ঠুমরি
ভারতীয় রাগাশ্রী গানের একটি শ্রেণি বিশেষ। লঘু-রাগসঙ্গীত হিসেবেই এই গানকে অভিহিত করা হয়। এই গানের বিষয় নরনারীর রোমান্টিক ভাবনা। সাধারণ নরনারীর প্রেমের বিষয় ছাড়াও রাধাকৃষ্ণের লীলা এই গানে বিশেষরূপে পাওয়া যায়। ফলে ঠুমরিতে শৃঙ্গাররসের আধিক্য রয়েছে। এর বাইরে কিছু  ভক্তিভাবের ঠুমরিও বিরল নয়।

ভারতীয় রাগসঙ্গীতের জগতে এর স্থান ধ্রুপদ, খেয়াল বা তারানার পড়ে। অনেকে একে লঘু-রাগসঙ্গীত হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ, শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ধ্রুপদ, ও খেয়ালে রাগের শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়, বা রাগের নানারকম নান্দনিক রূপকে প্রকাশ করা হয়, ঠুমরি তেমনটা করা হয় না। এই গানে বাণীর ভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুর সহযোগে সে ভাবকে নানাভাবে প্রকাশ করার ফলে ঠুমরি একটি বিশেষ আবেদন তৈরি করে। সুরের বৈচিত্র্য আনার জন্য ছোট ছোটো তান, মুর্কি, খটকা, গিটকিরি প্রয়োগ করা হয়। এই সব কারণে সকল রাগেই ঠুমরি গান করা হয় না। সাধারণত ভৈরবী, পিলু, খাম্বাজ, গারা, তিলক-কামোদ ইত্যাদি নির্বাচিত রাগে ঠুমরি গাওয়া হয়।  ঠুমরি চলনে সহায়ক তাল হিসেবে কাহারবা, ১৬ মাত্রার যৎ, দীপচন্দী, আদ্ধা, দাদরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। তালযন্ত্র হিসেবে এই গানে ব্যবহৃত হয় তবলা। এই গানের শুরুতে তালের ঠেকা চলে মাত্র। শেষের দিকে তবলাবাদক বেশ জমজমাট করে বাজিয়ে থাকেন।

ঠুমরি গান প্রচলনের প্রথম দিকে, বৈঠকি গান ছিল। বর্তমানে রাগের আসরে সাধারণত রাগসঙ্গীতের শিল্পীরা খেয়াল গানের পরে ঠুমরি পরিবেশন করে থাকেন। এই গানের সাথে একসময় সুরযন্ত্র হিসেবে থাকতো তানপুরা, সারেঙ্গী, সুরমণ্ডল ইত্যাদি। পরে এই গানের সাথে হারমোনিয়াম ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ঠুমরি গানের প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতকে রচিত ফকিরুল্লাহ্‌র রাগদর্পণ গ্রন্থে। সে সময় বারোঁয়া এবং এই জাতীয় রাগে বিশেষ ঢংয়ের ঠুমরি গাওয়া হতো। এই গান সে সময়ে ঠুমরি নামেই প্রচলিত ছিল। আদি ঠুমরি গানের পদগুলো রচিত হয়েছিল আওধি বা ব্রজভাষায়। পরবর্তী সময়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সকল ভাষাতেই এই গানের পদ রচিত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ্ণৌ-এর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ (১৮২২-১৮৯৭) এই গানকে তাঁর দরবারে স্থান দেন। ফলে নবাবের আনুকুল্যে এই গান দরবারে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হয়। সে সময় দরবারের বাইজিরা (নৃত্যগীতে পারদর্শিনী শিল্পী) নৃত্য-সহযোগে রাজপুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য এই গান পরিবেশন করতেন। ফলে ঠুমরিতে শৃঙ্গাররসের আধিক্য ঘটে।

ক্রমে ক্রমে এই গান ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অল্পবিস্তর ছড়িয়ে পড়ে। এর ভিতরে বেনারস ও কলকাতা ঠুমরি চর্চায় বিশেষ স্থান করে নেয়। তবে লক্ষ্ণৌতে এক সময় এই গান সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। কালের পরিক্রমায় অঞ্চলভেদে ঠুমরির প্রকাশশৈলীতে প্রভেদ সৃষ্টি হতে থাকে। মোটা দাগে ঠুমরি এই প্রভেদকে দুটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর একটি হলো পূর্বী অঙ্গ, অপরাটি পাঞ্জাবি অঙ্গ। পূর্বী অঙ্গে বাণী এবং সুরের বাঁধনের পরস্পরের অনুসঙ্গী। কিন্তু পাঞ্জাবি অঙ্গের ঠুমরিতে সুরের অলঙ্কার বেশি। অনেকে মনে করেন, পাঞ্জাবের টপ্পা'র প্রভাব ঠুমরি গানকে কিছুটা প্রভাবিত করেছিল। একমাত্র পাঞ্জাবি ঠুমরিতে তানের প্রয়োগ দেখা যায়।
অখণ্ড বঙ্গদেশে বাইজিদের সূত্রে ঠুমরি গান প্রচলিত হয়। এক্ষেত্রেও নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ-এর ভূমিকা ছিল। ইংরেজদের চক্রান্তে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ, কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। তাঁর এই নির্বাসিত জীবনেও তাঁর অপরিসর দরবারে সঙ্গীতের আসর বসতো। এই সূত্রে দরবারে কথক নৃত্যশিল্পী এবং ঠুমরি শিল্পীরা যোগদান করতেন। ওয়াজেদ আলী শাহ্-এর অনুসরণে বঙ্গদেশের অনেকে রাজা-মহারাজাও বায়না করে বাইজি আনতেন, কিম্বা স্থায়ীভাবে বাইজি রাখতেন। এক সময় বাইজি রাখাটা কলজাতার বাবু-সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঠুমরি ছড়িয়ে পড়েছিল, বাইজিদের দ্বারা। এই ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়াও এলাহাবাদ, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানেও ঘটেছে।

প্রাথমিক যুগের নামকরা বাইজিদের মধ্যে ছিলেন নিকি, আসরন, জিন্নাত, বেগমজান, হিঙ্গুলা, মীর্জাজান, নান্নীজান, সুপনজান প্রমুখ। জানা যায়, নিকি বাইজি ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রাযয়ের বাগানবাড়ীতে নৃত্যগীত পরিবেশন করে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভকারী বাইজিদের মধ্যে শ্রীজান, মুশতারী, মাশকাজান, গহরজান , জদ্দন, জানকী বা ছাপ্পান্ন ছুড়ি, জোরো, আবদন, নাছমী, নীলম, রোশনারা, আসতারী, রসুলুন, কালী, হীরা, কেশর, সরস্বতী, মুন্নী, কানীজান, আমিরজান, গাঙ্গু, বিদ্যাধরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

পূর্বী অঙ্গের ঠুমরির চরম বিকাশ ঘটেছিল বেনারসে। বেনারসের এই অঙ্গের প্রখ্যাত ঠুমরি শিল্পীরা ছিলেন মতি, রওশনারা , সিদ্ধেশ্বরী দেবী, গিরিজা দেবী এবং পণ্ডিত  চান্নুলাল মিশ্র। এই অঙ্গের অন্যান্য ঠুমরি শিল্পী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন গহরজান , বেগম আখতার, সোভা গুর্তু, প্রভা আত্রে প্রমুখ। এর বাইরে কিছু প্রখ্যাত রাগসঙ্গীতের শিল্পী ঠুমরি গানকে সমৃদ্ধ করেন। রাগের বৈঠকী মেজাজ এবং গায়নশৈলীর পারঙ্গমতায় ভিন্নতর এঁদের ঠুমরি একটি বিশিষ্ট মর্যাদাপূর্ণ রূপ লাভ করেছে। এঁদের ভিতর উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন আব্দুল করিম খান, ফৈয়াজ খান, নাজাকাত-সালামত আলী খান, বরকত আলী খান, বড়ে গুলাম আলী খান, ভীমসেন যোশী প্রমুখ। এঁদের এই ঠুমরিকে অনেকে রাগপ্রধান ঠুমরি বলে থাকেন। 
ঢাকায় বাইজিদের আনগোনা শুরু হয়েছিল মোগল শাসনালে। যতদূর জানা যায়, সুবেদার ইসলাম খাঁর দরবারে যারা নাচ-গান করতেন তাদেরকে 'কাঞ্চনী' বলা হতো।

উনিশ শতকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নাচ-গান তথা মেহফিল বৃদ্ধি পায়। এঁরা আহসান মঞ্জিল-এর রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। লক্ষ্ণৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান বাজি হিসেবে বিশেষ সম্মানিতা ছিলেন। এছাড়া ঢাকার বিখ্যাত বাজিরা ছিলেন মুশতারী বা, এলাহীজান, পিয়ারীবা, হীরাবা, ওয়ামুবা, আবেদী বা, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বা, বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন প্রমুখ। কলকাতা থেকে মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতেন মালকাজান বুলবুলি, মালকাজান আগরওয়ালী, জানকী, গহরজান, জদ্দন, হরিমতী প্রমুখ। উল্লেখ্য গ্রামোফোন রেকর্ডে কণ্ঠদানকারী প্রথম শিল্পী গহরজান ।  তাঁর গানের রেকর্ড নং পি-০১ (হিজ মাস্টার ভয়েস)।