খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত
চোল,
পাণ্ড্য ও চের-রা
দক্ষিণ ভারতের শাসক ছিল। এই রাজশক্তিত্রয়ের ভিতরে, আদিতে
চোলরা বিশেষভাবে
শক্তিশালী রাজত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আদিতে এদের
চোল রাজ্যের সীমা
পেনার ও ভেলার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের মধ্যবর্তী তাঞ্জোর ও ত্রিচিনপল্লীতে। ধারণা
করা হয় কারিকল ছিলেন চোল রাজবংশের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তাঁর বাস্তুকলার
নিদর্শনগুলির জন্য খ্যাত। তিনি
পাণ্ড্য ও চেরদের পরাজিত করে পরাজিত করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের অন্যতম
রাজশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সে সময় তামিল ভাষাভাষী
চোলদের দখলে ছিল।
খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে
পাণ্ড্য-রা শক্তিশালী হয়ে উঠে। এদের
ক্রমাগত আক্রমণের মুখে চোল রাজ্যের পতন হয়। তামিলনাড়ু মূলত
পাণ্ড্যদের অধিকারে চলে যায়। এরপর ক্রমে ক্রমে চেররা শক্তিশালী হয়ে উঠে।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চেরদের উত্থান ঘটে নেডুঞ্জেরল-আদম। দক্ষিণভারতে অধিকাংশ
স্থান দখল করে নেন। এছাড়া কদম্ব রাজ্য জয় করেন এবং গ্রিক ও রোমান নৌবাহিনীকে পরাজিত
করে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। পরে রোমের রাজাদের সাথে কূটনৈতিক হৃদ্যতা
অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নেডুঞ্জেরল-আদমের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র
সেরান-সিঙ্গভুবান রাজত্ব লাভ করেন। সেরান-সিঙ্গভুবানও পিতার মতো প্রবল প্রতাপে
রাজত্ব করেছেন। এর পরবর্তী চের রাজাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে কডুঙ্গন নামক এক পাণ্ড্য রাজার নেতৃত্বে পাণ্ড্য
রাজ্যের পুনরুত্থান ঘটে। মূলত এদের দ্বারাই চের রাজ্যের অন্তিম দশা শুরু হয়েছিল। এরপর পাণ্ড্য
রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে, চোলরা
তা দখল করে নেয়। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই পাণ্ড্য রাজবংশের জটা-বর্মণ নামক
রাজার নেতৃত্বে এই রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠে। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে এই রাজ্য পুনরায়
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর এই রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ভারতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই অঞ্চল সমৃদ্ধজনপদে পরিণত হয়েছিল। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা
যায়-
কান্ব রাজবংশ -এর শেষ এবং চতুর্থ রাজা সুদর্শনকে দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন
রাজবংশের রাজা সিমুক পরাজিত করেন। এরপর মগধের রাজ সিংহাসনে মিত্র উপাধী ধারী দুর্বল
রাজার নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত এরা সাতবাহন বংশের রাজাদের অনুগ্রহভাজনেই শাসন করতেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ অব্দের দিকে রাজা সিমুক
সাতবাহন রাজবংশের সূচনা করেন। ১০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই বংশের
সাতকর্ণী নামক একজন রাজা সাতবাহন রাজ্যের ঘোরতর বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং রাজ্যের
প্রসার ঘটান। এই সাতকর্ণী গৌতমী সাতকর্ণী নামে পরিচিত। সিংহাসন লাভের পর তিনি তাঁর
সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেন। এরপর তিনি শকদের কাছ থেকে মালব ও কাথিয়াবাড় দখল করে
নেন। নাসিক প্রশস্তি থেকে আরো জানতে পারা যায় যে,পূর্বঘাট পর্বত থেকে
পশ্চিমঘাট পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি উত্তরে মালব
থেকে দক্ষিণে কানাড়া পর্যন্ত তাঁর দখলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। আনুমানিক ১৬৫
খ্রিষ্টাব্দে এই রাজবংশের শেষ রাজা যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী সিংহাসন লাভ করেন। তিনি
পশ্চিমী শক রাজাদের পরাজিত করে, রাজ্যের দক্ষিণাংশ উদ্ধার করেন। তাঁর সময়ে
মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশও সাতবাহন রাজ্যের অংশীভূত হয়। ১৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যজ্ঞশ্রী
মৃত্যুবরণ করেন।
দাক্ষিণাত্যে
সাতবাহন রাজবংশের ও উত্তর আর্যাবর্তে কুষাণ সাম্রাজ্য পতনের পর খ্রিষ্টীয় তৃতীয়
ও চতুর্থ শতকে গুপ্তবংশীয় রাজগণ ভারতে একটি বিশাল
সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই সময়ে পল্লব, চোল, পাণ্ড্য এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
প্রাচীন মাইলাপোর শহর ছিল পল্লব রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। এই নগরটি পরে চেন্নাই মহানগরীতে
পরিণত হয়েছে।
খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত বাদামীর চালুক্য,
কাঞ্চির পল্লব এবং মাদুরাইয়ের পান্ডিয়ারা এতদঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত
ছিল।
এ সময়টি হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও শিল্পকলার বিকাশলাভ করেছিল। তামিলনাড়ু চোল রাজবংশের শাসনাধীন ছিল প্রায় সাড়ে ৮
শত বছর। রাজেন্দ্রচোল দেব-১ (শাসনকাল ১০১৪-৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) -এর সময় তামিলনাড়ু
সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছিল। ১৪দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হিন্দুরাজ্য বিজয়নগর
তামিলনাড়ুর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করে।
১৫২২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজরা তামিলনাড়ুতে আসে এবং এরা বর্তমান চেন্নাইয়ের কাছে সাও তোমে
নামে একটি বন্দর নির্মাণ করেছিল। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলটি ওলন্দাজদের হাতে চলে
যায়। এই সময় এরা শহরের উত্তরে পুলিকটের কাছে নিজেদের কুঠি স্থাপন করে।
১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে আগস্ট স্থানীয় ওলন্দাজ শাসক দামের্লা ভেঙ্কটদিরি
(Damerla Venkatadri) ব্রিটিশ
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই অঞ্চলে জমি প্রদান করেন। ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় ওলন্দাজ শাসকের অনুমতি নিয়ে মাদ্রাজপত্তমের
জেলেপল্লীতে
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালু করে। এই সময় এরা সেন্ট জর্জ দুর্গ নির্মাণ করেছিল।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ফলে, ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার নিজদের
আধিপত্য সুদৃঢ় করার জন্য 'গভার্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট -১৮৫৮' জারি করে। এর ফলে
ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। এরপর থেকে ব্রিটিশ রাজ ব্রিটিশ
ইন্ডিয়াকে যুক্তরাজ্যের একটি উপনিবেশ হিসেবে সরাসরি শাসন করতে থাকে এবং ১৮৭৬ থেকে
ভারতের সরকারি নামকরণ হয় ভারত সাম্রাজ্য ।
এই সময়ে বর্তমান তামিলনাড়ু ব্রিটিশনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনে আনা হয়।
অষ্টাদশ শতকের মধ্য ও শেষাংশে কর্ণাটক যুদ্ধ ও এংলো-মহীশূর যুদ্ধের পর এই
প্রেসিডেন্সির প্রসার ঘটে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিকে
মাদ্রাজ রাজ্যে পরিণত হয়।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যের তেলুগুঅধ্যুষিত এলাকাসমূহকে অন্ধ্র প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মাদ্রাজ আরও
কিছু অংশ কেরালার সঙ্গে এবং কিছু অংশ মহীশূর (বর্তমান কর্নাটক)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
মাদ্রাজ রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে
তামিলনাড়ু হিসেবে নতুনভাবে চিহ্নিত হয়।
বর্তমান তামিলনাড়ু
রাজধানী:
চেন্নাই (পূর্ববর্তী নাম মাদ্রাজ)।
ভাষা: তামিল। শহরাঞ্চলে তামিল ছাড়া ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সরকারি ভাষা
হিসেবে তামিল ও ইংরেজি স্বীকৃত। এছাড়া অল্প প্রচলিত আছে তেলেগু এবং মালায়ম ভাষা।
আয়তন: ১৩০০৫৮ বর্গকিলোমিটার (৫০২১৬ বর্গমাইল)।
জনসংখ্যা: ৭,২১,৩৮,৯৫৮ (২০১১ খ্রিষ্টাব্দ)
ভূমিরূপ: তামিলনাড়ুর ভূপ্রকৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
১. পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলী সমভূমি: এই অঞ্চলের সমভূমির বৃহত্তম
অংশটি হলো- কাবেরী নদীর উর্বর দ্বীপাঞ্চল। এর দক্ষিণে রয়েছে ঊষর ঢালু সমতলভূমি। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নগরী হলো রামনাথপুরম ও মাদুরাই (মাদুরা)।
২. উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চালীয় পার্বত্য ভূমি। পশ্চিমঘাটের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ
রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত বরাবর প্রবহমান। এই পর্বতমালার বিভিন্ন ভাগে
রয়েছে নীলগিরি, আনাইমালাই ও পালনি পর্বতশ্রেণি। এদের ভিতরে আনাইমালাই পর্বতশ্রেণির অন্তর্গত আনাইয়ের উচ্চতা ৮ হাজার ৮ শো ৪২ ফুট (২৬ শো ৯৫ মিটার)। এট হচ্ছে ভারত এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পূর্বঘাটের অপেক্ষাকৃত শৃঙ্গগুলো নিচু। এদের শাখা-প্রশাখা স্থানীয়ভাবে জাবদি, কালরয়ন ও শেভারয় নামে পরিচিত। এই পর্বতগুলো রাজ্যের মধ্যাঞ্চল বরাবর চলে গেছে। পর্বতমালা থেকে পূর্ব থেকে প্রবাহিত নদীসমূহের দুই পাড় পলিসমৃদ্ধ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। পলি মাটির সংমিশ্রণে কাদা মাটির সৃষ্টি হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। এছাড়া পাওয়া দো-আঁশ, বালি ও লাল ল্যাটেরাইট (আয়রন অক্সাইড ও এলুমিনিয়াম ডাই অক্সাইড) সমৃদ্ধ মাটি।
নদী: তামিলনাড়ুর
প্রধান নদীগুলি হচ্ছে কাবেরী, পোনড়বাইয়ার, পালার, বাইগাই ও
তামব্রপারনি। নদীগুলো পর্বতমালা থেকে পূর্ব থেকে প্রবাহিত হয়ে সাগরে মিশেছে।
নদীদ্বীপসমূহের পলিমাটি ছাড়াও রেগুর নামে পরিচিত কালো তুলা উৎপাদনকারী মাটি
তামিলনাড়–র মধ
জলবায়ু: তামিলনাড়ুর জলবায়ু প্রধানত
উষ্ণ। মে-জুন মাসে চেন্নাইয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮০ সেলসিয়াস। শীতকালের
গড় অন্যদিকে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ২০০ সেলসিয়াস। তবে
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা সাধারণত ২১০-৩০০
সেলসিয়াস-এর মধ্যে থাকে।
এই রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অক্টোবর থেকে
ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৩০-১৯০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল বিশেষ করে
রাজ্যের
সর্ব পশ্চিমাংশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিচু দক্ষিণাঞ্চল ও
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়।
প্রাণি ও উদ্ভিদ: রাজ্যের প্রায় ১৫ শতাংশ ভূমি অরণ্যবেষ্টিত। এর ভিতরে
পশ্চিমঘাটের পূর্বাঞ্চল বরাবর এবং উত্তর ও মধ্যাঞ্চলীয় জেলাসমূহে পাওয়া যায় চিরসবুজ
এবং পত্রমোচী উদ্ভিদ। বণভূমিতে পাওয়া যায় গাউর (বুনো গরু), নীলগিরি তার্হ (ছাগল
জাতীয় স্তন্যপায়ী), বুনো শুয়োর, ভল্লুক ও বিভিন্ন জাতের হরিণ, বাঘ, চিতা, বিভিন্ন
জাতের বানর, হনুমান। তামিলনাড়ুর সবচেয়ে বিষধর সাপ হলো-কিং কোবরা। এছাড়া বিভিন্ন
ধরনের সরীসৃপ পাওয়া যায়। পক্ষীকুলের ভিতর রয়েছ কাঠ-ঠোকরা, পতঙ্গভুক নানা ধরনের পাখি
এবং নানা ধরনের জলচর পাখি।
তামিলনাড়ুতে কয়েকটি জাতীয় উদ্যান এবং দশটির বেশি বন্যপ্রাণি ও পাখির অভয়ারণ্য রয়েছে। এগুলোর ভিতরে উল্লেখযোগ্য অভয়ারণ্যগুলো হলো-মুদলুমবাই বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য, নীলগিরির জাতীয় উদ্যান, পশ্চিমঘাটের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ইন্দিরা গান্ধী বন্যপ্রাণি সংরক্ষণশালা ও জাতীয় উদ্যান।
কৃষি: তামিলনাড়ুর জনসংখ্যার প্রায়
অর্ধেক কৃষিজীবী। একসময় তামিল চাষীরা ছোট-বড় সেচ সংরক্ষণাগার বা পুকুরে বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখত। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে
খাল, গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই রাজ্যের উত্তর-পূর্ব মৌসুমি
বায়ুপ্রবাহের ফলে যে বৃষ্টিপাত হয় তার ওপরে ভিত্তি করে অনেক নদী উপত্যকা প্রকল্প
গড়ে তোলা হয়েছে। এই রাজ্যের প্রধান ফসলগুলি হচ্ছে ধান, ডাল, চিনাবাদাম, কলাই,
আখ, তুলা, কাজুবাদাম ও মরিচ।
প্রাণিজ খাদ্য: তামিলনাড়ুর চাষীরা মূলত পশুপালন করে থাকে। এদের মাধ্যমে
প্রচুর গরু ও মহিষের দুধ উৎপন্ন হয়। এছাড়া রয়েছে হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস।
কৃষিজীবীদের অনেকেই ছাগল ও মেষ প্রতিপালন করে থাকে।
তামিলনাড়ু ভারতের অন্যতম শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী রাজ্য। এর অধিকাংশ সামুদ্রিক মাছ।
এছাড়া মিঠা পানির মাছের চাহিদা পূরণ হয় নদী এবং বিভিন্ন ধরনের জলাশয় থেকে।
খনিজ সম্পদ:
তামিলনাড়ুতে নানা ধরনের
খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদগুলো হলো- চুনাপাথর, বক্সাইট, জিপসাম,
লিগনাইট (ধূসর কয়লা), ম্যাগনেসাইট ও লৌহ আকরিক। এই
রাজ্যের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত নেইভেলি উন্মুক্ত লিগনাইট আহরণ খনি হলো-
ভারতের সর্ববৃহৎ লিগনাইট খনি।
বিদ্যুৎ: তামিলনাড়ুর বিদ্যুতের প্রধান অংশ আসে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
থেকে। এছাড়া কাবেরী ও এর শাখানদীতে বিভিন্ন স্থাপিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে
উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাজ্যের চাহিদা মেঢায়। তামিলনাড়ু বায়ুবিদ্যুৎ
উৎপাদনেও অগ্রণী।
কলকারখানা:
তামিলনাড়ু ভারতের অন্যতম শিল্পোন্নত রাজ্য। এই রাজ্যের গড় উৎপাদনের
এক-তৃতীয়াংশ আসে উৎপাদনশীল খাত থেকে। এই রাজ্যের উল্লেখযোগ্য কারখানাজাত পণ্ হলো-
অটো মোবাইল, কৃষি যন্ত্রপাতি, সামরিক যানবাহন ও রেলের বগি। চেন্নাইয়ের নিকটবর্তী পেরামবুরে
রয়েছে এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ রেলের বগি উৎপাদন কারখানা। চেন্নাইয়ে একটি
তৈল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল প্লান্ট রয়েছে। অন্যান্য প্রধান শিল্পপণ্যগুলো হলো- টেক্সটাইল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ,
ফার্মাসিউটিক্যাল, রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম।
তামিলনাড়ুর হস্তশিল্প খুবই সমৃদ্ধ। এই রাজ্যে তৈরি হয় কাঁসা, পিতল, ব্রোঞ্জ ও চামড়ার
পণ্য, তাঁতজাত রেশমবস্ত্র। এই রাজ্যের প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে হাত দিয়ে চিত্রিত
বয়ন কলমকারি বিখ্যাত। এছাড়া তৈরি হয় কাঠ, তালপাতা ও বেতের নানা জিনিসপত্র।
যোগাযোগ: রাজ্যের
প্রধান প্রধান শহর বা স্থানে যাতায়াতে সুপরিসর সড়ক ব্যবস্থা ও রেল-ব্যবস্থা রয়েছে।
তামিলনাড়ুতে রয়েছে৩ ২টি প্রধান বিমানবন্দর। এর একটি
চেন্নাই, অপরটি তুতিকোরিনে। চেন্নাইয়ের নিকটবর্তী
মীনাম্বকম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ভারতের অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দর। এছাড়া
মাদুরাই, কোইম্বাটোর ও তুতিকোরিনসহ অন্যান্য শহর-নগরের মধ্যে
অভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। তিরুচ্চিরাপল্লি বিমানবন্দরে সীমিত অভ্যন্তরীণ
ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট রয়েছে।
শাসন ব্যবস্থা:
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতই তামিলনাড়ুতে রয়েছে প্রাদেশিক সরকার। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে
গৃহীত জাতীয় সংবিধান দ্বারা এই প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা নির্ধারিত হয়েছে। রাজ্যের প্রধান
হিসেবে নিযুক্ত হন
গভর্নর। এই পদের নিয়োগ দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। গভর্নরকে সহায়তা ও
পরামর্শ দেন স্থানীয় মন্ত্রীপরিষদ। এই মন্ত্রীপরিষদের প্রধান হিসেবে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী। এককক্ষ বিশিষ্ট
বিধানসভা নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করে, তারা সরকার গঠন করে।
রাজ্যের বিচারব্যবস্থার
সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হলো মাদ্রাজ হাই কোর্ট।
মাদুরাইয়ে এই হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ আছে। নিম্ন আদালতের মধ্যে
আছে জেলা ও সেশন কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও মুনসেফ কোর্ট। সমগ্র
তামিলনাড়ু ৩২টি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত। নিম্নতম প্রশাসন ও রাজস্ব
সংগ্রহকারী বিভাগকে বলা হয় বলা হয় তালুক, ফিরকা। এছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত স্থানীয়
স্বায়ত্তশাসন ও গ্রামোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসা: তামিলনাড়ুতে রয়েছে উন্নতমানের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই
ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে
বিপুলসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডিসপেনসারি এবং
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এই চিকিৎসাব্যবস্থায় রয়েছে এলোপ্যাথিক, ভারতের
ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদিক ও সিদ্ধা, ইসলামী ইউনানী পদ্ধতি ও
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা।
তামিলনাড়ুরতে মারত্মক রোগ হিসেবে রয়েছে কলেরা, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, এইচআইভি/এইডস মত রোগ।
রাজ্যে কুষ্ঠ রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বছরে বহু মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
শিক্ষা: তামিলনাড়ুতে রয়েছে
শিক্ষালাভের সুযোগ সুবিধা। রাজ্যজুড়ে রয়েছে বহু সরকারি-বেসরকারি
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া আছে অসংখ্য বিজ্ঞান,
বাণিজ্য ও কলাবিভাগ সমন্বিত কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল
মহাবিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং শিল্প প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
তামিলনাড়ুর উল্লেখযোগ্য উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো-
সংবাদপত্র:
তামিল ভাষায় শতাধিক দৈনিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক,
মাসিকসহ বিভিন্ন সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়ে থাকে। ইংরেজি দৈনিকের
মধ্যে চেন্নাইভিত্তিক 'দি হিন্দু' সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র
ধর্ম:
তামিলনাড়ুর প্রধান ধর্ম হলো- সনাতন হিন্দু ধর্ম। এদের সংস্কৃতিতে হিন্দুত্ববাদ খুব গভীরে প্রোথিত। রাজ্যের হাজার
হাজার মন্দির। এর ভিতরে বিখ্যাত মন্দির হলো- মধ্যে খ্রিষ্টীয় ৭ম-৮ম শতাব্দীতে নির্মিত মালাল্লাপুরা মন্দির
১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চিদাম্বরম, কাঞ্চিপুরম, থাঞ্জাবুর, মাদুরাই ও শ্রীরঙ্গম
তীর্থস্থানের মন্দিরের দ্বারস্তম্ভ বা গোপুরামগুলো খুবই দর্শনীয়। এছাড়া
তামিলনাড়ুতে বিভিন্ন মঠ ও মিশন রয়েছে। এসবের মধ্যে কুম্ভকোনমে শংকর মঠ এবং
শ্রীরঙ্গমে বৈষ্ণব মঠ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রাজ্যের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ভিতরে রয়েছে খ্রিষ্টান ও মুসলমান। এই রাজ্যে রয়েছে
বহু ঐতিহ্যবাহী আর্মানিয়ান, পর্তুগিজ চার্চ।
সঙ্গীতসংস্কৃতি:
তামিলনাড়ুর ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় নৃত্যরীতি ভরতনাট্যম বিখ্যাত। এই রাজ্যের কণ্ঠ ও
যন্ত্রসঙ্গীতের ভিত্তি দক্ষিণভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।