সেন্ট মার্টিন দ্বীপ
St. Martin's Island

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরে বুকে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। প্রশাসনিক দিক থেকে এই দ্বীপটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত টেকনাফ উপজেলার একটি দ্বীপ এবং ইউনিয়ন। 

কবে প্রথম এই দ্বীপ মানুষের আসাযাওয়া শুরু হয়েছিল তা জানা যায় না। ধারণা করা হয়, এক সময় সমুদ্রপথে আরব বণিকরা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেওয়ার জন্য এই দ্বীপে জাহাজ ভিড়াতো। এই সময় কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। কালক্রমে
চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের হিসেব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৭,০০০ জন। এবং এর ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৭৫ জন।

এই দ্বীপের শুরু থেকেই
কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ট এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছ প্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নাম দিয়েছিল।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরীপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে  খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সময় এই দ্বীপটি পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান: ৯২° ১৮ থেকে ৯২°২১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২০° ৩৪  থেকে ২০° ৩৯ উত্তর অক্ষাংশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। টেকনাফ উপজেলা থেকে এর দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। মিয়ানমার উপকূল থেকে নাফ নদীর পশ্চিমতীর বরাবর এর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার।  আর কক্সবাজার জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।

প্রবালপাথর সমৃদ্ধ সৈকত

সেন্টমার্টিনের আয়তন:
বঙ্গোপসাগরে সাগরের বুকে উত্তর-উত্তরপশ্চিম ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব বরাবর বিস্তৃত এই দ্বীপটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭.৩১৫ কিলোমিটার। পুরো দ্বীপটি ৩টি অংশে বিভক্ত। এর উত্তরাংশকে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা। স্থানীয় লোকেরা একে উত্তর পাড়া বলে থাকেন। এই অংশটির দৈর্ঘ্য ২,১৩৪ মিটার দীর্ঘ এবং প্রস্থ ১,৪০২ মিটার । এর মধ্যভাগের অপেক্ষাকৃত সরু অংশটিকে বলা হয় গলাচিপা। দক্ষিণাংশটি দক্ষিণপাড়া নামে ডাকা হয়। এর প্রস্থ সর্বোচ্চ ৯৭৫ মিটার। দৈর্ঘ্যের বিচারে যদিও এই অংশকে প্রায় ১৯৩০ মিটার বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে এই দৈর্ঘ্যের পরিমাপ যথাযথভাবে নিরুপণ করাটা বেশ মুশকিল। কারণ দক্ষিণপাড়া দক্ষিণাংশের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছ অগভীর স্থলভূমি। এর বেশ কিছু অংশ ভাটার সময় পানির উপর জেগে উঠে, কিন্তু জোয়ারের সময় ডুবে যায়। এর ভিতরে উল্লেযোগ্য একটি অংশটিকে ছেড়াদ্বীপ বলা হয়। মূলত এর নাম ছিল ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া। এছাড়া রয়েছে দারুচিনি দ্বীপ এবং এর সংলগ্ন অগভীর জলাভূমি। দক্ষিণপাড়ার সাথে এই সব ভূখণ্ডগুলো ফিতার মতো পরস্পরের সাথে যুক্ত রয়েছে। এই অগভীর অংশের পুরোটাই অমসৃণ প্রবাল-পাথরে ভরা।

সেন্টমার্টিনের উৎপত্তি
কোয়াটার্নারি (Quaternary) অধিযুগে পৃথিবীর সর্বশেষ বরফযুগ নেমে এসেছিল। এই বরফযুগকে সাধারণভাবে বলা হয় প্লেইস্টোসিনে বরফযুগ বা কোয়াটার্নারি বরফযুগ ভূতাত্ত্বিক কাল বিভাজনে এই বরফযুগটি সংঘটিত হয়েছিল কোয়াটার্নারি অধিযুগের অন্তর্গত হোলোসিন অন্তঃযুগের সাব-বোরিয়াল (৫,০০০-২,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পূর্বকালের মধ্যবর্তী সময়ে। প্রায় ৪,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বর্তমান বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলের তলদেশে প্রবালকীটের বসতি গড়ে উঠতে থাকে এবং সূত্রে এই প্রবাল দ্বীপের সূত্রপাত হয়। এই দ্বীপের উল্লেখযোগ্য প্রবালগুলো হলো- Porites lobata এবং  Acropora গণের কিছু প্রজাতি।

Porites lobata প্রজাতির প্রবাল

সেন্টমার্টিনের ভূপ্রকৃতি:
প্রবালের বহিঃকঙ্কালের সাথে বিভিন্ন সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুক জাতীয় প্রাণীর খোলস, নদীবাহিত পলিমাটি ও বালু জমে জমে শক্ত স্থলের জন্ম দিয়েছে। এই দ্বীপের চারপাশে ভূমির উত্থান এখনও অব্যাহত আছে। এই উত্থানের বাৎসরিক গড় পরিমাণ ১৯ মিলিমিটার।

দ্বীপের চারপাশের রয়েছে অমসৃণ প্রবাল পাথর। খালি পায়ে সতর্কতার সাথে না হাঁটলে, পা কেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। দ্বীপের মৃত্তিকাসমৃদ্ধ উচ্চভূমি সংলগ্ন সাগর সৈকতের কিছুদূর পর্যন্ত, খালি পায়ে হাঁটার মতো বালুকময় অংশ রয়েছে। এর মাঝে মাঝে প্রবালের টুকরো দেখা যায়। সৈকতের বালুকাময় অংশ মোটেও কৃষির উপযোগী নয়। এই অংশে কোনো গাছও জন্মে না।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীবজগৎ
বলাই বাহুল্য এই দ্বীপসংলগ্ন অঞ্চলের আদিবাসী হলো
প্রবাল। এই দ্বীপের বালুকময় অংশে রয়েছে প্রচুর ক্ষুদ্রাকার কাঁকড়া। জোয়ারের পানি নেমে গেলে সৈকতে প্রচুর কাঁকড়া গর্ত দেখা যায়। এরা মাটি তুলে তুলে অদ্ভুদ ধরনের আলপনা তৈরি করে। আমরা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত যে আলপনা দেখি, তার সাথে কাঁকড়ার তৈরি আলপনা সৌন্দর্য কোনো অংশেই কম নয়।

কাঁকড়ার তৈরি আলপনা

দ্বীপের দক্ষিণাংশে উত্তাল সাগরের ঢেউ লক্ষ্য করা যায়। সেই তুলনায় এর পশ্চিমাংশের সাগর অনেকটা শান্ত। পশ্চিমাংশে তুলনামূলকভাবে প্রবালের পরিমাণ বেশি।

এর উচ্চ সমতলভূমির প্রান্তদেশে রয়েছে প্রচুর কেয়া গাছ। উপরের মৃত্তিকাসমৃদ্ধ অংশ চাষের উপযোগী। এর উচ্চভূমিতে রয়েছে প্রচুর নারকেল, কেয়া, ঝাউ, বাঁশ ইত্যাদি গাছ। এছাড়া পর্যটন কুটিরগুলিতে লাগানো হয়েছ বিভিন্ন ধরনের মূল ভূখণ্ডের গাছ। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্বিপাক এখন পর্যন্ত এই দ্বীপে আঘাত হানে নি। এই বিচারে দ্বীপটি বসবাসের জন্য নিরাপদ। তবে দ্বীপের সামুদ্রিক মাছ, নারকেলের মতো কিছু পণ্য ছাড়া সবই বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আমদানি করতে হয়। এই দ্বীপের সাথে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ রক্ষিত হয়- সামুদ্রিক ট্রলার এবং কিছু ছোটো মাপের জাহাজ দ্বারা।

পেশা:
স্থানীয় লোকদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। কিছু কৃষক পরিবার এখানে ধান, ডাল, নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ইত্যাদি এই দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। এ ছাড়া পর্যটন শিল্পের সাথে এই দ্বীপের বহু স্থানীয় মানুষ জড়িত রয়েছে।


সূত্র :
http://teknaf.coxsbazar.gov.bd

http://en.wikipedia.org/wiki/St._Martin's_Island