আলফা কণা
Alpha particle

হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসকে সাধারণভাবে বলা হয় আলফা কণা। এর প্রতীক গ্রিক বর্ণমালার আদ্যাক্ষর আলফা (α বা α2+) হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে থাকে দুটি প্রোটিন আর দুটি নিউট্রন। ঘটনাটি শুধু হিলিয়ামের ক্ষেত্রে নয়, অন্য যে কোনো পদার্থ থেকে দুটি প্রোটন  আর দুটি নিউট্রন-এর বিচ্যুতি ঘটলে তা আলফা কণা হিসেবে বিবেচিত হয়। যখন কোনো পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে যদি একটা আলফা কণা বের হয়ে আসে তখন সেই পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা দুই ধাপ কমে যায়। ফলে আলফা কণার বিচ্যুতিতে একটি পদার্থ থেকে অন্য পদার্থের সৃষ্টি হয়। যেমন ইউরেনিয়ামের একটি আইসোটোপ আলফা কণা বিকিরণ করে থোরিয়ামের একটি আইসোটোপে পরিণত হয়।

আলফা কণার গতিবেগ আলোর বেগের ১০ ভাগ। এর ভর হাইড্রোজেন
পরমাণুর চার গুণ। এর ভর বেশি হওয়ায় এর ভেদন ক্ষমতা কম। একটা নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে যখন একটা আলফা কণা বের হয়ে আসে তখন তার শক্তি থাকে কয়েক MeV (মেগাভোল্ট)। এই কণা যখন বাতাসের ভেতর দিয়ে যায়, তখন বাতাসের অণু-পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে আয়নিত কণা উৎপন্ন করে। আলফা কণার গতিপথ হয় সরল। তবে আলফা কণা পদার্থের ভেতর দিয়ে বেশি দূর যেতে পারে না। বাতাসের ভেতর দিয়ে ৬ সেন্টিমিটার অতিক্রম করার পর, বাতাসের অণু-পরমাণুকে তীব্রভাবে আয়নিত করে পুরো শক্তি ক্ষয় করে থেমে যায়। একটা কাগজ দিয়েই আলফা কণাকে থামিয়ে দেওয়া যায়।

আলফা কণায় থাকে দুটি প্রোটন আর দুটি নিউট্রন। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানে প্রোটন হলো হ্যাড্রোন (
hadron)-এর অন্তর্গত ব্যারিয়ন শ্রেণির যৌগিক কণা। এটি তিনটি কোয়ার্ক কণা নিয়ে তৈরি হয়। এর ভিতরে থাকে দুটি আপ কোয়ার্ক (up quarks) এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক (down quark)। দুটি আপ কোয়ার্কের আধান হলো- ২/৩+২/৩=৪/৩। পক্ষান্তরে এতে -১/৩যুক্ত ডাউন কোয়ার্ক থাকায় এর চূড়ান্ত মান দাঁড়ায় ৪/৩-১/৩= +১। অন্যদিকে দুটি ডাউন কোয়ার্ক এবং একটি আপ কোয়ার্ক  দিয়ে নিউট্রন গঠিত হয়। এর দুটি ডাউন কোয়ার্ক  আধান হয় -১/৩-১/৩= -২/৩। এর সাথে ২/৩ (আপ কোয়ার্ক) থাকায় এর আধান মান হয় ০। ফলে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন যুক্ত নিউক্লিয়াসের আধান মান হয় +২।

আলফা কণা আবিষ্কারের ইতিহাস
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে গবেষণার জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি একটি  একটি বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষাটি রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষা নামে পরিচিত। এই যন্ত্রের ভিতরে তিনি কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ রাখেন। সেই যন্ত্রের সামনের দিকে একটা ছিদ্র রাখেন। এই ছিদ্রপথে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বেরিয়ে আসা কিছু কণা ওই ছিদ্রের সামনে থাকা স্বর্ণপাতের উপর আপাতিত হয় এবং স্বর্ণের নিউক্লিয়াসে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসা এই বিশেষ কণা। এ পরীক্ষা থেকেই রাদারফোর্ড নিশ্চিত হন যে, পরমাণুর কেন্দ্রে আছে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সন্ধান পান। এই বিচ্যুত কণাই ছিল আলফা কণা।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিউজিল্যান্ডার বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মার্সডেন এই আলফা কণা বাতাসের ভিতর চালিত করেন। এই সংঘর্ষের ফলে এক ধরনের নতুন ভারি কণার জন্ম হচ্ছে। উল্লেখ্য রাদারফোর্ড হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে আঘাত করে একই ফল পেয়েছিলেন। মার্সডেন ভেবেছিলেন এটাই হাইড্রোজেনে নিউক্লিয়াস।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাদারফো্ড অনুরূপ আরও কিছু পরীক্ষা করে ঘোষণা দেন যে,বাতাসে আলফা কণার সংঘর্ষে যে সব কণা তৈরি হচ্ছে সেগুলো শুধু হাইড্রোজেন নয়, সেগুলো নাইট্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়ামেরও হতে পারে। তিনি বিষয়টা নিয়ে প্রায় দুই বছর গবেষণা করেন এবং ১৯১৯ সালে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। এর শিরোনাম ছিল 'হালকা পরমাণুর সঙ্গে আলফা কণার সংঘর্ষ'। এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্য ছিল কৃত্রিমভাবে একটি পদার্থকে অন্য পদার্থে রূপান্তর করা সম্ভব।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাদারফোর্ড নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে পান অক্সিজেন নিউক্লিয়াস আর একটি ধনাত্মক চার্জ যুক্ত কণা। রাদারফোর্ড নিশ্চিত হন যে, এতদিন তিনি যেগুলোকে শুধু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস বলেই মনে করতেন, সেই কণাটি আসলে সকল পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরেই থাকে। এর ভর ইলেকট্রনের ১৮৩৬ গুণ। চার্জ ইলেকট্রনের সমান কিন্তু বিপরীত। এরপর থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞান তরতর করে এগিয়ে চলল। এখন দরকার আরেকটা কণা, যেটা চার্জ নিরপেক্ষ। এরজন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন রাদারফোর্ড। তিনি অনুমান করেন এমন কিছু হাইড্রোজন পরমাণু আছে, যার কক্ষপথ থেকে ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে নিউক্লিয়াসে পতিত হবে। তখন হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রন পরস্পরের চার্জকে নাকচ করে দিয়ে চার্জ নিরপেক্ষ কণায় পরিণত হবে। আর বিকিরিত হবে গামা রশ্মি।
সাইক্লোট্রোন