বিংশ শতাব্দীর নব্যধারার গান

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতা কেন্দ্রিক নাগরিক গানকে আলোকিত করে রেখেছিল ঠাকুরবাড়ির গান। রবীন্দ্রনাথ তখন শুধু ঠাকুরবাড়ির নয় বঙ্গদেশের অন্যতম গীতিকার হিসেবে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির বাইরে পঞ্চকবির তিন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩- ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ),  রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ) ও অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১ - ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা গানকে খনও সমৃদ্ধ করে চলেছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলামের গীতিকার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল 'বাজাও প্রভু বাজাও প্রভু' গানের মধ্য দিয়ে। এই সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং রজনীকান্ত সেন-এর মৃত্যু হয়েছে। এরপর পঞ্চভাস্করের ধারাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে বাকি তিন কবি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে অতুলপ্রসাদ সেনের মৃত্যু হয়।  রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটলো ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে। র পঞ্চকবির শেষ কবি কাজী নজরুল ইসলা (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) দীর্ঘজীবন লাভ করলেও ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে স্তব্ধ হয়ে যান। মূলত এর ভিতর দিয়ে বাংলা গানের 'পঞ্চভাস্কর' যুগের সমাপ্তি ঘটে।

বাংলাগান গানের স্থপতি হিসেবে পঞ্চভাস্করকে মান্য করা হয়। কিন্তু সেই সাথে সময়ের অন্যান্য প্রতিভাবান সুরকার ও গীতিকারকে অবহেলার সাথে ইতিহাসের বিস্মৃতির অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা ভুলে যাই এঁদের দ্বারাই রেকর্ডের গান এবং বাংলা চলচ্চিত্রের গানের কথা। আমরা বাংলা গানের যে স্বরণযুগের কথা বলতে গিয়ে যতটা আবেগ তাড়িত হই, ততটাই বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেই এ সকল স্রষ্টাদের। এই বিস্মৃতির পিছনে আরও একটি বিষয় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রাম্ভিক সময় পর্যন্ত গানের পরিচয় হতো গীতিকারদের গান। পরবর্তী সময়ে রেকর্ড, বেতার এবং চলচ্চিত্রের সূত্রে গানের পরিচয় ঘটলো নানা নামে। এই গানগুল হয়ে উঠলো, অমুক শিল্পীর গান, অমুক সিনেমার গান। গীতিকার এবং সুরকার অপ্রধান হয়ে গেলো। আগের দিনের সঙ্গীত স্রষ্টার গান লিখে নিজেরাই সুর দিতেন। গায়ক হিসেবেও এঁদের অধিকাংশের সুখ্যাতি ছিল। রেকর্ড, বেতার এবং চলচ্চিত্রের সূত্রে যে সকল গান রচিত হতো, তার গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর নামের দরকার করলো। সেকালের সঙ্গীতশিল্পীরা তাঁদের পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এক একটি গানকে যে অসাধারণ মানে পৌঁছে দিতেন, তাকে অন্যান্য অতিক্রম করাটা অন্যদের কাছে ধৃষ্টতার কাজ মনে হতো। আগের যুগের গানগুলো যে কেউ গাইতে পারতেন। সে গানগুলো একজন গেয়েছে বলে অন্য কেউ গাইতে পারবেন না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু রেকর্ড ও চলচ্চিত্র তাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতো কতকগুলো ক্ষেত্রে। দেখা গেলো রবীন্দ্রনাথের গান একটু অনুমতি নিয়ে যে কেউ গাইতে পারছেন। কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া নব্যধারার গান অন্য কেউ গাইতে পারছেন না। চলচ্চিত্রের ব্যবহারত গান অপরিবর্তনীয় অবস্থার ভিতরে থাকে। একই গানের একাধিক শিল্পীর গানের বিচারে রেকর্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু বিধি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেকালের আধুনিক গান বলতে যে সকল গানকে বুঝানো হয়েছে, সে গানগুলো নানা শিল্পীদের দিয়ে করানো হতো। পঞ্চকবির গান যে কোনো শিল্পীর কণ্ঠেই গীত হোক অনুমতি সাপেক্ষে তা রেকর্ডে প্রকাশ হতো। যেমন শৈলেন রায়ের রচিত, রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে যে গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, সে গান অন্যকোন শিল্পীর দ্বারা রেকর্ড হতো না। অবশ্য সে সময়ে এই প্রতিবন্ধকতার বাইরে ছিলেন পঞ্চকবিরা। শ্রোতাদের কাছে গানের ভালোলাগা বা ভালোবাসা সবই ছিল গান এবং সঙ্গীত শিল্পীকে ঘিরে। কালক্রমে শ্রোতাদের কাছে গানগুলো পরিচয় হয়ে উঠলো- পঙ্কজ মল্লিকের গান, হেমন্তের গান, লতার গান ইত্যাদি।

এই যুগের সৃষ্টির বিচারে ১৯৩০ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারি। লক্ষ্য করা যায় এই সময়ের ভিতরে ঝাঁক বেঁধে কিছু এই সকল স্রষ্টারা আবির্ভূত হয়েছিলেন। লক্ষ্য করুন পঞ্চভাস্করের শেষ কবির জন্ম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। ৭ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত গীতিকার  অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ)কে গানের সংখ্যার বিচারে নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁকে স্থান দেওয়া হয়। তাঁর গানের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার। এর তিন বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন রোমাণ্টিক গীতিকার শৈলেন রায় (১৯১০-১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ)। এঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ১৮০০। কাজী নজরুল ইসলামের সহায়তায় তাঁর রচিত গান 'স্মরণপারের ওগো প্রিয়, তোমার মাঝে আপন হারা' আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল।
        [রেকর্ডে বাংলা গান]

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন সুরসাগর  হিমাংশু দত্ত সুরকার কমল দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২খ্রিষ্টাব্দে।
শিল্পীদের ভিতরে অগ্রজ ছিলেন।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর জন্মগ্রহণ রাইচাঁদ বড়াল ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। পঙ্কজকুমার মল্লিক জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে।
 

 

 


পঞ্চকবির বলয় থেকে বেড়িয়ে এসে বাংলা গানের যে আধুনিক কালের সূচনা ঘটেছিল, তার আদি পর্বে বৃহত্তর অঙ্গন সৃষ্টি করেছিলেন। এঁর গানের সংখ্যা প্রায় ১৮০০।


বাংলা গানে কলকাতা বেতারকেন্দ্র
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তিনি কলকাতার ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে কাজ শুরু করেন। আর এই

কবি ও গীতিকার হিসেবে পাওয়া বাণী কুমারকে পাওয়া যায় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তাঁর রচিত গীতি-আলেখ্য 'মহিষাসুরমর্দিনী' বেতারে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই এই গীতি-আলেখ্যটি। এর গানের অংশের সুর করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক (
১৯০৫-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) আর চণ্ডীপাঠ ও ভাষ্যে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

এরই ভিতরে  ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক্ চিত্রের শুভারম্ভ হয়। উল্লেখ্য ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী নির্মিত প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র ছিল ‘জামাই ষষ্ঠী’। এরপর এই বছরে মুক্তি পায় পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছবি 'দেনা পাওনা'। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল কলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে। এসব চলচ্চিত্রের গানকে রেকর্ড করে প্রচার করার জন্য ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুস্থান ও মেগাফোন কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা হয়। আর ১৯৩৫-এ আবির্ভুত হয় রেকর্ড কোম্পানি সেনোলা কোম্পানী। চলচ্চিত্রের গানের চাহিদা মেটানোর জন্য আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে নতুন নতুন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের। এই সূত্রে সৃষ্টি হয় বাংলা সিনেমার গান যুগ।

কাজী নজরুল ইসলামের হাত ধরেই সঙ্গীত জগতে সুরকার বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিলেন  কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে)। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নজরুল ইসলামের কথায় সুরারোপ করা শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি নজরুলের প্রায় তিনশত গানের সুরারোপ করেন।

এরপর সুরকার ও গীতিকার হিসেবে পাওয়া সুধীন দাশগুপ্ত (১৯৩০-১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ)। পাশ্চাত্য, প্রাচ্য এবং বাংলা লোকগানের বোদ্ধা এই সঙ্গীতজ্ঞ নানা ধরনের সুরে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

---------

 পর  এই সময়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং পূর্বে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তাঁরাও সুপ্রতিষ্ঠিত হন। সর্বোপরি এই সময় থেকেই বাংলা গানে এক নতুন ধারা পরিলক্ষিত হয়। পূর্বে বাংলা গানের ক্ষেত্রে চিরাচরিত কীত্র্তন, ভক্তিমূলক গান, টপ্পা অঙ্গের গান প্রচলিত ছিল। তিরিশের দশকে বাংলা গান আধুনিকতার দিকে ঝোঁকে। বিভিন্ন প্রকারের নতুন ধারার গানের প্রকাশও এই সময়ে লক্ষণীয় - যেমন, গ্রাম্য সুরের গান, পল্লীগীতি, লোকগীতি,ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, চট্কা ইত্যাদি। এছাড়া শ্যামাসঙ্গীত ও ইসলামী গানের নতুন ধারাও এই কালেই সংযোজিত হয়। এই সময় থেকেই বাংলা গীত ও গজলের প্রচলন হয়, ভজন গানও বিশেষ প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম ইসলামী গানের রেকর্ডও হয় এই তিরিশের দশকেই। আহ্মেদের গাওয়া ইসলামী গান দুটি "ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে" এবং "ইসলামের ঐ সওদা লয়ে" ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত হয় (রেকর্ড নং এন-৪১১১১)।

ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি ও ইসলামী গানে "পল্লীদুলাল" আব্বাসউদ্দিন আহ্মেদ, মিঃ আবদুল লতিফ, মিঃ আশরফ আলি, সাকিনা বেগম, কে মল্লিক, ধীরেন্দ্রচন্দ্র সরকার, সিরাজুর রহমান, গনি মিঞা, রোশন আরা বেগম, লালিয়া বিবি প্রভৃতি শিল্পীদের নাম উল্লেখ যোগ্য। আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া "রঙ্গিলা নায়ের মাঝি' এবং অপর পিঠে "আমার গহীন গাঙের নাইয়া" (এফ্টি ২৮১৮) এবং "তোরষা নদীর ধারে ধারে" ও অপর পিঠে "কুঁচবরণ কন্যা রে তোর" (এফ্ টি ২২২৭)- এই ভাটিয়ালী গানগুলি সেই সময়ে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া ওঁর গাওয়া "মহরমের চাঁদ এলো ঐ" এবং "বহিছে সাহারায় শোকেরই লু হাওয়া" (এফ্টি ২৫৯৫) গানদুটিও বেশ লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল । অন্যান্য ইসলামী গানের মধ্যে যে গানগুলি জনগনের কাছে সমাদর পেয়েছিল সেগুলি হল, মিঃ আশরফ আলির গাওয়া "সকাল হল শোন রে আজান" এবং "নামাজ পড় রোজা রাখো"(এফ্টি ১২৫৯), এবং আবদুল লতিফের "ঈদ্ মুবারক" এবং "যেওনা যেওনা মদিনা দুলাল"। এই একই সময়ে সুকণ্ঠী কমল ঝরিয়া-র গাওয়া পল্লীগীতি "ও বিদেশী বন্ধì" এবং "ও দুটি নয়ন" এবং হরিমতীর গাওয়া "আমি বন্ধìর প্রেমাগুণে পোড়া" গানগুলি বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। শ্যামা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এই সময়কার জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন মৃণালকান্তি ঘোষ ও ভবানী চরণ দাস। কাজী নজরুল ইস্লাম রচিত ও সুরারোপিত শ্যামাসঙ্গীত এইসময় বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মৃণাল কান্তি ঘোষের গাওয়া "বল রে জবা বল", "মহাকালের কোলে এসে", "আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়" ও "আর লুকাবি কোথায় মা কালী" এক সময়ে লোকের মুখে মুখে ফিরতো।
এই সময়ে গীতিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, প্রণব রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্র কুমার রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শৈলেন রায় প্রভৃতিরা। এঁদের রচিত নানাধরনের বাংলা গান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত এবং স্বল্প প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর কণ্ঠে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সুরকারদের মধ্যে নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ , দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ তো ছিলেনই, আর ছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, শচীনদেব বর্মন, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, রাইচাঁদ বড়াল প্রভৃতিরা। বাংলা গানের গীতিকার ও সুরকার হিসাবে খ্যাত রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন প্রভৃতির স্বকণ্ঠের গান ছিলো বাংলা গানের রেকর্ডের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট সম্পদ। হিন্দুস্তান কোম্পানী তাদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের গান দিয়ে।গানদুটি হলো "তবু মনে রেখো" এবং অপর পিঠে রয়েছে আবৃত্তি "আমি যখন বাবার মতো হব"।কাজী নজরুলের স্বকণ্ঠের গান হলো "দিতে এলে ফুল হে প্রিয়" এবং অপর পিঠে "পাষাণে ভাঙ্গালে ঘুম"। অতুল প্রসাদ সেনের নিজকণ্ঠের গান হলো "মিছে তুই ভাবিস মন" এবং "জানি জানি তোমারে"।

পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে যাঁরা এই সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন,তাঁরা হলেন কুন্দনলাল সাইগল (কে.এল.সাইগল), অন্ধ গায়ক কৃষ্ণ চন্দ্র দে (সঙ্গীতাচার্য কে.সি.দে), শচীন দেব বর্মন, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী ও পঙ্কজ মল্লিক। কীর্তনে কে.সি.দে-এর গাওয়া একটি বিখ্যাত গান হলো "এই তো মাধবীতলে" এবং "শুন শুন হে পরাণ প্রিয়"। কে. এল.সাইগলের গাওয়া প্রেমসঙ্গীত "নাইবা ঘুমালে প্রিয়" ও "এখনি উঠিবে চাঁদ" এবং শচীন দেব বর্মনের গাওয়া গান "ডাকলে কোকিল রোজ বিহনে" ও "এই পথে আজ এস প্রিয়" আধুনিক-সঙ্গীত পিপাসুদের মনে এক সময়ে বেশ আলোড়ন তোলে।পঙ্কজ মল্লিক তাঁর বিশেষ অবদান রেখে গেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে । ১৯৩২ সালের আগষ্ট মাসে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত "প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে" এবং "তোমার আসন শূন্য আজি" বিশেষ জনপ্রিয় হয়। রেকর্ডটি হিন্দুস্থান কোম্পনি থেকে প্রকাশিত হয়। এই সময়ে ওঁর গাওয়া আর দুটি উল্লেখযোগ্য গান হল "মুক্তি" ছায়াছবির দুটি গান "আমি কান পেতে রই" (রবীন্দ্রসঙ্গীত) এবং "দিনের শেষে ঘুমের দেশে"(রবীন্দ্রনাথের কথা, কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ও কণ্ঠে গাওয়া গান)। কৌতুক বা হাসির গানে নতুনত্ব আসে কমল দাশগুপ্তের অগ্রজ বিমল গুপ্ত এবং হাস্য কৌতুক অভিনেতা ও গায়ক রঞ্জিত রায়ের প্রচেষ্টায়। হাসির গানে রঞ্জিত রায়-এর গাওয়া গান দুটি " আমার খোকার মাসী " এবং "মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়" বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল।
বাংলা গানের ক্ষেত্রে দুই বিখ্যাত গায়ক জগন্ময় মিত্র ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ৩০-এর দশকের শেষ দিকে আত্মপ্রকাশ করেন।জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে "শাওন রাতে যদি" এবং "গুনগুনিয়ে ভ্রমর আসে" বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। গানদুটির রেকর্ড ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে এইচ্.এম.ভি. থেকে প্রকাশিত হয়।ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে গীত " যদি ভুলে যাও মোরে" এবং "ছিল যে আঁখির আগে", এই রেকর্ডটি ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়।

মহিলা শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কমল ঝরিয়া, যুথিকা রায়, আঙুরবালা, ইন্দুবালা, কানন দেবী, রেণুকা দাশগুপ্ত, গোপালীবালা, বীনাপাণী দেবী, হরিমতী প্রভৃতিরা। আঙুরবালা বিশেষ সুকণ্ঠের অধিকারিণী ছিলেন। রাগ সঙ্গীতে ছিল তাঁর বিশেষ দক্ষতা। বাংলা গজল গানেও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। বাংলা রাগ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কমলা ঝরিয়া অপর একজন উজ্জ্বল তারকা। এছাড়াও আছেন হরি বাঈজী, ইন্দুমতী প্রভৃতিরা। কমল ঝরিয়া-র কণ্ঠে গজল "প্রিয় যেন প্রেম ভুল না এ মিনতি করি হে" এবং "নিঠুর নয়নবান কেন হানি" উল্লেখযোগ্য। যুথিকা রায়-এর কণ্ঠের "সাঁঝের তারকা আমি" এবং "ভোরের যুথিকা" বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।

স্বনামধন্য অভিনেত্রী ও গায়িকা কানন দেবী এই সময়েই তার গান রেকর্ড করেন। তার প্রথম রেকর্ড "ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা শঠ" এবং "প্রিয় তোমারি লাগি জাগি সারারাতি"(১৯৩২)। কানন দেবী তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন বাংলা সিনেমার গানের ক্ষেত্রে। মুক্তি, বিদ্যাপতি, সাথী, পরাজয়, পরিচয়, শেষ উত্তর, নববিধান এইসব চলচ্চিত্রে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, পদাবলী, লোকগীতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলা গানকে সুখশ্রাব্য করে তোলেন। এগুলির মধ্যে "আনে আওব যব রসিয়া" (বিদ্যাপতি), "আমি বনফুল গো" (শেষ উত্তর), "আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে" (মুক্তি), "তার বিদায় বেলার মালাখানি" (মুক্তি), "তোমায় হারাতে পারিনা" (সাথী), "প্রিয় তোমার তুলনা নাই" (অভিনেত্রী), "প্রাণ চায় চক্ষু না চায়" (পরাজয়), "সেই ভালো সেই ভালো" (পরিচয়) - এইসব গানগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

তিরিশের দশক থেকেই শিশু সঙ্গীতের রেকর্ড বেরোতে থাকে। পুরোপুরি শিশুদের জন্যই এধরনের নার্সারী রেকর্ডের প্রবর্তন। শিশুদের মন আকৃষ্ট করার জন্য এগুলি আকারে ছোট করা হতো। গানগুলির বিষয়বস্তু ছিল শিশুদের উপযোগী। বিশেষ ধরণের গায়কী ও কথোপকথনের ঢং থাকায় এগুলি শিশুদের চিত্তগ্রাহী হত। এই সমস্ত রেকর্ডগুলিতে 'সাউণ্ড এফেক্টের' প্রয়োগও শিশুদের মনকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। "হিজ মাস্টার্স ভয়েস" কোম্পানী থেকে জিটি, এফজি কোড নাম্বারে যে রেকর্ডগুলি প্রকাশিত হতো সেগুলিই সব নার্সারী রেকর্ড।

নাটকে সঙ্গীতের প্রয়োগ বহুদিন থেকেই এবং রেকর্ডিং-এর আদি যুগ থেকেই এইসব নাটকের গান রেকর্ড করা হতো। চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের আগমনের ফলে এবং নাটক, যাত্রা ইত্যাদির মঞ্চস্থ হওয়ার ব্যাপার কমে যাওয়ায় চলচ্চিত্রের সঙ্গীতই রেকর্ডে প্রাধান্য পায় ।তবুও নাটকে ব্যবহৃত কিছু কিছু জনপ্রিয় গানের রেকর্ডও প্রকাশ করা হতো । ৩০-এর দশকে কিছু নাটকের গান রেকর্ড করা হয়েছিলো।

আগেই বলা হয়েছে যে, বাংলা সবাক চলচ্চিত্রের সূত্রপাত ১৯৩১ সালে। প্রথম ছবি হলো 'জামাইষষ্ঠি' । এই বত্সরেই বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্তু চলচ্চিত্রের সঙ্গীত-রেকর্ডের প্রকাশ সব্র্বপ্রথম ১৯৩২ সালে চিত্র চণ্ডীদাস- 'ফিরে চলো ফিরে চলো আপন ঘরে', শিল্পী - কৃষ্ণচন্দ্র দে। ক্রমে চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার প্রয়োগ বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রোতাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে । ফলে সহজেই বাংলা গান জনপ্রিয় হতে থাকে।

১৯৩৫ সালে 'ভাগ্যচক্র'চিত্রের সঙ্গীত গ্রহণের মাধ্যমে প্রথম প্লে-ব্যাক প্রথার প্রচলন হলো। গানটি হলো 'মোরা পুলক যাচি তবু সুখ না মানি'। এই প্রথার উদ্যোক্তা ছিলেন নীতিন বসু, হীরেন বসু ও পঙ্কজ মল্লিক। এই পদ্ধতি সঙ্গীত জগতে যুগান্তর আনে। যেহেতু সঙ্গীত শিল্পীর কাজ শুধু গানটি গাওয়া সে কারণে তিনি মনোযোগ সহকারে গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন। ফলে গানের মান উন্নত হলো । এই পদ্ধতিতে, শুটিং এর আগেই প্রাথমিকভাবে গান রেকর্ড করে নেওয়া হতো। শুটিং-এর সময় অভিনতা-অভিনেত্রীরা গানের কথার সঙ্গে মুখ মেলাতেন। প্রথম প্লে-ব্যাক শিল্পী পঙ্কজ মল্লিক ও সুপ্রভা ঘোষ (সরকার)। এছাড়াও এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা হলেন কানন দেবী, কে.এল.সায়গল, বিনয় গোস্বামী,পাহাড়ী সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, বীণাপানি, পূর্ণিমা, শৈল দেবী, ছায়া দেবী প্রমুখেরা।

বাংলা গানের ক্ষেত্রে বহু শিল্পীর মধ্যে ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রচলন ছিলো। বিশেষতঃ ইসলামী গানের ক্ষেত্রে এর প্রচলন ছিলো। বলা বাহুল্য ইসলামী গানের ক্ষেত্রে মুসলমান শিল্পী তো আছেনই, বহু হিন্দু শিল্পীও মুসলমানী ছদ্মনামে গান রেকর্ড করেছেন । এইসব শিল্পীরা কেবলমাত্র ইসলামী গানের ক্ষেত্রেই নয়, হিন্দী গানের ক্ষেত্রেও অথবা অন্য কোম্পানী থেকে রেকর্ড করার সময়ও ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। কারণ প্রখ্যাত শিল্পীরা বিশেষ বিশেষ কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকতেন ।ফলে স্বভাবতই অন্য কোম্পানীতে রেকর্ড করার সময় তাদের অন্য নাম গ্রহণ করতে হতো । তবে হিন্দু শিল্পীর ইসলামী গান রেকর্ডের ক্ষেত্রেই ছদ্ম নামের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। নিচে আসল নাম ও ছদ্মনামের একটি তালিকা দেওয়া হল:

এই লেখায় যে-সব বই ও যাঁদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
গ্রন্থপঞ্জী
কানন দেবী, "সবারে আমি নমি", কলিকাতা, এম.সি.সরকার এণ্ড সন্স, ১৩৯৭;
দেবব্রত বিশ্বাস; "ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সঙ্গীত", কলিকাতা, করুণা প্রকাশনী ,১৩৮৭;
পঙ্কজ কুমার মল্লিক; "আমার যুগ আমার গান", কলিকাতা, ফার্মা কে. এল. এম , ১৯৮০;
সিদ্র্ধাথ ঘোষ; "রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কলিকাতা, ইন্দিরা সঙ্গীত শিক্ষায়তান,১৯৮৯;
ব্যক্তিগত উত্স:
বরদা গুপ্ত, ২ এ বিপিন মিত্র লেন, (সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক), কলকাতা-৭০০০০৪;
সুরজলাল (হারুবাবু) মুখোপাধ্যায়, (পুরনো রেকর্ড সংগ্রাহক), ১/২ সমর সরণী, কলকাতা-৭০০০০২।

 

 

 

 

সুবোধ কুমার পুরকায়স্থ,প্রণব রায়েরা গীতিকার হিসাবে আসলে সুরকার হিসাবে দিলীপ কুমার রায়,রাইচাঁদ বড়াল,কৃষ্ণচন্দ্র দে,শচীন দেব বর্মন,কমল দাশ গুপ্ত,সুধীরলাল চক্রবর্তী,হিমাংশু দত্ত,অনীল বাগচি,অনুপম ঘটকেরা এগিয়ে আসেন । আর এই ত্রিবিভক্ত(গীতিকার,সুরকার,গায়ক) ধারায় শিল্পী ছিলেন কুন্দ লাল,সায়গল,কানন দেবী,কমলা ঝরিয়া,ইন্দু বালা,আঙুর বালা,জগন্ময় মিত্র শৈল দেবীর মতো লোকেরা ।
এরপর পরই আসেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,মান্না দে,জগজিৎ সিং,ভূপেন হাজারিকা’র মত মায়াবী কণ্ঠের গায়কেরা । হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর গাওয়া সলিল চৌধুরীর সুরে “রানার” কিংবা “গাঁয়ের বধু ”,গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সাথে জুটি বাঁধা মান্না দে’র “কফি হাউসের সে আড্ডাটা” কিংবা ভূপেন হাজারিকা’র “মানুষ মানুষের জন্যে” আজও মানুষকে আবেগে ভাসায় ।
১৯৫০ এর দশকে সিনেমা জগতে নতুণ সাড়া লক্ষ্য করা যায় ।সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,সতীনাথ মুখোপাধ্যায়,শ্যামল মিত্র,ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য,মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,সত্যজিৎ রায় ও রবিশংকর জুটি’র মতো শিল্পীরা বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেন ।
সত্তুরের দশকে আসে যুদ্ধের জাগরনী ও দেশাত্মবোধক গান । এগুলোর প্রভাবব্যাপ্তি এত যে এই আলোচনায় আর সম্ভব নয় । আশির দশকে পপ গুরু আজম খানের হাত ধরে যে ব্যান্ডের বা পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের যে ধারাটা আসে তা পরিবর্তিত হয়ে পুরোপুরি পাশ্চাত্যের ধারার দিকে যাচ্ছে ।পালটে যাচ্ছে চিরপরিচিত ফোক (Folk) বা পল্লী গীতি এর ধরন ।সে আলোচনা অন্য একদিন ।

কিন্তু এই আগ্রাসী বিশ্বায়নের আকাশ সংস্কৃতির যুগে গানের আসল ধারা টিকিয়ে রাখা যতটুকু না কষ্টসাধ্য,তার চেয়ে বেশি কষ্ট হলো তার স্বত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করা । গান আত্মার খোরাক ,গান প্রানের খোরাক । সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, আনন্দ –কান্না যে কোনো অনুভুতি প্রকাশ পায় গানে ।গানে জেগে ওঠে হৃদয় ,গানে জেগে ওঠে ভালোবাসা ।আর কিছু না থাক যদ্দিন কথা আছে ,ভাষা আছে, অনুভূতি আছে থাকবে সুর, থাকবে গানের প্লাবন ।



সূত্র :