কীর্তন
বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা। সংস্কৃত
কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ,
স্তবন। এই অর্থের সাথে বাংলা গানের কীর্তন-এর ভাবের সবিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সাঙ্গীতিক পরিভাষায় কীর্তন যে
কোনো বিষয়ের গুণকীর্তন নয়। মূলত এর সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে হিন্দু পৌরাণিক দেবতা
বিষ্ণু'র অবতার
কৃষ্ণ
এবং
রাধার উপখ্যান। উল্লেখ্য,
কৃষ্ণ ছিলেন
বিষ্ণুর
দ্বাপর
যুগের প্রথম অবতার এবং তাঁর দশম অবতারের অষ্টম অবতার।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে-
ভোজবংশীয়
কংস
নামক এক
অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা
ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে,
ব্রহ্মা
সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে
বিষ্ণু'র
আরাধনা শুরু করেন।
বিষ্ণু
সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে,
তিনি
বসুদেবের ঔরসে
দেবকীর
গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন।
কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল।
তাঁর সহযোগী হলেন
বলরাম, তাঁর প্রতীক হলো সাদা চুল। এই সূত্রে
ববসুদেবের ঔরসে
দেবকীর
অষ্টম গর্ভে
কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল।
পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে,
গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ থেকে
রাধার উৎপত্তি হয়েছিল।
জন্মের পর পরই তিনি
কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন।
তিনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন।
এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি
গোপের জন্ম হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- একবার
বিষ্ণু
রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
ফলে তাঁর ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়।
রাধা
কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন।
রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান।
তিনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।
ভাবের বিচারে কীর্তন গান হলো- সুর-তাল সহযোগে কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর দশম অবতারের গুণকথন বা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর লীলা অনুধাবনের চেষ্টা। পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারার আদি উৎস হিসাবে ধরা হয়, সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দম্। এই আখ্যানকাব্যে যে পদগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর সাথে রাগ-তালের নাম পাওয়া যায়। তবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ রচিত এই গ্রন্থের পদগুলোর গীতরীতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না। এরপর একই ধারায় কীর্তনের সূচনা ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মাধ্যমে। এর ভাষাকে মধ্যযুগীয় বাংলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থটি অনেকাংশই গীতগোবিন্দম্ দ্বারা প্রভাবিত। এরপর বা এর কাছাকাছি সময়ে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমুখ পদকর্তারা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলাকে উপজীব্য করে পদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই পদগুলো গীতগোবিন্দম্ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মতো কোনো অখণ্ড আখ্যান-কাব্য হিসাবে গ্রথিত হয় নি। এ সকল পদের সুর হারিয়ে গেছে।
বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর সূত্রে বঙ্গদেশের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক এক ধরনের গান। কালক্রমে এই গানের সাধারণ নাম হয়ে ছিল কীর্তন। এই গানের চর্চা বৈষ্ণবদের অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে প্রচলিত ছিল। সে সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠী ক্ষুদ্রাকার একটি গোষ্ঠী হিসেবে নদীয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এঁরা মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কীর্তন গান করতেন।
লীলাকীর্তন:
কীর্তনের নানা প্রকরণের ভিতরে লীলাকীর্তন সর্বপ্রাচীন বলে মান্য করা হয়। মূলত
বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেমকে বিষ্ণু'র লীলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই
লীলাকে গানের ভিতর দিয়ে উপস্থাপনই হলো লীলা কীর্তন বলা হয়। এক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের
লীলার কাহিনির ধারাক্রম অনুসরণ না করে, পৃথক পৃথক গান হিসেবে পরিবেশন করা হয়।
লীলাকীর্তনের আসরে বিভিন্ন শিল্পীরা ইচ্ছা মতো গান পরিবেশন করে থাকেন। ফলে
লীলাকীর্তনের আসর হয় অনেকটা কীর্তনের বিচিত্রানুষ্ঠান। শ্রীচতন্যের আবির্ভাবে
পূর্বে এই কীর্তন হতো মূলত কীর্তনের আখড়াতে। এই বিচারে বলা যায়, এই কীর্তনকে আখড়াই
কীর্তনও বলা যায়।
লীলাকীর্তনে শুরুর দিকে কীর্তনের সুরে লোকসুরের প্রভাব ছিল। কালক্রমে এর সাথে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর ও তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। সুর তালের বৈচিত্র্যর
সূত্রে লীলাকীর্তনে যুক্ত হয়েছিল তাল ফেরতা এবং নানাধরনের শাস্ত্রীয় তাল। একতাল,
ঝাঁপতালের মতো প্রথাগত শাস্ত্রীয় তালের পাশাপাশি লোফা, দশকোশীর মতো জটিল তালের
প্রয়োগ শুরু হয়েছিল এবং এখনও তা চলছে।
পালা-কীর্তন: লীলাকীর্তনের শুরুর দিকে আখ্যানভিত্তিক ঝুমুর গানের চর্চা শুরু হয়েছিল। একই ধারায় পালকীর্তনে শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকৃর্তনের আমলেই পালা-কীর্তনের ধারাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। পালা-কীর্তনে কাহিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে গানে গানে পরিবেশন করা হয়। এতে শিল্পীরা গানের পাশাপাশি অভিনয় করে থাকেন। মূলত পালাকীর্তন গড়ে ওঠে বহু লীলাকীর্তনে সমাহারে।
পালা-কীর্তন দলগত পরিবেশনা। তাই এর একজন পরিচালক থাকে। এদেরকে বলা হয় অধিকারী। প্রথাগতভাবে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ভেঙেই অধিকারীরা নিজেদের মতো করে পালা সাজাতেন। এদের প্রচলিত লীলাকীর্তনের পাশাপাশি নিজেদের রচিত গান যুক্ত করতেন। অনেক সময় প্রথাগত পালাকীর্তনের ধারার সাথে নিজেদের ভাবনা থেকে নতুন আঙ্গিকের কোনো অধ্যায় যুক্ত করতেন। এরূপ একটি অধ্যায় ছিল 'কলঙ্কভঞ্জন'। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে পালাকীর্তনে পৃথকভাবে একটি অধ্যায় ব্যবহৃত হতো। কৃষ্ণের সাথে প্রণয়, কলহ, মান-অভিমানের সূত্রে কলঙ্ক রটতে পারে, এই কলঙ্কমোচনের দায় গায়েন নিজেই গানে গানে মোচন করতেন। কখনো অতিরিক্ত কাহিনিও যুক্ত করতেন। কলঙ্কভঞ্জনের এই বিষয়টি অনেক সময় সেকালের কৃষ্ণবিষয়ক পালাগান বা কবি গানেও ব্যবহৃত হতো।
পালকীরতন পরিবেশনায় কিছু শৃঙ্খলা মান হয়। মূলত
মূল পালা-কীর্তন আরম্ভের শুরুতে কিছু বিশেষ গান বা
লীলাকীর্তন ও পালাকীর্তনের পর কীর্তনে নব্যধারা যুক্ত হয়েছিল নাম-কীর্তন।
নাম-কীর্তন:
১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলার বৈষ্ণবদের ভিতরে লীলা কীর্তনের চর্চা ছিল।
১৫০০খ্রিষ্টাব্দের দিকে নদীয়ায়
অদ্বৈতাচার্য,
যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতরা বৈষ্ণবপন্থীরা নিয়মিত আখড়াই লীলাকীর্তনের চর্চা
করতেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
শ্রীচৈতন্য
এই বৈষ্ণবগোষ্ঠীর অন্যতম সদ্স্য হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন।
তিনিই প্রচলন করেছিলেন নাক-কীর্তন।
শ্রীচৈতন্য
বিষ্ণু বা কৃষ্ণের
আরাধনার সহজতর উপায় হিসাবে, সুর ও ছন্দে এঁদের নাম ক্রমাগত উচ্চারণের রীতি
প্রচলন করেন। একে বলা হয় সংকীর্তন।
শ্রীচৈতন্য
তাঁর ভক্তদের নিয়ে নগর পরিক্রমা করতেন। সে সময়ে এই কীর্তনকে বলা হতো 'নগর-কীর্তন'।
এই সংকীর্তন বা নগর-কীর্তনে- হরে (বিষ্ণুর অপর
নাম) এবং কৃষ্ণ এব রাম (বিষ্ণুর অবতার) নাম ৩টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার মধ্য এই
কীর্তনের যে ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল, তার সাধারণ নাম 'নাম-কীর্তন। নাম-কীর্তনের
রূপটি হলো-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে
মূলত শ্রীচৈতন্য সেকালের কীর্তনের আদলে উল্লেখিত পদবিন্যাসে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের প্রয়াণের পর, বৈষ্ণবরা ধর্মীয় বিশ্বাসে আরাধনার অংশ হিসেবে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। কালক্রমে এঁরা নাম-কীর্তনের সময়কে দীর্ঘতর করে, শুরু করেছিলেন প্রহরব্যাপী (তিন ঘন্টায় এক প্রহর) আয়োজন। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল চতুঃপ্রহর, অষ্টপ্রহরের নামকীর্তন। প্রহরভিভিত্তিক নামকীর্তনে শুধু জপমন্ত্রের সাথে কিছু আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত করা হয়েছিল। যেমন- চতুঃপ্রহর, অষ্টপ্রহরের কীর্তনে শুরু হতো দিবা প্রথম প্রহরের শুরুতে অর্থাৎ ভোর ৬টা নাগাদ। এই সময় নাম-কীর্তনের জন্য প্রথম অধিবাস করা হয়। অধিবাসে মূলত কিছু মাঙ্গলিক উপকরণ দিয়ে নামকীর্তনের স্থান এবং কীর্তন শিল্পীদের সংস্কার করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়- মৃ্ত্তিকা, গন্ধদ্রব্য, শিলা, ধান, দুর্বা, ফুল, ফল, দধি, ঘি স্বস্তিক (চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি গোলা), সিঁদুর ইত্যাদি। অধিবাসে পর, কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ঘট স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় নামকীর্তন। এই নামকীর্তন বিরতীহীনভাবে চতঃপ্রহর বা অষ্টপ্রহর।
লীলাকীর্তন নাম-কীর্তনের বিবর্তনের ধারা
গীতগোবিন্দম্-এর সূত্রে লীলাকীর্তনের যে ধারার সূচনা
হয়েছিল, চৈতন্যদেবের সময় নামকীর্তনের ধাক্কায় তার অনেকাংশই ম্লান হয়ে
গিয়েছিল নদীয়া অঞ্চলে কমে গিয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নাম-কীর্তনের পাশাপাশি লীলা-কীর্তনের চর্চা
অব্যাহত ছিল।
আঞ্চলিকতার প্রভাবে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লীলা-কীর্তন আলাদা আলাদা
বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তবে এর সবচেয়ে চর্চা হয়েছে- উত্তরবঙ্গ, বীরভূম,
ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সংলগ্ন বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসহ মেদিনীপুর, নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে।
আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি
হয়েছিল। পরে শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাগুলো পরিপুষ্ট হয়েছিল। নিতান্তই ছোটো খাটো
ধারাগুলো কালক্রমে হারিয়ে গেলেও কিছু ধারা এখনও অল্প-বিস্তর চর্চিত হয়ে
থাকে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য
ধারাগুলো হলো- গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী, ঝাড়খণ্ডী এবং ঢপ্।
গড়ানহাটি ধারা :
খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী জেলার গড়েরহাট বা গড়েনহাটি পরগণার পদকর্তা নরোত্তম দাস
এই
বিশেষ ধরনের কীর্তনের ধারা প্রবর্তন করেন। তবে
নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে এই ঘরানার কীর্তনের
জনপ্রিয় ছিল।
এই ধারায় মূল
লীলা-কীর্তনের পূর্বে 'গৌরচন্দ্রিকা' নামক প্রারম্ভিক গান গাওয়ার রীতি প্রচলন করেন।
নরোত্তম দাস ধ্রুপদ গানের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন। এই কারণে তাঁর গানে
ধ্রুপদের প্রভাবটা বেশি ছিল।
এই ধারার কীর্তনে ধ্রুপদের মতো প্রথমে স্বরালাপ করা হয়ে থাকে। এই আলাপ শেষে নিবদ্ধ গান
পরিবেশন করা হয়। ধ্রুপদের মতো এই কীর্তনে চারটি তুক রয়েছে। এগুলোকে বলা হয়-
উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ।
মূলত নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্যরা এই ঘরানার কীর্তন গাইতেন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে এই ধারা। হাতে গোনা কিছু
দক্ষ কীর্তনিয়া গরানহাটি ঘরানার গানের নমুনা আসরে উপস্থাপন করলেও ওই ঘরানার
কীর্তন গাওয়ার শিল্পী দ্রুত কমে আসছে।
মনোহরশাহী :
চৈতন্যদের সমসাময়িক কালে বর্ধমান
জেলার মনোহরশাহী পরগণার শ্রীখণ্ডে কীর্তনের একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন
জ্ঞানদাস মনোহর। এই ধারাটি
'মনোহরশাহী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই ধারাকে যেসব প্রখ্যাত কীর্তনীয়ারা সমৃদ্ধ করেছিলেন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন– নরহরি সরকার, রঘুনন্দন আচার্য, কবি
লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ প্রমুখ। এই কীর্তনে খেয়ালের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে এর সাথে
মিশ্রিত হয়েছিল আঞ্চলিক লোকধারার সুর। এর একটি ভিন্ন রূপ
ছিল। এর নাম ছিল ময়নাডাল ঘরানা
তবে এই ঘরানার কীর্তন বরতমানে
শোনা যায় না।
রেনেটি : খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বর্ধমান জেলার রাণীহাটি পরগণার কীর্তনের এই ধারটি বিকশিত হয়েছিল। এই অঞ্চলের বিপ্রদাস ঘোষ কীর্তনকে টপ্পার মতো করে পরিবেশন করার রীতি প্রচলন করেন। টপ্পা অঙ্গের গায়নরীতি যাঁরা পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে কীর্তনের এই ধারাটি বিশেষভাবে আদৃত ছিল। এই ধারাটি রাণীহাটী ধারা হিসাবে প্রথমদিকে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময় এই নামটি লোকমুখে ধারাটি 'রেনেটি' নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এই ধারাটিই কলকাতা অঞ্চলে আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
মন্দারিণী:
হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার পশ্চিমের মন্দারন অঞ্চলে এই ধারাটির সৃষ্টি।
মন্দারণ অঞ্চলের চর্চিত কীর্তন ধারাটি 'মন্দারিণী' নামে
অভিহিত হয়ে থাকে। বংশীবদন নামক প্রখ্যাত কীর্তনীয়া এই ধারাটির প্রবর্তন করেন। এই
গানে ঠুংরির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে
মূল ধরনটি পাঁচালী ও মঙ্গলগানের সুরের মিশ্রণে এই ঢং
গড়ে উঠেছিল।
ঝাড়খণ্ডী : শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য গোকুলানন্দ ষোড়শ শতকের শেষে এই
কীর্তন ধারার প্রবর্তন করেন। ঝাড়খণ্ডে এই কীর্তনের উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারাটি
ঝাড়খণ্ডী
নামে অভিহিত হয়ে থাকে। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের লোকায়ত সুরাশ্রয়ী ও
বাণীশৈলী দ্বারা এই ধারা পুষ্ট হয়েছিল। চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে এই কীর্তনের
নাম পাওয়া যায়। কথিত আছে চৈতন্যদেব এই পথে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। এই ধারায়
ঝাড়খণ্ড-এর ঘরনার কীর্তনে ঝুমুরগানের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা
যায়। বর্তমানে এই ধারার কীর্তনের ব্যাপক চল নেই।
ঢপকীর্তন: খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে ঢপ্কীর্তন নামে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়। এই ধারার সূচনা হয়েছিল কলকাতায়। এই ধারার গুরু হিসাবে মান্য করা হয় রাধামোহন ঠাকুর-কে। নতুন ধারার এই কীর্তনে বৈঠকি-মেজাজে কোনো না কোনো রাগের আশ্রয়ে সুরবিন্যাস করা হতো। গানের মাঝে মাঝে কথকতার ভঙ্গিতে কিছু বাক্য ব্যবহার রীতিও ক্রমে ক্রমে এই কীর্তনের অংশে পরিণত হয়। যেমন- রাধা কহিতেছেন, কৃষ্ণ কহিলেন ইত্যাদি। এছাড়া এই কীর্তনে আঞ্চলিক পালাগানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সেকালের কীর্তনীয়রা এই কীর্তনে বাউলের সুরভঙ্গিমা অত্যন্ত কুশলতার সাথে ব্যবহার করতেন। বৈঠকি আসরে ঢপকীর্তনে অনেক সময় খোলকর্তাল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম সহযোগে রাগভিত্তিক সম্মিলিত বাদ্য পরিবেশন হতো। কথকতার নাট্যকীয়তা, বাদ্যযন্ত্রের অনুসঙ্গ, শিল্পীদের লীলায়িত নৃত্য ইত্যাদি মিলে ঢপ্কীর্তন গ্রাম বাংলায় যাত্রাগানের মতও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এক সময়। মধুসূদন কিন্নর বা মধুকান (১২২৫-১২৭৫ বঙ্গাব্দে) নামক যশোহর জেলার জনৈক কীর্তনীয় এই কীর্তনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অনেকের ধারণা, ঢপ্কীর্তন নামটি মধুসূদন কানের দেওয়া। পরবর্তী সময়ে এই ধারাকে ঐতিহ্যগত একটি ধারায় পরিণত করেন রূপচাঁদ পক্ষী, লোচন দাস, দ্বারিক দাস, শ্রীরাম দাস, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, দাশরথী রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পান্নাবাই, পটলবাই, ছাপান্ন ছুরী কমল ঝরিয়া, ললিতা বৈষ্ণবী প্রমুখেরা। ঢপ্কীর্তনে ব্যবহৃত হত লোফা, ঝাঁপ, চঞ্চুপুট, আদ্ধা প্রভৃতি তাল।
কীর্তনে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র
কীর্তনগানের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র ছিল শ্রীখোল ও করতাল ব্যবহৃত হয়। অনুষঙ্গী
সুরযন্ত্র হিসেবে ছিল বাঁশি। ইংরেজ শাসনমালে
ইউরোপীয় যন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবহার শুরু হয়েছে।
কীর্তনাঙ্গ: বাংলা কাব্য ও সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা হলো মঙ্গলকাব্য। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের কবিরা চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গলের মাধ্যমে কীর্তনের রস পরিবেশন করতেন বটে, তাতে মূলকীর্তনের ধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত ছিলেন। মধ্যযুগের শেষে এসে বাংলা গান কীর্তন দ্বারা দুই ভাবে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এর একটি ধারায় মূল কীর্তনীয়ার কীর্তনের আদর্শ ধরে রেখে নতুন নতুন কীর্তন সৃষ্টি করেছেন। অন্য ধারায়, কীর্তনের সুরশৈলী অনুসরণে অন্য ধরনের গান রচনা করেছেন। কীর্তনের আদলে সৃষ্ট গানকে বলা হয় কীর্তনাঙ্গের গান।
বর্তমানে ভারতীতের পুরীধাম ও বাংলাভাষাভষী
অঞ্চলে প্রচলন সর্বাধিক। কীর্তিনীয়াদের মধ্যে প্রাচীনকালে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, ব্রহ্ম
হরিদাস, শ্রী মহাপ্রভু, শ্রীবাস পণ্ডিত সবিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। শ্রীপুরীধামে
কীর্তনীয়াগনের মধ্যে স্বরূপ দামোদার, দামোদার পণ্ডিত, শ্রী গোবিন্দ ঘোষ, বল্লভ সেন,
ছোট হরিদাস বিখ্যাত। বঙ্গের কীর্তনীয়াদের মধ্যে ময়নাডাল, শ্রী নিবাস আচার্য,
সরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রী শামানন্দ, রসিক দাস, গনেশ দাস, নন্দ কিশোর দাস, রাধাশ্যাম
দাস, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, রাধারানী , রথীন ঘোষ, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিদাস কর, ব্রজেন
সেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
কীর্তনের রাগ ও রস :
কীর্তণে রাগাশ্রয়ী রূপ থাকলেও রাগরূপটি
প্রাধান্য পায় না। মূলত কীর্তনে রাগের ছায়া বা কাঠামো পাওয়া যায় মাত্র। ওই কাঠামোর
উপর ভিত্তি করে কীর্তনের মূল ভাবকে প্রকাশ করা হয়। কিছু বিশেষ রাগের উপর কীর্তন গান
নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। এই রাগগুলো হলো- তোড়ি, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী
ইত্যাদি।
কীর্তনে ভাবের কারণে বিভিন্ন ভাবে প্রায় সকল স্বরই ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ
রাগের বিচারে কীর্তনের সুর অশুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রসের বিচারে তার মূল্য
অনন্যসাধারণ।
কীর্তনগুরুরা কীর্তনে ৬৪-রসের কথা বলে থাকেন। এই রস ফুটিয়ে তোলা হয়, সুরে নিবদ্ধ
কথায় বা আখরে। কীর্তনের আসরে রস সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দোহার-এর দল সঙ্গ দেয়।
কীর্তনের তাল : কীর্তনে প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন ধরনের
তাল ব্যবহার করা হয়। এই সব তাল-বাদনে শ্রীখোলের ও মন্দিরা ব্যবহার করা হয়। কীর্তনের
ভাব বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন তাল ব্যবহার করা হয়। যেমন- কাহারবা, দাদরা,
একতাল, ছোট লোফা, বড় লোফা, রূপক, যৎ, তেওড়া, দোঠুকী, মধ্যম দশকোশী, দশকোশী,
দাশপেড়ে, শশীশেখর, বীরবিক্রম ইত্যাদি।
কীর্তনের অঙ্গ : কীর্তন বিচিত্রভাবে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপিত করা হয়।
উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য হিসাবে কীর্তনের ভাবগুলোকে অঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
কীর্তনগুরুরা কীর্তনের অঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো-
১. কথা : কীর্তনের বাণীকে
সাধারণভাবে কথা বলা হয়। কথা হলো লীলা-কীর্তনের ভিত্তি। এই কারণে কথা-কে
অনেক সময় মূল কীর্তন বলা হয়। ২. দোঁহা : কীর্তনের এই অঙ্গে কীর্তনের বিষয়কে আবৃত্তি করা হয়। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনে বৈচিত্র্যতা প্রকাশ পায়। এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীর্তন পরিবেশনের সময়, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়। ৩. আঁখর : কীর্তনের ভাবকে সহজভাবে সুর-তাল সহযোগে ব্যাখ্যা করার একটি প্রক্রিয়া। মূলত কীর্তনিয়া এই অঙ্গে তাঁর নিজের অভিমত ব্যাখ্যা সহযোগে জানিয়ে দেন। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনীয়া তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন। ৪. তুক : কীর্তনের কাব্যগীতি অংশ হলো তুক। এই অঙ্গে অনুপ্রাসযুক্ত, ছন্দোময়, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ পরিবেষণ করা হয়। ৫. ছুট : কীর্তনের কোনো পদকে সম্পূর্ণ পরিবেশন না করে, ছোটো ছোটো ছন্দে লীলায়িত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়। এই অঙ্গটির মধ্য দিয়ে কীর্তনীয়ার ব্যক্তি পারঙ্গমতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। এছাড়া একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ কোনো কোনো কীর্তনের আসরে ঝুমুর নামক একটি অঙ্গ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুমুরের চটুল ছন্দে, নেচে নেচে কীর্তন পরিবেশন করা হয়। সাধারণত এই অঙ্গ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কীর্তন পালা শেষ করা হয়। |
তথ্যসূত্র :
বাংলাপেডিয়া। দ্বিতীয় খণ্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। চৈত্র
১৪০৯/মার্চ ২০০৩।
রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান। স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়। জুলাই ২০০৯।