কীর্তন।
বাংলা ধর্মসঙ্গীতের ধারায় বৈষ্ণব সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা।

মূলত বিষয়াঙ্গ ও সুরাঙ্গের সুনির্দিষ্ট ধারায় পুষ্ট বৈষ্ণবসঙ্গীত হলো- কীর্তন।
সংস্কৃত কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। এই বিচারে যে কোনো বিষয়ের গুণকথনই কীর্তন বলা যায়। বাস্তবে কীর্তন বলতে বিষ্ণু ও রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানকেই কীর্তন বলা হয়। কীর্তনের ক্ষেত্রে এই বিষয়াঙ্গ সুনির্দিষ্ট। সুরাঙ্গের বিচারে কীর্তনের নিজস্ব সুরশৈলী রয়েছে। যেমন নজরুল ইসলামের রচিত- 'ব্রজগোপী খেলে হোরি' গানটি রাধা-কৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু সুরের বিচারে কীর্তনাঙ্গ নয় বলে, তাকে কীর্তন বলা যাবে না।

বৈদিক, মহাকাব্যিক এবং পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে, বঙ্গদেশে বিষয়াঙ্গ ও সুরাঙ্গের বিচারে বৈষ্ণব-সঙ্গীত হয়ে কীর্তন হয়ে উঠছিল, কবি
জয়দেবের রচিত 'গীতগোবিন্দম্'-এর  হাত ধরে। যতদূর জানা যায়, জয়দেব ছিলেন বাংলা রাজা লক্ষণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম। উল্লেখ্য অপর চারজন রত্ন ছিলেন− গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ীউমাপতি ধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপণ্ডিত ছিলেন। এই গীতগোবিন্দের পদগুলো সাথে পাওয়া যায়, রাগ-তালের নাম পাওয়া যায়। তবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ রচিত  এই গ্রন্থের পদগুলোর গীতরীতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না।

১২০৪-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে সংঘটিত '
বাংলা গানের অন্ধকারযুগ'-এই কাব্যের খ্যাতি বঙ্গদেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ধারায় মৈথিলী-বাংলার কবি বিদ্যাপতি পদাবলী রচনা করেছিলেন। মূলত বাংলা বৈষ্ণব সঙ্গীতের পদাবলীর ধারার সূত্রপাত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায়, রায়, বিদ্যাপতি'র পরবর্তী কবি হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসকে ধরা হয়। আনুমানিক ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর আসল নাম ছিল অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু, গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবির নাম পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণচরিতের রচয়িতা।

বড়ুচণ্ডীদাসের দাসের
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর সূত্রে বঙ্গদেশের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক এক ধরনের গান। কালক্রমে এই গানের সাধারণ নাম হয়ে ছিল কীর্তন। এই গানের চর্চা বৈষ্ণবদের অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে প্রচলিত ছিল। সে সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠী ক্ষুদ্রাকার একটি গোষ্ঠী হিসেবে নদীয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এঁরা মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কীর্তন গান করতেন।

১৩৫০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে লীলাকীর্তন দুটি ধারায় বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এই ধারা দুটি হলো- বিভিন্ন পদকর্তাদের দ্বারা রচিত বিচ্ছিন্নভাবে রচিত পদাবলী এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদলে রচিত অভিনয়যোগ্য পালাকীর্তন। মূলত পদাবলী কীর্তন এবং পালাকীর্তন ছিল  শৃঙ্গারধর্মী গান।

 

লীলাকীর্তন:
কীর্তনের নানা প্রকরণের ভিতরে লীলাকীর্তন সর্বপ্রাচীন বলে মান্য করা হয়। মূলত বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেমকে বিষ্ণু'র লীলা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই লীলাকে গানের ভিতর দিয়ে উপস্থাপনই হলো লীলা কীর্তন বলা হয়। এক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের লীলার কাহিনির ধারাক্রম অনুসরণ না করে, পৃথক পৃথক গান হিসেবে পরিবেশন করা হয়। লীলাকীর্তনের আসরে বিভিন্ন শিল্পীরা ইচ্ছা মতো গান পরিবেশন করে থাকেন। ফলে লীলাকীর্তনের আসর হয় অনেকটা কীর্তনের বিচিত্রানুষ্ঠান। শ্রীচতন্যের আবির্ভাবে পূর্বে এই কীর্তন হতো মূলত কীর্তনের আখড়াতে। এই বিচারে বলা যায়, এই কীর্তনকে আখড়াই কীর্তনও বলা যায়।

লীলাকীর্তনে শুরুর দিকে কীর্তনের সুরে লোকসুরের প্রভাব ছিল। কালক্রমে এর সাথে শাস্ত্রীয়  সঙ্গীতের সুর ও তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। সুর তালের বৈচিত্র্যর সূত্রে লীলাকীর্তনে যুক্ত হয়েছিল তাল ফেরতা এবং নানাধরনের শাস্ত্রীয় তাল। একতাল, ঝাঁপতালের মতো প্রথাগত শাস্ত্রীয় তালের পাশাপাশি লোফা, দশকোশীর মতো জটিল তালের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল এবং এখনও তা চলছে।

 

পালা-কীর্তন: লীলাকীর্তনের শুরুর দিকে আখ্যানভিত্তিক ঝুমুর গানের চর্চা শুরু হয়েছিল। একই ধারায় পালকীর্তনে শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকৃর্তনের আমলেই পালা-কীর্তনের ধারাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। পালা-কীর্তনে কাহিনি রাধাকৃষ্ণের লীলাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে গানে গানে পরিবেশন করা হয়। এতে শিল্পীরা গানের পাশাপাশি অভিনয় করে থাকেন। মূলত পালাকীর্তন গড়ে ওঠে বহু লীলাকীর্তনে সমাহারে।

 

পালা-কীর্তন দলগত পরিবেশনা। তাই এর একজন পরিচালক থাকে। এদেরকে বলা হয় অধিকারী। প্রথাগতভাবে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ভেঙেই অধিকারীরা নিজেদের মতো করে পালা সাজাতেন। এদের প্রচলিত লীলাকীর্তনের পাশাপাশি নিজেদের রচিত গান যুক্ত করতেন। অনেক সময় প্রথাগত পালাকীর্তনের ধারার সাথে নিজেদের ভাবনা থেকে নতুন আঙ্গিকের কোনো অধ্যায় যুক্ত করতেন। এরূপ একটি অধ্যায় ছিল 'কলঙ্কভঞ্জন'।  অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে পালাকীর্তনে পৃথকভাবে একটি অধ্যায় ব্যবহৃত হতো। কৃষ্ণের সাথে প্রণয়, কলহ, মান-অভিমানের সূত্রে কলঙ্ক রটতে পারে, এই কলঙ্কমোচনের দায় গায়েন নিজেই গানে গানে মোচন করতেন। কখনো অতিরিক্ত কাহিনিও যুক্ত করতেন। কলঙ্কভঞ্জনের এই বিষয়টি অনেক সময় সেকালের কৃষ্ণবিষয়ক পালাগান বা কবি গানেও ব্যবহৃত হতো।

 

পদাবলী ও পালাকীর্তনের ধারাকে ভক্তি রসে সিক্ত করেছিলেন শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি ভক্তিকে নামজপের সূত্রে প্রণয়ন করেছিলেন নামকীর্তন।

 

নাম-কীর্তন: ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলার বৈষ্ণবদের ভিতরে লীলা কীর্তনের চর্চা ছিল। ১৫০০খ্রিষ্টাব্দের দিকে নদীয়ায় অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতরা বৈষ্ণবপন্থীরা নিয়মিত আখড়াই লীলাকীর্তনের চর্চা করতেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শ্রীচৈতন্য এই বৈষ্ণবগোষ্ঠীর অন্যতম সদ্স্য হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। তিনিই প্রচলন করেছিলেন নাম-কীর্তন।

শ্রীচৈতন্বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরাধনার সহজতর  উপায় হিসাবে, সুর ও ছন্দে এঁদের নাম ক্রমাগত উচ্চারণের রীতি প্রচলন করেন। একে বলা হয় সংকীর্তন। শ্রীচৈতন্য তাঁর ভক্তদের নিয়ে নগর পরিক্রমা করতেন। সে সময়ে এই কীর্তনকে বলা হতো 'নগর-কীর্তন'।

এই সংকীর্তন বা নগর-কীর্তনে- হরে (বিষ্ণুর অপর নাম) এবং কৃষ্ণ এব রাম (বিষ্ণুর অবতার) নাম ৩টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার মধ্য এই কীর্তনের যে ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল, তার সাধারণ নাম 'নাম-কীর্তন। নাম-কীর্তনের
রূপটি হলো-

 

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে

মূলত শ্রীচৈতন্য সেকালের কীর্তনের আদলে উল্লেখিত পদবিন্যাসে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের প্রয়াণের পর, বৈষ্ণবরা ধর্মীয় বিশ্বাসে আরাধনার অংশ হিসেবে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। কালক্রমে এঁরা নাম-কীর্তনের সময়কে দীর্ঘতর করে, শুরু করেছিলেন প্রহরব্যাপী (তিন ঘন্টায় এক প্রহর) আয়োজন। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল চতুঃপ্রহর, অষ্টপ্রহরের নামকীর্তন। প্রহরভিভিত্তিক নামকীর্তনে শুধু জপমন্ত্রের সাথে কিছু আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত করা হয়েছিল। যেমন- চতুঃপ্রহর, অষ্টপ্রহরের কীর্তনে শুরু হতো দিবা প্রথম প্রহরের শুরুতে অর্থাৎ ভোর ৬টা নাগাদ। এই সময় নাম-কীর্তনের জন্য প্রথম অধিবাস করা হয়। অধিবাসে মূলত কিছু মাঙ্গলিক উপকরণ দিয়ে নামকীর্তনের স্থান এবং কীর্তন শিল্পীদের সংস্কার করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়- মৃ্ত্তিকা, গন্ধদ্রব্য, শিলা, ধান, দুর্বা, ফুল, ফল, দধি, ঘি স্বস্তিক (চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি গোলা), সিঁদুর ইত্যাদি। অধিবাসে পর, কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ঘট স্থাপন করা হয়। এরপর শুরু হয় নামকীর্তন। এই নামকীর্তন বিরতীহীনভাবে চতঃপ্রহর বা অষ্টপ্রহর।

 শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর পর, বহু পদকর্তা বাংলা পদাবলী কীর্তনকে সমৃদ্ধ করেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- জ্ঞানদাস (১৫২০/৩৫-?), নরোত্তম দাস (১৫৩১-১৬১১). গোবিন্দ দাস (
১৫৩৪/৩৭-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রমুখ।


লীলাকীর্তন নাম-কীর্তনের বিবর্তনের ধারা
গীতগোবিন্দম্-এর সূত্রে লীলাকীর্তনের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, চৈতন্যদেবের সময় নামকীর্তনের ধাক্কায় তার অনেকাংশই ম্লান হয়ে গিয়েছিল নদীয়া অঞ্চলে কমে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নাম-কীর্তনের পাশাপাশি লীলা-কীর্তনের চর্চা অব্যাহত ছিল। আঞ্চলিকতার প্রভাবে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লীলা-কীর্তন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তবে এর সবচেয়ে চর্চা হয়েছে- উত্তরবঙ্গ, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সংলগ্ন বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসহ মেদিনীপুর, নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাগুলো পরিপুষ্ট হয়েছিল। নিতান্তই ছোটো খাটো ধারাগুলো কালক্রমে হারিয়ে গেলেও কিছু ধারা এখনও অল্প-বিস্তর চর্চিত হয়ে থাকে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো- গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী, ঝাড়খণ্ডী এবং ঢপ্।

 

 

কীর্তনে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র
কীর্তনগানের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র ছিল শ্রীখোল ও করতাল ব্যবহৃত হয়। অনুষঙ্গী সুরযন্ত্র হিসেবে ছিল বাঁশি। ইংরেজ শাসনমালে ইউরোপীয় যন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

 

কীর্তনাঙ্গ: বাংলা কাব্য ও সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা হলো মঙ্গলকাব্য। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের কবিরা চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গলের মাধ্যমে কীর্তনের রস পরিবেশন করতেন বটে, তাতে মূলকীর্তনের ধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত ছিলেন। মধ্যযুগের শেষে এসে বাংলা গান কীর্তন দ্বারা দুই ভাবে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এর একটি ধারায় মূল কীর্তনীয়ার কীর্তনের আদর্শ ধরে রেখে নতুন নতুন কীর্তন সৃষ্টি করেছেন। অন্য ধারায়, কীর্তনের সুরশৈলী অনুসরণে অন্য ধরনের গান রচনা করেছেন। কীর্তনের আদলে সৃষ্ট গানকে বলা হয় কীর্তনাঙ্গের গান।

 

বর্তমানে ভারতীতের পুরীধাম ও বাংলাভাষাভষী অঞ্চলে প্রচলন সর্বাধিক। কীর্তিনীয়াদের মধ্যে প্রাচীনকালে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, ব্রহ্ম হরিদাস, শ্রী মহাপ্রভু, শ্রীবাস পণ্ডিত সবিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। শ্রীপুরীধামে কীর্তনীয়াগনের মধ্যে স্বরূপ দামোদার, দামোদার পণ্ডিত, শ্রী গোবিন্দ ঘোষ, বল্লভ সেন, ছোট হরিদাস বিখ্যাত। বঙ্গের কীর্তনীয়াদের মধ্যে ময়নাডাল, শ্রী নিবাস আচার্য, সরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রী শামানন্দ, রসিক দাস, গনেশ দাস, নন্দ কিশোর দাস, রাধাশ্যাম দাস, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, রাধারানী , রথীন ঘোষ, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিদাস কর, ব্রজেন সেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

 

কীর্তনের রাগ ও রস : কীর্তণে রাগাশ্রয়ী রূপ থাকলেও রাগরূপটি প্রাধান্য পায় না। মূলত কীর্তনে রাগের ছায়া বা কাঠামো পাওয়া যায় মাত্র। ওই কাঠামোর উপর ভিত্তি করে কীর্তনের মূল ভাবকে প্রকাশ করা হয়। কিছু বিশেষ রাগের উপর কীর্তন গান নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। এই রাগগুলো হলো- তোড়ি, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী ইত্যাদি। কীর্তনে ভাবের কারণে বিভিন্ন ভাবে প্রায় সকল স্বরই ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ রাগের বিচারে কীর্তনের সুর অশুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রসের বিচারে তার মূল্য অনন্যসাধারণ। কীর্তনগুরুরা কীর্তনে ৬৪-রসের কথা বলে থাকেন। এই রস ফুটিয়ে তোলা হয়, সুরে নিবদ্ধ কথায় বা আখরে। কীর্তনের আসরে রস সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দোহার-এর দল সঙ্গ দেয়।

কীর্তনের তাল : কীর্তনে প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন ধরনের তাল ব্যবহার করা হয়। এই সব তাল-বাদনে শ্রীখোলের ও মন্দিরা ব্যবহার করা হয়। কীর্তনের ভাব বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন তাল ব্যবহার করা হয়।

কীর্তানে কিছু তাল বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণভাবে এগুলোকে বলা হয় কীর্তনাঙ্গের তাল। এর প্রায় সকল তালই মাত্রা, লঘু, গুরু ও গতি, ছন্দ ইত্যাদির বিচারে নানা রকমের হয়। গুরু লঘুর বিচারে একই তালকে গুরু লওয়া বা লঘু লওয়া নামে অভিহিত করা হয়। কীর্তনে ব্যবহৃত তালগুলো বর্ণানুক্রমিক তালিকায় উপস্থাপন করা হলো।

যেমন- কাহারবা, দাদরা, একতাল, ছোট লোফা, বড় লোফা, রূপক, যৎ, তেওড়া, দোঠুকী, শশীশেখর, বীরবিক্রম ইত্যাদি।

কীর্তনের অঙ্গ : কীর্তন বিচিত্রভাবে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপিত করা হয়। উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য হিসাবে কীর্তনের ভাবগুলোকে অঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কীর্তনগুরুরা কীর্তনের অঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো-
 

  ১. কথা : কীর্তনের বাণীকে সাধারণভাবে কথা বলা হয়। কথা হলো লীলা-কীর্তনের ভিত্তি। এই কারণে কথা-কে অনেক সময় মূল কীর্তন বলা হয়।

২. দোঁহা : কীর্তনের এই অঙ্গে কীর্তনের বিষয়কে আবৃত্তি করা হয়। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনে বৈচিত্র্যতা প্রকাশ পায়। এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীর্তন পরিবেশনের সময়, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়।

৩. আঁখর : কীর্তনের ভাবকে সহজভাবে সুর-তাল সহযোগে ব্যাখ্যা করার একটি প্রক্রিয়া। মূলত কীর্তনিয়া এই অঙ্গে তাঁর নিজের অভিমত ব্যাখ্যা সহযোগে জানিয়ে দেন। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনীয়া তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন।

৪. তুক : কীর্তনের কাব্যগীতি অংশ হলো তুক। এই অঙ্গে অনুপ্রাসযুক্ত, ছন্দোময়, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ পরিবেষণ করা হয়।

৫. ছুট :
কীর্তনের কোনো পদকে সম্পূর্ণ পরিবেশন না করে, ছোটো ছোটো ছন্দে লীলায়িত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়। এই অঙ্গটির মধ্য দিয়ে কীর্তনীয়ার ব্যক্তি পারঙ্গমতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।

এছাড়া একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ কোনো কোনো কীর্তনের আসরে ঝুমুর নামক একটি অঙ্গ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুমুরের চটুল ছন্দে, নেচে নেচে  কীর্তন পরিবেশন করা হয়। সাধারণত এই অঙ্গ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কীর্তন পালা শেষ করা হয়।


তথ্যসূত্র :
বাংলাপেডিয়া। দ্বিতীয় খণ্ড। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। চৈত্র ১৪০৯/মার্চ ২০০৩।
রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান। স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়। জুলাই ২০০৯।