স্বরলিপি
ইংরেজি : musical notation
সঙ্গীতজ্ঞদের ব্যবহৃত সঙ্গীত-সঙ্কেতলিপি।


সঙ্গীতের সুরের প্রতিটি অংশ এক বা একাধিক স্বরকে আশ্রয় করে তৈরি হয়। এই স্বরগুলিকে লিখিত আকারে প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সঙ্গীত পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রতীকীরূপে লেখা হয়ে থাকে। একটি সুনির্দিষ্ট সঙ্গীত পদ্ধতিতে সুরকে লিখিত আকারে প্রকাশের জন্য যত ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তার প্রত্যেকটি ওই পদ্ধতির উপাদান। আর এই সকল উপাদান দিয়ে যখন কোন সুরকে লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে স্বরলিপি বলা হয়। পদ্ধতি অনুসারে সকল স্বরলিপি একই রকম হয় না। এই পদ্ধতি নির্ধারিত হতে পারে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতি-ভিত্তিক। যেমন
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতি, ইউরোপ তথ্য পাশ্চাত্য সঙ্গীত পদ্ধতি।
পাশ্চাত্য রীতির স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি চিত্রধর্মী। এই স্বরলিপিককে আন্তর্জাতিক স্বরলিপিও বলা হয়। এর বহুল পরিচিত নাম স্টাফ নোটেশান (Staff Notaion)। আবার একই সাংস্কৃতিক সঙ্গীত পদ্ধতির মধ্যে স্বরলিপি পদ্ধতির বিচারে একাধিক বিভাগ থাকতে পারে। উল্লেখ্য, উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে একাধিক স্বরলিপি পদ্ধতি পাওয়া যায়। যেমন

ভারতীয় সঙ্গীতজগতে প্রথম স্বরলিপির আদি পর্ব উপস্থাপন করেছিলেন পিঙ্গল (
पिङ्गल)। কারো কারো মতে ইনি ছিলেন পাণিনির ছোট ভাই। আবার কোনো কোনো মতে তিনি ছিলেন পতঞ্জলির ছোটো ভাই। পতঞ্জিলির অনুজ ধরলে, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে জীবিত ছিলেন। পিঙ্গল তাঁর চন্দশাস্ত্র (মতান্তরে চন্দসূত্র) নামক গ্রন্থে প্রথম স্বরলিপির চিহ্ন ব্যবহার করেন। তবে তিনি সঙ্গীতের ধ্বনিগুলোকে সংস্কৃত ছন্দের দীর্ঘ হ্রস্বাকারে সাজিয়েছিলেন। শারঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকারে কিছু সঙ্গীতের জন্য চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন। বিশেষ করে স্বরগুলোকে সঙ্কেতে প্রকাশ করার উপযোগী চিহ্ন নির্ধারণ করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে স্বরলিপি লেখার উপযোগী এ সকল চিহ্ন নিয়ে কেউই পূর্ণাঙ্গ স্বরলিপি তৈরি করার চেষ্টা করেন নি।

 

ভারতবর্ষে প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্বরলিপি প্রণয়ন করেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তৎকালীন বেলগাছিয়া নাট্যাশালা'র প্রথম নাটক 'রত্নাবলী' অভিনয়ের জন্য তিনি ঐকতান বাদন প্রবর্তন করেন। আর এই ঐক্যতান বাদন তথা অর্কেস্ট্রার জন্য তিনি স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত রত্নাবলীর সাথে সুর-সংযোগের সময়- যন্ত্রীরা ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-কৃত স্বরলিপি সামনে রেখে বাজাতেন। তাঁর  প্রথম স্বরলিপি গ্রন্থ 'ঐকতানিক স্বরলিপি' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর এই স্বরলিপিটি  দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি নামে পরিচিত।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
 কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গীত শিক্ষার জন্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র কাছে আসেন।  কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাছে দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি শিক্ষা নেন। কিন্তু  কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আগ্রহ ছিল পাশ্চাত্য স্টাফ নোটেশান-এর প্রতি। ফলে তিনি ভারতীয় গানের জন্য পাশ্চাত্যরীতি অনুসরণে নতুন ধরনের স্বরলিপি তৈরি করার উদ্যোগ নেন। এই স্বরলিপিকে তখন বলা হয়েছিল রেখামাত্রিক। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে  কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্বরলিপি প্রকাশ করেন তাঁর  'বঙ্গৈকতান' গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র রচিত 'ঐকতানিক স্বরলিপি'-র এক বৎসর আগে। তাই স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশের বিচারে  কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী তাঁর স্বরলিপি পদ্ধতি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়  তাঁর স্বরলিপির প্রচারণায় পিছিয়ে পড়েছিলেন।

 

ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপির প্রাচারে তাঁর শিষ্য শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তবে এই সময় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও স্বরলিপি প্রণয়নে গবেষণা করেছিলেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রচেষ্টায়  ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র রচিত 'ঐকতানিক স্বরলিপি' প্রকাশিত হওয়ার পর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিলেন প্রথম স্বরলিপি প্রণয়নের কৃতিত্ব তাঁর পাওয়া উচিৎ। এ বিষয়ে শৌরীন্দ্রমোহনকে প্রায় স্বরলিপি-চোরের খাতায় নাম উঠিয়েছিলেন। তাঁর মতে-

"বাংলায় প্রথম স্বরলিপি যে আমার রচিত, তাহা একেবারে নিঃসন্দেহ। শৌরীন্দ্র মোহন তাহার পরে তাড়াতাড়ি একটা স্বরলিপি প্রস্তুত করিয়া ছাপাইয়া দিল।"

-দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা (বিপিনবিহারী গুপ্ত সম্পাদিত বিবিধ প্রসঙ্গ। ১৩৭৩)।

সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন না যে,  শৌরীন্দ্রমোহনের প্রকাশিত স্বরলিপি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-র এবং তা ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু এই স্বরলিপির কিছু অসুবিধা থাকায় ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণয়ন করেন 
আকারমাত্রিক স্বরলিপি। এই দুটি স্বরলিপিই বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। এতে ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলা বর্ণ এবং সঙ্গীতোপযোগী চিহ্ন।

উত্তর ভারত প্রথম স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন বিষ্ণুদিগম্বর পলুস্কর। এই স্বরলিপিটি বিষ্ণুদিগম্বর স্বরলিপি নামে পরিচিত। বিষ্ণুদিগম্বর তাঁর শিষ্যদের জন্য এই স্বরলিপি প্রণয়ন করেছিলেন। পরে তিনি ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে এই স্বরলিপি চালু করেন। এই স্বরলিপি অপেক্ষাকৃত জটিল এবং তৎকালীন মুদ্রণ ব্যবস্থায় যথাযথভাবে এই স্বরলিপি ছাপানো মুশকিল ছিল। তাই দুই জন শিষ্য পৃথক পৃথকভাবে ২টি স্বরলিপি পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। এঁরা ছিলেন ছিলেন পণ্ডিত
ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত বিনায়ক রাও পটবর্ধন। এর ভিতরে মৌলিকতার বিচারে পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর-এর স্বরলিপি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। পণ্ডিত বিনায়ক রাও পটবর্ধন-এর স্বরলিপি প্রায়  বিষ্ণুদিগম্বর স্বরলিপি-এর মতোই।

 ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত
ওঙ্কারনাথ ঠাকুর ভারুচে ফিরে এসে নিজেই একটি সঙ্গীত-বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল 'গন্ধর্ব নিকেতন'। সম্ভবত এই সময়ে তিনি তাঁর শিষ্যদের জন্য এই স্বরলিপি প্রণয়ন করেছিলেন। এই স্বরলিপটি ওঙ্কারনাথ ঠাকুর-এর স্বরলপি  নামেই পরিচিত। বর্তমানে এই স্বরলিপি ব্যবহার করা হয় না।

 

পণ্ডিত বিনায়ক রাও পটবর্ধন যে স্বরলিপিটি কবে তৈরি  করছিলেন তা বিশেষভাবে জানা যায় না। তাঁর স্বরলিপটি বিনায়ক রাও পটবর্ধন-এর স্বরলিপি নামেই পরিচিত হয়েছিল। বর্তমানে এই স্বরলিপি ব্যবহার করা হয় না।

পণ্ডিত বিষ্ণুনারয়াণ ভাতখণ্ডে একটি স্বরলিপি তৈরি করেন। এই স্বরলিপিটি হিন্দুস্থানী স্বরলিপি নামে পরিচিত। এই স্বরলিপিটি হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গীতজ্ঞরা এই চারটি স্বরলিপিই এক সময় ব্যবহার করতো। এর ভিতর দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুদিগম্বর স্বরলিপিও ততটা ব্যবহার হয় না।  বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত স্বরলিপি হলো
আকারমাত্রিক স্বরলিপি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী স্বরবিতানের মাধ্যমে এই স্বরলিপির চর্চা করে আসছিল। বর্তমানে প্রায় সকল গানের স্বরলিপিই এই স্বরলিপিতে করা হয়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বাইরে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে হিন্দুস্থানী স্বরলিপি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে প্রায় রাগসঙ্গীতের গ্রন্থে এই স্বরলিপির ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। তাও বর্তমানে অনেকেই আকারমাত্রিক স্বরলিপি অনুসরণ করছেন।

 


স্বরলিপির তালিকা