ভারতীয় সঙ্গীত
নাট্যশাস্ত্র থেকে বৃহদ্দেশী-পূর্বকাল (২০০ -৫০০ খ্রিষ্টাব্দ)

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে উত্তর ভারতে কুষাণ রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজ্যের প্রথম রাজা কুজুল-কদ্‌ফিসেস নিজ গোত্রের বিভিন্ন শাখাকে একত্রিত করে- ওয়াং বা রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। পরে নিজের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে হিন্দুকুশের দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন এবং কাবুল দখল করে নেন। এরোর ব্যাক্ট্রিয়া দখলে পারস্য সীমান্ত থেকে সিন্ধু ও ঝিলম নদী পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করেন। ধারণা করা হয়- তিনি ১৫ থেকে ৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করতে সক্ষম হন। ইতিহাসে তিনি প্রথম কদ্‌ফিস নামে পরিচিত। এরপর এই রাজ্যের রাজা প্রথম কদ্‌ফিসের পুত্র দ্বিতীয় কদফিস। ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কণিষ্ক কুষাণ রাজ্যের রাজা হন এবং সিংহাসন লাভের পর তিনি নূতন সৌরবর্ষ শকাব্দ প্রচলন করেন। কুষাণ রাজবংশের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাসুদেব ২৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আর ২৪০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন- শ্রীগুপ্ত।  ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে গুপ্ত রাজবংশের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর উত্থান ঘটে - হুনদের রাজত্ব।  এই সময়ের ভিতরে গান্ধার-সহ উত্তর ভারতে একটি সুস্থির দশায় ছিল। এই সময়ের ভিতরে রচিত হয়েছিল সঙ্গীত বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থাদি। এর ভিতরে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ভরতের নাট্যশাস্ত্র। অভিনয়, রস, গীত-বাদ্য-নৃত্যে বিষয়ক এই শাস্ত্রীয় গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের অব্দের ভিতর।
এই সময়ের ভিতরে উল্লেখযোগ্য তিনজন ঙ্গীত নাটকের সুযোগ্য পণ্ডিতের আবর্ভাব হয়েছিল। এঁরা হলেন- গন্ধর্ব নারদ, স্বাতী এবং ভরত।

গন্ধর্ব নারদ
'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থের রচয়িতা নারদের পর, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আরও একজন নারদের নাম পাওয়া যায়। মূলত এই নারদকে গন্ধর্ব নারদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষাকার নারদ আর গন্ধর্ব নারদ একই ব্যক্তি ছিলেন না। শিক্ষাকার নারদের ছিলেন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ। পক্ষান্তরে গন্ধর্ব নারদ ছিলেন খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ। ভরতে সময়ে এই নারদ এবং স্বাতী ভরতের সঙ্গীতসহযোগী ছিলেন।

স্বাতি
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে স্বাতির নাম পাওয়া যায়। ভরত ইন্দ্রধ্বজ মহোৎসবে প্রথম নাট্যাভিনয়ে স্বাতি বাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন নিয়েছিলেন। এই বিচারে ধারণা করা হয়, স্বাতি ভরতের সমাসায়িক ছিলেন।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়ের ঢাকের উৎপত্তি নামক অংশে স্বাতির নাম পাওয়া যায়। তিনি বর্ষাকালে সরোবরে পদ্মপাতার উপর বৃষ্টিপাতের শব্দ অনুসরণে তালযন্ত্র উদ্ভাবন করা ভাবেন। তিবি এর কাঠামো তৈরি করার জন্য বিশ্বকর্মার শরণাপন্ন হলে- বিশ্বকর্মা স্বাতির অনুরোধক্রমে মৃদঙ্গ, উষ্কর, পণব এ দর্দুর তৈরি করেন। এই সূত্রে তিনি নানা ধরনের ঢাক জাতীয় তালবাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন।

ভরতের নাট্যশাস্ত্র
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ থেকে  ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায় পর্যন্ত সঙ্গীত-বিষয়ক বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের অষ্টাবিংশ অধ্যায় থেকে গান্ধর্ব গানের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। ভরতের সময় গান্ধর্ব গান তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। এই ভাগগুলো হলো- স্বরগান্ধর্ব, তালগান্ধর্ব ও পদগান্ধর্ব। স্বরগান্ধর্বে বীণাসঙ্গীত এবং কণ্ঠসঙ্গীতের স্বরের ব্যবহারিক রূপ নিয়ে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া জাতিগানের বাদী, সম্বাদী, বিবাদী, অনুবাদী স্বর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভরতের সময় গীত ছিল ৪ প্রকার। এগুলো হলো- মাগধী, অর্ধমাগধী, সম্ভাবিতা এবং পৃথুলা।

গান্ধর্ব গানর ক্রমবির্তনের ধারায় গ্রামরাগ থেকে জাতিরাগ বা জাতিগান জাতি গান। এর সংখ্যা ছিল ১৮টি। এই জাতিরাগগুলো শ্রেণিবদ্ধ ছিল ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামে। এই গান শাস্ত্রীয় বিধিতে বাঁধা। এরপর প্রবন্ধগানের  সূত্রে  খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের দিকে নিবদ্ধ প্রবন্ধ গানের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্ট হয়েছিল সালগ সুড় প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধগানের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল তুক বিভাজনে। সালগসূড় প্রবন্ধ গানের একটি ধারা হলো ধ্রুব গান। শাস্ত্রীয়ভাবে এই গানের ব্যাপ্তী ছিল বিশাল। নাটকের প্রয়োজন যখন গানের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তখন নাটকের স্বল্প পরিসরে ধ্রুব গান ব্যবহার করা যেতো না। তাই এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে নাটকে ধ্রুবা গান ব্যবহৃত হতো। নাটকের বাইরে এই গানের পরিবেশিত হতো না। এর ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং প্রাকৃত।

নাট্যশাস্ত্রের রচনা ও প্রচারে ভরতের শতপুত্র
নাট্যশাস্ত্র প্রণয়নের পর, ব্রহ্মার কাছ থেকে নাট্যশাস্ত্র প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য ভরতের শতপুত্রকে ব্যবহার করার নির্দেশ পেয়েছিলেন। নাট্যশাস্ত্রের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শ্লোকের সূত্রে জানা যায়, এই কাজটি ভরত তাঁর পুত্রদের নিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নাট্যশাস্ত্রে প্রথম অধ্যায়ের ২৬ থেকে ২৯ সংখ্যক শ্লোকে ভরতের ১০০ পুত্রের তালিকা পাওয়া যায়। ভরতের পর, তাঁর শতপুত্রদের ভিতরে মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায় সঙ্গীত ও নাটকের গুণী হিসেব। এঁদের ভিতরে কয়েকজনের নাম নাট্যশাস্ত্রেই বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শার্দুলকে অন্যান্য গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে অত্যন্ত প্রশংসাসূচক বাক্যে স্মরণ করেছেন। এই শ্লোকে তিনে বলেছেন- 'বাৎস্য, শাণ্ডিল্য, ধূর্তিল (দত্তিল), সহ কোহল ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই ধরণীতে মরণশীল ব্যক্তিরূপে কিছুকাল বাস করে মানুষের বুদ্ধিবর্ধক ত্রিভুবনের কীর্তিকলাপপূর্ণ এবং অন্য সব শাস্ত্রের নমুনাস্বরূপ এই শাস্ত্রকে প্রয়োগ করলেন।'

ধারণা করা ভরতের পুত্র এবং শিষ্য হিসেবে এঁরা খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন।

কোহল
দত্তিলের '
ত্তিলম' গ্রন্থে তাল বিষয়ক আলোচনায় কোহলের নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে মতঙ্গ ও শার্ঙ্গদেব তাঁদের গ্রন্থাদিতে কোহলকে সঙ্গীতার্য নামে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়, তিনি 'সঙ্গীতমরু' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কোহলের শ্লোকগুলো থেকে ভট্টতণ্ডু, শার্দুল, নারদ, ক্ষেমরাজ, সন্তু, লোহিতভ্ট্ট, শম্ভু প্রভৃতি সঙ্গীতজ্ঞদের নাম পাওয়া যায়। এঁরা কোহলের সমসাময়িক বা বয়োজ্যেষ্ঠ্ ছিলেন। কোহল তাঁর গ্রন্থে নাচে ব্যবহৃত বিভিন্ন হস্তমুদ্রা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তিনি সঙ্গীতমেরু রচনা করেছিলেন সংস্কৃত অনুষ্টুভ ছন্দে। কথিত আছে- তিনি 'তাললক্ষণ', কোহলরহস্যম  এবং 'কোহলীর অভিনয় শাস্ত্র' নামে তিনটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কথিত আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের শেষাংশ 'উত্তরতন্ত্র' কোহল রচনা করছিলেন।

কোহল মূলত নাট্যধারা ও অভিনয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর সাথে তিনি আলোচনা করেছেন গ্রাম রাগ ও ভাষারাগ সম্পর্কে। কোহলের রচিত গ্রন্থাদি থেকে বিশেষভাবে জানা যায় ভরতের নির্দেশিত স্বর, শ্রুতি, মূর্ছনা বিষয়ক আলোচনা।

কোহলের স্বর বিষয়ক যে ধারণা, বৃহদ্দেশীতে কোহলের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ আছে- সেগুলো হলো-

১. 'ভূতল থেকে সমুত্থিত বায়ুকে নিজের প্রযত্নে ধারণ করা হয়: নাড়ীকে ভেদ ক'রে বায়ুর ঊর্ধ্বগতিতে যে ধ্বনি জাগ্রত হয়, তাকে স্বর বলা হয়।' পৃষ্ঠা: ১৬।

২. 'বিবিধজাতি এবং ভাষাদির সংযোগহেতু স্বরকে অনন্ত বলে ঘোষণা করা হয়। এই স্বর বহুনাদ সমন্বিত এবং তালযুক্ত হয়ে বহু রসের সঙ্গেও যোজিত হয়।'
[পৃষ্ঠা ১৭]

৩. ঊর্দ্ধ নাড়ির প্রযত্ন দ্বারা তলদেশ থেকে সর্বস্থানে তাড়নার ফলে যে ধ্বনি মূর্ধাদেশে (মস্তিষ্কে) এসে অবস্থিত হয় (মূর্চ্ছিত)। সেই স্বরই অতিশয় ব্যাপকরূপে প্রতিভাত হয়।' [পৃষ্ঠা ১৭]

৪.  পশুপাখির কণ্ঠস্বর থেকে স্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন- স্বর এবং পশুপাখিগুলো হলো- ময়ুর থেকে ষড়্‌জ, চাতক থেকে ঋষভ, ছাগ থেকে গান্ধার, ক্রৌঞ্চ থেকে মধ্যম, কোকিল থেকে পঞ্চম, বর্ষাকালের ব্যাঙের ডাক থেকে ধৈবত এবং  হাতি থেকে নিষাদ উৎপন্ন হয়েছে। [পৃষ্ঠা ১৭]

এছাড়া অলঙ্কার সম্পর্কে কোহল ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব ভাবনা থেকে। গ্রন্থাদির কালনুক্রমিক সূত্রে মনে হয়ে জাতিগান বা জাতিরাগ থেকে উদ্ভুত গ্রামরাগের প্রসার ঘটেছিল কোহলের সময়। এছাড়া ভাষারাগের বিকাশ ঘটেছিল কোহলের সময়।  কোহল রচনা করেছিলেন 'সঙ্গীতমেরু' নামক গ্রন্থ। এছাড়া 'তাল লক্ষণ' ও কোহল রহস্য' নামক দুটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। কোহলের তাল সম্পর্কে প্রথম জানা যায়-  ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত মতঙ্গের 'বৃহদ্দেশী গ্রন্থে'।

দত্তিল
দত্তিল ছিলেন ভরতের শিষ্য। তাঁর রচিত গ্রন্থ 'দত্তিলম'-এ পাওয়া যায় ভরতের অনুসরণীয় সাঙ্গীতিক চিত্র। তিনি নারদের অনুসরণে স্বরমণ্ডলের বিশ্লেষণ করেছেন। আর ভরতের  অনুসরণে ২২টি শ্রুতি, মূর্চ্ছনা, গ্রাম, সাধারণ জাতি, বর্ণ রস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে আরও পাওয়া যায়, ৮৪টি তান, ১০টি রাগত্ব ধর্ম, গ্রহস্বর, তার, মন্দ্র, ষাড়ব ঔড়ব, অল্পত্ব, গ্রহ, অংশ, ন্যাস অপন্যাস ইত্যাদী রাগের উপাদানসমূহ। তিনি তালের উপাদান এবং ৭টি তালের বিশ্লেষণ করেছেন।

বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ আছে- দত্তিলের মতে- তন্ত্রীতে তান দুই প্রকার। প্রকার দুটি হলো- প্রবেশ ও নিগ্রহ। প্রবেশক্রিয়ায় ধ্বনিসাদৃশ্য মনে হয়। অর্থাৎ প্রকর্ষণ দ্বারা উচ্চতর স্বর পাওয়া যায়, মৃদুভাবে নিম্নকর্ষণে নিম্নবর্তী স্বর পাওয়া যায়। অসংস্পর্শ হলে নিগ্রহ বলা হয়। তাঁর মতে- পূর্ণ কূটতানের সংখ্যা ৫০৩৩টি। পূর্বাম্পাদিত তানটি পরবর্তী একটি স্বরসংখ্যা যোজিত হয়ে তান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এখানে কূটতান হলো- মূর্চ্ছনার স্বরগুলোর বিপরীতক্রমে উচ্চারণ। আর পূর্ণা হলো- সাতটি স্বরের সহযোগে সম্পাদিত মূর্চ্ছনা। 

শার্দুল
নারদের মতই পাঁচটি শ্রুতির কথা বলেছেন। তবে এই পাঁচটি শ্রুতির পাশাপাশি ২২টি শ্রুতিরও উল্লেখ করেছিলেন। শার্দুল এবং কোহলের প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি 'শার্দুল' বা 'ব্যাল কোহল' নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে শার্দুল সঙ্গীত বিষয়ে কোহলকে যে সকল প্রশ্ন করেছেন, তার উত্তর দিয়েছেন কোহল। এই গ্রন্থে দেশী রাগের বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকটি বিভাষা রাগের বর্ণনা করেছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল- দেবলবধনী, পৌরালী, ত্রাবণী, তানলতিকা, দেহ্যা, শার্দূলী, ভিন্নলতিকা, রবিচন্দ্র, ভিন্নপৌবালী, দ্রাবিড়ী, পিঞ্জরীম পার্বতী, টঙ্ক ইত্যাদি। সম্ভবত শার্দূল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সিদ্ধ ছিলেন। বৃহদ্দেশী গ্রন্থ থেকে জানা যায় শার্দুল ভরতের চারপ্রকার গীতের পরিবর্তে শুধু ভাষাগীতের  উল্লেখ করেছেন।  

শাণ্ডিল্য
ভরতের ভাষায় গুণী পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ প্রাচীনকালেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পরবর্তী গ্রন্থাদিতে তাঁর বিষয়ে বিশেষ কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের- শাণ্ডিল্যকে ভরতের শতপুত্রের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শাণ্ডিল্যকে  অন্যান্য গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে অত্যন্ত প্রশংসাসূচক বাক্যে স্মরণ করেছেন। এই শ্লোকে তিনে বলেছেন- 'বাৎস্য, শাণ্ডিল্য, ধূর্তিল (দত্তিল), সহ কোহল ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই ধরণীতে মরণশীল ব্যক্তিরূপে কিছুকাল বাস করে মানুষের বুদ্ধিবর্ধক ত্রিভুবনের কীর্তিকলাপপূর্ণ এবং অন্য সব শাস্ত্রের নমুনাস্বরূপ এই শাস্ত্রকে প্রয়োগ করলেন।' তবে শাণ্ডিল্যের রচিত গ্রন্থাদি বহুপূর্বে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বাখিল

খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীতে দত্তিলের রচিত 'দত্তিলম' গ্রন্থে বিশ্বাখিলের নাম উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তিনি দত্তিলের সমসাময়িক ছিলেন। সঙ্গীতরত্নাকরে বিশ্বাখিলকে প্রাচীন সঙ্গীজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বাবসু
খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ।  বৃহদ্দেশীতে থেকে তাঁর স্বর. শ্রুতি প্রভৃতি বিষয়ের অভিমত পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায় তিনি নাট্য, নৃত্য, গীত ও বাদ্য বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন।

গুপ্তরাজবংশের পঞ্চম রাজা চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (৩৮০-৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্বকালে ষাষ্টিক, নন্দিকেশর, কশ্যপ ও দুর্গাশক্তি-র সঙ্গীত ভাবনাই সক্রিয় ছিল। গুপ্তরাজবংশের শেষের দিকে অযোগ্য শাসক এবং হুনদের ক্রমাগত আক্রমণের কারণে সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। গুপ্তরাজবংশের সপ্তম রাজা কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্য (৪১৪-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)-এর দুই মহিষীর মধ্যে প্রথম মহিষীর পুত্র ছিলেন পুরুগুপ্ত। পক্ষান্তরে কুমারগুপ্ত-এর দ্বিতীয় স্ত্রী দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্কন্ধগুপ্ত। ৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কুমারগুপ্ত-এর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রথম সন্তান হিসেবে পুরুগুপ্ত রাজত্ব লাভ করেন। কিন্তু রাজ্য চালনায় এবং বীরত্বের দিক থেকে তিনি তাঁর বৈমাত্রৈয় ভাই স্কন্ধগুপ্ত -এর সমতুল্য ছিলেন না। ফলে রাজ্য লাভের কিছুদিন পরই স্কন্ধগুপ্ত তাঁকে পরাজিত করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা হন। এই সময় বিদেশী হুনদের আক্রমণ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে স্কন্ধগুপ্ত হুনদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হুনদের রাজা তোরমান গুপ্তরাজ্যের একটি অংশ দখল করতে সক্ষম। যদিও ভানুগুপ্ত নামক এক রাজার কাছে তোরমান পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু হুনদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে পারেন নি। এই সময় গুপ্তরাজ বংশের উত্তরাধিকারদের মধ্যে আত্মকলহের সুযোগে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে একাধিক রাজবংশের উত্থান ঘটে। হুনরা গান্ধার, পাঞ্জাব থেকে শুরু করে মালব পর্যন্ত দখল করে। এর পাশাপাশি দক্ষিণে বলভীর  মৈত্রবংশ, থানেশ্বররের পুষ্যভূতি বংশ, কনৌজের মৌখরীবংশ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে দুটি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই রাজ্য দুটি হলো- স্বাধীন বঙ্গরাজ্য ও স্বাধীন গৌড়রাজ্য।

উত্তরভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, সঙ্গীত-সাহিত্য রচনায় বিঘ্ন ঘটেছিল। এরই ভিতরে গ্রাম রাগের
সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল এর প্রায় সবই জাতিগান হিসেবে ধ্রুবাগানে ব্যবহৃত হতো। এর বাইরে সৃষ্ট দেশী রাগগুলো ভাষারাগ ও বিভাষা রাগ হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল

এই সময়ের সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাদি জানা যায় ষাষ্টিক, নন্দিকেশর, কশ্যপ ও দুর্গাশক্তি-র মতো সঙ্গীত আলোচকদের মাধ্যমে।

ষাষ্টিক
ধারণা করা হয়
, যাষ্টিক ছিলেন গুপ্তরাজবংশের চতুর্থ রাজা সমুদ্রগুপ্তের (রাজত্বকাল ৩২৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে) সমসাময়িক। যাষ্টিকের  রচিত 'সর্বাগম সংহিতা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়- গ্রাম রাগ থেকে ভাষারাগ, ভাষারাগ থেকে বিভাষা, বিভাষা থেকে অন্তর ভাষিকা গীতের উদ্ভব হয়েছিল। গীত হিসেবে প্রচলিত ছিল- ভাষা, বিভাষা এবং অন্তরভাষা। তাঁর গ্রন্থ থেকে জানা যায় দেশীরাগের বিষয়ে জানা যায়। এর অনেক পরে (৫০০ খ্রিষ্টাব্দে) মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে এই দেশী রাগের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এই গ্রন্থে পাওয়া যায় গ্রমরাগ থেকে উদ্ভূত ভাষা রাগের তালিকা।

নন্দিকেশ্বর
নন্দিকেশ্বর নাট্যশাস্ত্রী হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত কোনো সঙ্গীতজ্ঞই নন্দিকেশ্বরের নাম উল্লেখ করেন নি। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে প্রথম নন্দিকেশ্বরের উক্তি দিয়ে দ্বাদশ স্বরসম্পন্না মূর্‌ছনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

নন্দিকেশ্বরেণাপ্যুক্তম-
    দ্বাদশস্বরসম্পন্না জ্ঞাতব্যা মূর্ছনা বুধৈঃ।
    জাতিভাষাদিসিদ্ধার্থঃ তার মন্ত্রাদি সিদ্ধেয়॥

অর্থাৎ, নন্দিকেশ্বরও বলেছেন- অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ জাতি, ভাষা প্রভৃতি এবং তারমন্দ্রদি যাতে সিদ্ধ হয় সেইজন্য দ্বাদশস্বরসম্পন্ন মূর্ছনাসমূহকেই স্বীকার করবেন। [বৃহদ্দেশী। গ্রামনির্ণয়, মূর্ছনা, তান, বর্ণ, অলঙ্কার। পৃষ্ঠা : ৪৭]

তাঁর অভিনয় দর্পণ গ্রন্থে মন্দ্র-মধ্য-তার স্থানে ১২টি মূর্চ্ছনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থ থেকে জাতিরাগ, গ্রামরাগ, ভাষারাগ এবং দেশীরাগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

দুর্গাশক্তি
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে মতঙ্গ দুর্গশক্তির উদ্ধৃতিতে লিখেছেন- গীত ছিল পাঁচ প্রকার। এগুলো হলো- শুদ্ধা, ভিন্না, বেসরা, গৌড়ী এবা সাধারিতা। তিনি বেসরা রাগের ব্যাখ্যায় বলেছেন- রাগসমূহের প্রত্যকটিই বেসরা। স্বরসমূহ বেগের সাথে যাতায়াত করে বলে- এর নাম দেওয়া হয় বেসরক। তাঁর মতে বেসরষাড়ব হলো মুখ্যরাগ। [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা ১৬২]

কশ্যপ
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে মতঙ্গ কশ্যপের উদ্ধৃতিতে লিখেছেন- গীত মাত্র এক প্রকার। তা হলো ভাষাগীতি। বেসরাগীতি সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল- 'স্থায়ী, অন্তরা, আরোহী, অবরোহী, -এই  চতুর্বর্ণের প্রয়োগ, যা শোভিত হয়ে রাগপ্রাপ্তি ঘটায় এবং এতদ্বারা সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি হয়, তাকে সেই কারণে রাগ আখ্যা প্রদান করা হয়।' [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা ১৬২]

কশ্যপের টক্ক রাগই মুখ্য রাগ। কারণ এই রাগ লক্ষ্মীর প্রীতিকর।


আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত মতঙ্গের 'বৃহদ্দেশী গ্রন্থে' ভাষা ও বিভাষা রাগগুলোে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।  


তথ্যসূত্র: