ভারতীয় সঙ্গীত
নাট্যশাস্ত্র থেকে বৃহদ্দেশী-পূর্বকাল (২০০ -৫০০ খ্রিষ্টাব্দ)

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে উত্তর ভারতে কুষাণ রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল। এই রাজ্যের প্রথম রাজা কুজুল-কদ্‌ফিসেস নিজ গোত্রের বিভিন্ন শাখাকে একত্রিত করে- ওয়াং বা রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। পরে নিজের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে হিন্দুকুশের দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন এবং কাবুল দখল করে নেন। এরোর ব্যাক্ট্রিয়া দখলে পারস্য সীমান্ত থেকে সিন্ধু ও ঝিলম নদী পর্যন্ত রাজত্ব বিস্তার করেন। ধারণা করা হয়- তিনি ১৫ থেকে ৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করতে সক্ষম হন। ইতিহাসে তিনি প্রথম কদ্‌ফিস নামে পরিচিত। এরপর এই রাজ্যের রাজা প্রথম কদ্‌ফিসের পুত্র দ্বিতীয় কদফিস। ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কণিষ্ক কুষাণ রাজ্যের রাজা হন এবং সিংহাসন লাভের পর তিনি নূতন সৌরবর্ষ শকাব্দ প্রচলন করেন। কুষাণ রাজবংশের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাসুদেব ২৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আর ২৪০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন- শ্রীগুপ্ত।  ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে গুপ্ত রাজবংশের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর উত্থান ঘটে - হুনদের রাজত্ব।  এই সময়ের ভিতরে গান্ধার-সহ উত্তর ভারতে একটি সুস্থির দশায় ছিল। এই সময়ের ভিতরে রচিত হয়েছিল সঙ্গীত বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থাদি। এর ভিতরে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ভরতের নাট্যশাস্ত্র। অভিনয়, রস, গীত-বাদ্য-নৃত্যে বিষয়ক এই শাস্ত্রীয় গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের অব্দের ভিতর। এই সময়ের ভিতরে উল্লেখযোগ্য তিনজন সঙ্গীত নাটকের সুযোগ্য পণ্ডিতের আবর্ভাব হয়েছিল। এঁরা হলেন- গন্ধর্ব নারদ, স্বাতী এবং ভরত।

গন্ধর্ব নারদ
'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থের রচয়িতা নারদের পর, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আরও একজন নারদের নাম পাওয়া যায়। মূলত এই নারদকে গন্ধর্ব নারদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষাকার নারদ আর গন্ধর্ব নারদ একই ব্যক্তি ছিলেন না। শিক্ষাকার নারদের ছিলেন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ। পক্ষান্তরে গন্ধর্ব নারদ ছিলেন খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ। ভরতে সময়ে এই নারদ এবং স্বাতী ভরতের সঙ্গীতসহযোগী ছিলেন।

স্বাতি
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে স্বাতির নাম পাওয়া যায়। ভরত ইন্দ্রধ্বজ মহোৎসবে প্রথম নাট্যাভিনয়ে স্বাতি বাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন নিয়েছিলেন। এই বিচারে ধারণা করা হয়, স্বাতি ভরতের সমাসায়িক ছিলেন।  নাট্যশাস্ত্রের ৩৩তম অধ্যায়ে ঢাকের উৎপত্তি  প্রসঙ্গে আখ্যান পাওয়া যায়। এই আখ্যানে বল হয়েছে- স্বাতী একবার একটি সরোবরে জল আনতে যান। এই সময় ইন্দ্র মুষলধারে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে পৃথিবীকে একটি বিশাল সাগরে পরিণত করতে আরম্ব করেন। এই সময় বায়ুতাড়িত বৃষ্টির ফোঁটা পদ্মপাতার উপর পতিত হয়ে যে শব্দ তৈরি হয়েছিল, তা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি উচ্চ, মধ্যম ও নিচু ধ্বনিগুলোকে গম্ভীর, মিষ্ট ও সুখকর বিবেচনা করে, এই শ জাতীয় শব্দ-উৎপাদক তালযন্ত্র তৈরির কথা ভাবলেন। এরপর তিনি বিশ্বকর্মার সাহায্যে পুষ্কর, পণব ও দর্দুর নামক তালযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। এছাড়া  তিনি দেবতাদের দুন্দুভি দেখে মুরজ, আলিঙ্গ্য, ঊর্ধ্বক ও আংকিক তৈরি করেছিলেন।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়ের ঢাকের উৎপত্তি নামক অংশে স্বাতির নাম পাওয়া যায়। তিনি বর্ষাকালে সরোবরে পদ্মপাতার উপর বৃষ্টিপাতের শব্দ অনুসরণে তালযন্ত্র উদ্ভাবন করা ভাবেন। তিবি এর কাঠামো তৈরি করার জন্য বিশ্বকর্মার শরণাপন্ন হলে- বিশ্বকর্মা স্বাতির অনুরোধক্রমে মৃদঙ্গ, উষ্কর, পণব এ দর্দুর তৈরি করেন। এই সূত্রে তিনি নানা ধরনের ঢাক জাতীয় তালবাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন। মূলত বিশ্বকর্মা এই যন্ত্রগুলোর কাঠামো তৈরি করেছিলেন। স্বাতী এই যন্ত্রগুলো মুখকে চামড়া দিয়ে আবৃতি করে তালযন্ত্র তৈরি করেছিলেন।  নাট্যশাস্ত্রের এই আখ্যান অনুসরণ করলে লক্ষ্য করা যায় যে- তালযন্ত্রের ভিতরে আদি তালযন্ত্র ছিল দুন্দুভি। এই যন্ত্রের অনুকরণে স্বাতী বিশ্বকর্মার সাহায্য যে সকল যন্ত্র নিয়ে উদ্ভাবন করেছিলেন, সেগুলো হলো- আংকিক, আলিঙ্গ্য, ঊর্ধক, ঝল্লরী, দুর্দুর, পটহ, পুষ্কর, পণব, মুরজ। এ সকল বাদ্যযন্ত্রে সাধারণ নাম ছিল ঢাক। এই ঢাকগুলোর মধ্যে  প্রধান যন্ত্রকে বলা হতো মুখ্য অঙ্গে এবং অপেক্ষাকৃত অপ্রধান যন্ত্রগুলোকে  বলা হতো গৌণ।  তালযন্ত্রের ভিতরে মুখ্য অঙ্গের তালযন্ত্র ছিল মৃদঙ্গ,. দুর্দর ও পণব। গৌণ যন্ত্রের ভিতরে ছিল- ঝল্লরী ও পটহ।

এরূপ ভাগ ততযন্ত্রেরও ছিল। কাঠের কাঠামোতে তার জুড়ে যে সকল ততযন্ত্র নির্মিত হতে- এর ভিতরে বিপঞ্চী ও চিত্রা ছিল মুখ্য অঙ্গের তত বাদ্যযন্ত্র, পক্ষান্তরে কচ্ছপী এবং ঘোষক ছিল গৌণ অঙ্গের ততযন্ত্র।

শুষীর যন্ত্রের ভিতরে  বাঁশিও ছিল মুখ্য অঙ্গের এবং শঙ্খ ও ডাকিনী ছিল গৌণ অঙ্গের।

ভরতের নাট্যশাস্ত্র
নারদের সমকালীন সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়, প্রায় এক শতাব্দীর পরে সঙ্গীত যে নব্যরূপ লাভ করেছিল,  নাট্যশাস্ত্রে তাই বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নাট্যশাস্ত্রের শাস্ত্রীয় গান উপস্থাপন করা হয়েছে গান্ধর্ব-সঙ্গীতকে ভিত্তি করে। এই গ্রন্থ মতে - যা তত ও অন্যান্য যন্ত্র সহকারে স্বর, তাল ও পদযুক্ত- তাই গান্ধর্ব গান। এই গানকে স্বরগান্ধর্ব, তালগান্ধর্ব ও পদগান্ধর্বে ভাগ করা হয়েছে। এই গানের মুখ্য স্বর ছিল ৭টি। আর বিকৃত স্বর ছিল ২টি। ৭টি শুদ্ধ স্বর হলো- ষড়্‌জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। বিকৃত স্বর দুটি হলো- অন্তর গান্ধার ও কাকলী নিষাদ। এর ভিতরে অন্তর গান্ধারের অবস্থান ছিল শুদ্ধ গান্ধার ও মধ্যমের মাঝখানে। শুদ্ধ নিষাদ যখন ষড়্‌জের দুটি শ্রুতি গ্রহণ করে, তখন দুই শ্রুতির নিষাদ হয়ে যায় চার শ্রুতির। এই চতুর্থ শ্রুতির নিষাদকে বলা হয়েছে কাকালী নিষাদ। এই দুটি স্বরকে স্বর সাধারণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। একালের কোমল ঋষভ বা কোমল ধৈবতের কোনো প্রকরণ ছিল না। 

এই ৭টি স্বর স্থাপিত হয়েছিল ২২টি শ্রুতিতে।  নাট্যশাস্ত্রে শ্রুতিগুলোর স্বতন্ত্র নাম ছিল না। কিন্তু গ্রামভেদে স্বরবিন্যাসে শ্রুতি বিভাজনে ভিন্নতা ছিল।  নাট্যশাস্ত্রে  ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামের উল্লেখ করা হয়েছে। গান্ধার গ্রামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।  গ্রামভেদে শ্রুতিভিত্তিক স্বরবিন্যাসের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

ষড়্‌জ গ্রামের স্বরবিন্যাসে শ্রুতি বিভাজন ছিল- ষড়্‌জ ৪ শ্রুতি, ঋষভ ৩ শ্রুতি, গান্ধার ২ শ্রুতি,  মধ্যম ৪ শ্রুতি, পঞ্চম ৪ শ্রুতি, ধৈবত ৩ শ্রুতি, নিষাদ ২ শ্রুতি।

মধ্যম গ্রামের স্বরবিন্যাসে শ্রুতি বিভাজন ছিল- ষড়্‌জ ৪ শ্রুতি, ঋষভ ৩ শ্রুতি, গান্ধার ২ শ্রুতি,  মধ্যম ৪ শ্রুতি, পঞ্চম ৩ শ্রুতি, ধৈবত ৪ শ্রুতি, নিষাদ ২ শ্রুতি।

এই দুটি গ্রামভিত্তিক মূর্চ্ছনা তৈরি করা হয়েছিল। এই মূর্চ্ছনাগুলো- সম্পূর্ণ, ষাড়ব, ঔড়ব  ও সাধারণ (বিকৃত স্বরযুক্ত) ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।  ষড়জ ও মধ্যম গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল ১৮ প্রকার গ্রামরাগ। এই গ্রামরাগগুলো নাটকে প্রয়োগ হতো জাতি গান হিসেবে।

এই গ্রন্থে জাতি গানের ১০ লক্ষণের অংশ হিসেব-  গ্রহ, অংশ, তার গতি, অল্পত্ব, বহুত্ব, ন্যাস, অপন্যাস ইত্যাদির বর্ণনা করে হয়েছে। এছাড়া জাতিগানগুলোতে প্রযুক্ত  রসের উল্লেখ করা হয়েছে। স্বরের বিচারের  স্বর উচ্চারণে চার প্রকার বর্ণের উল্লেখ আছে। এগুলো হলো- উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত ও কম্পিত। কিন্তু জাতিগানগুলোর চার প্রকার বর্ণ ছিল। এগুলো হলো- আরোহী অবরোহী স্থায়ী ও সঞ্চারী।

এই গ্রন্থে ৩৩টি প্রধান অলংকারের কথা বলা হয়েছে।  এছাড়া ২৫টি মিশ্র অলঙ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  

জাতি গান প্রবন্ধগানের রূপ নিয়েছিলে।  খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের দিকে নিবদ্ধ প্রবন্ধ গানের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্ট হয়েছিল সালগ সুড় প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধগানের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল তুক বিভাজনে। সালগসূড় প্রবন্ধ গানের একটি ধারা হলো ধ্রুব গান। শাস্ত্রীয়ভাবে এই গানের ব্যাপ্তী ছিল বিশাল। নাটকের প্রয়োজন যখন গানের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তখন নাটকের স্বল্প পরিসরে ধ্রুব গান ব্যবহার করা যেতো না। তাই এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে নাটকে ধ্রুবা গান ব্যবহৃত হতো। নাটকের বাইরে এই গানের পরিবেশিত হতো না। এর ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং প্রাকৃত।

নাট্যশাস্ত্রের রচনা ও প্রচারে ভরতের শতপুত্র
নাট্যশাস্ত্র প্রণয়নের পর, ব্রহ্মার কাছ থেকে নাট্যশাস্ত্র প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য ভরতের শতপুত্রকে ব্যবহার করার নির্দেশ পেয়েছিলেন। নাট্যশাস্ত্রের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শ্লোকের সূত্রে জানা যায়, এই কাজটি ভরত তাঁর পুত্রদের নিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নাট্যশাস্ত্রে প্রথম অধ্যায়ের ২৬ থেকে ২৯ সংখ্যক শ্লোকে ভরতের ১০০ পুত্রের তালিকা পাওয়া যায়। ভরতের পর, তাঁর শতপুত্রদের ভিতরে মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায় সঙ্গীত ও নাটকের গুণী হিসেব। এঁদের ভিতরে কয়েকজনের নাম নাট্যশাস্ত্রেই বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শার্দুলকে অন্যান্য গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে অত্যন্ত প্রশংসাসূচক বাক্যে স্মরণ করেছেন। এই শ্লোকে তিনে বলেছেন- 'বাৎস্য, শাণ্ডিল্য, ধূর্তিল (দত্তিল), সহ কোহল ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই ধরণীতে মরণশীল ব্যক্তিরূপে কিছুকাল বাস করে মানুষের বুদ্ধিবর্ধক ত্রিভুবনের কীর্তিকলাপপূর্ণ এবং অন্য সব শাস্ত্রের নমুনাস্বরূপ এই শাস্ত্রকে প্রয়োগ করলেন।'
 

নাট্যশাস্ত্রে প্রথম ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিশীলিত সুরে পরিবেশিত ১৮ প্রকার জাতিগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাতী মুনির উদ্ভাবিত তালযন্ত্রের ব্যবহার হতো এই সকল গানে। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের বীণা এবং বেণুর পরিচয়।

ধারণা করা ভরতের পুত্র এবং শিষ্য হিসেবে এঁরা খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন।  

কোহল
দত্তিলের 'দত্তিলম' গ্রন্থে তাল বিষয়ক আলোচনায় কোহলের নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে মতঙ্গ ও শার্ঙ্গদেব তাঁদের গ্রন্থাদিতে কোহলকে সঙ্গীতার্য নামে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়, তিনি 'সঙ্গীতমরু' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কোহলের শ্লোকগুলো থেকে ভট্টতণ্ডু, শার্দুল, নারদ, ক্ষেমরাজ, সন্তু, লোহিতভ্ট্ট, শম্ভু প্রভৃতি সঙ্গীতজ্ঞদের নাম পাওয়া যায়। এঁরা কোহলের সমসাময়িক বা বয়োজ্যেষ্ঠ্ ছিলেন। কোহল তাঁর গ্রন্থে নাচে ব্যবহৃত বিভিন্ন হস্তমুদ্রা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

তিনি সঙ্গীতমেরু রচনা করেছিলেন সংস্কৃত অনুষ্টুভ ছন্দে। কথিত আছে- তিনি 'তাললক্ষণ', কোহলরহস্যম  এবং 'কোহলীর অভিনয় শাস্ত্র' নামে তিনটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কথিত আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের শেষাংশ 'উত্তরতন্ত্র' কোহল রচনা করছিলেন।

কোহল মূলত নাট্যধারা ও অভিনয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর সাথে তিনি আলোচনা করেছেন গ্রাম রাগ ও ভাষারাগ সম্পর্কে। কোহলের রচিত গ্রন্থাদি থেকে বিশেষভাবে জানা যায় ভরতের নির্দেশিত স্বর, শ্রুতি, মূর্ছনা বিষয়ক আলোচনা।

কোহলের স্বর বিষয়ক যে ধারণা, বৃহদ্দেশীতে কোহলের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ আছে- সেগুলো হলো-

১. 'ভূতল থেকে সমুত্থিত বায়ুকে নিজের প্রযত্নে ধারণ করা হয়: নাড়ীকে ভেদ ক'রে বায়ুর ঊর্ধ্বগতিতে যে ধ্বনি জাগ্রত হয়, তাকে স্বর বলা হয়।' পৃষ্ঠা: ১৬।

২. 'বিবিধজাতি এবং ভাষাদির সংযোগহেতু স্বরকে অনন্ত বলে ঘোষণা করা হয়। এই স্বর বহুনাদ সমন্বিত এবং তালযুক্ত হয়ে বহু রসের সঙ্গেও যোজিত হয়।'
[পৃষ্ঠা ১৭]

৩. ঊর্দ্ধ নাড়ির প্রযত্ন দ্বারা তলদেশ থেকে সর্বস্থানে তাড়নার ফলে যে ধ্বনি মূর্ধাদেশে (মস্তিষ্কে) এসে অবস্থিত হয় (মূর্চ্ছিত)। সেই স্বরই অতিশয় ব্যাপকরূপে প্রতিভাত হয়।' [পৃষ্ঠা ১৭]
৪. পশুপাখির কণ্ঠস্বর থেকে স্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন- স্বর এবং পশুপাখিগুলো হলো- ময়ুর থেকে ষড়্‌জ, চাতক থেকে ঋষভ, ছাগ থেকে গান্ধার, ক্রৌঞ্চ থেকে মধ্যম, কোকিল থেকে পঞ্চম, বর্ষাকালের ব্যাঙের ডাক থেকে ধৈবত এবং  হাতি থেকে নিষাদ উৎপন্ন হয়েছে। [পৃষ্ঠা ১৭]

এছাড়া অলঙ্কার সম্পর্কে কোহল ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব ভাবনা থেকে। গ্রন্থাদির কালনুক্রমিক সূত্রে মনে হয়ে জাতিগান বা জাতিরাগ থেকে উদ্ভুত গ্রামরাগের প্রসার ঘটেছিল কোহলের সময়। এছাড়া ভাষারাগের বিকাশ ঘটেছিল কোহলের সময়।  কোহল রচনা করেছিলেন 'সঙ্গীতমেরু' নামক গ্রন্থ। এছাড়া 'তাল লক্ষণ' ও কোহল রহস্য' নামক দুটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। কোহলের তাল সম্পর্কে প্রথম জানা যায়-  ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত মতঙ্গের 'বৃহদ্দেশী গ্রন্থে'।

দত্তিল
দত্তিল ছিলেন ভরতের শিষ্য ও পুত্র। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে প্রথম দত্তিলের নাম পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রন্থাদিতে কোহলের পরে দত্তিলের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।  দত্তিলের রচিত সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থের নাম 'দত্তিলম'। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি ছাপা হয়েছিল।  গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছিলেন সাম্বস্বামী শাস্ত্রী। তবে অধিকাংশ গবেষকদের মতে গ্রন্থটি ছিল অসম্পূর্ণ। তবে সাম্বস্বামী শাস্ত্রীর মতে এই গ্রন্থটি এই গ্রন্থটি পৃথক নাট্যগ্রন্থের সঙ্গীত-বিষয়ক সারসংক্ষেপ।

দত্তিলমের সঙ্গীতবিষয়ক উপাদানের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তাঁর

এই বিষয়টি 'দত্তিলম'-এর পরিচয়জ্ঞাপক প্রথম শ্লোকেই পাওয়া যায়। এই শ্লোকে বলা হয়েছে-

(প্রণম্য পরমেশানাং) ব্রহ্মাদ্যাংশ্চ গুরুংস্তথা
গান্ধার্বশাস্ত্রসংক্ষেপঃ সারতোহয়ং মায়াচ্যতে॥১

দত্তিলমের তৃতীয় শ্লোকে গান্ধর্ব সঙ্গীতের সংজ্ঞায় লিখেছেন-
        পদস্থস্বরসংঘাতস্তালেন সুমিধতস্তথা।
        প্রযুক্তশ্চাবধানেন গান্ধর্বমভিধীয়ন॥২
অর্থাৎ পদস্থ স্বরসমূহ এবং তাল দ্বারা যে গান অবধাবনের (মনোসংযোগ, প্রযত্ন এবং অধ্যাবসায়) দ্বারা প্রযুক্ত হয়, তাকেই গান্ধর্ব গান বলা হয়। নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের  অষ্টম শ্লোকে একই কথা পাওয়া যায়- এই ভাবে- 'যা ততবাদ্যের দ্বারা গঠিত, অন্যান্য যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল এবং স্বর, তাল ও পদযুক্ত, তা গান্ধর্ব নামে জ্ঞেয়।

এই গ্রন্থের ৬-৭ শ্লোকে গান্ধর্ব গানের উপদান সম্পর্কে বলেছেন- শ্রুতু, স্বর, গ্রাম, মূর্চ্ছনা তান, স্থান, শুষ্ক (নির্গীত বাদ্য), সধারণ, জাতি বর্ণ, অলঙ্কার ও রস। নবম শ্লোকে তিনি ২২টি শ্রুতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি শ্রুতিগুলোকে ধ্বনি বলেছেন। এবং শ্রতিগুলো উত্তোরোত্তর  মন্দ্র থেকে তার স্বরের দিকে চলে।  এই গ্রন্থে  ষড়্‌জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের  উল্লেখ করা  হয়েছে। উল্লেখ্য, দত্তিলের সময় গান্ধার গ্রামের ব্যবহার ছিল না। 

এই গ্রন্থে আরও পাওয়া যায়, ৮৪টি তান, ১০টি রাগত্ব ধর্ম, গ্রহস্বর, তার, মন্দ্র, ষাড়ব ঔড়ব, অল্পত্ব, গ্রহ, অংশ, ন্যাস অপন্যাস ইত্যাদী রাগের উপাদানসমূহ। তিনি তালের উপাদান এবং ৭টি তালের বিশ্লেষণ করেছেন।

বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ আছে- দত্তিলের মতে- তন্ত্রীতে তান দুই প্রকার। প্রকার দুটি হলো- প্রবেশ ও নিগ্রহ। প্রবেশক্রিয়ায় ধ্বনিসাদৃশ্য মনে হয়। অর্থাৎ প্রকর্ষণ দ্বারা উচ্চতর স্বর পাওয়া যায়, মৃদুভাবে নিম্নকর্ষণে নিম্নবর্তী স্বর পাওয়া যায়। অসংস্পর্শ হলে নিগ্রহ বলা হয়। তাঁর মতে- পূর্ণ কূটতানের সংখ্যা ৫০৩৩টি। পূর্বাম্পাদিত তানটি পরবর্তী একটি স্বরসংখ্যা যোজিত হয়ে তান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এখানে কূটতান হলো- মূর্চ্ছনার স্বরগুলোর বিপরীতক্রমে উচ্চারণ। আর পূর্ণা হলো- সাতটি স্বরের সহযোগে সম্পাদিত মূর্চ্ছনা। 

তাঁর মতে- তন্ত্রীতে তান দুই প্রকারে নিষ্পন্ন হয়। একে বলা হয়েছে প্রবেশ এবং নিগ্রহ। [সূত্র: বৃহদ্দেশী পৃষ্ঠা: ৪১]
উল্লেখ্য এক স্বরের ঊর্ধে অবস্থিত স্বরের প্রবেশকে বলা হয়- প্রকর্ষ। আবার নিম্নস্থিত স্বরে প্রবেশকে বলা হচ্ছে মার্দব। এই দুটি ক্রিয়াকেই প্রবেশ বকা হয়। যেমন- স গগ, প্রকর্ষ আর স ধ্  মার্দব। আর প্রকর্ষ এবং মার্দব হলো প্রবেশকের দুটি প্রকরণ মাত্র। নিগ্রহ হলো- নিম্নস্থ স্বরের অসংস্পর্শজনিত পরিত্যাগ। যেমন- স স  গ র প প ম র। এখানে আরোহণে- স এর পরে গা, অর্থৎ ঋষভ বর্জিত। কিন্তু অবরোহণে বক্রভাবে ঋষভে পৌঁছেছে। আরোহণ নিম্নস্থ স্বর অসংস্পর্শিত ঋষভ। এটাই নিসর্গক্রিয়া।

শার্দুল
নারদের মতই পাঁচটি শ্রুতির কথা বলেছেন। তবে এই পাঁচটি শ্রুতির পাশাপাশি ২২টি শ্রুতিরও উল্লেখ করেছিলেন। শার্দুল এবং কোহলের প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি 'শার্দুল' বা 'ব্যাল কোহল' নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে শার্দুল সঙ্গীত বিষয়ে কোহলকে যে সকল প্রশ্ন করেছেন, তার উত্তর দিয়েছেন কোহল। এই গ্রন্থে দেশী রাগের বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকটি বিভাষা রাগের বর্ণনা করেছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল- দেবলবধনী, পৌরালী, ত্রাবণী, তানলতিকা, দেহ্যা, শার্দূলী, ভিন্নলতিকা, রবিচন্দ্র, ভিন্নপৌবালী, দ্রাবিড়ী, পিঞ্জরীম পার্বতী, টঙ্ক ইত্যাদি। সম্ভবত শার্দূল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সিদ্ধ ছিলেন। বৃহদ্দেশী গ্রন্থ থেকে জানা যায় শার্দুল ভরতের চারপ্রকার গীতের পরিবর্তে শুধু ভাষাগীতের  উল্লেখ করেছেন।  

শাণ্ডিল্য
ভরতের ভাষায় গুণী পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ প্রাচীনকালেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পরবর্তী গ্রন্থাদিতে তাঁর বিষয়ে বিশেষ কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের রচিত নাট্যশাস্ত্রের- শাণ্ডিল্যকে ভরতের শতপুত্রের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই গ্রন্থের ৩৬ অধ্যায়ের ৭৫-৭৬ সংখ্যাক শাণ্ডিল্যকে  অন্যান্য গুণী সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে অত্যন্ত প্রশংসাসূচক বাক্যে স্মরণ করেছেন। এই শ্লোকে তিনে বলেছেন- 'বাৎস্য, শাণ্ডিল্য, ধূর্তিল (দত্তিল), সহ কোহল ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই ধরণীতে মরণশীল ব্যক্তিরূপে কিছুকাল বাস করে মানুষের বুদ্ধিবর্ধক ত্রিভুবনের কীর্তিকলাপপূর্ণ এবং অন্য সব শাস্ত্রের নমুনাস্বরূপ এই শাস্ত্রকে প্রয়োগ করলেন।' তবে শাণ্ডিল্যের রচিত গ্রন্থাদি বহুপূর্বে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বাখিল
খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীতে দত্তিলের রচিত 'দত্তিলম' গ্রন্থে বিশ্বাখিলের নাম উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তিনি দত্তিলের সমসাময়িক ছিলেন। সঙ্গীতরত্নাকরে বিশ্বাখিলকে প্রাচীন সঙ্গীজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বাবসু
খ্রিষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ।  বৃহদ্দেশীতে থেকে তাঁর স্বর. শ্রুতি প্রভৃতি বিষয়ের অভিমত পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে জানা যায় তিনি নাট্য, নৃত্য, গীত ও বাদ্য বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন।

গুপ্তরাজবংশের পঞ্চম রাজা চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (৩৮০-৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্বকালে ষাষ্টিক, নন্দিকেশর, কশ্যপ ও দুর্গাশক্তি-র সঙ্গীত ভাবনাই সক্রিয় ছিল। গুপ্তরাজবংশের শেষের দিকে অযোগ্য শাসক এবং হুনদের ক্রমাগত আক্রমণের কারণে সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। গুপ্তরাজবংশের সপ্তম রাজা কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্য (৪১৪-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)-এর দুই মহিষীর মধ্যে প্রথম মহিষীর পুত্র ছিলেন পুরুগুপ্ত। পক্ষান্তরে কুমারগুপ্ত-এর দ্বিতীয় স্ত্রী দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্কন্ধগুপ্ত। ৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে কুমারগুপ্ত-এর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রথম সন্তান হিসেবে পুরুগুপ্ত রাজত্ব লাভ করেন। কিন্তু রাজ্য চালনায় এবং বীরত্বের দিক থেকে তিনি তাঁর বৈমাত্রৈয় ভাই স্কন্ধগুপ্ত -এর সমতুল্য ছিলেন না। ফলে রাজ্য লাভের কিছুদিন পরই স্কন্ধগুপ্ত তাঁকে পরাজিত করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা হন। এই সময় বিদেশী হুনদের আক্রমণ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে স্কন্ধগুপ্ত হুনদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হুনদের রাজা তোরমান গুপ্তরাজ্যের একটি অংশ দখল করতে সক্ষম। যদিও ভানুগুপ্ত নামক এক রাজার কাছে তোরমান পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু হুনদের সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে পারেন নি। এই সময় গুপ্তরাজ বংশের উত্তরাধিকারদের মধ্যে আত্মকলহের সুযোগে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে একাধিক রাজবংশের উত্থান ঘটে। হুনরা গান্ধার, পাঞ্জাব থেকে শুরু করে মালব পর্যন্ত দখল করে। এর পাশাপাশি দক্ষিণে বলভীর  মৈত্রবংশ, থানেশ্বররের পুষ্যভূতি বংশ, কনৌজের মৌখরীবংশ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে দুটি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই রাজ্য দুটি হলো- স্বাধীন বঙ্গরাজ্য ও স্বাধীন গৌড়রাজ্য।

উত্তরভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, সঙ্গীত-সাহিত্য রচনায় বিঘ্ন ঘটেছিল। এরই ভিতরে গ্রাম রাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর প্রায় সবই জাতিগান হিসেবে ধ্রুবাগানে ব্যবহৃত হতো। এর বাইরে সৃষ্ট দেশী রাগগুলোকে ভাষারাগ ও বিভাষা রাগ হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল।

এই সময়ের সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাদি জানা যায় ষাষ্টিক, নন্দিকেশর, কশ্যপ ও দুর্গাশক্তি-র মতো সঙ্গীত আলোচকদের মাধ্যমে।

ষাষ্টিক
ধারণা করা হয়, যাষ্টিক ছিলেন গুপ্তরাজবংশের চতুর্থ রাজা সমুদ্রগুপ্তের (রাজত্বকাল ৩২৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে) সমসাময়িক। যাষ্টিকের  রচিত 'সর্বাগম সংহিতা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়- গ্রাম রাগ থেকে ভাষারাগ, ভাষারাগ থেকে বিভাষা, বিভাষা থেকে অন্তর ভাষিকা গীতের উদ্ভব হয়েছিল। গীত হিসেবে প্রচলিত ছিল- ভাষা, বিভাষা এবং অন্তরভাষা। তাঁর গ্রন্থ থেকে জানা যায় দেশীরাগের বিষয়ে জানা যায়। এর অনেক পরে (৫০০ খ্রিষ্টাব্দে) মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে এই দেশী রাগের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এই গ্রন্থে পাওয়া যায় গ্রমরাগ থেকে উদ্ভূত ভাষা রাগের তালিকা।

নন্দিকেশ্বর
নন্দিকেশ্বর নাট্যশাস্ত্রী হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত কোনো সঙ্গীতজ্ঞই নন্দিকেশ্বরের নাম উল্লেখ করেন নি। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে প্রথম নন্দিকেশ্বরের উক্তি দিয়ে দ্বাদশ স্বরসম্পন্না মূর্‌ছনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-

নন্দিকেশ্বরেণাপ্যুক্তম-
    দ্বাদশস্বরসম্পন্না জ্ঞাতব্যা মূর্ছনা বুধৈঃ।
    জাতিভাষাদিসিদ্ধার্থঃ তার মন্ত্রাদি সিদ্ধেয়॥

অর্থাৎ, নন্দিকেশ্বরও বলেছেন- অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ জাতি, ভাষা প্রভৃতি এবং তারমন্দ্রদি যাতে সিদ্ধ হয় সেইজন্য দ্বাদশস্বরসম্পন্ন মূর্ছনাসমূহকেই স্বীকার করবেন। [বৃহদ্দেশী। গ্রামনির্ণয়, মূর্ছনা, তান, বর্ণ, অলঙ্কার। পৃষ্ঠা : ৪৭]

তাঁর অভিনয় দর্পণ গ্রন্থে মন্দ্র-মধ্য-তার স্থানে ১২টি মূর্চ্ছনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থ থেকে জাতিরাগ, গ্রামরাগ, ভাষারাগ এবং দেশীরাগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

দুর্গাশক্তি
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে মতঙ্গ দুর্গশক্তির উদ্ধৃতিতে লিখেছেন- গীত ছিল পাঁচ প্রকার। এগুলো হলো- শুদ্ধা, ভিন্না, বেসরা, গৌড়ী এবা সাধারিতা। তিনি বেসরা রাগের ব্যাখ্যায় বলেছেন- রাগসমূহের প্রত্যকটিই বেসরা। স্বরসমূহ বেগের সাথে যাতায়াত করে বলে- এর নাম দেওয়া হয় বেসরক। তাঁর মতে বেসরষাড়ব হলো মুখ্যরাগ। [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা ১৬২]

কশ্যপ
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে মতঙ্গ কশ্যপের উদ্ধৃতিতে লিখেছেন- গীত মাত্র এক প্রকার। তা হলো ভাষাগীতি। বেসরাগীতি সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল- 'স্থায়ী, অন্তরা, আরোহী, অবরোহী, -এই  চতুর্বর্ণের প্রয়োগ, যা শোভিত হয়ে রাগপ্রাপ্তি ঘটায় এবং এতদ্বারা সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি হয়, তাকে সেই কারণে রাগ আখ্যা প্রদান করা হয়।' [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা ১৬২]

কশ্যপের টক্ক রাগই মুখ্য রাগ। কারণ এই রাগ লক্ষ্মীর প্রীতিকর।

আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত মতঙ্গের 'বৃহদ্দেশী গ্রন্থে' ভাষা ও বিভাষা রাগগুলোকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।  

[দেখুন:  বৃহদ্দেশী, খ্রিষ্টীয় ৫০০ অব্দ]

তথ্যসূত্র: