যাত্রা, যাত্রা পালা
বঙ্গদেশে অভিনয় শিল্পের একটি ধারা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঁচালি, কথক ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পালাগান এবং যাত্রাপালা। বাংলা কাব্যনাট্যরূপের আদি নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বড়ুচণ্ডীদাসে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-কে। এই সূত্রে বৈষ্ণব-সঙ্গীত একটি নতুন ধারা পেয়েছিল। এরপর বাংলা গানের জগতে ভরতচন্দ্র, রামপ্রসাদের সূত্রে বাংলার শাক্তসঙ্গীত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বৈষ্ণব এবং শাক্তসঙ্গীতের পাশ কাটিয়ে বাংলার লোক-কবিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পাঁচালি কথক। এরই ক্রমোত্তোরণে সৃষ্টি হয়েছিল কবিগান। আর এসবের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল যাত্রা পালা।

অভিনয়ের মাধ্যমে কোন কাহিনিকে উপস্থাপন করার চলমান প্রক্রিয়াই হলো যাত্রা। এই বিচারে নাটকের যে কোনো ধারাই যাত্রা হিসেবে অভিহিত হতে পারে। তবে বঙ্গদেশে একটি বিশেষ ধরনের প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থায় উপস্থাপিত অভিনয়কে যাত্রা বলা হয়। মঞ্চ, কাহিনি উপস্থাপন, অভিনয়রীতি, সাজসজ্জা, আবহসঙ্গীত ইত্যাদির মাধ্যমে  এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাওয়া যায়। যেমন- বঙ্গাদেশে অভিনয় শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ধারায় যাত্রা গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন ভারতে গণ মানুষের ভিতরে লোক-নাটকের প্রচলনের ছিল। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্র থেকে এই ধারার কথা জানা যায়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজস্ব ভাষা ও সামাজিক পরিবেশের উপর ভিত্তিক করে লোকনাটকগুলো তৈরি হয়েছিল। মূলত এই ধারারই একটি নাগরিক রূপ ছিল- জয়দেবর 'গীতগিবিন্দ'। আরো পরে এই ধারা থেকে বড়ুচণ্ডীদাস রচনা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। মধ্যযুগে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে নানা ধরনের কাব্যনাট্য বা গীতিনাট্য রচিত হয়েছিল। এসবের ভিতরে ছিল রাসযাত্রা, ভাসানযাত্রা ইত্যাদি।

বঙ্গদেশে  শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বৈষ্ণবধর্মকে বেগবান করেছিলেন। তাঁর সময়ে কীর্তন একটি আদর্শিক মানে পৌঁছেছিল। এই সময় রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক নাটক মঞ্চস্থ হতো খোলা মাঠের ভিতরে উঁচু করে তোলা মঞ্চে। এর মধ্য দিয়ে যাত্রা-মঞ্চের প্রাথমিক রূপের সূচনা হয়েছিল। সে সময়ে বেশকিছু সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ যাত্রাপালার আদলে অনূদিত হয়েছিল। এগুলোর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল-রামানন্দের 'জগন্নাথবল্লভ'। অনুবাদক ছিলেন লোচনদাস। যদুনন্দন দাস অনুবাদ করেছিলেন রূপগোস্বামীর 'বিদগ্ধমাধব'। রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক পালার পাশাপাশি রচিত হয়েছিল অন্যান্য বিষয়ের পালা। এসব পালার কাহিনি হিসেবে নেওয়া হয়েছিল- শাক্ত কাহিনি, ধর্মমঙ্গলের উপাখ্যান, গোপীচন্দ্রের উপাখ্যান, গোরক্ষনাথের উপাখ্যান ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগানের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল নব্যধারার পাঁচালিঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ ) পাঁচালির এই মিশ্ররূপ দান করেন। এই মিশ্ররীতিতে কবিগানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। এছাড়া এর সাথে মিশেছিল কীর্তন, টপ্পার সুরশৈলী। পরবর্তী সময়ে পাঁচালি, কথক ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পালাগান এবং যাত্রাপালা। দুর্ভাগ্যক্রমে সেকালের যাত্রাপালার কোনো সংকলন পাওয়া যায় না।

ইংরেজ শাসনমলের শুরুতে বঙ্গদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের ১৩ বছরে মাথায় বাংলায় ঘটেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বহু মানুষ তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় সংস্কার ত্যাগ করে জীবনধারণের জন্য নানা ধরনের পেশায় চলে এসেছিল। জাত-পাতের বালাই ছিল না। কলকাতার নগরেকন্দ্রিক সভ্যতায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। মূলত এই সময় থেকে কলকাতায় ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য জীবনধারার মিশ্ররূপ গড়ে উঠা শুরু হয়েছিল। ইংরেজদের সাহচর্যে গড়ে উঠেছিল নব্য ধনী সম্প্রদায়। সেই নিম্নবর্গের মানুষের নগরেকন্দ্রিক বিভিন্ন পেশায় কর্মসংস্থান হয়েছিল। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা মানুষর বিনোদনের মাধ্যম ছিল- আখড়াই, কবিগান, যাত্রাপালা ইত্যাদি। এ ভিতরে হাফ আখড়াই এবং টপ্পা ছাড়া প্রায় সকল লোক-অনুষ্ঠান হয়ে পড়েছিল রুচিহীন খিস্তিতে ভরা অশালীন উপস্থাপন। এই সূত্রে যাত্রাগানও কলুষিত হয়েছিল। যাত্রাগানে ব্যাপকভাবে অশালীন নৃত্য পরিবেশন করতো যে সকল নরত্কীরা, তারা সবাই ছিল সস্তা যৌনকর্মী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সোনাগাছির বেশ্যাপল্লী থেকে মঞ্চে নামনো হতো। ফলে কলকাতা বা অন্যান্য অঞ্চলের অভিজাত লোকেরা যাত্রাপালাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিল। সে সময়ে শিক্ষিত রুচিশীল মানুষের কাছে যাত্রা নিষিদ্ধ পল্লীর মতই ছিল অস্পৃশ্য অঙ্গন। তাদের ভাষায় ছিল- 'যাত্রা দেখে ফাতরা লোকে'।

এরই ভিতরে যাত্রাকে সম্মানজনক স্থানে আনার জন্য কেউ কেউ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সুচিশীল ধারার যাত্রা প্রচলনের জন্য প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন শিবরাম। এছাড়া এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন শ্রীদাম-সুবল। তিনি যাত্রাপালায় রুচিশীল গান ও নাচ উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন এঁদের শিষ্য পরমানন্দ।  ফলে ১৯২০ থেকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে যাত্রা দুটি ধারায় বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। ধারার দুটি হলো- রুচিশীল ধারা ও নতুন যাত্রা

এই ধারার যাত্রার টানাপোড়নের ভিতর কলকাতায় পাশ্চাত্য রীতির থিয়েটারের বিকাশ ঘটেছিল ধীরে ধীরে। যাত্রা বিমুখ কলকাতার রুচিশীল শিক্ষিত মানুষের ভিতরে থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে, যাত্রা কলকাতায় অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছিল। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে কৃষ্ণকমল গোস্বামী কৃষ্ণযাত্রার মধ্য দিয়ে যাত্রাকে রুচিশীল মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে 'নিমাই সন্ন্যাস' মঞ্চস্থ করে খ্যাতি লাভ করেছিলন। এছাড়া তিনি মঞ্চস্থ করেছিলেন- স্বপ্নবিলাস, রাই উন্মাদিনী, বিচিত্র বিলাস, ভরতমিলন, সুবল সংবাদ, নন্দবিদায়, গন্ধর্বমিলন। কৃষ্ণকমল এই ধরনের যাত্রাকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ারও উদ্যোগ নিয়েছলেন। পূর্ববাংলায় এই যাত্রাকে জনপ্রিয় করা উদ্যোগ নিয়েছিলেন কৃষ্ণকমল নিজেই। আর রাঢ় অঞ্চলে প্রচারের এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়। এই প্রচেষ্টার প্রথম দিকে কিছুটা সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এই সূত্রে সূচিত হয়েছিল যাত্রাদল। সখের যাত্রাদল হিসেবে তৈরি হয়েছিল উমেশ মিত্রের দল, আড়পুলি গলির দল, সিমলার 'সকের যাত্রা দল।'

এরপর শুরু হয়েছিল যাত্রার নতুন ধারা 'গীতাভিনয়'। এদের গীত, নৃত্য এবং সংলাপ। গীতাভিনয়ের লোকজ গানের পরিবর্তে স্থান পেয়েছিল ভারতীয় রাগভিত্তিক গান। নাচের ক্ষেত্রে কুরুচিপূর্ণ খেমটা নাচ বিতারিত হয়েছিল। এর পরিবর্তে দেশী ও শাস্ত্রীয় নৃত্যের সমন্বয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিল অভিনয়ধর্মী নাচ। এই ধারায় গীতাভিনয় উপযোগী বেশ কিছু উৎকৃষ্টমানের নাটক রচিত হয়েছিল। এগুলোর ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শকুন্তলা (১৮৬৫), হরমোহন রায়ের রত্নাবলী (১৯৬৫), শ্রীবৎসচিন্তা (১৮৬৬), জানকী বিলাপ (১৮৬৭), মালিনী (১৮৭৫) ইত্যাদি।

তৎকালীন প্রখ্যাত নাট্যকার মনোমোহন বসু (মদন মাস্টার), পাশ্চাত্য থিয়েটার এবং দেশী যাত্রার সংমিশ্রণে কয়েকটি মিশ্ররীতির পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক নাটক রচনা করেছিলেন। চন্দন নগরে তাঁর একটি পেশাদারি যাত্রাদল ছিল। তাঁর রচিত এই জাতীয় উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- রামাভিষেক(১৮৬৮), সতী (১৮৭৪), হরিশ্চন্দ্র (১৮৭৫), প্রণয় পরীক্ষা (১৮৬৯), পার্থপরাজয় (১৮৮১), রাসলীলা (১৮৮৯), আনন্দময় (১৮৯০)  ইত্যাদি। তিনি কাহিনির প্রাধান্য দিতে গিয়ে গানের সংখ্য কমিয়ে দিয়েছিলেন। এসব নাটকে তিনি অশ্লীল সংলাপ এবং অপ্রয়োজনীয় ভাঁড়ামো বাদ দিয়েছিলেন। ফলে সুরুচির দর্শকদের দ্বারা নাটকগুলো আদৃত হয়েছিল।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাগবাজারের সখের যাত্রাদল ধনী বাঙালিরা ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তাদের ভিতরে বাগবাজার এমেচার থিয়েটার (শ্যামবাজার নাট্যসমাজ)-এর গিরিশচন্দ্র ব্যতীত সকল কর্তাব্যক্তিরা। এঁদের মধ্যে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন- নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মধ্যস্থ পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন বসু, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, হিন্দুমেলার উদ্যোক্তা ও ন্যাশনাল পেপার পত্রিকার সম্পাদক 'ন্যাশনাল” নবগোপাল মিত্র।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যাত্রাপাল রচনায় সবচেয়ে খাতিলাভ করেছিলেন মতিলাল রায়। যাত্রাপালা রচনার পাশাপাশি তিনি নিজে অভিনয়ও করতেন। তিনি ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে নবদ্বীপ বঙ্গ গীতাভিনয় সম্প্রদায় নামে একটি যাত্রাদল তৈরি করেন। মতিলাল প্রথম জীবনে পাঁচালী রচয়িতা ও গায়ক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর পরিচালিত যাত্রায় তিনি পাঁচালীর পৌরাণিকভাবকে লোকশিক্ষা ও ধর্মশাস্ত্রের কথকতার আদলে উপস্থাপন করেছিলেন। এসকল যাত্রা পালায় তিনি লোকগীতির সুর ব্যবহার করে, শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তিনি যাত্রাপালায় থিয়েটারী ঢং যুক্ত করেছিলেন। তাঁর রচিত ৪০টি পালায় তিনি সহস্রাধিক গান ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য যাত্রাগুলো ছিল- তরণীসেন বধ, রামবনবাস, সীতাহরণ (১৮৭৮), বিজয়চণ্ডী (১৮৮০), দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ (১৮৮১), ভীষ্মের শরশয্যা, কর্ণবধ, ভরত আগমন (১৮৮৮), নিমাই সন্ন্যাসী, ব্রজলীলা (১৮৯৪), যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক (১৯০০), রাবণবধ, পাণ্ডবনির্বাসন, যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ, গয়াসুরের হরিপাদপদ্ম লাভ প্রভৃতি।

মূলত ঊনিশ শতকের শেষার্ষের গীতাভিনয়গুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে থিয়েটারের সমতুল্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। এ গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে একের পর এক রচনা করতে থাকেন হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে মঞ্চনাটক। এই সময়ে তাঁর রচিত রাবণবধ, সীতার বনবাস, 'অভিমন্যু বধ‌', যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন। এ সকল নাটকের জনপ্রিয়তা দেখে আরও অনেক নাট্যকার পৌরাণিক কাহিনি-ভিত্তিক নাটক রচনায় উৎসাহী হয়েছিলেন এবং জনসমাদর পেয়েছিলেন। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল- কেদার চৌধুরীর 'শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রোণাচার্য', অমৃত মিত্রের 'ভীম ও গর্গ', মহেন্দ্রলাল বসুর 'অর্জুন ও জয়দ্রথ', অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়ের অভিমন্যু। থিয়েটারের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার জন্য যাত্রাপালাকাররা একের পর এক রচনা করেছিলেন জনপ্রিয় যাত্রা পালা। এই সসূত্রে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্থ থেকে বিংশ শতাব্দীরে প্রথমার্ধ পর্যন্ত যাত্রাপালা জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গিয়েছিল। মনোমোহন বসু এবং  মতিলাল রায়ের ছাড়া এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নাট্যপালাকাররা ছিলেন- হারাধন রায়, ধনকৃষ্ণ সেন, ব্রজমোহন রায়, ধর্মদাস রায়, পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য এঁদের রচিত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালাগুলো ছিল-

জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে অনেক নাট্যপালাকার যাত্রায় যুক্ত করা শুরু করেন আখাড়াই ধাঁচের নৃত্য-গীতি। এসব নাচে অংশগ্রহণ করতো অল্পবয়সী সুদর্শন কিশোরেরা। এরা নাচতো নর্তকী সাজে। যাত্রায় বাংলার ঐতিহ্যগত দেশী বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশী বিদেশী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের আধিক্য ঘটেছিল। বিদেশী হারমোনিয়াম, নানা ধরনের বিদেশী বাঁশী‌র ব্যবহারের পাশাপাশী ব্যবহৃত হতো দেশী বেহালা, ঢোল, বাঁয়াতবলা, মন্দিরা ইত্যাদি।

নবযাত্রা পালার শুরুতে যুক্ত করা হয়েছিল জুড়ি গান। এর অপর নাম ছিল 'উক্ত গান'। এই গানের জন্য নির্বাচিত চারজন শিল্পী মঞ্চলের চারকোণায় অবস্থান নিতেন। এঁদের পরিধান করতেন সাদা চোগা-চাপকান ও পাগড়ি। এঁরা মূলত গানে গানে যাত্রার চরিত্রদের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। অনেক সময় এঁদের সহযোগী শিল্পী থাকতেন। এঁদেরকে বলা হতো- হাফ জুড়ি। যাত্রা পালার মাঝে পাত্রপাত্রীদের মনোভাব প্রকাশ তথা মনোগত দর্শ গানে গানে প্রকাশ করতেন এক বা একাধিক শিল্পী। এঁরা পরিচিতি লাভ করেছিলেন 'বিবেক' নামে। এই সময় অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং অন্যান্য সহযোগী ব্যক্তিবর্গকে বলা হতো 'আসামী'।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মহিলা পরিচালিত যাত্রাদল তৈরি হয়েছিল। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রাজা বৈদ্যনাথের কোনো এক রক্ষিতা প্রথম যাত্রাদল তৈরি করেছিলেন। পরে এই দলের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে মনোমোহন বসু'র মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী নাট্যদল পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই দলের তখন নাম দেওয়া হয়েছিল বৌমাষ্টারের দল।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের সূত্রে বাংলা নাটক ও যাত্রাপালায় স্বদেশপ্রেমের ছোঁয়া লেগেছিল। এই সূত্রে প্রচুর যাত্রাপালা তৈরি হয়েছিল। এই ধারার অন্যতম পালা রচয়িতা, পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে চারণকবি মুকুন্দ দাস যাত্রাপালা নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। এর ফলে অচিরেই ইংরেজ সরকারের কোপানলে পড়েন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেছিলেন।

অশ্বিনী কুমারের আগ্রহে মুকুন্দ দাস ‘মাতৃপূজা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে এই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই যাত্রাপালার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাঁলে প্রায় আড়াই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছিল। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা ছিল- মাতৃপূজা, পথ, সাথী, সমাজ, পল্লীসেবা ইত্যাদি।

মুকুন্দদাসের প্রভাবে কুঞ্জবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় 'মাতৃপূজা' পালা রচনা করে কারারুদ্ধ হন। পালাটিও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এই সময়ের বাজেয়াপ্তকৃত অন্যান্য যাত্রাপালাগুলো ছিল- হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের 'রণজিতের জীবনযজ্ঞ'। মথুর সাহা'র 'পদ্মিনী' ও 'ভরতপুরের দুর্গজয়', ভূষণদাসের  'মাতৃপূজা'।

স্বদেশ ভাবনায় রচিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য যাত্রাপালাগুলো ছিল- ভোলানাথ রায়ের 'পঞ্চনদ', 'দাক্ষিণাত্য', পাচকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের 'টিপু সুলতান', ব্রজেন্দ্কুমার দে'র 'বাঙালি', সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের 'মাটির মা', পূর্ণদাসের 'শৃঙ্খলমোচন'।

বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের তীব্রতা কমে গেলে এই জাতীয় যাত্রাপালা রচনায় ভাটা পড়ে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী'র ডাকা অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে- যাত্রাপালায় তার ছোঁয়া লাগে। তবে এই সময়ে যাত্রাপালায় স্থান পেতে থাকে সামাজিক সমস্যাদি। এর ভিতরে ছিল   অস্পৃশ্যতা, অসবর্ণ বিবাহ, জাতপাত ইত্যাদি।

বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট নানা ধরনের সামাজিক যাত্রা রচিত হয়েছিল। এই সময়ে রচিত হয়েছ মহামারী, মন্বন্তর, আগস্ট আন্দোলন, কালোবাজারি, মজুতদারি ইত্যাদি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সূত্রে বঙ্গদেশ বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে যাত্রার যাত্রাপথ বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল দুটি ধারা। যাকে মোটা দাগে অভিহিত করা হয়, পশ্চিম বঙ্গের যাত্রা এবং পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের যাত্রা।

পশ্চিম বঙ্গের যাত্রা
পশ্চিম বঙ্গ ভারত প্রজজাতন্ত্রে অন্তর্গত হয়ে যাওয়ায়- স্বদেশী যাত্রা হয়ে উঠেছিল সর্বভারতীয়। তবে পঞ্চাশ-ষাট দশকে এসে যাত্রায় পালায় এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ভারত বিভাজনের কুফল, দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই ধারার উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালগুলো ছিল- ব্রজেন্দ্রকুমার দে'র আকালের দেশ (১৯৪৫), কানাই শীলের দেশের দাবী (১৩৫৬), বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বেইমান (১৩৫৭), জীতেন্দ্রনাথ বসাকের মানুষ (১৩৫৪), সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের রক্তবীজ (১৩৫৮)।

এই সময়কালের ব্রজেন্দ্রকমার দে (১৯০৭-১৯৭৬) যাত্রাকে রুচিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদিও তিনি রুচিশীল যাত্রা রচনায় হাত দিয়েছিলেন ত্রিশের দশকে। এই ধারায় তিনি প্রথম ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেছিলেন 'স্বর্ণলঙ্কা'। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেছিলেন 'বজ্রনাভ' এবং ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেছিলেন 'স্বামীর ঘর', আকালের দেশ। ১৯৪৭ রচনা করেছিলেন 'মায়ের ডাক'। ভারত বিভাজুনের পরে তিনি রচনা করেছিলেন- গাঁয়ের মেয়ে (১৯৫১), ধর্মের বলি (১৯৫৬), রাজা দেবদাস (১৯৫৭), সোনার ভারত (১৯৬১), কবি চন্দ্রবাতি (১৯৬১)। 

পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব-পাকিস্তানের যাত্রা
পূর্ববঙ্গের যাত্রাপালা থেকে নব্য পাকিস্তানী ভাবধারায় বিকশিত হয়েছিল। স্বদেশী ভাবনা থেকে ঐতিহাসিক যাত্রা হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল- শচীন সেনগুপ্তের 'সিরাজদ্দৌলা'। হিন্দু পৌরাণিক যাত্রাপালার পরিবর্তে ধীরে ইসলামী ভাবধারার যাত্রা বিকশিত হয়েছিল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানের যে সকল উল্লেখযোগ্য যাত্রাদলের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো-

এ সকল যাত্রাদলের আধিকারিকরা ঐতিহাসিক রাজা-বাদশার কাহিনি ভিত্তিক পালাকে প্রাধান্য দিতেন বেশী। এছাড়া ছিল ইসলামী কাহিনি-ভিত্তিক যাত্রাপালা জনপ্রিয় ছিল। মুসলিম যাত্রাদলের আধিকারিকারা মঞ্চস্থ করতেন ‘বিষাদ সিন্ধুর’ বিভিন্ন পর্ব। এসবের ভিতরে ছিল- এজিদ বধ, জয়নাল উদ্ধার, কাসেম-সখিনা প্রভৃতি। কথিত আছে বরিশালের ইমাম যাত্রা থেকেই এ দেশে ইসলামী আখ্যানভিত্তিক পালা মঞ্চায়ন শুরু হয়েছিল। ’

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখযোগ্য যাত্রাদলের সংখ্যা ছিল ২৬টি। এদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য দলগুলো ছিল-

পূর্বপাকিস্তানের যাত্রাদল এবং যাত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। ৬০-এর দশকে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় মহাসমারোহে যাত্রাগান হতো রণদা প্রসাদের বাড়ির আশানন্দ হলে। এখানে বায়না করা হতো জয়দুর্গা অপেরা, বাবুল অপেরা, বাসন্তী অপেরা ও ভোলানাথ অপেরার মতো জনপ্রিয় দলগুলোকে।

ময়মনসিংহের গণেশ অপেরা, বুলবুল অপেরা এবং নবরঞ্জন অপেরায় অভিনয় করতেন যাত্রাজগতের প্রথম দু’জন মুসলিম যাত্রাশিল্পী নেত্রকোনা জেলার হোগলা গ্রামের আশরাফ আলী এবং একই জেলার পূর্বধলা গ্রামের নয়ন মিয়া।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়-আরণ্যক, থিয়েটার, বহুবচন, প্রতিদ্বন্দ্বী, স্বরলিপি, আবাহনী এবং স্বদেশ সংস্কৃতি সংসদ।

এই সময় বিজয়ের আনন্দ উচ্ছ্বাসে একই বছরে আত্মপ্রকাশ করে কয়েকটি নতুন যাত্রাদল। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল-  ময়মনসিংহের শ্যামগঞ্জের-সবুজ অপেরা। এর মালিক ছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু।
পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী'র  নিউ গণেশ অপেরা, যশোরের ফাল্গুনি অপেরা, খুলনার ডুমুরিয়া'র শিরিন যাত্রা ইউনিট, ভদ্রা অপেরা, রংপুরের নর্থবেঙ্গল অপেরা এবং নওগাঁর ভাটকৈ গ্রামের রূপশ্রী অপেরা।

১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে থিয়েটার-৭৩-এর প্রতিষ্ঠা। এ বছরের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামেরই যাত্রাদল বাবুল অপেরা যশোরের সাগরদাঁড়ীর মধুমেলায় পরিবেশন করে বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত যাত্রাপালা ‘বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন।’ এ মঞ্চায়নের নেপথ্যে যার বিশেষ ভূমিকা ছিল, তিনি যশোরের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ। মধুসূদন চরিত্রে অভিনয় করে অমরেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫-১৯৮৭)। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি দলের উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা হয়েছিল। এগুলোর ভিতরে ছিল-চট্টগ্রামের গীতশ্রী যাত্রা ইউনিটের লেনিন (১৯৭৪), মানিকগঞ্জের চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর হিটলার (১৯৭৫), সিরাজগঞ্জের বাণীশ্রী অপেরার জানোয়ার (১৯৭৬), চট্টগ্রামের নবারুণ নাট্য সংস্থার নটি বিনোদিনী (১৯৭৬), সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার মা-মাটি-মানুষ (১৯৭৯), মানিকগঞ্জের নিউ গণেশ অপেরার বিদ্রোহী নজরুল (১৯৭৯), খুলনার শিরিন যাত্রা ইউনিটের ক্লিওপেট্রা ও দস্যুরানী ফুলন দেবী (১৯৮৪) এবং ময়মনসিংহের নবরঞ্জন অপেরার চিড়িয়াখানা (১৯৮১)।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম ব্যয়বহুল দল চট্টগ্রামের নবারুণ নাট্য সংস্থা । সর্বাধিক দল গঠনের একক কৃতিত্ব গোপালগঞ্জের ধীরেন বাগচীর। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একাধারে ৫টি দলের মালিক হন। দলগুলো হচ্ছে দিপালী, ১নং দিপালী আদি দিপালী, নব দিপালী ও দীপ দিপালী অপেরা।

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যাত্রাপালায় যুক্ত হতে থাকে নর্তকীদের অশালীন নাচ-গান। এরা পরিচিতা হয়ে উঠেছিলেন প্রিন্সেস নামে।
১৯৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্সেস লাকী খান ও প্রিন্সেস রত্না এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোড়ন তুলেছিল। অনেক যাত্রাদলে যাত্রাপালার চেয়ে এই নাচগানই প্রধান সম্পদ হয়ে উঠেছিল। এর ফলে সুশীল দর্শকরা যাত্রাপালা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। 'যাত্রা দেখে ফাৎরা লোকে' প্রবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এদের কারণেই। তবে লাভজনক দল হিসেবে দ্রুত যাত্রাদল গড়ে উঠেছিল। ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে দলের সর্বোচ্চ সংখ্যা দাঁড়ায় ২১০-এ।  অশ্লীলতার অজুহাতে তখন থেকে সরকারিভাবে বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। অনিশ্চয়তা আর মন্দা ব্যবসার কবলে দলের সংখ্যা কমতে থাকে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে প্রথম জাতীয় যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, যাত্রাকে অবক্ষয়ের কবল থেকে রক্ষা এবং যাত্রাভিনয়ের মানের মূল্যায়ন কল্পে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম এ উৎসবের আয়োজন। এর পর ১৯৯৫ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আরও ৪টি জাতীয় যাত্রা উৎসব এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েকটি লোকনাট্যোৎসব এবং সপ্তাহব্যাপী যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দুটি উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন অমলেন্দু বিশ্বাস এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হন শবরী দাশগুপ্তা। এর পরের উৎসবগুলোয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা স্বপন কুমার, সুলতান সেলিম। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী রিক্তা সুলতানা ও চন্দ্রা ব্যানার্জি। বিভিন্ন পর্যায়ে পুরস্কৃত হন অশোক ঘোষ, মেরী চিত্রা, প্রতিমা সরকার, এম. সিরাজ মহীতোষ, অমল দত্ত, সরল খাঁ, মুক্তি রানী প্রমুখ।

এই সময়ের কিছু যাত্রা দল বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিল। এদের ভিতরে ছিল ঢাকার বিশ্বেশ্বরী অপেরা, গাইবান্ধার সোনালী অপেরা, মুন্সীগঞ্জের শিল্পী অপেরা, নোয়াখালীর ভাগ্যলিপি অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট এবং নারায়ণগঞ্জের আজাদ অপেরা।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই সময় রুচিশীল যাত্রা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সোচ্চার কণ্ঠে বলেন ‘যাত্রাকে ধ্বংস করা চলবে না।’ রাজপথে যাত্রাশিল্পীদের মিছিলে শরিক হয়েছেন কামাল লোহানী, রামেন্দু মজুমদার ও মামুনুর রশীদের মতো ব্যক্তিত্বরা। এরই ভিতরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠা বাবুল অপেরা, ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা, দিপালী অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা এবং নিউ বাসন্তী অপেরার পালা মঞ্চায়ন অব্যাহত ছিল ১৯৮৫ পর্যন্ত। ৯০ দশকের শেষ দিকে সিরাজগঞ্জের বাসন্তী নাট্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। জয়দুর্গা অপেরা ও অন্নপূর্ণা অপেরার কার্যক্রম স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত চালু ছিল।

১৯৮০ থেকে ২০০০- এ বিশ বছরে বিভিন্ন দলে মঞ্চায়িত উল্লেখযোগ্য পালা হচ্ছে- বাবুল অপেরার নবাব সরফরাজ খাঁ, নিউ গণেশ অপেরার আঁধারের মুসাফির, দেবী সুলতানা, বলাকা অপেরার সুলতানা রাজিয়া, নবপ্রভাত অপেরার মা হলো বন্দি, সত্যনারায়ণ অপেরার শ্রীমতি বেগম, শিরিন যাত্রা ইউনিটের এ পৃথিবী টাকার গোলাম, অগ্রগামী নাট্য সংস্থার যৌতুক ও দেবদাস, চণ্ডী অপেরার শার্দুল জারাক খান, বিশে ডাকাত, প্রতিমা অপেরার জালিম সিংহের মাঠ, রাজমহল অপেরার কে ঠাকুর ডাকাত, নবরঞ্জন অপেরার মুঘল-এ আজম, তুষার অপেরার মানবী দেবী, বিরাজ বউ, চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর রক্তস্নাত ৭১, সবুজ অপেরার হকার ও গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা, আদি দিপালী অপেরার সংসার কেন ভাঙে ও মেঘে ঢাকা তারা, ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরার ফরিয়াদ ও ফাঁসির মঞ্চে। একুশে শতকের দুই দশকে উল্লেখযোগ্য দল ও পালার তালিকায় রয়েছে- আনন্দ অপেরার ডাইনি বধূ, চৈতালী অপেরার জীবন এক জংশন, নিউ রঙমহল অপেরার দু’টুকরো বউমা, চ্যালেঞ্জার যাত্রা ইউনিটের জন্ম থেকে খুঁজছি মাগো, সিজার্স যাত্রা ইউনিটের চরিত্রহীন, দেশ অপেরার বাংলার মহানায়ক ও বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা, চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর মহীয়সী কৈকেয়ী, লোকনাট্য গোষ্ঠীর বর্গী এল দেশে, ব্রহ্মপুত্র যাত্রা ইউনিটের বঙ্গবন্ধুর ডাকে, তিতাস অপেরার রক্তে রাঙানো বর্ণমালা, ডায়মন্ড যাত্রা ইউনিটের মায়ের চোখে জল ও জয়যাত্রার বীরকন্যা প্রীতিলতা। বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রতি বছরই দুই ধরনের যাত্রাপালা মঞ্চায়িত হয়ে আসছে।

এই সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল- নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মা-মাটি-মানুষ, সোহ্রাব-রুস্তম, জানোয়ার, একটি পয়সা। এছাড়া  রূপকথা কিংবা লোককাহিনিভিত্তিক সংগীত বহুল জনপ্রিয় পালা ছিল- রহিম বাদশা ও রূপবান কন্যা, লাইলী মজনু, আলোমতি-প্রেমকুমার, কমলার বনবাস, গুনাইবিবি প্রভৃতি। এসব পালা পরিবেশনকারী দলগুলোকে গীতিনাট্য বা ঝুমুর দল বলা হয়।

এতসবের ভিতরেও যাত্রাজগতে এমন কয়েকজন শক্তিমান গুণী অভিনেতা অভিনেত্রী সুনাম অর্জন করেছিলেন। এরা হলেন- মুকুন্দ ঘোষ, ননী চক্রবর্তী, ভিক্টর দানিয়েল, সাধন মুখার্জি, নরেশ ঘোষ, কল্পনা ঘোষ, পূর্ণিমা ব্যানার্জি, বিবেক গৌরাঙ্গ আদিত্য এবং হাবিব সারোয়ার।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে রুচিশীল যাত্রাপালার জন্য নানা উদ্যোগ চলতে থাকে। এই সময় থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নানা রকম কার্যক্রম চালু করেছিল। এর ভিতরে ছিল উল্লেখযোগ্য কিছু নাটককে যাত্রাপালায় রূপান্তরের কার্যক্রম। যেমন- ‘ঈশা খাঁ’কে প্রত্নযাত্রায় রূপান্তর (২০১২), মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’কে যাত্রাপালাকারে উপস্থাপন (২০১৩)।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গুণীজনদের সঙ্গে প্রতি বছর অমলেন্দু বিশ্বাসকে যুক্ত করা হয়। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে দেশীয় পালা ও বিবেক নিয়ে যাত্রা উৎসবের আয়োজন এবং কয়েকজন শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি যাত্রা নীতিমালা প্রণয়ন ও গেজেটভুক্ত করে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট। এরই আওতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গঠন করে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটি। আগে যাত্রাদলের লাইসেন্স দেওয়া হতো ডিসি অফিস থেকে। ২০১৩ থেকে দল নিবন্ধন করছে শিল্পকলা একাডেমির এ উন্নয়ন কমিটি।

বর্তমানে ইন্টারনেট ভিত্তিক নানাধরনের নাটক, চলচ্চিত্র ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কারণে যাত্রাপালার ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত এই শিল্পমাধ্যমটি অস্তিত্ব থাকবে কিনা অনেকেই সন্দীহান।


সূত্র: