এসো এসো চাঁদবদনি
এ রসে নীরস কোরো না ধনি॥
তোমাতে আমাতে একই অঙ্গ,
তুমি কমলিনী আমি সে ভৃঙ্গ,
অনুমানে বুঝি আমি সে ভুজঙ্গ,
তুমি আমার তায় রতনমণি।
তোমাতে আমাতে একই কায়া
আমি দেহ প্রাণ, তুমি লো ছায়া,
আমি মহাপ্রাণী তুমি লো মায়া,
মনে মনে ভেবে দেখ আপনি॥
গোঁজলা গুই-এর শিষ্য রঘুনাথ দাস (১৭২৫- ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ) এই কবিগানের সুরের ধারাকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। তিনি কবিগানকে শাস্ত্রীয় গানের আদর্শে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। কবি গানের এই বিশেষ বিন্যাসকে বলা হয়ে থাকে দাঁড়া কবি গান। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত 'বাঙালির গান' গ্রন্থে রঘুনাথ দাসের ৬টি গান পাওয়া যায়। গানগুলো বেশ দীর্ঘ। এই ধারার গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন রঘুনাথ দাস-এর দুই শিষ্য রাসু রায় ও নৃসিংহ রায় (১৭৩০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)। এঁরা কবিয়াল হিসেবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এই ধারায় আরও একজন বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন লালু নন্দলাল। তবে কবিগানকে মর্যাদার আসনে তুলে ধরেছিলেন রঘুনাথ দাস-এর অপর শিষ্য হরুঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪খ্রিষ্টাব্দ)।
হরুঠাকুর তাঁর গানগুলোকে কয়েকটি তুকে ভাগ করেছিলেন। এই তুকগুলো হলো-মহড়া, চিতেন, অন্তরা, পরচিতেন। তাঁর গান শুরুর অংশে নাম ছিল 'মহড়া'। এই অংশের দ্বারা গানের অবতারণা হতো। পরে অংশটি ছিল 'চিতেন'। এই অংশটি 'মহড়া' অংশের সম্প্রসারণ বলা যেতে। ছোটো গানগুলো লেখা হতো মহড়া ও চিতেন নিয়ে। একটু বড় গানে এই দুটি তুকের পরে যুক্ত হতো 'অন্তরা'। এই অংশে থাকতো আত্মকথন, স্বগোক্তি, সখীজ্ঞাপন জাতীয় বিষয়। অন্তরার পরে আবার যুক্ত করা হতো 'চিতেন'। 'পরচিতেন' ছিল অতিরিক্ত কথন। একে চিতেনের সম্প্রসারিত তুক হিসেবে ধরা যেতে পারে। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত 'বাঙালির গান' গ্রন্থে হরু ঠাকুরের ৪২টি গান পাওয়া যায়। নিচে মহড়া, চিতেন, অন্তরা ও পরচিতেন সম্বলিত গানের নমুনা তুলে ধরা হলো।
মহড়া
কই বিপিনবিহারী বিনোদ আমার এলে না।
মনেতে করিতে সে বিধুবয়ান, সখি,
এ যে পাপ প্রাণ, ধৈরজ না মানে,
প্রবোধি কেমনে তা বল না॥
চিতেন
সই, হেরি ধারাপথ থাকয়ে যেমত,
তৃষিত চাতক জনা।
আমি সেই মতো হয়ে, আছি পথ চেয়ে,
মানসে করি সেরূপ ভাবনা॥
অন্তর
হায়, কী হবে সজনি, যায় যে রজনি,
কেন চক্রপাণি এখনো।
না এলো এ কুঞ্জে, কোথা সুখ ভুঞ্জে,
রহিল না জানি কারণে॥
পরচিতেন
বিগলিত পত্রে, চমকিত চিত্তে,
হতেছে স্থির মানে না।
যেন এল এল হরি, হেন জ্ঞান করি,
না এল মুরারি, পাই যাতনা॥
অন্তরা
সই, রবিকিরণের প্রায় হিমকর,
এ তনু আমারও দহিছে।
শিখিপিক-রব, অঙ্গে মোর সব,
বজ্রাঘাত সম বাজিছে॥
পরচিতেন
সই, করিয়ে সঙ্কেত, হরি কেন এত,
করিলেকে প্রবঞ্চনা।
আমি বরঞ্চ গরল, ভকি সেও ভাল,
কী ফল বিফলে কালযাপনা॥
অন্তরা
সই, দেখো নিজ করে, প্রাণপণ ক'রে,
গাথিলাম এ কুসুমহার।
একী নিরানন্দ, বিনে সে গোবিন্দ,
হেন মালা গলে দিব কার॥
পরচিতেন
সই, খেদে ফাটে হিয়ে, কার মুখ চেয়ে,
রহিব অবল জনা।
আমি শ্যাম অন্বেষণে, পাঠালাম মনে,
তার সঙ্গে কেন প্রাণ গেল না |
এই ধারার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কবিয়াল ছিলেন
নিত্যানন্দ বৈরাগী
(১৭৫১-১৮২১
খ্রিষ্টাব্দ) ও তাঁর অন্যতম
প্রতিদ্বন্দ্বী
ভবানী বণিক
(?)। উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিকালে
কলকাতায় কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। তবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এ গানের
জনপ্রিয়তা অব্যাহত ছিল। এই পর্যায়ে কবিগানের উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন তারকচন্দ্র
সরকার (১৮৪৭-১৯১৪)। বিশ শতকে যাঁরা সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন−
কবিয়াল হরিচরণ আচার্য (১৮৬১-১৯৪১), রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার
(১৮৯২-১৯৭৪), বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩-১৯৮৫), গুমানী দেওয়ান প্রমুখ।
কথিত আছে অষ্টাদশ থকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে কেবল বীরভূম জেলাতেই শ তিনেক
খ্যাতনামা কবিয়াল বিদ্যমান ছিলেন। তবে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে কবি গানের
স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে।
আদি কবিগান এবং পরবর্তীতে
রঘুনাথ দাসের
সৃষ্ট দাঁড় কবিগানে, কবির লড়াই ছিল অনেকটা পাতানো। অর্থাৎ কবিয়ালরা আগে থেকেই ঠিক
করে নিতেন কোন বিষয়ে গান হবে বা কোন্ কোন্ প্রশ্নের ভিত্তিতে গান হবে। এই সময়ের
কবিগানের চলনকে বলা হয় 'বাঁধুটি'। এর মাঝে মাঝে কবিয়ালরা কিছু কিছু নিজের
মতো করে ছকের বাইরে বেরিয়ে এসে গান করতেন বা প্রতিপক্ষ কবিয়ালকে প্রশ্ন করতেন। এই
ধারার সূত্রে মুক্ত ধারার কবি গানের চল বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ধারার আনুষ্ঠানিকভাবে
পরিবর্তন ঘটান
রাম বসু (১৭৮৬-১৮২৮
খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি কবিয়ালদের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করার অঙ্গ হিসেবে প্রচলন করেন, তাৎক্ষণিক
প্রশ্নোত্তরের অধ্যায়। এই ধারার কবিগানের সূত্রে আগে থেকে মহড়া দিয়ে সাজানো রীতি
প্রচলিত হয়। এই পর্যায়ে সাধারণ প্রতিভার কবিরা পিছনের সারিতে চলে
গিয়েছিলেন। সেখানে কবির আসরে উঠে
এসেছিলেন
ভোলা ময়রা,
এ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মতো শিল্পীরা।
উল্লেখ্য
ভোলা ময়রা
ছিলেন হরুঠাকুর
শিষ্য। 'বাঁধুটি' গান দিয়ে তাঁর কবিগানের সূচনা ঘটেছিল, কিন্তু তাঁর
সমসাময়িক কবিয়াল
রাম বসু'র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে,
মুক্ত ধারার কবিগানে চলে আসেন।
এই সময় কিছু কবি ছিলেন, যাঁরা অন্যদের জন্য গান লিখে দিতেন। যেমন
ভোলা ময়রার
জন্য গান লিখে দিতেন হরুঠাকুর
ও
সাতু রায়।
আর
এ্যান্টনি ফিরিঙ্গির
জন্য
গান লিখে দিতেন
গোরক্ষনাথ।
উল্লেখ্য, কবিগানের জন্য যাঁরা গান রচনা করে দিতেন, তাঁদেরকে বলা হতো বাধনদার।
উল্লিখিত বাঁধনদার ছাড়া আরও বিশেষ কিছু নাম পাওয়া যায়। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য
ছিলেন
কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য,
গদাধর মুখোপাধ্যায় ও
ঠাকুরদাস চক্রবর্তী।
বিভিন্ন অঞ্চলের কবিগানের প্রকৃতি এক হলেও, অঞ্চলভেদে এসব গানের ভাষাগত এবং সুরগত
পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কবিয়ালদের গান মুখে মুখে রচিত হতো। এগুলো আসরের পরে
সংগ্রহের কথা সেকালে কেউ ভাবতেন না। কবিরাও এ বিষয়ে খুব একটা যত্নবানও ছিলেন না। ১৮৫৪
খ্রিষ্টাব্দে
ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) কবিগান সংগ্রহ করা শুরু করেন।
সংঋহীত এই কবিগানগুলো তিনি তাঁর
সম্পাদিত পত্রিকা
'সংবাদ প্রভাকর'-এ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নিজেও কবিগান রচনা করতেন।
দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত 'বাঙালির গান' গ্রন্থে এঁর ১৮টি গান পাওয়া যায়।