বাংলা ভাষার প্রাগৈতিহাসিক যুগ
(প্রাকৃতজন গোষ্ঠীর আদিকাল থেকে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত)

নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে
প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকা ইথিওপিয়া  অঞ্চলে। আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে আগত আদি নৃগোষ্ঠীকে বলা হয় নেগ্রিটো খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০০ বৎসর আগে বঙ্গদেশের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বসবাস করতো। এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠী। নেগ্রিটোদের সাথে  প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের রক্তের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল যে মিশ্র জাতি, ভাষাতাত্ত্বিকরা তাদের ভাষাকে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভাষার বিচারে তাই এদেরকে কখনো কখনো অস্ট্রিক জাতি বলা হয়। প্রাচীন ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে এই ভাষার মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে দেশী শব্দ হিসেবে যে সকল শব্দকে উল্লেখ করা হয়, তার একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের দুটি ভাষার শব্দাবলি। এই ভাষা দুটি হলো মুণ্ডারি এবং সাঁওতালি। সে সময়ের বাংলাদেশের মানুষের মূল ভাষাই ছিল এই দুই ভাষা কেন্দ্রিক।

বাংলা ভাষার পারিবারিক পরিচয়
প্রাগৈতিহাসিক ভাষা
প্রাগ্-ভাষা পরিবার : প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার
ভাষা পরিবার :
ইন্দো-ইউরোপিয়ান
ভাষা উপ-পরিবার :   ইন্দো-ইরানিয়া ভাষা
শাখা :  ভারতীয়-আর্য ভাষা
উপ-শাখা : পূর্বাঞ্চলীয় আর্য ভাষা
ভাষাগোষ্ঠী : বাংলা-অহমিয়া ভাষা
ভাষা সঙ্কেত

আইএসও ৬৩৯-১
bn,
আইএসও ৬৩৯-২
ben
আইএসও ৬৩৯-৩
ben

প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠীর মানুষের আগমনের পর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল  দ্রাবিড়রা। এদের প্রবেশ ঘটেছিল ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর এরা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের সাথে অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের সম্মিলনে ভারতবর্ষের ভাষায় আবার সংমিশ্রণের ধারা সচল হয়ে উঠেছিল। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে দ্রাবিড়দের বিস্তার যতটা প্রবলভাবে ঘটেছিল, বঙ্গদেশে ততটা ঘটে নি। ফলে এই অঞ্চলের ভাষায় অস্ট্রিক ভাষার আধিপত্য রয়েই গিয়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে আর্যরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে এই আগত এই জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দের দিকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের ভিতরে এই পরিবর্তিত ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। বিভিন্ন ঋষিদের রচিত বিভিন্ন শ্লোকগুলো একত্রিত করে যে সংকলিত গ্রন্থ প্রস্তুত করা হয়, তাই ঋগ্বেদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর লেখা হয় অন্য তিনটি বেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থ। গোড়ার দিকে সকল বেদ সংকলিত হয়ে একটি বেদ-আকারে ছিল। বেদের এই ভাষাকে বলা হয় বৈদিক ভাষা।

বৈদিকভাষার যুগে আর্য ঋষিদের সাথে সাধারণ আর্যদের যতটা যোগাযোগ ছিল, কালক্রমে তা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। বৈদিক ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা না হয়ে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বৈদিক ভাষার নানা ধরনের কথ্যরূপ তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে বৈদিক ভাষা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাকরণ দিয়ে এই ভাষার রীতি নীতি অনেকে বাঁধার চেষ্টাও করেছিলেন অনেকে। এক্ষেত্রে পাণিনি সফল হয়েছিলেন। তাঁর সাফল্য সাময়িকভাবে বৈদিক ভাষাকে জীবন্ত করেছিল বটে, দীর্ঘজীবী করতে ব্যর্থ হয়েছে।

পাণিনি 'অষ্টাধ্যায়ী' নামক একটি ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের দিকে। এই ব্যাকরণের সূত্রে বৈদিক সংস্কৃতি বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটি পরিমার্জিত ও পরিশীলিতরূপ লাভ করেছিল। পাণিনির পূর্বে বা সমসাময়িককালে সংস্কৃত ভাষার তিনটি কথ্য রূপ গড়ে উঠিছল।

সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার অপর একটি রূপ ছিল বলে অনুমান করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন দাক্ষিণ্যাত্য।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত  (মাওলা ব্রাদার্স, জুলাই ১৯৯৮) গ্রন্থে একটি সারণীতে আর্য ভাষার থেকে বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় যে তথ্য উপাস্থাপন করেছেন, সেই তথ্যানুসরণে নিচের তালিকাটি দেওয়া হলো।
  • ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩৫০০-২৫০০)
  • শতম (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫০০-১২০০)
  • আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ  ২০০০-১২০০)
  • প্রাচীন ভারতীয় আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১২০০-৮০০)
  • আদিম প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৮০০-৫০০)
  • প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৫০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পালি
  • গৌড়ী প্রাকৃত (২০০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • গৌড় অপভ্রংশ (৪৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • সন্ধিযুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
  • মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ)
  • নব্যযুগ (১৮০০)

সংস্কৃত ভাষার প্রাচ্য  রূপটি প্রচলিত ছিল পূর্বভারতের অযোধ্যা, উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল। আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন 'ভারতীয়-আর্য ভাষা'র 'পূর্বাঞ্চলীয় শাখা'য় (প্রাচ্য) পৃথকভাবে বাংলা-অহমীয়া প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রাকৃত রূপটি কি ছিল তা নিয়ে ব্যাকরণবিদের মধ্য মতবিরোধ আছে। যেমন  সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের মতে: " মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে"। আর ড. শহীদুল্লাহর মতে: "গৌড়ীয় প্রাকৃত হতেই গৌড়ীয় অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে "। কিন্তু উভয়ই মনে করেন যে, বাংলা-অহমিয়া ভাষা ভাষাগোষ্ঠীই বিভাজিত হয়ে বাংলা এবং অহমিয়া নামক দুটি ভাষার জন্ম হয়েছে।

মূলত ভারতের বিবর্তিত আর্য ভাষার অন্যান্য শাখার মতোই পূর্বাঞ্চলীয় শাখার কথ্যরূপ, স্থানীয় অনার্য ভাষাভাষীদের সংমিশ্রণে গড়ে উঠছিল। কালক্রমে উভয়ের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পূর্বাঞ্চলীয় প্রাকৃত ভাষা। বাংলা-অহমিয়া ভাষা হলো বাংলা ভাষার সর্বশেষ প্রাকৃত ভাষার একটি রূপ। খ্রিষ্টীয় ৫০০-৬০০ অব্দের দিকে বাংলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষায় রূপ নিয়েছিল।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের সূচনা হয়েছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (রূপম, ১৩৯৬) গ্রন্থ মতে- খ্রিষ্টীয় ৬০০ অব্দের পরে প্রাকৃত ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপ লাভ করেছিল, সেই রূপটিই অপভ্রংশ। আর চর্যাপদের রচনাকালকে তিনি ৯০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বলে অনুমান করেছেন। তাঁর মতে এর আগে উত্তর বিহারের মৈথিলী, দক্ষিণ বিহারের মগহী, পশ্চিম বিহারের ভোজপুরিয়া, উড়িষ্যার উড়িয়া ও আসামের আসামী ভাষা মিলে একটি ভাষা ছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এর নামকরণ করেছেন মাগধী অপভ্রংশ। বাঙালী এই দুই প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক ছাড়াও দেশী বিদেশী বহু ভাষাতাত্ত্বিক ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের পরের দিকে সংস্কৃত সাহিত্যিকরা প্রাকৃত ভাষার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করতে পারেন নাই। তাঁরা প্রাকৃতভাষাকে অশিক্ষিতের ভাষা হিসাবে বিবেচনা করেছেন, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে তার নমুনাও হাজির করেছেন, সংস্কৃত নাটকে হাস্য-কৌতুকের ভাষা হিসাবে প্রাচীন মাগধী ভাষাকে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষের সকল প্রান্তের প্রাকৃত ভাষা একইভাবে বিকশিত হয় উঠে নি। ভাষার এই ব্যবধান লক্ষ্য করে পাণিনি প্রাকৃতভাষাকে প্রাচ্যাং ও উদীচ্যাং নামে চিহ্নিত করেছিলেন। স্থানীয় অনার্য ভাষা তথা প্রাকৃত ভাষার কালানুক্রমিক বিকাশের আদি অধ্যায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এই সংস্কৃতের সংস্পর্শে এসে প্রাকৃত ভাষার যে মিশ্ররূপ তৈরি হয়, তাকেই অপভ্রংশ ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যে কোনো ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা জানতে গেলে, তার লিখিত বা শ্রবণ নমুনা দরকার। সে আমলের শ্রবণ নমুনা সংগ্রহের কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাই সেকালের ভাষারীতি জানার জন্য প্রয়োজন পড়ে লিখিত নমুনা। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে তা হলো- চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে " আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়।" [বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮]। চর্যাগীতির রচনাকাল নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত আছে। বিভিন্ন গবেষকদের আলোচনার সূত্রে চর্যাপদের একটি কালসীমা নিতে পারি ৬০০-১২০০  খ্রিষ্টাব্দ। একটি ভাষায় কবিতা লেখার প্রান্তীক সময় যদি ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ ধরে নেই। তাহলে বুঝতে হবে ওই ভাষাটা আদি অবস্থা থেকে অন্তত কবিতা লেখার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত ১০০ বৎসর অতিক্রম করেছে। তাহলে বাংলা আদিরূপটি গড়ে উঠার জন্য ৫০০ অব্দ ধরে নেওয়া যেতে পারে। সাহিত্যের নমুনার বিচারে ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চর্যাগীতি ' র সময়কালকে মধ্যযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

            [দেখুন : প্রাচীন যুগ (চর্যাগীতি কাল)]


সূত্র :
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা। বৈশাখ ১৩৯৬।
ভাষার ইতিবৃ্ত্ত।
সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স।
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা
। ডঃ রামেশ্বর শ।
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit