ভারতীয় সঙ্গীত
ভারতীয় সঙ্গীত বলতে বুঝানো হয়ে থাকে- ভারতবতর্ষের স্থানীয় গণমানুষের দ্বারা সৃষ্ট এবং চর্চিত সঙ্গীতের সামগ্রিক রূপ। এই সঙ্গীতের উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষা ও সাঙ্গীতিক উপকরণসমূহ। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রাথমিক উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় গীত-বাদ্য-নৃত্যকে। এসকল উপকরণের ক্রমবির্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, লোক সঙ্গীত এবং উভয়ের সংমিশ্রণে সৃষ্ট মিশ্রধারার সঙ্গীত।

ভারতবর্ষের সঙ্গীতের আদিরূপ নিয়ে আলোচনা করা আগে- এখানাকার জনগোষ্ঠীর দৈহিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব জানা প্রয়োজন। পৃথিবীর ভূমণ্ডল এবং জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরণ করলে, দেখা যায়- ভারতবর্ষের সকল মানুষই বহিরাগত। ভূতাত্ত্বিকদের মতে- প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ ৩০ হাজার বৎসর আগে ভারতীয় পাতের সাথে ইউরেশিয়ান পাতের প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং এর ফলে হিমালয় পর্বতমালার উত্থান ঘটে। একই কারণে হিমালায়ের একদিকে তৈরি হয়েছিল ভারতবর্ষ অন্যদিকে মহাচীন। এই সংঘর্ষের কারণে, হিমালয়ের উভয় পার্শ্বের উদ্ভিদ এবং প্রাণীসমূহ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল এই সময় অগভীর সমুদ্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। কালক্রমে ভারতীয় জলমগ্ন অংশ সাগরতল থেকে জেগে উঠেছিল। একই সাথে ভারতবর্ষের আশপাশের অঞ্চলের জীবজগতের প্রজাতিসমূহ ভারতবর্ষের নতুন পরিবেশের সাথে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। একই ভাবে ভারতবর্ষে মানুষ প্রবেশ করেছিল, ভারতবর্ষে মানুষের আগমন ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫-৬০ অব্দের দিকে।

প্রায় ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবির্ভূত হোমো স্যাপিয়েন্সদের আভির্ভাব হয়েছিল আফ্রিকার মরোক্কোতে। সম্ভবত পরবর্তী ৩০-৩৫ হাজার বছর ধরে এদের বিচরণক্ষেত্র ছিল মরোক্কোর বনভূমিতে। এই সময়ের ভিতরে নিজেদের প্রচেষ্টায় কিম্বা হোমো হাইডেলবার্গেনসিস হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের অনুসরণে এরা আগুন জ্বালানো এবং নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছিল। প্রায় ৪৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা তারও আগে নিয়ানডার্থাল-রা সুরের আবিষ্কার করেছিল। এখন পর্যন্ত সর্বপ্রাচীন বাঁশির নমুনা পাওয়া গেছে স্লোভেনিয়ার ডিভ্‌জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে। এই বাঁশিটি বর্তমানে ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি নামে পরিচিত। বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল এক বা দুই বছরের গুহাভল্লুকের বাম-ঊর্বাস্থি (left femur) থেকে। এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩৩.৬ মিলিমিটার (৫.৩৬ ইঞ্চি)। এর পূর্ণাঙ্গ ফুটোর ব্যাস ছিল ৯.৭ এবং ৯ মিলিমিটার। ফুটো দুটোর কেন্দ্রবিন্দুর দূরত্ব ৩৫ মিলিমিটার (১.৩৮ ইঞ্চি)। এই সময়ে আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সরা হয়তো সুরের সাথে পরিচিত ছিল। এই দাবির সপক্ষে এখনো কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থিত করা যায় নি।

ভারতীয় সঙ্গীত (খ্রিষ্টপূর্ব ১,২০, ০০০-২০০০ অব্দ)
ভারতের নেগ্রিটো জাতির আবির্ভাব

ক্রমবিবর্তনের ধারায় হাইডেলবার্গেনসিস হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের অনুগামী প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্সরা আফ্রিকায় বিকশিত হলেও, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এরা অচিরেই খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব মোচনের আফ্রিকা থেকে মানুষ অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একাংশ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, অন্য অংশ এশিয়া হয়ে অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়, প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। অন্য দলটি ইরিত্রিয়ার ভিতর দিয়ে লোহিত সাগর পার হয়ে আফ্রিকা সংলগ্ন এশিয়ায় ইয়েমেন অঞ্চলে প্রবেশ করে। এদের অগ্রগামী দল এই সময়ের ভিতর আরব উপদ্বীপ ও পারশ্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার থাকে ১ লক্ষ বৎসরের ভিতরে। এরপর এদের কিছু মানুষ মঙ্গোলিয়া ঘুরে চীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। অপর দলটি পারশ্য হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে এরা প্রবেশ করে প্রায় প্রায় ৭৫-৬০ হাজার বৎসর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। নৃ-বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন নেগ্রিটো।

এই যুগে নেগ্রিটোরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়, দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। নেগ্রিটোদের ভাষা কেমন ছিল তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এর পরে যে দল ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, তাদেরকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে অভিহিত করা হয়। প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা ভারতবর্ষে কোন সময় প্রবেশ করেছিল, তা সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না। ধারণা করা এরা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে চলে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামানে চলে গিয়েছিল। এই অনুমান করা হয়, কারণ আন্দমানে নেগ্রিটোদের অন্ততঃ ১২টি গোষ্ঠী অস্তিত্ব এখনো রয়েছে।

ভারতের নেগ্রিটো যুগের সঙ্গীত (৭৫-২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
এই যুগে নেগ্রিটোরা ভারতে প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা করেছিল। এরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়, দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে।

সম্ভবত এরা কৃষিকাজ জানতো না। তবে আগুনের ব্যবহার হয়তো জানতো। এরা গুহাবাসী ছিল বা বড় বড় গাছের নিচে দলবদ্ধভাবে বাস করতো। এদের প্রধান খাদ্য ছিল বন্য পশুপাখি। এছাড়া খাওয়ার উপযোগী ফলমূল ও লতা আহার করতো। এদের হাতেই পত্তন ঘটেছিল ভারতের মধ্য প্রস্তরযুগ। খ্রিষ্টপূর্ব ১০-৬ হাজার বৎসরের ভিতরে এই মধ্য এই মধ্য প্রস্তরযুগের ব্যাপ্তীকাল ধরা হয়। এই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় দক্ষণ ভারতের তিনেভেলি, গুজরাটের সবরমতি, বোম্বাই-এর উপকূলে, গোদাবরী  ও নর্মদা নদীর  উপত্যাকায়, মহীশূরের ব্রহ্মগিরি অঞ্চলে।  ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম বাংলার দুর্গাপুরে কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এসব নমুনাকে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০০ বৎসরের পুরানো হিসেবে দাবি করেছিলেন। অনেকের মতে এই নমুনা খ্রিষ্টপূর্ব ৮ থেকে ১২ হাজার বৎসরের পুরানো। মধ্য প্রস্তরযুগের নেগ্রিটোরা পাথরের ফলা তৈরি করে তীরের মাথায় ব্যবহার করতে শিখেছিল। মাটির তৈরি পাত্র তৈরির কৌশল তারা শিখেছিল বটে। কিন্তু কুমোরের চাকা তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। এযুগের নেগ্রিটোদের প্রধান খাবার ছিল বন্য পশু-পাখি। তবে তারা কিছু প্রাণীকে পোষ মানানোর চেষ্টা করেছিল। এই সময় কৃষিকাজের চেষ্টা তারা করেছিল, কিন্তু পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে নি।

নেগ্রিটোদের ভাষা কেমন ছিল তা জানার কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে এদের সঙ্গীত সম্পর্কেও কোনো ধারণা লাভ করা যায় না। সম্ভবত এরা বাঁশি বা তালযন্ত্রের ব্যবহার করতো। সম্ভবত পাতার বাঁশির পাশাপাশি নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদের শাখা থেকে সৃষ্ট বাঁশি তৈরি করতে পারতো। এদের কণ্ঠসঙ্গীত ছিল আদিম পর্যায়ের।

ভারতের প্রোটো-অস্ট্রালয়েড যুগের সঙ্গীত (২০-৬ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
নেগ্রিটোদের পরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা। ধারণা করা এরা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে চলে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামানে চলে গিয়েছিল। এই অনুমান করা হয়, কারণ আন্দমানে নেগ্রিটোদের অন্ততঃ ১২টি গোষ্ঠী অস্তিত্ব এখনো রয়েছে।

ভারতের মূল-ভূখণ্ডে টিকে থাকা অবশিষ্ট নেগ্রোটোদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের হয়তো কিছুটা সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তবে তবে এরা প্রটো অষ্ট্রালয়েডদের সাথে মিশে গিয়ে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। মূলত প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বা এদের মিশ্র জাতিসত্তার দ্বরা ভারতবর্ষে কৃষির সূচনা হয়েছিল। তবে খাদ্যসংগ্রহের প্রধান বিষয় ছিল শিকার। শিকারের জন্য এরা ব্যবহার করতো তীর-ধনুক, বর্শা এবং নানা ধরনের ফাঁদ।

প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের ভাষা ছিল। এদের ভাষা-পরিবারকে ভাষা বিজ্ঞানরা এর নাম দিয়েছেন অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার। এই পরিবারে ভাষা-উপ-পরিবার হলো- মুণ্ডা। বঙ্গদেশে মুণ্ডা ভাষা-উপরিবারের সদ্স্য হলো সাঁওতালি, মুণ্ডারি, কোল ইত্যাদি।

আদিম ভারতীয় ভাষা এবং সঙ্গীতের আদি রূপ গড়ে উঠেছিল এদের মাধ্যমেই। এই সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল আদিম লোকসঙ্গীত। আদিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় আদর্শে সৃষ্ট গান। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ভিতরে ছিল শিশুর জন্মোৎসব, অন্নপ্রাসন, প্রেম-বিরহ, প্রত্যাহিক জীবনের সুখ-দুঃখের গান। অন্য দিকে ছিল প্রকৃতি-পূজার সূত্রে সৃষ্ট আদিম ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক গান। দেব-পূজা, প্রেতপূজা ইত্যাদি প্রচলিত হয়েছিল মানুষের কল্যাণার্থে। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল আদিম ভক্তিগীতি। এরা সুরযন্ত্র হিসেবে বাঁশের বাঁশি, তন্ত্রদ্বারা তৈরি সারিন্দা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতো। তাল যন্ত্র হিসেবে এদের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল মাদল ও ঢোলক জাতীয় বাদ্যযন্ত্র।

ভারতের দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয় যুগ (৬-২ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর পরে এবং আর্যদের ভারতে প্রবেশের আগে দ্রাবিড়রা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে যে সকল নমুনা এই অঞ্চলের হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে এই সভ্যতাকে সামগ্রিকভাবে 'সিন্ধু সভ্যতা' নামে অভিহিত করা হয়। আবার  এবং M. Witzel -এর মতো অনেকে গবেষক মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ছিল আর্যদের অগ্রবর্তী দল এবং অনেকে মনে করেন, এদের দ্বারা ঋগ্বেদের আদি অংশ রচিত হয়েছিল। দ্রাবিড়রা ধীরে ধীরে দক্ষিণ ভারতে নিজেদের বসতি স্থাপন করা শুরু করে। অনেক মনে করেন বেলুচিস্তানের ব্রাহুই ভাষাভাষীরা দ্রাবিড়দের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। ব্রাহুইরা তুলনামূলকভাবে ভারতীয় দ্রাবিড়দের চেয়ে ফর্সা, লম্বা এবং সুদর্শন।

প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয় মহাজাতি প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান এবং হিমালয়ের ভারতবর্ষে অভিমুখী অঞ্চল নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলের মোঙ্গোলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীন পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। স্থানীয় প্রোটো-অস্ট্রালয়েড -দের সাথে সংমিশ্রণও ঘটেছিল। বাঙলি জাতিগোষ্ঠীর সাথে এদের সংমিশ্রণ ঘটেছে পূর্ব-ভারতের পাহাড়ী মোঙ্গলয়েডদের সাথে।

আর্যদের আসার আগে নেগ্রিটোরিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড , দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলীয়-রা ভারতবর্ষে একটি মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি করেছিল। এদেরকে মোটা দাগে অনার্য বা প্রাকৃতজনগোষ্ঠী বলা হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারীদের বলা যেতে পারে পূর্ব-ভারতীয় প্রাকৃত জন। এদের ভিতর নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড -দের প্রভাব বেশি। ধারণা করা যায়, রক্তের মিশ্রণের পাশাপাশি এদের ভাষা ও সঙ্গীত নতুন রূপ লাভ করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় গড়ে ওঠা সভ্যতা-সংস্কৃতির কতটা নির্ভেজাল দ্রাবিড়দের নিজস্ব ছিল, আর কতটা মিশ্র জনগোষ্ঠীর ছিল, তা নিরূপণ করাটা সত্যিই মুশকিল। নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলীয় মহাজাতি সত্তার সমন্বয়ে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে মিশ্র মানবগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, তার দ্বারা তৎকালীন ভারতবাসীদের মিশ্র দৈহিক রূপ গঠিত হচ্ছিল। একই সাথে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ছিল, মিশ্র সংস্কৃতি।

প্রাক্-আর্য যুগের সামগ্রিক সাঙ্গীতক রূপরেখা
নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড , দ্রাবিড় সত্তার সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতির হাতে পত্তন হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু উপত্যাকা খননের সূত্রে আমরা, তৎকালীন মানুষের যে সকল ব্যবহারিক উপকরণ পাই, তার ভিতরে রয়েছে বেশ কিছু সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত নমুনা। এর ভিতরে রয়েছে নৃত্যরতা নারী, দু'তিনটি তন্ত্রীযুক্ত হার্পের মতো বীণা, চামড়া আচ্ছাদিত মৃদঙ্গ, করতাল ইত্যাদি। এই সকল নমুনা দেখে ধারণা করা যায়,

সিন্ধুসভ্যতায় প্রাপ্ত নৃত্যরতা নারীর ব্রোঞ্জ মূর্তি।

সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের চর্চা ছিল। দ্রাবিড় সংস্কৃতির সঙ্গীতের লিখিত কোনো বিবরণ বা ইতিহাস পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র এবং সঙ্গীত উপাদান থেকে অনুমান করা যায়, নগরের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে আদিম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল।

নগরকেন্দ্রিক সিন্ধুসভ্যতায় বিশিষ্ট সঙ্গীত-শিল্পীরা সঙ্গীতের চর্চা করতেন এবং তাতে রাজা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এর বাইরে গ্রাম্য সাধারণ মানুষের ভিতরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল নিজেদের আনন্দে। এরা নিজেদের পৃষ্ঠপোষক নিজেরা ছিল। এদেরকে ভারতের প্রাচীন প্রাকৃতজন হিসেবে চিহ্নিত করলে, সে সকল মানুষের ভাষাকে বলতে হয় প্রাচীন প্রাকৃতজনের ভাষা এবং এদের সঙ্গীতকেও বলা যেতে পারে প্রাচীন প্রাকৃতজনের লোকসংগীত।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের যে ধরনের চর্চা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা আর্যদেরদের ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্বতাত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু-উপত্যকার ধ্বংসম্তুপ আবিষ্কার করার পর,  ১৯২২ থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যস্ত ধারাবাহিকভাবে খননকার্য চলেছিল। এই খননকার্যের সূত্রে  সিন্ধু উপত্যাকার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয় সভ্যতার নানা উপাদান আবিষ্কার হয়েছে। এই সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের আদিম অধ্যায়ে সঙ্গীতের যে সকল উপকরণের সন্ধান পাই তা হলো-

গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপ যদি সঙ্গীত হয়ে থাকে, তাহলে- যথার্থই সিন্ধুসভ্যতায় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল।  গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপ যদি সঙ্গীত হয়ে থাকে, তাহলে- যথার্থই সিন্ধুসভ্যতায় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল। এই সঙ্গীতের ধারার বিঘ্ন ঘটেছিল আর্যদের আগমনের সূত্রে। আর্যরা আগে থেকেই সঙ্গীতের সাত সুরের সন্ধান পেয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না। তবে আর্য-লোকসঙ্গীতে বাঁশি, মৃদঙ্গ, ততযন্ত্র, সাতসুর ইত্যাদির ব্যবহার ছিল এমনটা ভাবা যেতেই পারে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের যে ধরনের চর্চা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা আর্যদেরদের ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে পারশ্য থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল আর্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী। ভারতে নবাগত আর্যদের দ্বারা পত্তন ঘটেছিল- ভারতীয় আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠী। এদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সঙ্গীত।

পরবর্তী অধ্যায়: বৈদিক যুগ: খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০- ৬০০ অব্দ


তথ্যসূত্র: