টারান্টিয়ান আমল
Tarantian age
১.২৬ লক্ষ-১১.৭ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ

প্লেইস্টোসিন অন্তঃযুগের চতুর্থ এবং শেষ আমল। এই আমলের শুরু হয়েছিল ১ লক্ষ ২৬ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এবং শেষ হয়েছি ১১ হাজার ৭ শত খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এই আমলের শেষে শুরু হয়েছিল হোলোসিন অন্তঃযুগ

প্রস্তর যুগের বিচারে এই আমলটি ছিল মধ্যপ্রস্তরযুগ। এই যুগের প্রায় ১ লক্ষ থেকে ৭৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে হোমো স্যাপিয়েন্
দের একটি দল আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এমনি একটি ভ্রাম্যমান দল বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলে ব্লোম্বোস গুহায় পাওয়া গিয়েছে কিছু প্রাপ্ত প্রস্তরে খোদিত চিত্রকর্ম।  যদিও এই চিত্রকর্ম গুহার গায়ের দেয়ালে বা ছাদে আঁকা হয় নি, তারপরেও গুহায় প্রাপ্ত বলে একে গুহাচিত্র বলা হয়। প্রাপ্তি স্থানের বিচারে এ সকল শিল্পকর্মকে ব্লোম্বোস-গুহাচিত্র বলা হয়। আভিধানিক বিচারে এই চিত্রগুলো গুহাচিত্র হিসেবে বিবেচিত হয় না। ধারণা করা হয়, প্রায় ৭৫-৭০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই চিত্রগুলো অঙ্কিত হয়েছিল। আফ্রিকায় প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকর্মসমূহের ভিতরে ব্লোম্বোস গুহাচিত্রের ভিতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

আফ্রিকার মানব গোষ্ঠী ৬০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ কেপ শহরের নিকটবর্তী ডিয়েপক্লুফ গুহা
এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। এখানে পাওয়া গেছে অস্ট্রিকের ডিমের খোলসের উপর অঙ্কিত চিত্র। এই চিত্রগুলোকে ডিয়েপক্লুফ চিত্র অভিহিত করা হয়। এই গুহায় পাওয়া গেছে ২৭০টি চিত্রকর্ম। সম্ভবত ২৫টি অস্ট্রিকের ডিমের খোলসের ভাঙা অংশে এই ছবিগুলো অঙ্কিত হয়েছিল। ছবিগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। এই চিহ্নগুলো দিয়ে কোনো বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল কিনা তা জানা যায় নি।

আফ্রিকার শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য ছেড়ে, ভাগ্যান্বেষে  প্রায় ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ইউরেশিয়ায় আধুনিক মানুষ প্রবেশ করেছিল।আদিম মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির সূত্রে এবং এদের পূর্ববর্তী নিয়ানডার্থলদের অনুসরণে সঙ্গীত ক্রমবিকাশের ধারায় চলমান ছিল। আফ্রিকার আদিম নরগোষ্ঠীদের কোন সঙ্গীতযন্ত্রের নমুনা না পাওয়া গেলেও সঙ্গীতচর্চা এদের ভিতরে ছিল, এমটা অনুমান করাই যায়। এই সময়ের ভিতরে সঙ্গীতোপযোগী কোনো যন্ত্রের নমুনা পাওয়া না গেলেও চিত্রকর্মের নমুনা পাওয়া গেছে বিভিন্ন পর্বতগুহায়। এদের হাতে তৈরি হয়েছিল প্রাচীনতম শিল্পকর্ম। এরা পাহড়ের গুহা বাস করতো। আর সেই গুহাকে অলঙ্কৃত করতো চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে।

আফ্রিকা থেকে আগত মানবগোষ্ঠী ইউরেশিয়া ছেড়ে এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের ভিতর দিয়ে চীন ও ভারতের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। চীনে আধুনিক মানুষ প্রবেশ করেছিল সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়া অতিক্রম। জীবাশ্মের সূত্রে ধারণা করা চীনে প্রথম আধুনিক মানুষ প্রবেশ করেছিল, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫ হাজার অব্দের দিকে।


খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫ থেকে ৩০ হাজার অব্দের ভিতরে এদের একটি দল আফ্রিকা থেকে প্রথমে প্রবেশ করেছিল তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চলে। পরবর্তী ১৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা ইউরোপের স্পেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। হোমো স্যাপিয়েন্স তথা আধুনিক মানব গোষ্ঠীর ক্রো-ম্যাগনান নামক এই আদি দলটির দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল অরিগ্ন্যাসিয়ান সভ্যতা(Aurignacian Civilization)

মূলত ইউরোপে আগত ক্রো-ম্যাগনান তথা আদিম মানুষের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এরা ইউরোপের উল্লেখযোগ্য সকল নিয়ানডার্থালদের গুহাই এরা দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময়ের ভিতরে ভিতরে এরা ইউরোপে অন্যতম জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এরা ইউরোপের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ (জিব্রাল্টার) থেকে রাশিয়ার উরাল অঞ্চল পর্যন্ত নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে প্রায়য় ৩৫০টি চিত্রকর্ম-গুহা। এর ভিতরে প্রায় অর্ধেক নমুনা পাওয়া গেছে উত্তর স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে। সামগ্রিকভাবে ইউরোপে আগত ক্রো-ম্যাগনানদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল চারটি পর্যায়ে। এই পর্যায় চারটি হলো-

সোলুট্রিয়ান সভ্যতার শুরু দিকে শেষ বরফযুগের আবির্ভাব হয়েছিল। এই বরফযুগ ছিল ২০ থেকে ১৭ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। তাই এই আমলকে কোয়াটার্নারি বরফযুগের শেষ ধাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এই সময়ে মানুষের পাশাপাশি বাস করতো হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস'দের বড় বড় দল। সম্ভবত বরফযুগের শীতের তীব্রতায় এরা ১৭ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল।

কোয়াটার্নারি বরফ যুগের শেষের দিকে, আনুমানিক ১৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। এর ফলে হিমবাহ অধিযুগ শেষ হয়ে যায়। এই সময় ম্যাডালেনিয়ান সভ্যতার বিকাশ ঘটে।
এই সময়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দক্ষিণাংশ থেকে ধীরে ধীরে বরফ অপসারিত হওয়া শুরু হয়েছিল। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল বর্তমান সাহারা মরুভূমি অঞ্চলে। ক্রমাগত তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার সূত্রে এই অঞ্চল ধীরে ধীরে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে পরিণত হতে থাকে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সে কালের সাহারা উর্বর ভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ফলে হোমো স্যাপিয়েন্
-দের একটি বড় অংশ এই অঞ্চলে চলে এসেছিল। 

১২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে এই অঞ্চলের মাটি উর্বতা লাভ করেছিল। এই সূত্রে এই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছিল বৃহৎ অরণ্য। ফলে এই অঞ্চল তৃণভোজী প্রাণীর বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য প্রাণী ছিল এন্টিলোপ ও গবাদি পশু। আবার তৃণভোজীদের সূত্রে এই অঞ্চলের জলভূমিগুলো কুমিরে ভরে গিয়েছিল। সেই সাথে ডাঙ্গায় ছিল সিংহ, হায়না জাতীয় মাংশাসী প্রাণীকূল।


সূত্র: