বাংলা গান
(১৭০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)

সপ্তদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে নতুন ধারার বিপত্তি নেমে এসেছিল 'বর্গীর হাঙ্গামা'র সূত্রে। যদিও নবাব আলীবর্দী খান (১৬৭১-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), মারাঠী বর্গীদের অনেকাংশে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে আদি কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন  অঞ্চল কলকাতা নিরাপদ হয়ে উঠেছিল। কিম্তু এর ভিতরেই বাংলার বহুজন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছিল। এই অস্থিরতার মধ্যে বাংলার সাহিত্য-সঙ্গীত অঙ্গনেও বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বর্গীর হাঙ্গামার পর বাংলার জনজীবনে দ্বিতীয় আঘাত এসেছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিরাজদৌল্লাহ-র পতন। পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা বঙ্গদেশের উপর ধীরে ধীরে তাদের রাজত্ব সুদৃঢ় করা শুরু করেছিল। মূলত ইংরেজদের নতুন প্রশাসন কার্যক্রম সুদৃঢ় হয়ে ওঠেছিল ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।

এই শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন ছিল নাগারিক ও আধা-নাগরিক গান। এই ধারায় আমরা যে সকল গান পাই তা হলো- কবিগান, শাক্তসঙ্গীত, রামপ্রসাদী সুর, আখড়াই ও টপ্পা।

কবি গান
এক সময় বাংলাদেশে কবিগান খুবই জনপ্রিয় ছিল। আঠারো শতক কবিগানের উদ্ভব কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নানা ধরনের লোকগানের সমন্বয়ে এই গান তৈরি হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কবিগান তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গোঁজলা গুইকে (১৭০৪-? খ্রিষ্টাব্দে)  বলা হয় কবিগানের আদি কবিয়াল। তাঁর আবির্ভাবকাল আঠারো শতকের প্রথমার্ধ।

গোঁজলা গুই-এর শিষ্য রঘুনাথ দাস (১৭২৫- ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ) এই কবিগানের ধারাকে সচল রেখেছিলেন মাত্র। তবে রঘুনাথ দাস কবিগানকে শাস্ত্রীয় গানের আদর্শে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। কবি গানের এই বিশেষ বিন্যাসকে বলা হয়ে থাকে দাঁড়া কবি গান। এই বিন্যাসের অধ্যায়গুলোর নাম ছিল চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, মেল্‌তা, মহড়া, শওয়ারী, খাদ ও অন্তরা। এই ধারার গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন রঘুনাথ দাস-এর দুই শিষ্য রাসু রায় নৃসিংহ রায় (১৭৩০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) কবিয়াল হিসেবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এই ধারায় আরও একজন বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন লালু নন্দলাল। তবে কবিগানকে মর্যাদার আসনে তুলে ধরেছিলেন রঘুনাথ দাস-এর অপর শিষ্য হরুঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪খ্রিষ্টাব্দ)। এই ধারার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কবিয়াল ছিলেন নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১-১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ) ও তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভবানী বণিক ।

শাক্তসঙ্গীত
মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষ শক্তিমান কবি হলেন ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ)। দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে ভারতচন্দ্রের ৫৩টি গান সংকলিত হয়েছে।এই গানের সাথে যে রাগনামের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হলো— আড়ানা, বাহার, আলাইয়া, আলেয়া, ইমন, ইমনকল্যাণ, কালাংড়া, কেদার, খাম্বাজ, গান্ধার, গৌরী, ঝিঁঝিট, ঝিঁঝিট-খাম্বাজ, টোড়ি,টোড়ি-বাগেশ্রী, দেশ, পরজ, পরজ-বাহার, পুরবি, বসন্ত -বাহার,বাগেশ্বরী, বাগেশ্রী, বাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরব, মালশ্রী, মুলতান, মেঘমল্লার, যোগিয়া, রামকেলি, ললিতবিভাস, লুম-ঝিঁঝিট, শ্যামকল্যাণ, সারঙ্গ, সুরট, সুরটমল্লার, সিন্ধু, সিন্ধু-ভৈরবী, সোহিনী, হাম্বির।
    [সহায়ক পাঠ:
মঙ্গলকাব্য]

রামপ্রসাদী গান
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ যখন শেষ তখন কলকাতা নগরীর শৈশব দশা চলছিল। সে সময় কলকাতা কেন্দ্রিক নাগরিক সঙ্গীতে নানা ধরনের সংমিশ্রণের ধারা সঞ্চালিত হয়েছিল। এ সময় শাক্ত কবি ভারতচন্দ্রের প্রভাব ফেলেছিল কলকাতা কেন্দ্রিক নাগরিক গানে। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল
রামপ্রসাদ সেনের (১৭২০-১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) শ্যামাসঙ্গীততিনিই বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর লীলাকীর্তন শ্যামাসংগীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন দেবী কালীর লীলাকীর্তনমূলক গান। তাঁর গানেই প্রথম কালীকে স্নেহময়ী মাতা এমনকি ছোটো মেয়ের রূপেও দেখা যায়। কীর্তন ও বাংলার লোকসঙ্গীত ধারার বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ বাংলা সংগীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। এই সুরের ধারার নাম হয়ে যায় রামপ্রসাদী সুর। মূলত নবদ্বীপকেন্দ্রিক নগরসভ্যতার ফসল হলো ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ সেনের গান। এই গান নবদ্বীপ ছাড়িয়ে বাংলার নগরকেন্দ্রিক নগর, উপনগরে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তৎকালীন বাংলার রাজধানী কলকাতার নাগরিক গানকে আলোড়িত করে তুলেছিল।
    [রামপ্রসাদ সেন রচিত গানের তালিকা]

এই গানের সূত্রে একটি বিশেষ সুরাঙ্গ প্রতিষ্ঠা পায়। একে বলা হয় রামপ্রসাদী সুর। ভাবের বিচারে এই গানই শ্যামাসঙ্গীত। বাঙ্গালির গান গ্রন্থে রামপ্রসাদের ২৫২টি গানের সংকলনে বেশ কিছু গানের সাথে রাগ ও তালের নাম পাওয়া যায়। এই সংকলন অনুসারে যে সকল রাগ ও তালের নাম পাওয়া যায়, সেগুলো হলো−ইমন, কালেংড়া, খটভৈরবী, খয়রা, খাম্বাজ, গারাভৈরবী, গৌরী, গৌরীগান্ধার, ছায়ানট, জংলা, জয়জয়ন্তী, ঝিঁঝিট, টুরিজায়েনপুরী, তেতালা (জলদ, ঢিমা) পিলুবাহার, বসন্তবাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরবী, মল্লার, মালশ্রী, মুলতানি, মুলতানি ধানেশ্রী, রামকেলি, লগ্নি, ললিত, ললিতখাম্বাজ, ললিতবিভাস, সিন্ধু, সিন্ধুকাফি, সোহিনী, সোহিনীবাহার।

আখড়াই গান
১৭৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে, কীর্তন
গানের আখড়া থেকে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ-শান্তিপুর অঞ্চলে।
নবদ্বীপ অঞ্চলের বিকশিত হয়েছিল আখড়াই গান।
বৈষ্ণবদের আখড়ায় এই গানের আসর বসতো। এই সূত্রে এই গান আখড়াই নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। প্রথমদিকে এই গান ছিল ভদ্রসন্তানদের বৈঠকি গান। পরে এই গান অশ্লীল এবং কুরূচিপূর্ণ শব্দ ও বাক্যে ভদ্রজনের অশ্রাব্য গানে পরিণত হয়।
        [সহায়ক পাঠ:
আখড়াই]

বাংলা টপ্পা
বাংলা নাগরিক গানে কীর্তন এবং রামপ্রসাদী সুরের সাথে নতুন ধরনের গানের সূচনা হলো যুক্ত হলো টপ্পার মাধ্যমে। এই গানের সূচনা হয়েছিল। কালী মীর্জা (১৭৫০-১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ) মাধ্যমে। পরে একে সমৃদ্ধতর করে তোলেন নিধুবাবু (১৭৪১-১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)।

বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ কালী মীর্জা। ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি উত্তর ভারত থেকে সঙ্গীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন। কালী মির্জা বারানসীতে টপ্পা শিখেছিলেন গাম্মু বা শাদে খাঁর কোন শিষ্যের কাছ থেকে। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক ছিলেন। তিনি হিন্দুস্থানী টপ্পার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় টপ্পা রচনা করেন এবং গুপ্তি পাড়ায় তাঁর জন্মস্থানে বাংলা টপ্পা শুনিয়ে স্থানীয় গুণিজনদের মুগ্ধ করেন। শেষ জীবনে তিনি কলকাতায় কাটান।

তিনি নিধুবাবুর অনেক আগে থেকে বাংলা টপ্পার প্রচলন করেন। উল্লেখ্য, ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা শুরু করেন ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের নিরিখে বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ বলতে কালী মির্জাকে বিবেচনা করা হয়।

বাংলা খেয়াল
কলকাতা যখন নিধুবাবুর টপ্পা মাতোয়ারা করে রেখেছিল, সেই সময়,
বর্ধমান রাজদরবারে দেওয়ান রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ), তাঁর বাবা এবং বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণা স্বতন্ত্রভাবে বাংলা খেয়াল রচনায় হাত দেন।

রঘুনাথ রায় রাগাশ্রয়ী গান না খেয়ালের বন্দেশ তৈরি করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। কারণ তাঁর গানগুলো ছিল চার তুকের। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য রঘুনাথের গানকে খেয়াল নামেই অভিহিত করেছেন। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গীতসূত্রসার গ্রন্থে খেয়াল গানের আলোচনায় লিখেছেন

 '...ইহাতে দুই তুকের অধিক সচরাচর ব্যবহার হয় না, অর্থাৎ ইহাতে কেবল আস্থায়ী ও অন্তরা। কখন কখন ইহাতে তিন চারি কলিও থাকে। কিন্তু তাহাদের সুর সবই অন্তরার ন্যায়। খেয়ালীর সুরের কতকগুলি বাংলা গানে ধ্রুপদের ন্যায় চারি তুক আছে, অর্থাৎ চারি কলির বিভিন্ন প্রকার সুর। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী চুপি গ্রাম নিবাসী মৃত দাওয়ান রঘুনাথ রায় (যিনি 'অকিঞ্চন' বলিয়া খ্যাত) খাস হিন্দুস্থানী খেয়ালে বাংলায় ঐরূপ চারি তুকের অনেক শ্যামাবিষয়ক গান রচনা করিয়াছিলেন।'

কৃষ্ণধনের বিবরণ থেকে মনে হয়ে রঘুনাথ খেয়ালের ধাঁচে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য রঘুনাথ পরবর্তীকালে বেশ কিছু কৃষ্ণবিষয়ক গানও রচনা করেছিলেন। দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে রঘুনাথ রায়ের ৯৯টি গান সংকলিত হয়েছে।