পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধারা
ধারণা করা হয়ে খ্রিষ্টাপূর্ব ৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত হয়েছিল লোককাহিনি ও
পৌরাণিক উপাখ্যানের সমন্বয়ে মহাকাব্য 'রামায়ণ'। রামায়ণের যুগে সামগানের প্রচলন
ছিল। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের ২৮তম সর্গের ৫৪তম শ্লোকে সামগানের উল্লেখ পাওয়া যায়।
উত্তরকাণ্ডের ১৬তম সর্গের ৩৩-৩৪তম শ্লোকে অনার্য (রাক্ষস) মহাদেবের স্তুতি
করেছেন সামগানের দ্বারা। বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে,
বাল্মীকি রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য
শেখান। কুশীলব এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে রামায়ণের এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে- এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও
বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত,
বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি
সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা
গাহিতে লাগিলেন। সুন্দরকাণ্ডের প্রথম সর্গে ১৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে- হনুমান সীতাকে
রাবণের নিকট থেকে এনে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকাশপথে যাত্রা করেন। এই
যাত্রাপথের বর্ণনায় পাওয়া যায় -'গীতনিপুণ গন্ধর্বগণে সমাবৃত..'।
এই অংশ থেকে ধারণা করা যায়- রামায়ণের যুগে গান্ধর্বগানের প্রচলন ছিল। এই গানে
সপ্তসুর, গ্রাম, মূর্চ্ছনার ব্যবহার ছিল। নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত রসসমূহের
গান্ধর্বগানে প্রয়োগ করা হতো। তবে রামায়ণের যুগে রাগের উৎপত্তি ঘটেছিল কিনা এ
বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। কুশী ও লব ছিলেন চারণ গায়ক। আর্য-অনার্য গানের
প্রভাব তাদের গানে ছিল বলে অনুমান করা যায়। এই দুই সঙ্গীতশিল্পী গান শেখার পর,
গুরু বাল্মীকির আদেশে এঁরা সুর ও ছন্দে রামায়ণের কাহিনি পরিবেশন করতেন- লোকসুরে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান উপকরণ রাগের উৎপত্তি তখনো হয় নি।
রাময়ণে যুগে প্রচলিত বেশকিছু বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডের পঞ্চম
স্বর্গের ১৮তম শ্লোকে রয়েছে- দুন্ধুভি, মৃদঙ্গ, বীণা ও পণব।
শিক্ষায়
সঙ্গীত
বৈদিক মন্ত্রের স্বর বিন্যাস এবং ছন্দ-নিয়ামক শাস্ত্রের সাধারণ শিক্ষা। ৩০০
খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে সঙ্গীতবিষয়ক যে 'শিক্ষা'র পরিচয় পাওয়া যায়, সেগুলো হলো-
পাণিনীয় শিক্ষা,
যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা,
মাণ্ডুকী শিক্ষা ও
নারদীয় শিক্ষা। এসকল গ্রন্থ থেকে সঙ্গীতবিষয়ক যে তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো-
পাণিনি ও
পাণিনীয় শিক্ষা
প্রখ্যাত সংস্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা। পাণিনির জন্মকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। এই সকল মতভেদ অনুসারে ধরা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের মধ্যে পাণিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
পণি বা পাণিন্ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি ফিনিসীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। এদেরকে পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। পাণিনির পিতা ছিলেন ফিনিকিয় বা পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর পিতার নাম ছিল শলঙ্ক। এই কারণে অনেক সময় তাঁকে শলাঙ্কি বলা হয়। পাণিনির মা ইলেন দক্ষ জাতির কন্যা। অনেকের মতে পাণিনির মায়ের নাম ছিল দাক্ষী। এই সূত্রে অনেকে ক্ষেত্রে তাঁকে দাক্ষীপুত্র বা দাক্ষেয় নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পাণিনি পারিবারিক সূত্রে বেদোত্তর সনাতন পৌরাণিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন অহিগলমালার (শিব) উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।
তাঁর শিক্ষকের নাম ছিল উপবৎস। তাঁর রচিত ব্যাকরণের নাম– অষ্টাধ্যায়ী। কথিত আছে, মহাদেবের ঢাকের শব্দে চৌদ্দটি ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই ধ্বনি অনুসারে তিনি শব্দসূত্র তৈরি করেন। একে বলা হয়েছে শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র। মূলত এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা বা সংজ্ঞাসূত্র। এই ১৪টি শিবসূত্র হলো—
১. অ ই উ ণ্ ২. ঋ ৯ ক্ ৩. এ ও ঙ্ ৪. ঐ ঔ চ্ ৫. হ য ৱ র ট্ ৬. ল ণ্ ৭. ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ |
৮. ঝ ভ ঞ ৯. ঘ ঢ ধ ষ্ ১০. জ ব গ ড দ শ্ ১১. খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্ ১২. ক প য্ ১৩. শ ষ স র্ ১৪. হ ল্ । |
মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি
এই সূত্রগুলোকে আরও সংক্ষিপ্ত করে নাম দিয়েছিলেন প্রত্যাহার (সংক্ষেপিত) সূত্র।
এক্ষেত্রে প্রতিটি সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ যুক্ত করে সংক্ষিপ্ত বা প্রত্যাহার
সূত্র হয়েছিল।
প্রত্যহার সূত্র তৈরির বিধি
১. শিবসূত্রের বিচারে প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে।
২. প্রতিটি প্রত্যাহারের নামকরণ করা হয়েছে শিবসূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ দ্বারা।
যেমন—
প্রথম শিবসূত্রটি হলো
—
অ ই উ ণ্
।
এক্ষেত্রে
প্রত্যাহরটির নাম হবে অণ্।
৩. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শেষ ব্যঞ্জনবর্ণটি ইৎ হবে, অর্থাৎ অগ্রাহ্য হবে। যেমন প্রথম
চারটি শিবসূত্র হলো—
১. অ
ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্ এই চারটি শিবসূত্রের মিলিত সূত্র প্রত্যাহর হবে
অচ্ । এর শেষ বর্ণ চ্ বাদ দিলে পাওয়া যাবে—
অ ই উ ণ্ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ। এই বর্ণগুলোই হবে সংস্কৃত ভাষার স্বরধ্বনি। অর্থাৎ অচ্
প্রত্যাহর সূত্র দ্বারা স্বরধ্বনির সংখ্যা পাওয়া গেল। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে এই সূত্রে
দীর্ঘ, হ্রস্ব, প্লুত স্বরধ্বনির উল্লেখ নাই। একই ভাবে ৫ম শিবসূত্র থেকে ১৪শ
শিবসূত্র থেকে পাওয়া যায় প্রত্যাহার সূত্র হল্। এর অর্থ হলো সমস্ত
ব্যঞ্জনবর্ণ। পাণিনি ব্যাকরণে প্রত্যাহার সূত্র মোট ৪৩টি। তাঁর সমগ্র রচনাটি আটটি
অধ্যায়ে বিভাজিত এই সূত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে- অষ্টাধ্যয়ী। এই
ব্যাকরণের অন্যতম ভাষ্যকার ছিলেন পতঞ্জলি ।
বৈদিক মন্ত্রের স্বর বিন্যাস এবং ছন্দ-নিয়ামক শাস্ত্রের
সাধারণ শিক্ষা। এরূপ একটি শিক্ষা গ্রন্থ হলো পাণিনীয় শিক্ষা। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী
গ্রন্থে পাওয়া যায় স্বরের উৎপত্তি বিষয়ক একটি উপাখ্যান। এই উপাখ্যান থেকে জানা যায়
যে, নৃত্ত শেষে ১৪ বার ঢাকে আঘাত করেছিলেন। এর ফলে বর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৪বারের
আঘাতে সৃষ্ট হয়েছিল ১৪টি সূত্র। এই সূত্রগুলো মহেশ্বর সূত্র (শিবসূত্রের) উৎপত্তি
ঘটেছিল। পাণিনীয় শিক্ষায় বর্ণ-উৎপত্তির এই পৌরাণিক কাহিনি ছাড়া পাওয়া যায়- উদাত্ত,
অনুদাত্ত ও স্বরিত নামক তিনটি স্বরস্থানের নাম। শিক্ষাকার একে 'স্বরস্ত্রয়' নামে
অভিহিত করেছেন। স্বরের সময়জ্ঞাপক মাত্রামান তথা সময় জ্ঞাপক মান হিসেবে উল্লেখ
করেছেন- হ্রস্ব (১ মাত্রা), দীর্ঘ (২ মাত্রা) ও প্লুত (৩ মাত্রা)। এছাড়া লয় হিসেবে
উল্লেখ করেছেন দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত।
পাণিনীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে 'স্বরস্ত্রয়' থেকে সাত স্বরের উৎপত্তি ঘটেছিল। বৈদিক
শাস্ত্রীয় স্বরের নামের পরিবর্তে লৌকিক নাম ব্যবহার করেছেন। এই গ্রন্থ মতে-
যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষাউদাত্তে নিষাদগান্ধারাবানুদাত্তঋষভধৈবতৌ
স্বরিতঃ প্রভবা হোতো ষড়্জমধ্যমপঞ্চমাঃ॥উদাত্ত থেকে - নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিত থেকে ষড়্জ, মধ্যম ও পঞ্চমের উৎপত্তি হয়েছে। স্বরের উৎপত্তি স্থান হিসেবে ৮টি অধিষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- উরঃ, কণ্ঠ, শির, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ ও তালু। এছাড়া স্বরে উৎস হিসেবে পশুপাখির কণ্ঠস্বরের উল্লেখ করেছেন।
স্বর | স্থান | বর্ণ | দেবতা | জাতি | ঋষি | ছন্দ |
উদাত্ত | উচ্চ | শুক্ল | অগ্নি | ব্রাহ্মণ | ভরদ্বাজ | গায়ত্রী |
অনুদাত্ত | নীচ | লোহিত | সোম (তেজঃ) | ক্ষত্রিয় | গৌতম | ত্রৈষ্টুভ |
স্বরিত | মধ্যম | কৃষ্ণ | সবিতা | বৈশ্য | গার্গ্য | জগতী |
ঊচ্চৌ নিষাদগান্ধারৌ নীচাঋষভধৈবতৌএখনে ঊচ্চৌ শব্দের দ্বারা উদাত্তকে বুঝানো হয়েছ। এখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে নিষাদ ও গান্ধার। নীচা শব্দের দ্বারা অনুদাত্তকে বুঝানো হয়েছে। এখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে- ঋষভ ও ধৈবত। স্বরিত থেকে উৎপন্ন হয়েছে - ষড়্জ, মধ্যম ও পঞ্চম।
শেষস্তু স্বরিতা জ্ঞেয়াঃ যড়্জ-মধ্যম-পঞ্চম॥
মাণ্ডুকী শিক্ষা
যাজ্ঞবল্ক্যের পরে সঙ্গীতবিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে মাণ্ডুকী শিক্ষা।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে মণ্ডুক মুনি এই গ্রন্থটি রচনা
করেছিলেন। এই গ্রন্থের বিবরণ থেকে ধারণা করা হয়, তাঁর সময়ে সামগানের প্রচলন ছিল। এই
গ্রন্থে সামগানের পাঁচটি স্বরস্থানের প্রচলন ছিল। এগুলোর নাম ছিল- উদাত্ত,
অনুদাত্ত, স্বরিত ও প্রচর। সম্ভবত প্রচর স্বরস্থানটি ছিল স্বরিত স্বরস্থানের বর্ধিত
অংশ।
এই গ্রন্থ মতে পশুপাখির স্বর অনুসরণে সঙ্গীতের ৭টি স্বর গ্রহণ করা হয়েছিল। এই
স্বরগুলোর উৎস এবং বর্ণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। যেমন-
স্বর | উৎস (পশুপাখির কণ্ঠস্বর) | বর্ণ |
ষড়্জ | ময়ুর | পদ্মপত্র |
ঋষভ | গাভী | শুকপিঞ্জর |
গান্ধার | ছাগ | স্বরণাভ |
মধ্যম | বক | কুন্দফুল |
পঞ্চম | কোকিল | কৃষ্ণ |
ধৈবত | ঘোড়া | পীত |
নিষাদ | হাতি | সর্ববর্ণযুক্ত |
অথাতঃ স্বরশস্ত্রাণাং সর্বেষাং বেদনিশ্চয়ম্।
উচ্চনীচবিশেষাদ্ধি স্বরাণ্যত্বং প্রবর্ততে॥ ১
আচিকং গাধিকং চৈব সামিকং চ স্বরাত্তরম্।
কৃতান্তে স্বরশান্ত্রাণাং প্রযোক্তব্যং বিশেষতঃ॥ ২
একাস্তরস্বরো হৃক্ষু গাথাসু দ্যান্তরঃ স্বরঃ।
সামসু ত্র্যন্তরং বিদ্যাদেবতাবৎ স্বরিতোস্তরম॥৩
প্রথম শ্লোকে নারদ বলেছেন- উচ্চ-নিচ ও মধ্য তথা উদাত্ত,
অনুদাত্ত ও স্বরিত স্বর বৈদিক গানে ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্লোকে স্বরসংখ্যার
বিচারে গানের জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে- আর্চিক (এক স্বর), গাথিক (দুই স্বর), সামিক
(তিন স্বর), স্বরান্তর (চার স্বর)।
কিন্তু পরবর্তী ৯-১৪ শ্লোকে বৈদিক সাতটি স্বরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদিক
এই ৭ স্বরের
নাম ছিল- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র,
ক্রুষ্ট ও অতিশ্বার্য। এই স্বরগুলো
বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থাদির গানগুলোর কোনটিতে কোন স্বর ব্যবহৃত হবে, তা উল্লেখ করা
হয়েছে। যেমন-
নারদীয় শিক্ষার দ্বিতীয় কণ্ডিকায় পাওয়া যায় তান, রাগ স্বর গ্রাম ও মূর্চ্ছনার বিষয়। এই কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
তানরাগস্বরগ্রামমূর্ছনানাং তু লক্ষণম্
পবিত্রং পাবনং পুণ্যং নারদেন প্রকীর্তিতম্। দ্বিতীয় কণ্ডিকা। ২
এই গ্রন্থের তান, রাগ, স্বর, গ্রাম আনা হয়েছে লৌকিক গান থেকে। মূলত এই বিষয়গুলোর ব্যবহার করা হতো গান্ধর্ব মার্গ এবং দেশী গানগুলোতে। অনেকে মনে করেন এই শ্লোকের স্বর ও গ্রাম হবে মূলত রাগস্বর। মূলত গ্রামের আদ্যস্বরকে বলা হয়, রাগস্বর। তৃতীয় কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
''ষড়্জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ী গ্রামাঃ প্রকীতর্তিতা।
ভূলোকজ্জায়তে ষড়্জো ভূবর্লোকচ্চা মধ্যমঃ৬
সর্গান্ননাত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষণ গ্রামরাগো ইতি স্মৃতাঃ। ৭
নারদের সময়ে প্রচলিত তিনটি গ্রাম ছিল যড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম। নারদ এই সকল রাগের প্রচলনের স্থান হিসেবে পৌরাণিক ভাবনা থেকে লিখেছিলেন- পৃথিবীতে ষড়্জগ্রাম, ভুর্বলোকে মধ্যমগ্রাম এবং স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত ছিল। নারদীয় শিক্ষায় বৈদিক ও লৌকিক গানের ক্ষেত্রে দশ রকম গুণের কথা বলেছেন। এই গুণগুলো হলো- রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সুকুমার ও মধুর।
১, রক্তা: বেণু ও বীণা একত্রিত ধ্বনি বা স্বর যা সকলকে আনন্দ দান করে।
তত্র রক্তং নাম বেণুবীণাস্বরাণামেকীভাবে রক্তমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা।২. পূর্ণ: স্বর (মধ্যামদি) ও শ্রুতির করণ বা পূরণ হয় এবং ছন্দের পাদ ও অক্ষরের পরস্পরের সংযোগে উচ্চারণ হয়।
পূর্ণ নাম স্বরশ্রুতিপূরণাছন্দঃ পাদাক্ষর সংযোগাৎপূর্ণমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৩
৩. অলঙ্কৃত: ক্ণ্ঠ থেকে নির্গত স্বরকে নিম্ন ও উচ্চ উচ্চারণ
অলঙ্কৃত নামোরসি শিরসি কণ্ঠযুক্তমিত্যলঙ্কৃতম্ । প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৪
৪. প্রসন্ন:_কণ্ঠকে নিপীড়ন ক'রে গদগদ ধ্বনি
প্রসন্নং নামাপগতগদ্গদ্নির্বিশঙ্কং- প্রসন্নমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৫
৫. ব্যক্ত-শব্দ বা ধাতু ও প্রত্যযঘৃক্ত এবং ছন্দ, রাগ, পদ ও স্বরসমূহের দ্বারা ধ্বনির অভিব্যক্তি
ব্যক্ত নামপদপদার্থপ্রকৃতিবিকারাগমলোপকৃত্তদ্ধিসমাসধাতুনিপাতোপস-
র্গস্বরলিঙ্গবৃত্তিবার্তিকবিভক্ত্যর্চনানাং সম্যগুপপাদনে ব্যক্তমিত্যুচ্যতে॥ প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৬৬. বিকৃষ্ট: উচ্চ ভাবে উচ্চারণ করলে যেখানে পদের অন্তর্গত অক্ষরের স্পষ্টতা থাকে অব্যক্ত বা অস্পষ্ট হয় না। প্রকৃতপক্ষে তারস্বরে বা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করাকেই বিক্রষ্টা বলে
বিক্রুষ্টং নামোচ্চৈরচ্চারিতং ব্যক্তপদাক্ষরমিতি বিক্রুষ্টম্। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৭
৭. শ্লক্ষ্ণ: দ্রুত, বিলম্বিত, উচ্চ, নীচ, প্লুত, সমাহার প্রভৃতির সম্পাদন।শ্লক্ষ্ণং নামাদ্রুতম্বিলম্বিতমুচ্চনীচপ্লুতসমাহারহেলতরাবীপনয়ানাদিভি-
রুপপাদনাদিভিঃ শ্লক্ষ্ণমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৮৮. সম: স্থায়ী, সঞ্চারী, আরোহ ও অবরোহ প্রভৃতি বর্ণগুলিকে লয়ের সঙ্গে একীভূত করা।
সম নামাবাপনির্বাপপ্রদেশী প্রত্যন্তরস্থানানাং সমাসঃ সমমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৯
৯. সুকুমার: মৃদু পদ,বর্ণ, স্বর কুহরণ যুক্ত হবে।
সুকুমারং নাম মৃদুপদবর্ণস্বরকুহরণযুক্তং সুকুমারমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ১০
১০. মধুর: স্বভাবত সাবলীল গতিতে পদের ও অক্ষরের উচ্চারণ । এই উচ্চারণে কণ্ঠের স্বভাবসুন্দর মাধুর্য ও কমনীয়তা বজায় থাকে ।
মধুরং নাম স্বভাবোপনীতললিতপদাক্ষর গুণসমৃদ্ধং মধুরমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ১১
গ্রাম থেকে উৎপন্ন ২১টি মূর্চ্ছনাকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দেবতা ও গান্ধর্ব গণের মূর্চ্ছনার নাম একই ছিল, কিন্তু পিতৃগণের নাম ছিল ভিন্ন। প্রথম প্রপাঠকের তৃতীয় কণ্ডিকার ৭ থেকে ২৪ শ্লোকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে-
নন্দী-বিশালা-সুমুখী-চিত্রা-চিত্রবতী-সুখা।
বলা যা চাথ বিজ্ঞেয়া দেবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥
আপ্যায়নী-বিশ্বভৃতা-চন্দ্রা-হেমা-কপর্দিনী।
মৈত্রী-বার্হতী চৈব পিতৃণাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥
* * *
উপজীবন্তি গন্ধর্বাদিবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ। ২৩
পিতৃণাং মূর্ছনা সপ্ত তথা যক্ষা ন সংশয়ঃ।
ঋষিণাং মূর্ছনা সপ্ত যাস্তিমা লৌকিকাঃ স্মৃতা ॥২৪
মূর্চ্ছনা সংখ্যা | দেবগণ | পিতৃগণ | গান্ধর্গণ |
১ | নন্দী | আপ্যায়নী | নন্দী |
২ | বিশালা | বিশ্বভৃতা | বিশালা |
৩ | সুমুখী | চন্দ্রা | সুমুখী |
৪ | চিত্রা | হেমা | চিত্রা |
৫ | চিত্রবতী | কপর্দিনী | চিত্রবতী |
৬ | সুখা | মৈত্রী | সুখা |
৭ | বলা | বার্হতী | বলা |
নারদীয় শিক্ষায় ৭টি স্বরের উৎপত্তি হয় শরীরের ৭টি স্থান থেকে। এর পাশাপাশি পাওয়া যায় পশুপাখির কণ্ঠস্বর জাত ধ্বনির কথা। এই শিক্ষায় পাওয়া যায় স্বরসমূহের জাতিগত পরিচয়। এই জাতিগুলো ছিল- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এছাড়া ছিল স্বরগুলোর অধিদেবতাদের নাম। নারদীয় শিক্ষা'র চতুর্থ কণ্ডিকার ৭-১২ শ্লোকে বৈদিক ও লৌকিক সাত স্বরের উৎপত্তির উৎস হিসেবে শরীরের স্থানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
স্বর | উৎস (পশুপাখির কণ্ঠস্বর) | শরীরের স্থান | অধি দেবতা | জাতি |
ষড়্জ | ময়ুর | কণ্ঠ | অগ্নি | ব্রাহ্মণ |
ঋষভ | বৃষ | শির | অগ্নি | ক্ষত্রিয় |
গান্ধার | ছাগ | নাসিকা | সোম | বৈশ্য |
মধ্যম | সারস | ঊরঃ | বিষ্ণু | ব্রাহ্মণ |
পঞ্চম | কোকিল | ঊরঃ, শির ও কণ্ঠ | নারদ | ব্রাহ্মণ |
ধৈবত | হাতি | ললাট | তম্বরু | ক্ষত্রিয় |
নিষাদ | ঘোড়া | সর্বসন্ধি | তম্বরু | বৈশ্য |
নারদীয় শিক্ষা'র প্রথম প্রপাঠকের চতুর্থ কণ্ডিকার ৮-১১ শ্লোকে পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব।
নারদীয় শিক্ষায় ২২টি শ্রুতির পরিবর্তে ৫টি শ্রুতির নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- দীপ্তা, আয়তা, করুণা, মৃদু ও মধ্য। এগুলোর পরিণতি হতি হয় পাঁচটি রসে।
নারদীয় শিক্ষায় সামগানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি
মার্গ ও দেশী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সাতটি স্বর, ৩টি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা, ৫১ট তানের
কথা উল্লেখ করেছেন। এ সকল উপকরণের সমবেত রূপের নাম ছিল 'স্বরমণ্ডল'।
নারদ যদিও ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে সময়ে
গান্ধার গ্রামের প্রচলন ছিল না। তবে গান্ধার গ্রাম সম্পর্কে নারদ বিশেষভাবে অবগত
ছিলেন। এই গ্রামগুলোর নাম পাওয়া ষড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম (ষড়্জ-মধ্যম-গান্ধারা
ত্রয়ো গ্রামঃ প্রকীর্তিতঃ)। এই তিনটি গ্রামের আদ্যস্বরের নামকরণ করেছেন 'রাগস্বর'।
গ্রামের অধীনস্থ মূর্চ্ছনা রাগের অনুরূপ। তাই মূর্চ্ছনাকে রাগের আদ্যরূপ ধরলে,
গ্রামকে ঠাট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই গ্রামের অধীনে ছিল গ্রামরাগ। নারদীয়
শিক্ষায়৭টি গ্রামরাগের তালিকা পাওয়া যায়। এগুলো হলো
ষড়্জগ্রাম,
পঞ্চমগ্রাম,
কৈশিক,
কৈশিকমধ্যমগ্রাম,
মধ্যমগ্রাম,
সাধারিত ও
ষাড়ব।
নারদীয় শিক্ষায় বাদ্যযন্ত্র
যদিও বৈদিকযুগে বহু ধরনের বীণার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু নারদীয় শিক্ষা'য় মাত্র
দুটি বীণার নাম পাওয়া যায়। বীণা দুটি হলো- দারবীবীণা ও গাত্রবীণা।
নারদী্য শিক্ষার পরে সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেযোগ্য গ্রন্থ হলো- ভরতের
রচিত নাট্যশাস্ত্র। এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী গ্রন্থ হিসেবে- আদিভরতের
নাট্যশাস্ত্রের নাম উল্লেখ করা হয়।
নারদের সমসাময়িক সঙ্গীতাচার্য
নাট্যশাস্ত্রে তৃতীয় অধ্যায়ের 'মত্তবারণীর প্রতিষ্ঠা' অংশে- ভরত গন্ধর্বগণদের
পূজা উপাচার (বলি) গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন। গন্ধর্বগণের মধ্য বিশেষভাবে নারদ,
তম্বুরু ও বিশ্বাসুর নাম পাওয়া যায়। এই সূত্রে বলা যায়, এই তিনজন গন্ধর্ব ভরতের
অগ্রজ এনং প্রণম্য ছিলেন। পৃষ্ঠা: ৬০-৬১
তম্বুরু
প্রাচীন গান্ধর্ব সঙ্গীতজ্ঞের তালিকায় বিশেষভাবে তম্বুরু নাম নাম পাওয়া যায়।
তাঁর রচিত কোনো গ্রন্থের নমুনা পাওয়া যায় নি। তবে বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থে তাঁর
উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।
বৃহদ্দেশীতে সুরের স্নিগ্ধতা বা মধুরতা সম্পর্কে তম্বুরুর
উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায়। তাঁর মতে- 'বাতজ কারণে ধ্বনি উচ্চস্তরে রুক্ষ্ণতাযুক্ত হয়। পিত্তজ ধ্বনি
গম্ভীর এবং ঘন হয়ে থাকে। কফজ স্নিগ্ধ, সুমুমার এবং মধুর শোনায়। সন্নিপাতজ, অর্থাৎ
বাত, পিত্ত এব কফ, -এই সবের যথাযথ আনুপাতিক মিশ্রণযুক্ত ধ্বনিতে বর্ণিত সবগুলি গুণই
প্রতিভাত হয়।
মূলত মনোমুগ্ধকর সুর বা স্বরের প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন। যেমন-
বিশ্বাবসু
ভরতের গ্রন্থানুসারে বিশ্বাবসু ছিলেন ভরতে অগ্রজ এবং প্রণম্য।