কাপ্তাই হ্রদ
চট্টগ্রাম [বাংলাদেশ] বিভাগের রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, নানিয়ার চর, বরকল, লংগদু জুরাছড়ি উপজেলা জুড়ে অবস্থিত কৃত্রিম হ্রদ বিশেষ। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দেওয়া হয়। এর ফলে এই হ্রদের সৃষ্টি হয়েছিল।

ভৌগোলিক অবস্থান: ২২°২৯'৪৫'' উত্তর অক্ষাংশ ৯২°১৩'৪৫'' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। 

আয়তন: এর মোট আয়তন প্রায় ১১০০০ বর্গকিলোমিটার। এই হ্রদের মূল অংশে রয়েছে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণীভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চল। উল্লেখ্য, এই হ্রদ সৃষ্টির কারণে প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়েছিল।

কাপ্তাই হ্রদের জলের উৎস ও বৈশিষ্ট্য:
এই হ্রদের জলের প্রধান উৎস
কর্ণফুলী নদী। ইংরেজি এইচ বর্ণের আকৃতি বিশিষ্ট কাপ্তাই হ্রদের দুটি বাহু সুভলং-এর কাছে একটি সংকীর্ণ গিরিসঙ্কট দ্বারা সংযুক্ত। এই অংশটি মূলত কর্ণফুলি নদীর গতিপথের একটি অংশ। হ্রদের ডান বাহু অর্থাৎ কাসালং দক্ষিণ দিকে দুটি অন্তঃপ্রবাহী নদী মাইনি ও কাসালং যুক্ত হয়েছে। রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই, অর্থাৎ বাম বাহুটি দুটি নদী, উত্তরে চেঙ্গী (বা চিংগ্রী) ও দক্ষিণে রাইনখিয়াং দ্বারা পুষ্ট। কর্ণফুলি নদী তিনটি প্রধান শাখার জন্ম দিয়েছে- একটি রাঙ্গামাটিতে, একটি ধুলিয়াছড়িতে ও অপরটি কাপ্তাইয়ে। রাঙ্গামাটি ও ধুলিয়াছড়ি শাখাদ্বয় বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধ দ্বারা সৃষ্ট জলাধারের অধীনে। কাপ্তাই হ্রদ মধ্য কর্ণফুলি উপত্যকার প্রায় সমগ্র অংশ এবং চেঙ্গী, কাসালং ও রাইনখিয়াং নদীর নিম্ন মোহনাসমূহকে নিমজ্জিত করেছে। তবে কাপ্তাই হ্রদের তটরেখা ও অববাহিকা খুবই অনিয়মিত।

কাপ্তাই বাঁধ

এর পৃষ্ঠদেশের জলের উচ্চতা প্রায় ৩১.১ মিটার। এর তলদেশের আয়তন ৫,২৪,৭০০ ঘন মিটার। হ্রদের মোট বার্ষিক জল ক্ষরণ ১৭,০৭,০০০ ঘন মিটার, সঞ্চয় অনুপাত ০.৩১। জলের গড় গভীরতা ৯ মিটার। সর্বোচ্চ গভীরতা ৩২ মি। এর নির্গমদ্বারের গভীরতা ১৫.৫মি, পানি সীমার বাৎসরিক গড় হ্রাসবৃদ্ধি ৮.১৪ মি। বর্ধিষ্ণু জল মৌসুম ৭৬ দিন।

হ্রদের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা: কাপ্তাই হ্রদের নিম্নাঞ্চল  প্রতিবর্তী  কর্দমশিলা ও পলিশিলা দ্বারা গঠিত। এর সাথে মিশে আছে হলুদাভ-বাদামি, সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি দানাদার, ঘন থেকে তির্যক স্তরিত বেলেপাথরের স্তর। হ্রদের ঊর্ধাঞ্চলে পাওয়া যায় হলুদাভ-বাদামি, সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি দানাদার, উপকৌণিক, উপগলিত, বেলেপাথর এবং তার সঙ্গে স্ফটিক দানা, নুড়ি ও কাদা। আবার সুভলং ও বরকলের আশপাশের ভূমি ভিন্নতর। এই অঞ্চলের হ্রদ-সংলগ্ন পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলায়, বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পাহাড়ি আলগা মাটি হ্রদের তলদেশে জমা হচ্ছে। ফলে হ্রদটি দ্রুত নাব্যতা হারাচ্ছে।

হ্রদ প্রকল্প: ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ শেষ হয়। এই সময় ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। এ প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়।

এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট। শুরুর দিকে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত ঝুলন্ত সাঁকো

কাপ্তাই পর্যটন ব্যবস্থা: কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে রাঙামাটি সদর ও কাপ্তাই উপজেলার পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। এই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য হ্রদের উপর রয়েছে ঝুলন্ত সাঁকো স্থাপন করা হয়েছ। পর্যটকদের হ্রদে ভ্রমণের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত নৌযান। এই হ্রদের ধারে রয়েছে নতুন চাকমা রাজবাড়ি ও বৌদ্ধ মন্দির। উল্লেখ্য এই হ্রদ সৃষ্টির সময় পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি তলিয়ে যায়। এই হ্রদ অংশে রয়েছে বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বিহার 'রাজবন বিহার'। এই হ্রদ পাড়ি দিয়ে রাঙামাটি সদর থেকে শুভলং জলপ্রপাতে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বিলাইছড়ি উপজেলার ঝর্নাসমূহ (মুপ্পোছড়া ঝর্না, ধুপপানি ঝর্না ইত্যাদি ) দেখার জন্য কাপ্তাই হ্রদ নৌ-যোগাযোগের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে


তথ্যসূত্রঃ
http://kaptai.rangamati.gov.bd