দ্রোণাচার্য
বানান্ বিশ্লেষণ: দ্+র্+ও+ণ+আ+চ্+আ+র্+য+অ
উচ্চারণ:
d̪ro.na.carɟ.ɟo (দ্রোণাচার্য)
শব্দ-উৎস: সংস্কৃত দোরণাচার্য> বাংলা দ্রোণাচার্য
পদ: বিশেষ্য
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | হিন্দু পৌরাণিক মানব | হিন্দু পৌরাণিক সত্তা | ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা | পৌরাণিক সত্তা | অতিপ্রাকৃতিক সত্তা | কাল্পনিক সত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | কর্মক্ষমতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্তা | সত্তা | }


হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে-
মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র ভরদ্বাজ একদিন গঙ্গাস্নানকালে প্রায়নগ্ন অবস্থায় অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে কামার্ত হন ঘৃতাচী মুনির ভয়ে পালিয়ে গেলে, ভরদ্বাজের অতি উত্তেজনায় শুক্রপাত হয় ভরদ্বাজ সেই স্খলিত শুক্র দ্রোণ নামে এক যজ্ঞীয় পাত্রে রক্ষা করেন সেই যজ্ঞীয় পাত্র থেকে যে পুত্র জন্মলাভ করেন, তিনিই দ্রোণ নামে পরিচিত হন এর অপরাপর নাম : কুম্ভজ, কুম্ভযোনি, কুম্ভসম্ভব।

দ্রোণ প্রাথমিকভাবে অস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন পিতা ভরদ্বাজের কাছে এরপর অগ্নিবেশ্য নামক ভরদ্বাজের শিষ্যও দ্রোণকে অস্ত্র প্রদান করেছিলেন ভরদ্বাজের মৃত্যুর পর ইনি আশ্রমে থেকেই তপস্যা করতে থাকেন এবং অচিরেই বেদ-বেদাঙ্গ অনুশীলন ও তপোনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর পাপ মোচন করেন এর কিছুদিন পর ইনি মহর্ষি শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে পিতৃ আজ্ঞায় বিবাহ করেন এঁদের পুত্রের নাম ছিল অশ্বত্থামা। এরপর ইনি পরশুরামের কাছে মহাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রপর্বতে যান এবং তাঁর কাছে প্রথমে ধনরত্ন প্রার্থনা করেন পরশুরাম বলেন, আমার সমস্ত ধনরত্ন ব্রাহ্মণদের ও পৃথিবী কশ্যপকে দান করেছি, নানারকম অস্ত্রশস্ত্র ও এই শরীর ছাড়া আমার আর কিছুই নেই এর মধ্যে আমার শরীর ছাড়া তোমার ইচ্ছামত জিনিস প্রার্থনা কর এরপর দ্রোণ তাঁর কাছে অস্ত্র প্রার্থনা করলে, পরশুরাম তাঁকে তাঁর সকল অস্ত্র প্রদান করেন

দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা কিছু ধনীপুত্রদের সাথে খেলা করতেন ধনীপুত্রদের দুধ খাওয়া দেখে অশ্বত্থামা দ্রোণের কাছে আবদার করলে, দ্রোণ বহুচেষ্টা করেও একটি দুগ্ধবতী গাভী সংগ্রহ করতে পারলেন না এই সময় ধনীপুত্ররা দুধ হিসাবে অশ্বত্থামাকে আটারগোলা পান করান এই দৃশ্য দেখে, দ্রোণ দুঃখিত মনে, তাঁর বাল্যসখা দ্রুপদের কাছে যাবার জন্য মনস্থির করেন।  উল্লেখ্য, দ্রুপদের পিতা পাঞ্চালরাজ পৃষত ভরদ্বাজের বন্ধু ছিলেন সেই সূত্রে দ্রুপদ ছিলেন দ্রোণের ক্রীড়াসঙ্গী দ্রুপদ দ্রোণকে শৈশবে বলেছিলেন যে, রাজ্যলাভ করলে তিনি দ্রোণকে অর্ধরাজ্য দান করবেন কালক্রমে পিতার মৃত্যুর পর দ্রুপদ রাজত্ব লাভ করেন দ্রোণ দ্রুপদের দরবারে এসে সখা সম্বোধন করায়, দ্রুপদ কঠোরভাবে এই বন্ধুত্বকে অস্বীকার করেন এবং দ্রোণকে অপমান করেন দ্রোণ অপমানিত অবস্থায় রাজদরবার ত্যাগ করে তাঁর শ্যালক কৃপাচার্যের আশ্রয়ে সংগোপনে বসবাস করতে লাগলেন এই সময় কৃপাচার্য কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু ছিলেন কৃপাচার্যের শিক্ষা প্রদানের পর দ্রোণ তাঁর নিজের সন্তান অশ্বত্থামা ও পঞ্চপাণ্ডবদের পৃথকভাবে অস্ত্র শিক্ষা দিতেন

একদিন কৌরব-পাণ্ডব বালকেরা নগরের বাইরে কিছু লৌহর গুলি নিয়ে খেলা করছিল হঠাৎ নিকটস্থ একটি কুয়ার ভিতর একটি গুলি পড়ে গেলে, বালকদের কেউই তা উদ্ধার করতে পারলো না এই সময় দ্রোণ ওই পথে যাচ্ছিলেন বালকরা দ্রোণকে উক্ত গুলিটি উদ্ধার করে দিতে বললে, দ্রোণ বালকদের তিরস্কার করে তাঁর নিজের হাতের আঙটিও উক্ত কুপের ভিতর ফেলে দিলেন তারপর আঙটি ও গুলি উদ্ধার করার প্রতীজ্ঞা করেন ইনি প্রথমে ঈষীকার (নল-তৃণ) সাহায্যে অপূর্ব কৌশলে গুলি উদ্ধার করেন পরে কূপের ভিতর বাণ নিক্ষেপ করে আঙটি উদ্ধার করেন এরপর বালকরা তাঁর পরিচয় জানার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, দ্রোণ বালকদের কাছে বলেন যে- ভীষ্মের কাছে তাঁর রূপ ও গুণ বর্ণনা করলেই, ভীষ্ম তাঁর পরিচয় পাবেন এরপর বালকরা ভীষ্মের কাছে দ্রোণের বর্ণনা দিলে, ভীষ্ম দ্রোণকে চিনতে পারেন এবং দ্রোণকে ডেকে এনে কৌরব-পাণ্ডব বালকদের অস্ত্র শিক্ষার ভার দেন

দ্রোণ কৌরব-পাণ্ডব বালকদের অস্ত্র শিক্ষার আগে বলেন যে- অস্ত্র শিক্ষার পরে তাঁর  একটি ইচ্ছা পূরণ করতে হবে এর উত্তরে একমাত্র অর্জুন সম্মতি প্রদান করেন সেই কারণে ইনি অর্জুনকে বিশেষভাবে শিক্ষা দান করেন এঁর কাছে একলব্য নামক একটি বালক শিক্ষা গ্রহণ করতে এলে, অস্পৃশ্য ম্লেচ্ছজাতির ছেলে বলে- ইনি তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দেন নি পরে দ্রোণকে অস্ত্রগুরু হিসাবে মেনে, একলব্য নির্জনে অস্ত্র-সাধনা করেন। ঘটনাক্রমে, বিষয়টি দ্রোণের কাছে প্রকাশিত হলে, ইনি গুরুদক্ষিণা হিসাবে একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুল দাবী করেন পরে একলব্য তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে দ্রোণকে গুরুদক্ষিণা হিসাবে দেন।      

অস্ত্রশিক্ষার শেষে দ্রোণ গুরুদক্ষিণা হিসাবে দ্রুপদকে বন্দী করে আনার কথা বলেন কৌরব-পাণ্ডবরা দ্রুপদকে বন্দী করার জন্য অগ্রসর হন কৌরবরা প্রথমে দ্রুপদের সৈন্যদের আক্রমণ করলে, দ্রুপদ তা প্রতিহত করেন পরে, পঞ্চপাণ্ডবের সাথে যুদ্ধে প্রচুর দ্রুপদ-সৈন্য নষ্ট হয় শেষ পর্যন্ত অর্জুনের সাথে একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর, দ্রুপদ আত্মসমর্পণ করেন পরে অর্জুন দ্রুপদকে বন্দী করে দ্রোণের কাছে নিয়ে আসেন এরপর দ্রোণ দ্রুপদকে পূর্বের অর্ধেক রাজ্যত্ব প্রদান করার অঙ্গীকারের কথা এবং বন্ধুত্ব অস্বীকার করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিলেন এরপর দ্রুপদকে ইনি অর্ধেক রাজত্ব দান করলেন দ্রুপদ এই বিধান মেনে নিজের অর্ধেক রাজত্বে ফিরে আসেন এরপর দ্রোণ তাঁর প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে ব্রহ্মশিরাঃ নামক অস্ত্র দান করেন এরপর দ্রোণ অর্জুনের কাছে আরও কিছু গুরুদক্ষিণা দাবী করলে, অর্জুন তাতে সম্মতি দেন দ্রোণ এবার বলেন,- হে অর্জুন, রণস্থলে তুমি আমার প্রতিযোদ্ধা হবে অর্জুন তাতেই সম্মতি প্রদান করেন এটাই ছিল অর্জুনের গুরুদক্ষিণা

এর কিছুদিন পর, দ্রুপদ দ্রোণকে হত্যা করার জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন এবং যজ্ঞ থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন নামক পুত্র লাভ করেন উল্লেখ্য এই যজ্ঞ থেকেই ইনি দ্রৌপদী নামক কন্যাও লাভ করেন কৌরবরা বিরাটরাজের গোধন হরণের জন্য তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, ইনি বৃহন্নলারূপী অর্জুনের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এই যুদ্ধে ইনি অর্জুনের কাছে পরাজিত হন এই যুদ্ধের ভিতর অশ্বত্থামা প্রবেশ করলে, অর্জুন অশ্বত্থামার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এই অবসরে দ্রোণ পালিয়ে যান

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি কৌরবদের পক্ষে যোগ দেন কুরুক্ষেত্রের সপ্তম দিনে দ্রোণ বিরাট পুত্র শঙ্খকে হত্যা করেন ভীষ্মের শরশয্যা গ্রহণের পর, যুদ্ধের একাদশ দিনে দ্রোণ কৌরব পক্ষে সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন এবং পঞ্চদশ দিন পর্যন্ত ইনি এই পদে আসীন ছিলেন এই দিনে ইনি পাঞ্চালরাজকুমার ও ব্যাঘ্রদত্তকে হত্যা করেন যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে ইনি সত্যজিত, শতানীক, দৃঢ়সেন প্রমুখ বীরগণকে পরাজিত ও হত্যা করেন এই দিনে দ্রোণাচার্য চক্রবুহ্য রচনা করেন ব্যূহ ভেদ করতে গিয়ে অভিমন্যু মৃতুবরণ করেন যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে ইনি বৃহত্ক্ষেত্র, ধৃষ্টকেতু, ক্ষত্রধর্মাকে হত্যা করেন পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধে ইনি বিরাটরাজকে হত্যা করেন স্বেচ্ছায় অস্ত্র ত্যাগ না করলে, এঁকে পরাজিত করা অসম্ভব জেনে, কৃষ্ণ অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করেন দ্রোণ এই কথা প্রথমে বিশ্বাস করেন নি পরে যুধিষ্ঠিরের কথায় বিশ্বাস করে ইনি অস্ত্র ত্যাগ করে, বিষ্ণুর ধ্যান করতে থাকেন এই সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর রথের উপর উঠে খড়গ দ্বারা শিরশ্ছেদ করেন