নজরুলসঙ্গীতের কালানুক্রমিক সূচি
তৃতীয় পর্ব
১৮-১৯ বছর অতিক্রান্ত বয়স
সিয়ারসোল স্কুল থেকে বাঙালি পল্টন


১৮ বছর অতিক্রান্ত বয়স
১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (বৃহস্পতিবার ২৪শে মে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৭ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছিল। আর তাঁর ১৮ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (শুক্রবার ২৫শে মে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ)। এবং ১৮ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শুক্রবার ২৪শে মে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ)।
 

নজরুল তাঁর ১৮ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে সিয়ারসোল স্কুলে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে  যখন ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই সময় ইউরোপ জুড়ে চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মিত্রবাহিনীর পক্ষালম্বী ব্রিটিশরা যুদ্ধের জন্য তাদের উপনিবেশগুলো থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেছিল। এই সূত্রে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। বঙ্গদেশ থেকে বাঙালি যুবকদের সৈন্য ব্রিটিশ সেনাবহিনীতে যোগদানের প্রজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল। এটাই ছিল সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাংলা থেকে সৈনিক সংগ্রহের উদ্যোগ। উল্লেখ্য, নজরুল তাঁর ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষার প্রিটেষ্ট পরীক্ষা ফেলে বাঙালি পল্টনে সেনাদলে নাম লেখান।

বাঙালি পল্টন
সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাংলা থেকে সৈনিক সংগ্রহের উদ্যোগ, ব্রিটিশদের উৎসাহে ঘটে নি। মূলত বাংলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চাপের মুখে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের অন্তর্ভুক্ত না করার পিছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ ছিল। [বিস্তারিত: বাঙালি পল্টন]

বাঙালি পল্টনে নজরুল ইসলাম
বাঙালি পল্টনে যাওয়ার আগে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুলাই সিয়ারসোল থেকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক মৌলবি আব্দুল গফুরকে। [দ্রষ্টব্য: আব্দুল গফুরকে পাঠানো পত্র]

এই চিঠিতে বর্ণিত টাকা-পয়সার দায় মিটেছিল কিনা জানা যায় না। এরপর সম্ভবত নজরুল বাঙালি পল্টনের যোগদানের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সম্ভবত ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩২৪), কলকাতার হাওড়া রেলস্টেশন থেকে প্রশিক্ষণের জন্য নজরুল লাহোরে যান। এরপর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পেশোয়ারের কাছে নৌশেরাতে চলে যান। এখানে তিন মাসের সামারিক  প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখানে সামরিক শিক্ষার পাশাপাশি ফারসি ভাষা শিখেছিলেন এক পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে। এরপর তিনি করাচির উপকণ্ঠে গাজা লাইনে ৪৯ নম্বর বাঙালি প্লটনের সদর দফতরে সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একাংশ যুদ্ধের জন্য বসরা রওনা হয়। এই সময় নজরুল কলকাতাতেই ছিলেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস (পৌষ-মাঘ, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত  বাঙালি পল্টনের এই দলটি বাগদাদে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদ দখল করলে, বেঙ্গল পল্টনকে বাগদাদের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত হয়। এই সময় বাঙালি পল্টন বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনার নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে। বাগদাদে অবস্থানের শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে ৬৩ জন বাঙালি সৈন্য মৃত্যুবরণ করে । এ কারণে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে, ৪৯তম বেঙ্গলিজকে বাগদাদ থেকে আজিজিয়া এবং কূত-এ পাঠানো হয়। সেখানে অবস্থানকালে সৈনিকদের স্বাস্থ্যগত অবস্থার বিশেষ উন্নতি না হওয়ায়, অক্টোবর মাসের শেষের দিকে কূত থেকে এদেরকে বসরার সন্নিকটে তানুমাতে পাঠানো হয়। তানুমা, কূত ও আজিজিয়া অবস্থানকালে বেঙ্গলিজ মুলত বিভিন্ন নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে এবং এর পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। যতদূর জানা যায়,

নজরুল শুরু থেকেই করাচিস্থ ৪৯ নম্বর বাঙালি প্লটনের সদর দফতরে কাটান। প্রাণতোষ ভট্টাচার্যের কাছে লেখা বাঙালি পল্টনের সৈনিক শম্ভু রায়ের লেখা চিঠি থেকে জানা যায় [
শম্ভু রায়ের পত্র: ৫ম পত্র]- কোয়াটার মাস্টার জমাদার মনীরুদ্দীন আহমেদ, শম্ভু রায়কে অনুরোধ করেন যে- নজরুলকে যেন তাঁর অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই আবেদনের সূত্রে নজরুলকে কোয়াটার স্টাফে নায়ক হিসেবে অন্তরভুক্ত হন। এই নিয়োগের ফলে তিনি নিয়মিত প্যারেড, গার্ড ডিউটি, ফেটিগ ডিউটি ইত্যাদি থেকে মুক্তি পান। ফলে সৈনিক জীবনের বাঁধা-ধরা জীবনের বাইরে তিনি বাংলা সাহিত্য পাঠের সময় পেয়েছিলেন। পরে নজরুলের কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তাঁর কাজ ছিল সৈনিকদের বুট, প্যান্ট, কোট, মোজা কম্বল ইত্যাদি সরবরাহ করা।

এই কাজে থাকার সুবাদে তিনি সে সময়ের তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত লেখকদের রচনা পাঠ করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর এই পাঠের প্রধান উৎস ছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা সাময়িকী। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য সাময়িকী ছিল
প্রবাসী, ভারতী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, সওগাত , মানসী ও মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র  ইত্যাদি। শম্ভু রায়ের পত্র থেকে জানা যায়, এই নজরুলের সংগ্রহে ছিল রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের রচনা। এরই মধ্য দিয়ে তাঁর ভিতরে জেগে উঠেছিল তাঁর লেখক হওয়ার বাসনা। এই সূত্রে তিনি করাচি সেনানিবাস থেকে পত্রযোগে বিভিন্ন পত্রিকার সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন। এসকল পত্রের সাথে তিনি তাঁর রচিত গল্প ও কবিতা পাঠানো শুরু করেন। কিন্তু সদ্য পাঠানো রচনাগুলো- অপটু হাতের লেখা বিবেচনায় বাতিল হয়ে যেতো। তারপরেও তিনি নিরুৎসাহিত সাহিত্যচর্চা থেকে বিরত হন নি। অবশেষে তাঁর প্রথম রচনা সওগাত পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ (মে-জুন ১৯১৯) সংখ্যায় 'বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী'  নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

সে সময়ে এই সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গীতদল নজরুলের ঘরের সামনে গানের আসর বসাতেন। সে আসরে নজরুল গান পরিবেশন করে দর্শকদের আনন্দ দিতেন। সৈনিকদের পরিবেশিত কয়েকটি গানের উল্লেখ পাওয়া যায় শম্ভু রায়ের পত্র থেকে। এ গানগুলোর ভিতরে ছিল- চালাও পানসি বেলঘরিয়া, ঘি চপচপ কাবলী মটর, দে গরুর গা ধুইয়ে। নজরুলের
হারমোনিয়ামে হাতে খড়ি হয়েছিল চুরুলিয়াতে। তবে অর্গযান বাজানো শিখেছিলেন হাবিলদার নিত্যানন্দ দে-র কাছে।

রুশ বিপ্লবকে তিনি শ্রদ্ধার সাথে দেখা শুরু করেছিলেন এই সময়ে। সে সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীতে রুশ বিপ্লব আলোচনা বা এই বিষয়ের কোনো রচনা পড়া নিষিদ্ধ ছিল। সে কারণে রুশ বিপ্লবে আগ্রহী সৈনিক গোপনে সেসব রচনা পাঠ করতেন। নজরুল এই দলে ছিলেন। পল্টনের জীবন শেষ কলকাতায় নজরুলের সাথে মুজাফ্ফর আহমদরে সমাজতন্ত্রের দর্শনে যে মতৈক্য হয়েছিল, তার সূত্রপাত ঘটেছিল করাচি সেনানিবাসে।

পত্রযোগাযোগের মাধ্যমে সখ্য গড়ে উঠেছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সহ-সম্পাদক মুজাফ্ফর আহমদরে সাথে। উল্লেখ্য, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে (বৈশাখ ১৩২৫) কলকাতার ৪৭/২ মির্জা‌পুর স্ট্রিট থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। শুরুর দিকে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহমোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের যৌথ সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। এর সহ-সম্পাদক ছিলেন তিনজন। এঁরা হলেন মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ, মঈনউদ্দীন হোসায়েন ও  কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ । নজরুল এই পত্রিকার শুরু থেকেই গ্রাহক হয়েছিলেন মুজাফ্ফর আহমদ-এর মাধ্যমে। মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর কাজী নজরুল স্মৃতি কথা' গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন-

'৪৯ নম্বর বেঙ্গলী রেজিমেন্টের (49th Bengali Regiment) কয়েকজন সৈনিক শুরু থেকেই অর্থাৎ ১৯১৮ সালের এপ্রিল-মে মাস হতেই " বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে পত্রালাপও করতেন। কাজী নজরুল ইসলামও এই পত্রালাপকারীদের একজন ছিল।'
নজরুলের সাথে মুজাফ্ফর আহমদ হৃ্দ্যতা গড়ে উঠলে, নজরুলের ১৮ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে  কোনো রচনা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় নি।

নজরুলের ১৯ বৎসর অতিক্রান্ত বয়স

১৩২৫ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শুক্রবার ২৪শে মে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৮ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছিল। আর তাঁর ১৯ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার ২৫শে মে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ)। আর ১৯ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার ২৪শে মে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৯ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শুরু হয়েছিল করাচিস্থ ৪৯ নম্বর বাঙালি প্লটনের সদর দফতরে। সৈনিক জীবনের আড়ালে- লেটো গানের গীতকার ও সঙ্গীতশিল্পী, সিয়ারসোল স্কুলের কবি নজরুলের সাহিত্য-প্রেম নূতন করে জেগে উঠেছিল। করাচি সেনানিবাসের শিল্প-সাহিত্য বর্জিত অঙ্গনে, বিশেষ করে অবাঙালি পরিবেশের ভিতরে- সে সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ বৃদ্ধিতে ইন্ধন যুগিয়েছিল প্রবলভাবে।

নজরুলের ১৮ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা" সহ-সম্পাদ কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ-এর সাথে তাঁর পত্রযোগাযোগ অব্যাহত ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন সওগাত পত্রিকা'র সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন

সওগাত ও নজরুলের প্রথম প্রকাশিত রচনা:
উল্লেখ্য, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর (সোমবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৩২৫) কলকাতা থেকে, এটি প্রথমে মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এর সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন। সে সময় এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় একটি সাহিত্য চক্র গড়ে উঠেছিল। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিছুদিন পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় প্রকাশিত হয়।  নজরুল এই পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলেন এবং ১২জন গ্রাহক সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। গ্রাহক সংগ্রহের জন্য সওগাত পত্রিকার 'বৈশাখ ১৩২৬' সংখ্যায় নজরুলকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়েছিল।

নজরুল প্রায় নিয়মিতভাবে এই পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন এ বিষয়ে তাঁর -'সওগাতও নজরুল' প্রবন্ধে লিখেছেন-
'এই সময়েই হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের করাচীর বাঙালী পল্টন থেকে 'সওগাত'-এর লেখা পাঠাতে শুরু করেন। প্রতি লেখার সাথেই তিনি দীর্ঘ পত্র পাঠাতেন। তখনকার লেখাগুলো ছিল কিছুটা উচ্ছ্বাস-ভরা, সামঞ্জস্যহীন। এসব কারণে তাঁর লেখা 'সওগাতে' প্রকাশ করা তখন সম্ভবপর হয় নি। একজন, উচ্ছ্বাসময় ও আবেগময় কবিযশপ্রার্থীর কাঁচা রচনা হিসাবেই তখন সে-সব লেখা বিবেচিত হত, এবং যথারীতি নিক্ষিপ্ত হতো কাগজ-ফেলার ঝুড়িতে। কিন্তু এতেও এই কবিযশপ্রার্থী নিবৃত্ত হতেন না, তিনি লেখা পাঠাতেই থাকতেন।'
লেখা ছাপা না হওয়ার দুঃখ ও অভিমান নজরুলের মনে জমা হয়েছিল। এরই ভিতরে নজরুলের প্রথম একটি রচনা ' বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' প্রকাশিত হয়েছিল সওগাত পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ (মে-জুন ১৯১৯) সংখ্যায়। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন এ বিষয়ে তাঁর -"'সওগাত' ও নজরুল" প্রবন্ধে লিখেছেন-

'একদিন নজরুলের এক চিঠি এসে হাজির। তাতে আবেগ আর অভিমানের সুর জড়ানো। 'সওগাতে' প্রকাশের জন্য বহু কবিতা পাঠালাম, কিন্তু একটিও ছাপা হলো না।'- যতদূর মনে পড়ে চিঠিতে এই ছিল আবেদন। অবশ্য তখন পর্যন্ত কোনো কবিতা 'সওগাত'-এ প্রকাশিত না হলেও  ' বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী ' নামে আবেগময় রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। 'সওগাত'-এর প্রথম বর্ষ ৭ম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত এই রচনাটি উচ্ছ্বাসপূর্ণ হলেও ছিল বেশ সুন্দর আর আকর্ষণীয়। এই গুণেই রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'সওগাত'। ছাপার অক্ষরে এটাই নজরুলের প্রথম গদ্যরচনা।'

যদিও মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন 'বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী'-কে 'ছাপার অক্ষরে এটাই নজরুলের প্রথম গদ্যরচনা' উল্লেখ্ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুলের যেকোনো রচনার বিচারে এটাই ছিল প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত রচনা। স্মৃতিচারণা অনুসরণ করলে, অনুমান করা যায় ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলের দিকে ' বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' নামক গল্প রচিত হয়েছিল। পরে এই  গল্পটি ' রিক্তের বেদন' (ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ) গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

করাচি সেনানিবাসে থাকাকালে বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী '  ছাড়া নজরুলের রচিত বেশ কিছু রচনা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের পরে। এই রচনাগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দষ্টভাবে জানা যায় নি। তাই প্রকাশের বিচারে এ সকল রচনাগুলোকে নজরুলের ২০ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের ঘটনবলীর সাথে আলোচনা করা হলো। এই সময় ভারতীয় রাজনীতিতে দুটি বিশেষ ঘটনা নজরুলকে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছিল। যা তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবকে আরো তীব্রতর করেছিল। ঘটনা দুটি হলো-
নজরুলের ১৯ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষ দিন পর্যন্ত, ৪৯ নম্বর বেঙ্গলী রেজিমেন্টের (49th Bengali Regiment) -এর সদস্য হিসেবে করাচিতে ছিলেন।