|
নেগ্রিটোদের ভাষা কেমন ছিল তা জানার কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে এদের সঙ্গীত সম্পর্কেও কোনো ধারণা লাভ করা যায় না। সম্ভবত এরা বাঁশি বা তালযন্ত্রের ব্যবহার করতো। সম্ভবত পাতার বাঁশির পাশাপাশি নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদের শাখা থেকে সৃষ্ট বাঁশি তৈরি করতে পারতো। এদের কণ্ঠসঙ্গীত ছিল আদিম পর্যায়ের।
ভারতের প্রোটো-অস্ট্রালয়েড যুগের সঙ্গীত
(২০-৬ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
নেগ্রিটোদের পরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা। ধারণা করা এরা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬
হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো
নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে চলে গিয়েছিল। কিম্বা এরা
দক্ষিণের দিকে সরে গিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামানে চলে গিয়েছিল। এই অনুমান করা হয়,
কারণ আন্দমানে
নেগ্রিটোদের অন্ততঃ ১২টি গোষ্ঠী অস্তিত্ব এখনো রয়েছে।
ভারতের মূল-ভূখণ্ডে টিকে থাকা অবশিষ্ট নেগ্রোটোদের সাথে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের হয়তো কিছুটা সংমিশ্রণ
ঘটেছিল। তবে তবে এরা প্রটো অষ্ট্রালয়েডদের সাথে মিশে গিয়ে
নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। মূলত
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বা এদের মিশ্র জাতিসত্তার দ্বরা
ভারতবর্ষে কৃষির সূচনা হয়েছিল। তবে খাদ্যসংগ্রহের প্রধান বিষয় ছিল শিকার।
শিকারের জন্য এরা ব্যবহার করতো তীর-ধনুক, বর্শা এবং নানা ধরনের ফাঁদ।
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের ভাষা ছিল। এদের ভাষা-পরিবারকে ভাষা বিজ্ঞানীরা
এর নাম
দিয়েছেন অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার। এই পরিবারে ভাষা-উপ-পরিবার হলো- মুণ্ডা। বঙ্গদেশে
মুণ্ডা ভাষা-উপরিবারের সদ্স্য হলো সাঁওতালি,
মুণ্ডারি, কোল ইত্যাদি।
আদিম ভারতীয় ভাষা এবং সঙ্গীতের আদি রূপ গড়ে উঠেছিল এদের মাধ্যমেই। এই
সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল আদিম লোকসঙ্গীত। আদিম সংস্কৃতির অংশ
হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় আদর্শে সৃষ্ট গান।
সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ভিতরে ছিল শিশুর জন্মোৎসব, অন্নপ্রাসন, প্রেম-বিরহ,
প্রত্যাহিক জীবনের সুখ-দুঃখের গান। অন্য দিকে ছিল প্রকৃতি-পূজার সূত্রে সৃষ্ট আদিম
ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক গান। দেব-পূজা, প্রেতপূজা ইত্যাদি প্রচলিত হয়েছিল মানুষের
কল্যাণার্থে। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল আদিম ভক্তিগীতি। এরা সুরযন্ত্র হিসেবে বাঁশের
বাঁশি, তন্ত্রদ্বারা তৈরি সারিন্দা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতো। তাল যন্ত্র
হিসেবে এদের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল মাদল ও ঢোলক জাতীয় বাদ্যযন্ত্র।
ভারতের দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয় যুগ (৬-২ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীর পরে এবং
আর্যদের ভারতে প্রবেশের আগে
দ্রাবিড়রা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু
নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে যে সকল নমুনা এই অঞ্চলের হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো
থেকে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে এই সভ্যতাকে সামগ্রিকভাবে 'সিন্ধু সভ্যতা' নামে
অভিহিত করা হয়। আবার এবং M. Witzel -এর মতো অনেকে গবেষক মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার
অধিবাসীরা ছিল আর্যদের অগ্রবর্তী দল এবং অনেকে মনে করেন, এদের দ্বারা ঋগ্বেদের আদি
অংশ রচিত হয়েছিল। দ্রাবিড়রা ধীরে ধীরে দক্ষিণ ভারতে নিজেদের বসতি স্থাপন করা শুরু
করে। অনেক মনে করেন বেলুচিস্তানের
ব্রাহুই ভাষাভাষীরা দ্রাবিড়দের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। ব্রাহুইরা
তুলনামূলকভাবে ভারতীয় দ্রাবিড়দের চেয়ে ফর্সা, লম্বা এবং সুদর্শন।
প্রায় ৩ থেকে ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভারতবর্ষে
মোঙ্গলীয় মহাজাতি প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও
উত্তর ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী
তিব্বত, ভুটান এবং হিমালয়ের ভারতবর্ষে অভিমুখী অঞ্চল নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলের মোঙ্গোলীয়রা প্রবেশ করেছিল
মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীন পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। স্থানীয়
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড -দের সাথে সংমিশ্রণও ঘটেছিল। বাঙলি জাতিগোষ্ঠীর সাথে এদের
সংমিশ্রণ ঘটেছে পূর্ব-ভারতের পাহাড়ী মোঙ্গলয়েডদের সাথে।
আর্যদের আসার আগে
নেগ্রিটোরিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
,
দ্রাবিড় এবং
মোঙ্গলীয়-রা ভারতবর্ষে একটি মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি করেছিল। এদেরকে মোটা দাগে
অনার্য বা প্রাকৃতজনগোষ্ঠী বলা হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারীদের বলা যেতে পারে
পূর্ব-ভারতীয় প্রাকৃত জন। এদের ভিতর
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
-দের প্রভাব বেশি। ধারণা করা যায়, রক্তের মিশ্রণের পাশাপাশি এদের ভাষা ও সঙ্গীত
নতুন রূপ লাভ করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায়
গড়ে ওঠা সভ্যতা-সংস্কৃতির কতটা নির্ভেজাল দ্রাবিড়দের নিজস্ব ছিল, আর কতটা মিশ্র
জনগোষ্ঠীর ছিল, তা নিরূপণ করাটা সত্যিই মুশকিল।
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড,
দ্রাবিড় এবং
মোঙ্গলীয় মহাজাতি সত্তার সমন্বয়ে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে মিশ্র মানবগোষ্ঠী
গড়ে উঠেছিল, তার দ্বারা তৎকালীন ভারতবাসীদের মিশ্র দৈহিক রূপ গঠিত হচ্ছিল। একই সাথে
সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ছিল, মিশ্র সংস্কৃতি।
প্রাক্-আর্য যুগের সামগ্রিক সাঙ্গীতক রূপরেখা
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
,
দ্রাবিড় সত্তার সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতির হাতে পত্তন হয়েছিল
সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু উপত্যাকা খননের সূত্রে আমরা, তৎকালীন মানুষের যে সকল
ব্যবহারিক উপকরণ পাই, তার ভিতরে রয়েছে বেশ কিছু সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত নমুনা। এর
ভিতরে রয়েছে নৃত্যরতা নারী, দু'তিনটি তন্ত্রীযুক্ত হার্পের মতো বীণা, চামড়া
আচ্ছাদিত মৃদঙ্গ, করতাল ইত্যাদি। এই সকল নমুনা দেখে ধারণা করা যায়,
সিন্ধুসভ্যতায় প্রাপ্ত নৃত্যরতা নারীর ব্রোঞ্জ মূর্তি। |
সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের চর্চা ছিল। দ্রাবিড় সংস্কৃতির সঙ্গীতের লিখিত কোনো
বিবরণ বা ইতিহাস পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র এবং সঙ্গীত উপাদান থেকে
অনুমান করা যায়, নগরের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে আদিম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ
ঘটেছিল।
নগরকেন্দ্রিক সিন্ধুসভ্যতায় বিশিষ্ট সঙ্গীত-শিল্পীরা সঙ্গীতের চর্চা করতেন এবং তাতে
রাজা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এর বাইরে গ্রাম্য সাধারণ মানুষের
ভিতরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল নিজেদের আনন্দে। এরা নিজেদের পৃষ্ঠপোষক নিজেরা ছিল।
এদেরকে ভারতের প্রাচীন প্রাকৃতজন হিসেবে চিহ্নিত করলে, সে সকল মানুষের ভাষাকে বলতে
হয় প্রাচীন প্রাকৃতজনের ভাষা এবং এদের সঙ্গীতকেও বলা যেতে পারে প্রাচীন প্রাকৃতজনের
লোকসংগীত।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের যে ধরনের
চর্চা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা আর্যদেরদের
ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্বতাত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু-উপত্যকার
ধ্বংসম্তুপ আবিষ্কার করার পর, ১৯২২ থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যস্ত ধারাবাহিকভাবে খননকার্য চলেছিল। এই খননকার্যের সূত্রে সিন্ধু উপত্যাকার
বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয় সভ্যতার নানা উপাদান আবিষ্কার হয়েছে। এই
সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের আদিম অধ্যায়ে সঙ্গীতের যে সকল উপকরণের সন্ধান পাই তা হলো-
গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপ যদি সঙ্গীত হয়ে থাকে, তাহলে- যথার্থই
সিন্ধুসভ্যতায় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল। গীত-বাদ্য-নৃত্যের সমন্বিতরূপ যদি সঙ্গীত
হয়ে থাকে, তাহলে- যথার্থই সিন্ধুসভ্যতায় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল। এই সঙ্গীতের ধারার
বিঘ্ন ঘটেছিল আর্যদের আগমনের সূত্রে। আর্যরা আগে থেকেই সঙ্গীতের সাত সুরের সন্ধান
পেয়েছিল কিনা, তা জানা যায় না। তবে আর্য-লোকসঙ্গীতে বাঁশি, মৃদঙ্গ, ততযন্ত্র,
সাতসুর ইত্যাদির ব্যবহার ছিল এমনটা ভাবা যেতেই পারে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের যে ধরনের
চর্চা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা আর্যদেরদের
ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব-কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে পারশ্য থেকে
ভারতে প্রবেশ করেছিল আর্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী। ভারতে নবাগত
আর্যদের দ্বারা পত্তন ঘটেছিল- ভারতীয় আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠী। এদের ভাষা ও সংস্কৃতির
সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সঙ্গীত।
পরবর্তী অধ্যায়:
বৈদিক যুগ:
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০- ৬০০ অব্দ