হককে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে
১৭ই আগস্ট রিট আবেদনটির শুনানির দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয় এবং ওই নির্ধারিত
দিনে শুনানি
অনুষ্ঠিত হয়।
২২ শে আগষ্ট শুনানি গ্রহণ শেষে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞা
আদালতকে জানান যে, তিনি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের প্রতিটি ধারা ও
উপধারা নীরিক্ষা করেছেন এবং 'অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ মামলা চলাকালে আপিল বিভাগে
যেতে পারবেন না বরং দোষী সাব্যস্ত হলেই তা পারবেন', এটুকু বাদে তাঁর কাছে
ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের কোনো সমস্যা প্রতীয়মান হচ্ছে না। এরপর তিনি এটর্নী
জেনারেল মাহবুবে আলমকে ২৩শে আগষ্ট এ বিষয়টির সমাধানে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ
জানান।
২৩ আগষ্ট সকালে বিচারকাজের শুরুতে এবং সরকারপক্ষ থেকে কোনোরকম শুনানি আদালতে
উপস্থাপন করার পূর্বেই, বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ১৬ই
আগস্ট করা রিট আবেদন প্রত্যাহার করেন। এর প্রেক্ষিতে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ও
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের কয়েকটি ধারা বাতিল চেয়ে দায়ের করা রিট
আবেদনটি উপস্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট।
এই দিনই সকালে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল। এই
দলটি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপপরিদর্শক শিরু মিয়া ও তার ছেলে
হত্যার দায়ে দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত করেন। তদন্তের প্রথম দিন দলটি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুরাতন এবং নতুন জেলখানা, কুরুলিয়া ব্রিজের কাছে অবস্থিত
গণকবর, পইরতলা বধ্যভূমি পরিদর্শন করে। তদন্ত দল ঐদিন বিকেলে কয়েকজন
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেন।
২৪ আগষ্ট, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে ২১শে সেপ্টেম্বর হাজির করার নতুন তারিখ
নির্ধারণ করে ট্রাইব্যুনাল। একই দিনে
মতিউর রহমান নিজামী,
আলী আহসান
মোহম্মদ মুজাহিদ,
মুহাম্মদ
কামারুজ্জামান ও
আব্দুল
কাদের মোল্লা'র রিট আবেদনসমূহেরও শুনানির দিন ধার্য করা হয়।
২১শে সেপ্টেম্বর সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে শুনানির
জন্য আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নিজামুল হক, এটিএম ফজলে কবির ও একেএম
জহির আহমেদ এর নেতৃত্বে শুনানির কাজ শুরু হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন যথাযথভাবে উপস্থাপিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর
বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না করে তাকে পুনরায় কারাগারে ফেরত পাঠায়।
ট্রাইব্যুনাল এই আবেদনের ওপর সাঈদীর উপস্থিতিতে ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখকে ফের
শুনানির দিন ধার্য করে।
এই দিনে আদালত এরইমধ্যে গ্রেপ্তারকৃত জামায়াতের আমীর নিজামীসহ মুজাহিদ,
কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার আইনজীবীদের দায়ের করা চারটি আবেদন শুনানি শেষে
খারিজ করে দেয়। আবেদনগুলো হলো-
কারাবন্দীদের বিরুদ্ধে জারী করা গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার
তাদের কারামুক্তি
ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম স্থগিত রাখা
মামলার সার্টিফায়েড কপি সরবরাহ করা না পর্যন্ত পরবর্তী কার্যক্রম স্থগিত করা।
এ ছাড়াও দুইটি আবেদন
জামায়াত নেতাদের আইনজীবীরা প্রত্যাহার করে নেন। উল্লেখ্য এই দিন আদালতে কঠোর
নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
২২শে সেপ্টেম্বরে সাঈদী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে পূর্বনির্ধারিত তারিখ
ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সম্ভব হবে না বলে, ২১শে সেপ্টেম্বর বিকেলে কারা
কর্তৃপক্ষ আদালতকে অবহিত করে। সাঈদীর অনুপস্থিতিতে বিচারপতি নিজামুল হকের
নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ১২ই অক্টোবর শুনানির পরবর্তী তারিখ ঘোষণা
করে।
কিন্তু ১২ই অক্টোবর তারিখে সাঈদী অসুস্থ থাকায় ট্রাইবুনালে হাজির করা হয় নি।
তার অনুপস্থিতিতে শুনানিকালে ট্রাইব্যুনাল আগামী ২রা নভেম্বর শুনানির পরবর্তী
তারিখ নির্ধারণ করেন। তবে বারবার অসুস্থতার জন্য, ২রা নভেম্বর সাঈদীকে
প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্সে করে হলেও দরকারী কাগজপত্রসহ আদালতে হাজির করার
নির্দেশ দেয়া হয়। এই দিনে সাঈদীকে
আদালতে হাজির করা হয়। এই দিন বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের
ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ২৯শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আটক রাখার আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনাল
একই সাথে ২৩শে ডিসেম্বরের মধ্যে সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গঠন অথবা তদন্ত
প্রতিবেদন জমা দিতে তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ
হায়দার আলী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রাখার আবেদন করে আদালতকে জানান যে সাঈদীর
বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে বিধায়
তাকে তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তার রাখা প্রয়োজন।
১৯শে ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের
আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ই ডিসেম্বর
ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী প্যানেল এই আবেদনটি করেছিলেন। শুনানি শেষে নিজামুল হকের
নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার
দেখিয়ে ৩০শে ডিসেম্বরে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়।
২০১১
খ্রিষ্টাব্দের কালপঞ্জী
১৭ই জানুয়ারি আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরীকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত আটক রাখার নির্দেশ দেয়। আদালতের কার্যক্রম চলার
সময় চৌধুরীর পক্ষে দায়ের করা চারটি আবেদনের মধ্যে তিনটি খারিজ এবং একটি
নিষ্পত্তি হয়। ট্রাইব্যুনাল যত দ্রুত সম্ভব চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধে
সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত দলকে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট আদালতকে সরবরাহ
করার নির্দেশনাও দেয়।
১১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ সাঈদীর
বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে।
১৪ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অভিযোগ উপস্থাপন করেন প্রসিকিউশন
টিমের সদস্যরা।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের কালপঞ্জী
বিচারপ্রক্রিয়া আরও গতিশীল করতে সরকার নতুন
একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ট্রাইব্যুনাল-২ বা ICT-2) গঠন করে।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রাক্তন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে
ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল-২
ট্রাইব্যুনাল-১ এর কিছু বিধিমালা সংশোধন করে নিজস্ব কার্যপ্রণালি বিধিমালা
প্রণয়ন করে। নতুন বিধি অনুসারে ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশ পুনর্বিবেচনার
(রিভিউ) আবেদন একবারের বেশি করা যাবে না।
ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতের প্রাক্তন রুকন আবুল কালাম আযাদকে গ্রেফতার করে
২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত করার আদেশ দেয়। কিন্তু সেদিন ভোরেই তিনি বাড়ি
থেকে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নি।
২৮শে মে-তে, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি
ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগে
মতিউর রহমান নিজামীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ বিচারাধীনে আনা হয়।
২৬ আগস্ট থেকে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এই সময়ের তদন্ত কর্মকর্তা
আব্দুর রাজ্জাক খানসহ, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন। আর
নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের কালপঞ্জী
৫ই ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল যুদ্বাপরাধী আব্দুল কাদের
মোল্লাকে ৩টি মামলায় ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ২টি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
প্রদান করে। এই রায় স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি প্রত্যাখ্যান করে। এই সূত্রে কাদের
মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবিতে ব্যাপক সমাবেশ
ঘটে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে। ক্রমে ক্রমে এই সমাবেশের আবদেন শাহবাগ থেকে সারা
বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর পিছনে মূখ্য ভূমিকা ছিল ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম 'ফেসবুক', বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের 'ব্লগ'। শাহবাগের এই
বিভোক্ষ পরিচিতি লাভ করে 'শাহবাগ
গণজাগরণ'।
স্বাধীতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে ইন্টারনেটভিত্তিক যে সাইবার যুদ্ধ হয়,
তার নেতৃত্ব দিয়েছিল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। বিশেষভাবে বলতে হয়
ব্লগার এবং অসংখ্য সাইবার-যোদ্ধারা। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীতা বিরোধীরা যতটা
প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল, সাইবারযোদ্ধাদের বিরোধিতায় তার চেয়ে অনেক বেশি
পিছিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার সপক্ষের সাইবার যোদ্ধার দ্রুত তরুণ সমাজকে সচেতন করে
তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে দ্রুত স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির তরুণরা স্বশিক্ষিত
হয়ে উঠেছিল। এদের কম্পিউটারগুলো হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের বৈদ্যুতিন যাদুঘর।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে উপস্থিত প্রমাণাদি আদালতের সীমানা ছাড়িয়ে, সাধারণ
মানুষের কাছে পৌঁছি দিতে সক্ষম হয়েছিল সাইবার যোদ্ধারা।
১৫ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতা বিরোধীরা ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করে।
উল্লেখ্য,
সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাইবার যোদ্ধাদের গুরুত্ব যতটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তার চেয়ে
বেশি বুঝতে সক্ষম হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধীপক্ষ। তাই এরা সাইবারযোদ্ধাদের থামানোর জন্য বেছে
নিয়েছিল হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকণ্ডের প্রথম স্বীকার হয়েছিলেন শাহবাগ আন্দোলনের
সক্রিয় কর্মী রাজীব হায়দার। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের এই হত্যার জন্য স্বাধীনতা বিরোধীরা রাজীব হায়দারের বিরুদ্ধে
প্রচারণা চালিয়েছিল 'নাস্তিক ব্লগার' হিসেবে। এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে দৈনিক
ইনকিলাব ও এর পরপরই দৈনিক আমার দেশ ধারাবাহিক আকারে কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা
হয়েছিল যে- ব্লগার রাজীব মুসলমানদের শেষ নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে কটুক্তি করেছে।
এরপরেও এই অজুহাতে আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তবে এদের সবাই ছিল স্বাধীনতার
স্বপক্ষশক্তির সাইবার বা লেখক যোদ্ধা।
১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন
হয়।
শাহবাগ গণজাগরণ
মঞ্চের আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পক্ষশক্তির
অন্যনআয ব্যক্তিবর্গ এবং সংগঠনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জাতীয় সংসদে একটি
সংশোধনী বিল পাস হয়। উল্লেখ্য আগের আইনে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল
করার সুযোগ ছিল না। এই সংশোধিত আইনে, ২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ কাদের মোল্লার
সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে
রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে
৪ মার্চ আপিল করেন কাদের মোল্লা। এরপর
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে এই
বিচারের শুনানি শুরু হয়। অবশেষে
২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আবদুল কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে।
১৩ই নভেম্বর প্রথম
দফায় নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়। তবে রায় ঘোষণা
অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায় ঘোষণার আগেই ওই বছরের ৩১শে
ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে
কবীর। এরপর ৫৩ দিন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান-শূন্য ছিল ।
১২ ডিসেম্বর দিবাগত
রাত্রি ১২টা ১ মিনিটে সরকার
আব্দুল
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর
করা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এইদিন রাতে কাদের
মোল্লার আইনজীবীরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে না
জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ
মাহমুদ হোসেনের কাছে ফাঁসি কার্যকর
স্থগিতের আবেদন জানান৷ চেম্বার জজ তাদের
আবেদন গ্রহণ করে ১২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে
১০টা পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড কার্যকর স্থগিত
করেন। বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগে শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া
পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিতের আদেশ দেন
আদালত। ফলে এই আদেশ ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
স্থগিত করা হয়। এই দিন এই আপিল বাতিল করে
আদালত ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে। এই দিন ১০টা
১মিনিটে
আব্দুল
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।