ভারতীয় সঙ্গীত
বেদোত্তর যুগের ভারতীয় সঙ্গীত (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ -খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী)

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে বৈদিক যুগের ভাষা-সংস্কৃতি, সঙ্গীতের যে ধারা ছিল, তার ক্রমবিবর্তনের ধারায় পরিবর্তন ঘটে চলেছিল। প্রথাগত ভাবে বৈদিক যুগের সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছিল  দুটি ধারায়। এই ধারা দুটি হলো- পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধারা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধারা। এই দুটি ধারার ভিতরে পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধারায় বৈদিক গানের উত্তরাধিকারী হিসেবে উদ্ভব হয়েছিল গান্ধর্ব গান।  বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কাবুল ও সোয়াত নদীর তীরে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দের থেকে গান্ধার রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অনেক সময় এই রাজ্যকে প্রাচীন ভারতের ১৬ জনপদের অন্যতম জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে এই রাজ্যের দুটি বিখ্যাত নগরী কথা জানা যায়। এই নগর দুটি হলো- তক্ষশীলা ও পুস্করাবতী।

গান্ধর্বদের মাধ্যমে গান্ধর্ব গানের বিকাশ শুরু হয়েছিল বৈদিক যুগের শেষের দিকে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময় তথা বৈদিকোত্তর যুগে রচিত হয়েছিল বাল্মীকি রামায়ণ। এই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈদিক গানের পাশাপাশি আর্যপল্লীর দেশী গান ও অনার্য লোকগানের চল ছিল। এদের ভিতরে গান্ধর্বরা সঙ্গীতে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। এদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি রূপ।
  • পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধারা
    ধারণা করা হয়ে খ্রিষ্টাপূর্ব ৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত হয়েছিল লোককাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের সমন্বয়ে মহাকাব্য 'রামায়ণ'। রামায়ণের যুগে সামগানের প্রচলন ছিল।

    কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের ২৮তম সর্গের ৫৪তম শ্লোকে সামগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরকাণ্ডের ১৬তম সর্গের ৩৩-৩৪তম শ্লোকে অনার্য (রাক্ষস) মহাদেবের স্তুতি করেছেন সামগানের দ্বারা। বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে রামায়ণের এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে- এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্‌জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাহিতে লাগিলেন। সুন্দরকাণ্ডের প্রথম সর্গে ১৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে- হনুমান সীতাকে রাবণের নিকট থেকে এনে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকাশপথে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথের বর্ণনায় পাওয়া যায় -'গীতনিপুণ গন্ধর্বগণে সমাবৃত..'।

    এই অংশ থেকে ধারণা করা যায়- রামায়ণের যুগে গান্ধর্বগানের প্রচলন ছিল। কুশী ও লব ছিলেন চারণ গায়ক। আর্য-অনার্য গানের প্রভাব তাদের গানে ছিল বলে অনুমান করা যায়। এই দুই সঙ্গীতশিল্পী গান শেখার পর, গুরু বাল্মীকির আদেশে এঁরা সুর ও ছন্দে রামায়ণের কাহিনি পরিবেশন করতেন- লোকসুরে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান উপকরণ রাগের উৎপত্তি তখনো হয় নি। মূলত ভারতবর্ষের আর্য-অনার্যপল্লীর গানের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল লৌকিক গান। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এ সকল গানের কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ ছিল না। কিন্তু শাস্ত্রীয়ভাবে এই গানগুলোকে বিধিবদ্ধ করতে গিয়ে প্রাচীন সঙ্গীতাচার্যরা কিছু বিধি তৈরি করেছিলেন। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল সপ্তস্বর ভিত্তিক তিনটি গ্রাম, মূর্চ্ছনা। এ সকল গানের ভাব নির্দেশিত হয়েছিল রসের দ্বারা। এর মধ্য দিয়েই গান্ধর্বরীতিতে সৃষ্টি হয়েছিল নানা ধরনের লৌকিক গান।

    রাময়ণে যুগে প্রচলিত বেশকিছু বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডের পঞ্চম স্বর্গের ১৮তম শ্লোকে রয়েছে- দুন্ধুভি, মৃদঙ্গ, বীণা ও পণব।

    বৌদ্ধ ধর্ম ও জাতকের যুগ
    গৌতমবুদ্ধের (জন্ম: ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ধর্মীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা ধর্মীয় মতবাদ, সনাতন ধর্মেকে ভিন্নতর দর্শনের সন্ধান দিয়েছিল। সেই সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের ভাবগত বিষয়ের নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। গৌতমবুদ্ধের পূর্বজীবনের কাহিনিগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। প্রায় ৫০০টি জাতকের মধ্যে ১৫টি জাতকে গান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতকগুলো হলো- নৃত্য, ভেরীবাদক, বিশ্বম্ভর, কুশ, অসদৃশ্য, সর্বদ্রষ্ট, গুপ্তিল, ভদ্রঘট, বীণাস্থূণা, চুল্লু-প্রলোভন, ক্ষান্তিবাদি, কাকবতী, শঙ্খ, মৎস, বিদুরপণ্ডিত। এসকল জাতকে সঙ্গীতে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। গুপ্তিল জাতকে উত্তম ও মধ্যম মূর্ছনার নাম পাওয়া যায়। এ সকল গ্রন্থে কোনো রাগের নাম পাওয়া যায় না।

    মূলত বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিকাশে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। গান্ধর্বরা ছিল মূলত বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত। এঁরা সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিল ধর্মাচরণের অনুষঙ্গ হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্গীত-চর্চা নিষিদ্ধ ছিল না। এঁদের ধর্মগুরুরা গানের মধ্য দিয়ে ভক্তি প্রকাশের চেয়ে ধ্যন ও জ্ঞানের  চর্চার মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভের চেষ্টায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত গান্ধার এবং গান্ধর্ব সাহিত্য-সঙ্গীত পর্ব
বহিরাগতদের আক্রমণে গান্ধর রাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বার বার বিঘ্নিত হয়েছে। এই অঞ্চল মূলত পারশ্যের রাজাদের কাছে একটি লোভনীয় অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া অন্যান্য জাতিদের ভারত আক্রমণের প্রাথমিক অঞ্চল হিসেবেও গান্ধার রাজ্যকে প্রাথমিক আক্রমণের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। বৈদিক যুগোত্তর কালের প্রথম দিকে এই অঞ্চল আক্রমণের শিকার হয়েছিল- পারশ্যের রাজাদের দ্বারা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৪৬৫ অব্দের ভিতরে পারশ্যে রাজারা এই অঞ্চলে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ঐতিহাসিক প্লিনির মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৫৩০ অব্দের ভিতরে পারশ্য সম্রাট কাইরাস ভারতে কয়েকবার আক্রমণ করেন এবং কপিশা নগরী দখল করতে সমর্থ হন। আরিয়ান নামক অপর একজন ঐতিহাসিকের মতে- কাইরাস কাবুল ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেন এবং এই অঞ্চল থেকে কর আদায় করতেন। কাইরাসের তৃতীয় উত্তরসূরী সম্রাট প্রথম দারায়ুস খ্রিষ্টপূর্ব ৫২২ অব্দ থেকে ৪৮৬ অব্দের ভিতরে গান্ধার, সিন্ধু-উপত্যাকা এবং পাঞ্জাব দখল করেন। এরপর জারেক্সিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের উপরে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই সময় এই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সাথে তক্ষশিলাও পারশিকদের অধিকারে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এই সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন। এরপর অভিসার জাতির নেতাও আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এরপর আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের আগে ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য)  পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসারে নির্দেশে তাঁর যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে অশোক রাজত্ব লাভ করেন। তখন মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র। কিন্তু তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

খ্রিষ্টাপূর্ব ১৮৫ অব্দের দিকে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র। এই সময় মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের আত্মীয় যজ্ঞসেন বিদর্ভের স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। পুষ্যমিত্রের সাথে যজ্ঞসেনের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হলে, যজ্ঞসেন পরাজিত হন। পরে যজ্ঞসেনের দুই আত্মীয়ের ভিতর বিদর্ভরাজ্যকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পুষ্যামিত্রের রাজত্বকালে গ্রিকরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, গ্রিকরা পরাজিত হয়। পুষ্যামিত্র বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন। ফলে তাঁর সময় তক্ষশীলা গুরুত্ব হারাতে থাকে। অনেকে মনে করেন এই সময় তক্ষশীলারা বৌদ্ধ-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে পুষ্যামিত্র পরলোক গমন করার পর, তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র বিদিশার ক্ষমতা দখল করেন এবং বিদর্ভরাজকে পরাজিত করেন। অগ্নিমিত্রের পর পর এদের উত্তরপুরুষরা রাজত্বের সমৃদ্ধিকে বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। এই বংশের শেষ সম্রাট সুমিত, মুলাদেব নামক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর এই অঞ্চলে শুঙ্গবংশের রাজত্ব শুরু হয়। এই রাজবংশের রাজত্বকালে গ্রিকরা তক্ষশীল দখল করে নেয়। এরপর শকদের কাছে গ্রিকরা ক্ষমতা হারায় এবং তক্ষশিলা শকদের অধীনে চলে যায়।  এপর শকদের উৎখাত করে ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে কুষাণ রাজবংশ। কুষাণদের রাজ্য বিস্তারের সময় তক্ষশীলা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী সময় কুষাণ রাজবংশের শাসনমলেই তক্ষশিলা আবার তার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে থাকে। কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী রাজাদের দ্বারা তক্ষশীলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র হীন কাঠামোতে পরিণত হয়। এবং তক্ষশীলা জন-পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়।

এই অস্থির পরিবেশের ভিতরে গান্ধর্ব ঋষিরা নানা ধরনের গ্রন্থাদি রচনা করেছিলেন। এর ভিতরে সেকালের সঙ্গীতবিষয়ক ধারণা পাওয়া যায় 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থাদিতে থেকে।

শিক্ষায় সঙ্গীত

বৈদিক মন্ত্রের স্বর বিন্যাস এবং ছন্দ-নিয়ামক শাস্ত্রের সাধারণ শিক্ষা। ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে সঙ্গীতবিষয়ক যে 'শিক্ষা'র পরিচয় পাওয়া যায়, সেগুলো হলো- পাণিনীয় শিক্ষা, যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা, মাণ্ডুকী শিক্ষানারদীয় শিক্ষা। এসকল গ্রন্থ থেকে সঙ্গীতবিষয়ক যে তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো-
  •  সাতটি স্বর, ৩টি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা, ৫১টি তান সৃষ্টি হয়েছিল। ষড়্‌জ, মধ্যম ও গান্ধার নামক গ্রামের ভিতর,  গান্ধার গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।।
  • ৭টি গ্রাম রাগের উৎপত্তি হয়েছিল। একে রাগ বলা হলেও এগুলো ছিল গ্রাম। এগুলোর নাম ছিল- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সারিত ও ষাড়ব।
  • নারদীয় শিক্ষায় ২২টি শ্রুতির পরিবর্তে ৫টি শ্রুতির নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- দীপ্তা, আয়তা, করুণা, মৃদু ও মধ্য।
  • যদিও বৈদিকযুগে বহু ধরনের বীণার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু নারদীয় শিক্ষা'য় মাত্র দুটি বীণার নাম পাওয়া যায়। বীণা দুটি হলো- দারবীবীণা ও গাত্রবীণা।
পাণিনি ও পাণিনীয় শিক্ষা
প্রখ্যাত সংস্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা। পাণিনির জন্মকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। এই সকল মতভেদ অনুসারে ধরা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের মধ্যে পাণিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  

পণি বা পাণিন্‌ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি ফিনিসীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। এদেরকে পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। পাণিনির পিতা ছিলেন ফিনিকিয় বা পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর পিতার নাম ছিল শলঙ্ক। এই কারণে অনেক সময় তাঁকে শলাঙ্কি বলা হয়। পাণিনির মা ইলেন দক্ষ জাতির কন্যা। অনেকের মতে পাণিনির মায়ের নাম ছিল দাক্ষী। এই সূত্রে অনেকে ক্ষেত্রে তাঁকে দাক্ষীপুত্র বা দাক্ষেয় নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পাণিনি পারিবারিক সূত্রে বেদোত্তর সনাতন পৌরাণিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন অহিগলমালার (শিব) উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।

তাঁর শিক্ষকের নাম ছিল উপবৎস। তাঁর রচিত ব্যাকরণের নাম অষ্টাধ্যায়ী। কথিত আছে, মহাদেবের ঢাকের শব্দে চৌদ্দটি ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই ধ্বনি অনুসারে তিনি শব্দসূত্র তৈরি করেন। একে বলা হয়েছে শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র। মূলত এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা বা সংজ্ঞাসূত্র। এই ১৪টি শিবসূত্র হলো

১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
৫. হ য ৱ র ট্
৬. ল ণ্
৭. ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্
৮. ঝ ভ ঞ
৯. ঘ ঢ ধ ষ্
১০. জ ব গ ড দ শ্
১১. খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্
১২. ক প য্
১৩. শ ষ স র্
১৪. হ ল্ ।

মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এই সূত্রগুলোকে আরও সংক্ষিপ্ত করে নাম দিয়েছিলেন প্রত্যাহার (সংক্ষেপিত) সূত্র। এক্ষেত্রে প্রতিটি সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ যুক্ত করে সংক্ষিপ্ত বা প্রত্যাহার সূত্র হয়েছিল।

প্রত্যহার সূত্র তৈরির বিধি
১. শিবসূত্রের বিচারে প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে।
২. প্রতিটি প্রত্যাহারের নামকরণ করা হয়েছে শিবসূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ দ্বারা। যেমন  প্রথম শিবসূত্রটি হলো
ই উ ণ্ এক্ষেত্রে প্রত্যাহরটির নাম হবে অণ্
৩. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শেষ ব্যঞ্জনবর্ণটি ইৎ হবে, অর্থাৎ অগ্রাহ্য হবে। যেমন প্রথম চারটি শিবসূত্র হলো

           
১. ই উ ণ্
            ২. ঋ ৯ ক্
            ৩. এ ও ঙ্
            ৪. ঐ ঔ চ্ এই চারটি শিবসূত্রের মিলিত সূত্র প্রত্যাহর হবে অচ্ । এর শেষ বর্ণ চ্ বাদ দিলে পাওয়া যাবে—

অ ই উ ণ্ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ। এই বর্ণগুলোই হবে সংস্কৃত ভাষার স্বরধ্বনি। অর্থাৎ অচ্ প্রত্যাহর সূত্র দ্বারা স্বরধ্বনির সংখ্যা পাওয়া গেল। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে এই সূত্রে দীর্ঘ, হ্রস্ব, প্লুত স্বরধ্বনির উল্লেখ নাই। একই ভাবে ৫ম শিবসূত্র থেকে ১৪শ শিবসূত্র থেকে পাওয়া যায় প্রত্যাহার সূত্র হল্। এর অর্থ হলো সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ। পাণিনি ব্যাকরণে প্রত্যাহার সূত্র মোট ৪৩টি। তাঁর সমগ্র রচনাটি আটটি অধ্যায়ে বিভাজিত এই সূত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে- অষ্টাধ্যয়ী। এই ব্যাকরণের অন্যতম ভাষ্যকার ছিলেন পতঞ্জলি ।
বৈদিক মন্ত্রের স্বর বিন্যাস এবং ছন্দ-নিয়ামক শাস্ত্রের সাধারণ শিক্ষা। এরূপ একটি শিক্ষা গ্রন্থ হলো পাণিনীয় শিক্ষা। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে পাওয়া যায় স্বরের উৎপত্তি বিষয়ক একটি উপাখ্যান। এই উপাখ্যান থেকে জানা যায় যে, নৃত্ত শেষে ১৪ বার ঢাকে আঘাত করেছিলেন। এর ফলে বর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৪বারের আঘাতে সৃষ্ট হয়েছিল ১৪টি সূত্র। এই সূত্রগুলো মহেশ্বর সূত্র (শিবসূত্রের) উৎপত্তি ঘটেছিল। পাণিনীয় শিক্ষায় বর্ণ-উৎপত্তির এই পৌরাণিক কাহিনি ছাড়া পাওয়া যায়- উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত নামক তিনটি স্বরস্থানের নাম। শিক্ষাকার একে 'স্বরস্ত্রয়' নামে অভিহিত করেছেন। স্বরের সময়জ্ঞাপক মাত্রামান তথা সময় জ্ঞাপক মান হিসেবে উল্লেখ করেছেন- হ্রস্ব (১ মাত্রা), দীর্ঘ (২ মাত্রা) ও প্লুত (৩ মাত্রা)। এছাড়া লয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত।

পাণিনীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে 'স্বরস্ত্রয়' থেকে সাত স্বরের উৎপত্তি ঘটেছিল। বৈদিক শাস্ত্রীয় স্বরের নামের পরিবর্তে লৌকিক নাম ব্যবহার করেছেন। এই গ্রন্থ মতে-

উদাত্তে নিষাদগান্ধারাবানুদাত্তঋষভধৈবতৌ
স্বরিতঃ প্রভবা হোতো ষড়্‌জমধ্যমপঞ্চমাঃ॥
উদাত্ত থেকে - নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিত থেকে ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চমের উৎপত্তি হয়েছে। স্বরের উৎপত্তি স্থান হিসেবে ৮টি অধিষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- উরঃ, কণ্ঠ, শির, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ ও তালু। এছাড়া স্বরে উৎস হিসেবে পশুপাখির কণ্ঠস্বরের উল্লেখ করেছেন।
যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা
এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন- যাজ্ঞবল্ক্য নামক একজন ঋষি। এটি যজুর্বেদীয় শাখার শিক্ষা। তিনজন যাজ্ঞবল্ক্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- সংহিতাকার যাজ্ঞবল্ক্য, মহাভারতের যাজ্ঞবল্ক্য এবং শিক্ষাকার যাজ্ঞবল্ক্য। মহাভারত লিখিত হয়েছিল- খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের ভিতরে। তাই  মহাভারতের যাজ্ঞবল্ক্য  সর্বপ্রাচীন। অধ্যাপক জলি এবং ডাঃ কানের বিচারে সংহিতাকার যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন ১০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। শিক্ষাকার যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন সংহিতাকার যাজ্ঞবল্ক্যের সমসাময়িক বা কিছু পরের মানুষ।

ইতিহাসের নিরিখে বলা হয়ে থাকে- খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে উত্তর ভারতে কুষাণ রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজ্যের প্রথম রাজা কুজুল-কদ্‌ফিসেস নিজ গোত্রের বিভিন্ন শাখাকে একত্রিত করে- ওয়াং বা রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। পরে নিজের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে হিন্দুকুশের দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন এবং কাবুল দখল করে নেন। এরোর ব্যাক্ট্রিয়া দখলে পারস্য সীমান্ত থেকে সিন্ধু ও ঝিলম নদী পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করেন। ধারণা করা হয়- তিনি ১৫ থেকে ৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করতে সক্ষম হন। ইতিহাসে তিনি প্রথম কদ্‌ফিস নামে পরিচিত। এরপর এই রাজ্যের রাজা প্রথম কদ্‌ফিসের পুত্র দ্বিতীয় কদফিস। ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কণিষ্ক কুষাণ রাজ্যের রাজা হন এবং সিংহাসন লাভের পর তিনি নূতন সৌরবর্ষ শকাব্দ প্রচলন করেন। কুষাণ রাজবংশের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাসুদেব ২৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

এই সময়ের ভিতরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পাণিনীর ব্যাকরণের ভাষ্যকার পতঞ্জলি,  শিক্ষাকার যাজ্ঞবল্ক্য এবং সংহিতাকার যাজ্ঞবল্ক্য। এছাড়া গান্ধর্ব গানের সঙ্গীতবিশারদ নারদও এই সময়ের ভিতরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবরণের ধারায়- যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা ও নারদীয় শিক্ষা বিশেষ স্থান করে আছে।

যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষায় সঙ্গীত
যাজ্ঞ্যবল্ক্য শিক্ষায় তিনটি বৈদিক স্বর- উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত নামে পাওয়া যায়। তবে এই স্বরগুলোর স্থান, বর্ণ, দেবতা, জাতি, ঋষি ও ছন্দের বিচারে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
স্বর স্থান বর্ণ দেবতা জাতি ঋষি ছন্দ
উদাত্ত উচ্চ শুক্ল অগ্নি ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ গায়ত্রী
অনুদাত্ত নীচ লোহিত সোম (তেজঃ) ক্ষত্রিয় গৌতম ত্রৈষ্টুভ
স্বরিত মধ্যম কৃষ্ণ সবিতা বৈশ্য গার্গ্য জগতী

স্বরের এরূপ পরিচিতি ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে ভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষায় উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত স্বর থেকে যে অন্যান্য স্বরের উৎপত্তি ঘটেছে- সে সম্পর্কে লিখেছেন-
ঊচ্চৌ নিষাদগান্ধারৌ নীচাঋষভধৈবতৌ
শেষস্তু স্বরিতা জ্ঞেয়াঃ যড়্‌জ-মধ্যম-পঞ্চম॥
এখনে ঊচ্চৌ শব্দের দ্বারা উদাত্তকে বুঝানো হয়েছ। এখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে নিষাদ ও গান্ধার। নীচা শব্দের দ্বারা অনুদাত্তকে বুঝানো হয়েছে। এখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে- ঋষভ ও ধৈবত। স্বরিত থেকে উৎপন্ন হয়েছে - ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চম।

যাজ্ঞবল্ক্য মাত্রার মান নির্ণনয়ে সূর্যরশ্মিতে প্রতিভাত ক্ষুদ্রক্ষুদ্র অণুর কথা বলেছেন। তাঁর মতে চারটি অণুতে এক মাত্রা মাত্রা হয়। তাঁর মতে কণ্ঠে ২ মাত্রা থাকে, জিহ্বাগ্রে ৩ মাত্রা থাকে। মাত্রা এককগুলো হলো  হ্রস্ব (১ মাত্রা), দীর্ঘ (২ মাত্রা) ও প্লুত (৩ মাত্রা)। তিনি পশুপাখির স্বরের ভিতরে মাত্রার সন্ধান করেছিলেন। যেমন তাঁর মতে- নীলকণ্ঠ পাখির স্বর হ্রস্ব, কাকের স্বর দীর্ঘ এবং ময়ুরের স্বর প্লুত।

বেদপাঠে সহকারী আটটি স্বর ব্যবহৃত হতো। এগুলো হলো- জাত্য, অভিনিহিত, ক্ষৈপ্র, প্রশ্লিষ্ট, তৈরোবিরাম, তৈরোব্যঞ্জন, পাদবৃত্ত ও তাথাভাব্য। তিনি স্পর্শবর্ণের দেবতা ও রঙের উল্লেখ করেছেন। মাণ্ডুকী শিক্ষা
যাজ্ঞবল্ক্যের পরে সঙ্গীতবিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে মাণ্ডুকী শিক্ষা। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে মণ্ডুক মুনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের বিবরণ থেকে ধারণা করা হয়, তাঁর সময়ে সামগানের প্রচলন ছিল। এই গ্রন্থে সামগানের পাঁচটি স্বরস্থানের প্রচলন ছিল। এগুলোর নাম ছিল- উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত ও প্রচর। সম্ভবত প্রচর স্বরস্থানটি ছিল স্বরিত স্বরস্থানের বর্ধিত অংশ।

এই গ্রন্থ মতে পশুপাখির স্বর অনুসরণে সঙ্গীতের ৭টি স্বর গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্বরগুলোর উৎস এবং  বর্ণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। যেমন-
স্বর উৎস (পশুপাখির কণ্ঠস্বর) বর্ণ
ষড়্‌জ ময়ুর পদ্মপত্র
ঋষভ গাভী শুকপিঞ্জর
গান্ধার ছাগ স্বরণাভ
মধ্যম বক কুন্দফুল
পঞ্চম কোকিল কৃষ্ণ
ধৈবত ঘোড়া পীত
নিষাদ হাতি সর্ববর্‌ণযুক্ত
সঙ্গীত পরিবেশনায় হস্তসঙ্কেতকে তিনি বিশেষ মূল্য দিয়েছিলেন। তাঁর গ্রন্থ থেকে এ্ বিষয়ে বিখ্যাত উক্তি পাওয়া যায়- 'যথা বাণী তথা পাণি'।

নারদীয় শিক্ষা
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টীয় ১০০ থেকে ২০০ অব্দের ভিতরে নারদ 'শিক্ষা' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থ থেকে বৈদিক গান থেকে শুরু করে গান্ধর্ব গানের প্রাথমিক বিকাশের রূপরেখা পাওয়া যায়।

বৈদিক যুগের উদাত্ত- অনুদাত্ত ও স্বরিত স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়- 'নারদীয় শিক্ষা'র প্রথম প্রপাঠকের প্রথম কণ্ডিকার শুরুতেই।
অথাতঃ স্বরশস্ত্রাণাং সর্বেষাং বেদনিশ্চয়ম্‌।
উচ্চনীচবিশেষাদ্ধি স্বরাণ্যত্বং প্রবর্ততে॥ ১
আচিকং গাধিকং চৈব সামিকং চ স্বরাত্তরম্‌।
কৃতান্তে স্বরশান্ত্রাণাং প্রযোক্তব্যং বিশেষতঃ॥ ২
একাস্তরস্বরো হৃক্ষু গাথাসু দ্যান্তরঃ স্বরঃ।
সামসু ত্র্যন্তরং বিদ্যাদেবতাবৎ স্বরিতোস্তরম॥৩
প্রথম শ্লোকে নারদ বলেছেন- উচ্চ-নিচ ও মধ্য তথা উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিত স্বর বৈদিক গানে ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্লোকে স্বরসংখ্যার বিচারে গানের জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে- আর্চিক (এক স্বর), গাথিক (দুই স্বর), সামিক (তিন স্বর), স্বরান্তর (চার স্বর)। কিন্তু পরবর্তী ৯-১৪ শ্লোকে বৈদিক সাতটি স্বরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বৈদিক এই ৭ স্বরের নাম ছিল- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র, ক্রুষ্ট ও অতিশ্বার্য। এই স্বরগুলো বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থাদির গানগুলোর কোনটিতে কোন স্বর ব্যবহৃত হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
  • সামগানে- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্বর থেকে ক্রুষ্ট পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। এছাড়া প্রথম থেকে অতিশার্য পর্যন্ত পর পর সাতটি স্বর ব্যবহৃত হতো।
  • তৈত্তরীয়কে দ্বিতীয়াদি থেকে শুরুর করে তৃতীয়, চতুর্থ ও মন্দ্র স্বর পর্যন্ত চারটি স্বর পর পর ব্যবহৃত হতো।
  • ছন্দগানকারী, বাজসেনয়ি, তাণ্ড্যপঞ্চবিংশব্রাহ্মণ ও শতপথের অনুগামীরা গাথিক নিয়মে প্রথম ও দ্বিতীয় স্বর ব্যবহার করতো।
নারদীয় শিক্ষার দ্বিতীয় কণ্ডিকায় পাওয়া যায় তান, রাগ স্বর গ্রাম ও মূর্চ্ছনার বিষয়। এই কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
তানরাগস্বরগ্রামমূর্ছনানাং তু লক্ষণম্
পবিত্রং পাবনং পুণ্যং নারদেন প্রকীর্তিতম্। দ্বিতীয় কণ্ডিকা। ২
এই গ্রন্থের তান, রাগ, স্বর, গ্রাম আনা হয়েছে লৌকিক গান থেকে। মূলত এই বিষয়গুলোর ব্যবহার করা হতো গান্ধর্ব মার্গ এবং দেশী গান‌গুলোতে। অনেকে মনে করেন এই শ্লোকের স্বর ও গ্রাম হবে মূলত রাগস্বর। মূলত গ্রামের আদ্যস্বরকে বলা হয়, রাগস্বর। তৃতীয় কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
''ষড়্‌জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ী গ্রামাঃ প্রকীতর্তিতা।
ভূলোকজ্জায়তে ষড়্‌জো ভূবর্লোকচ্চা মধ্যমঃ৬
সর্গান্ননাত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষণ গ্রামরাগো ইতি স্মৃতাঃ। ৭
নারদের সময়ে প্রচলিত তিনটি গ্রাম ছিল যড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম। নারদ এই সকল রাগের প্রচলনের স্থান হিসেবে পৌরাণিক ভাবনা থেকে লিখেছিলেন- পৃথিবীতে ষড়্‌জগ্রাম, ভুর্বলোকে মধ্যমগ্রাম এবং স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত ছিল। নারদীয় শিক্ষায় বৈদিক ও লৌকিক গানের ক্ষেত্রে দশ রকম গুণের কথা বলেছেন। এই গুণগুলো হলো- রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সুকুমার ও মধুর।
১, রক্তা: বেণু ও বীণা একত্রিত ধ্বনি বা স্বর যা সকলকে আনন্দ দান করে।
        তত্র রক্তং নাম বেণুবীণাস্বরাণামেকীভাবে রক্তমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ২ ২, পূর্ণ: স্বর (মধ্যামদি) ও শ্রুতির করণ বা পূরণ হয় এবং ছন্দের পাদ ও অক্ষরের পরস্পরের সংযোগে উচ্চারণ হয়। 
পূর্ণ নাম স্বরশ্রুতিপূরণাছন্দঃ পাদাক্ষর সংযোগাৎপূর্ণমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৩
৩. অলঙ্কৃত: ক্ণ্ঠ থেকে নির্গত স্বরকে নিম্ন ও উচ্চ উচ্চারণ
       অলঙ্কৃত নামোরসি শিরসি কণ্ঠযুক্তমিত্যলঙ্‌কৃতম্ । প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৪

৪. প্রসন্ন:_কণ্ঠকে নিপীড়ন ক'রে গদগদ ধ্বনি
        প্রসন্নং নামাপগতগদ্‌গদ্‌নির্বিশঙ্কং- প্রসন্নমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৫

৫. ব্যক্ত-শব্দ বা ধাতু ও প্রত্যযঘৃক্ত এবং ছন্দ, রাগ, পদ ও স্বরসমূহের দ্বারা ধ্বনির অভিব্যক্তি
        ব্যক্ত নাম
পদপদার্থপ্রকৃতিবিকারাগমলোপকৃত্তদ্ধিসমাসধাতুনিপাতোপস-
র্গস্বরলিঙ্গবৃত্তিবার্তিকবিভক্ত্যর্চনানাং  সম্যগুপপাদনে ব্যক্তমিত্যুচ্যতে॥  প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৬
৬. বিকৃষ্ট:  উচ্চ ভাবে উচ্চারণ করলে যেখানে পদের অন্তর্গত অক্ষরের স্পষ্টতা থাকে অব্যক্ত বা অস্পষ্ট হয় না। প্রকৃতপক্ষে তারস্বরে বা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করাকেই বিক্রষ্টা বলে
    বিক্রুষ্টং নামোচ্চৈরচ্চারিতং ব্যক্তপদাক্ষরমিতি বিক্রুষ্টম্‌। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৭
৭. শ্লক্ষ্ণ: দ্রুত, বিলম্বিত, উচ্চ, নীচ, প্লুত, সমাহার প্রভৃতির সম্পাদন।
শ্লক্ষ্ণং নামাদ্রুতম্‌বিলম্বিতমুচ্চনীচপ্লুতসমাহারহেলতরাবীপনয়ানাদিভি-
রুপপাদনাদিভিঃ শ্লক্ষ্ণমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৮
৮. সম: স্থায়ী, সঞ্চারী, আরোহ ও অবরোহ প্রভৃতি বর্ণগুলিকে লয়ের সঙ্গে একীভূত করা।
সম নামাবাপনির্বাপপ্রদেশী প্রত্যন্তরস্থানানাং সমাসঃ সমমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ৯
৯. সুকুমার:  মৃদু পদ,বর্ণ, স্বর কুহরণ যুক্ত হবে।
সুকুমারং নাম মৃদুপদবর্ণস্বরকুহরণযুক্তং সুকুমারমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ১০
১০. মধুর: স্বভাবত সাবলীল গতিতে পদের ও অক্ষরের উচ্চারণ । এই উচ্চারণে কণ্ঠের স্বভাবসুন্দর মাধুর্য ও কমনীয়তা বজায় থাকে ।
মধুরং নাম  স্বভাবোপনীতললিতপদাক্ষর গুণসমৃদ্ধং মধুরমিত্যুচ্যতে। প্রথম প্রপাঠক। তৃতীয় কণ্ডিকা। ১১
গ্রাম থেকে উৎপন্ন ২১টি মূর্চ্ছনাকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দেবতা ও গান্ধর্ব গণের মূর্চ্ছনার নাম একই ছিল, কিন্তু পিতৃগণের নাম ছিল ভিন্ন। প্রথম প্রপাঠকের তৃতীয় কণ্ডিকার ৭ থেকে ২৪ শ্লোকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে-
নন্দী-বিশালা-সুমুখী-চিত্রা-চিত্রবতী-সুখা।
বলা যা চাথ বিজ্ঞেয়া দেবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥
আপ্যায়নী-বিশ্বভৃতা-চন্দ্রা-হেমা-কপর্দিনী।
মৈত্রী-বার্হতী চৈব পিতৃণাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥

*             *            *
উপজীবন্তি গন্ধর্বাদিবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ। ২৩
পিতৃণাং মূর্ছনা সপ্ত তথা যক্ষা ন সংশয়ঃ।
ঋষিণাং মূর্ছনা সপ্ত যাস্তিমা লৌকিকাঃ স্মৃতা ॥২৪
মূর্চ্ছনা সংখ্যা দেবগণ পিতৃগণ গান্ধর্গণ
নন্দী আপ্যায়নী নন্দী
বিশালা বিশ্বভৃতা বিশালা
সুমুখী চন্দ্রা সুমুখী
চিত্রা হেমা চিত্রা
চিত্রবতী কপর্দিনী চিত্রবতী
সুখা মৈত্রী সুখা
বলা বার্হতী বলা
নারদীয় শিক্ষায় ৭টি স্বরের উৎপত্তি হয় শরীরের ৭টি স্থান থেকে। এর পাশাপাশি পাওয়া যায় পশুপাখির কণ্ঠস্বর জাত ধ্বনির কথা। এই শিক্ষায় পাওয়া যায় স্বরসমূহের জাতিগত পরিচয়। এই জাতিগুলো ছিল- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এছাড়া ছিল স্বরগুলোর অধিদেবতাদের নাম। নারদীয় শিক্ষা'র চতুর্থ কণ্ডিকার ৭-১২ শ্লোকে বৈদিক ও লৌকিক সাত স্বরের উৎপত্তির উৎস হিসেবে শরীরের স্থানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
স্বর উৎস (পশুপাখির কণ্ঠস্বর) শরীরের স্থান অধি দেবতা জাতি
ষড়্‌জ ময়ুর কণ্ঠ অগ্নি ব্রাহ্মণ
ঋষভ বৃষ শির অগ্নি ক্ষত্রিয়
গান্ধার ছাগ নাসিকা সোম বৈশ্য
মধ্যম সারস ঊরঃ বিষ্ণু ব্রাহ্মণ
পঞ্চম কোকিল ঊরঃ, শির ও কণ্ঠ নারদ ব্রাহ্মণ
ধৈবত হাতি ললাট তম্বরু ক্ষত্রিয়
নিষাদ ঘোড়া সর্বসন্ধি তম্বরু বৈশ্য

নারদীয় শিক্ষা'র প্রথম প্রপাঠকের চতুর্থ কণ্ডিকার ৮-১১ শ্লোকে  পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব।

নারদীয় শিক্ষায় ২২টি শ্রুতির পরিবর্তে ৫টি শ্রুতির নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- দীপ্তা, আয়তা, করুণা, মৃদু ও মধ্য। এগুলোর পরিণতি হতি হয় পাঁচটি রসে।
  • দীপ্তা: সৌর্য, বীর্য, তেজদীপ্ত, গাম্ভীর্য প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ। এর পরিণতি রৌদ্র রস
  • আয়তা: অসীমতা, প্রসন্নতা, উদারতা প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ। এর পরিণতি বীর রস
  • করুণা: কারুণ্য, কোমলতা, শোক প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ। এর পরিণতি করুণ রস
  • মৃদু: নম্রতা, প্রীতি, উৎসাহ প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ। এর পরিণতি শান্ত রস
  • মধ্যা: সংযম, মমতা প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ। এর পরিণতি অদ্ভুত রস
নারদীয় শিক্ষায় সামগানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি মার্গ ও দেশী সঙ্গীতের ক্ষেত্রে  সাতটি স্বর, ৩টি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা, ৫১ট তানের কথা উল্লেখ করেছেন। এ সকল উপকরণের সমবেত রূপের নাম ছিল 'স্বরমণ্ডল'।

নারদ যদিও ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে সময়ে গান্ধার গ্রামের প্রচলন ছিল না। তবে গান্ধার গ্রাম সম্পর্কে নারদ বিশেষভাবে অবগত ছিলেন। এই গ্রামগুলোর নাম পাওয়া ষড়্‌জ, গান্ধার ও মধ্যম (ষড়্‌জ-মধ্যম-গান্ধারা ত্রয়ো গ্রামঃ প্রকীর্তিতঃ)। এই তিনটি গ্রামের আদ্যস্বরের নামকরণ করেছেন 'রাগস্বর'। গ্রামের অধীনস্থ মূর্চ্ছনা রাগের অনুরূপ। তাই মূর্চ্ছনাকে রাগের আদ্যরূপ ধরলে, গ্রামকে ঠাট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই গ্রামের অধীনে ছিল গ্রামরাগ। নারদীয় শিক্ষায়৭টি  গ্রামরাগের তালিকা পাওয়া যায়। এগুলো হলো ষড়্‌জগ্রাম, পঞ্চমগ্রাম, কৈশিক, কৈশিকমধ্যমগ্রাম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিতষাড়ব

নারদীয় শিক্ষায় বাদ্যযন্ত্র
যদিও বৈদিকযুগে বহু ধরনের বীণার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু নারদীয় শিক্ষা'য় মাত্র দুটি বীণার নাম পাওয়া যায়। বীণা দুটি হলো- দারবীবীণা ও গাত্রবীণা।

নারদী্য শিক্ষার পরে সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেযোগ্য গ্রন্থ হলো- ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্র। এই গ্রন্থের  পূর্ববর্তী গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়- আদিভরতের নাট্যশাস্ত্রের নাম উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী অধ্যায়ে আদিভরতের নাট্যশাস্ত্র এবং ভরতের নাট্যশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। 

নারদের সমসাময়িক সঙ্গীতাচার্য
নাট্যশাস্ত্রে তৃতীয় অধ্যায়ের 'মত্তবারণীর প্রতিষ্ঠা' অংশে- ভরত গন্ধর্বগণদের পূজা উপাচার (বলি) গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন। গন্ধর্বগণের মধ্য বিশেষভাবে নারদ, তম্বুরু ও বিশ্বাসুর নাম পাওয়া যায়। এই সূত্রে বলা যায়, এই তিনজন গন্ধর্ব ভরতের অগ্রজ এনং প্রণম্য ছিলেন। পৃষ্ঠা: ৬০-৬১

তম্বুরু
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত মহাভারতে- সুপ্রিয়া, অতিবাহু, হাহা ও হুহুকে বলা হয়েছে তম্বুরু। এ ক্ষেত্রে তম্বরু গোত্রগত নাম, নাকি পদবী ছিল তা জানা যায় না। তবে এই তম্বুরু সঙ্গীতাচার্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল। নারদ সমসমায়িক বিবেচনা এবং নারদের অগ্রজ বিবেচনা করলে, এর জীবনকাল দাঁড়ায় খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী। প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থাদিতে তম্বুরু নাম পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন- তম্বুরুবীণা থেকে তানপুরার উৎপত্তি ঘটেছিল।

বিশ্বাবসু
ভরতের গ্রন্থানুসারে বিশ্বাবসু ছিলেন ভরতে অগ্রজ এবং প্রণম্য।

   [দেখনু: নাট্যশাস্ত্র থেকে বৃহদ্দেশী (২০০ -৫০০ খ্রিষ্টাব্দ)]
তথ্যসূত্র:
  • নাট্যশাস্ত্র (চার খণ্ড)। ভরত। বঙ্গানুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ডঃ ছন্দ চক্রবর্তী
  • নারদীয় শিক্ষা। শ্রীপীতাম্বরাপীঠ-সংস্কৃত পরিষদ। ১৯৬৫
  • পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী। বলরাম প্রকাশনী প্রকাশনী। কলকাতা। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ
  • পাণিনীয় শব্দশাস্ত্র। ড. সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ।
  • ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস (প্রথম ভাগ)। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। জানুয়ারি ১৯৮৭।
  • বায়ুপুরাণ। পঞ্চানন তরজকরত্ন সম্পাদিত। নবভাত পাবলিশার্স, কলকাতা। দ্বিতীয় নবভারত সংস্করণ। আষাঢ় ১৪১৮।
  • মার্কেণ্ডে পুরাণ। মহেশচন্দ্র পাল-কর্তৃক সঙ্কলিত ও প্রকাশিত। উপনিষৎ কার্যালয়, কলকাতা। মাঘ ১৮১২ শকাব্দ।
  • সামবেদ সংহিতা। অনুবাদ ও সম্পাদনা: শ্রীপরিতোষ ঠাকুর। হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা। অষ্টম মুদ্রণ, ২০ জুলাই ২০০১