কুন্তী
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা
{
পৌরাণিক সত্তা
|
কাল্পনিকসত্তা
|
কল্পনা
|
সৃজনশীলতা
|
দক্ষতা
|
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়
|
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত-সত্তা
|
সত্তা
|}
সমনাম: কুন্তী, পৃথা
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে–
কর্ণ,
যুধিষ্ঠির,
ভীম
ও
অর্জুন-এর
জননী।
কুন্তী
যদু বংশের রাজা
শূরসেন-এর
কন্যা এবং
কৃষ্ণের পিতা
বসুদেবের বোন।
শূরসেন
তাঁর বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে,
তাঁর প্রথম সন্তান
কুন্তিভোজকে দান করবেন।
যথা সময়ে
শূরসেনের একটি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করলে,
ইনি তাঁর নাম রাখেন পৃথা।
ইনি
কুন্তিভোজকে এই কন্যা দান করে।
পালক-পিতা
কুন্তিভোজের
নামানুসারে এই কন্যা কুন্তী নামে পরিচিতা হন।
একবার
দুর্বাসা
মুনি কুন্তীর অতিথি হয়ে এলে,
কুন্তী সেবা দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করেন।
এরপর
দুর্বাসা
কুন্তীকে এমন একটি মন্ত্র দান করেন যে,
যার দ্বারা ইনি যে দেবতাকে স্মরণ করবেন,
সেই দেবতাই এসে কুন্তীকে সংগম দ্বারা পরিতৃপ্ত করে পুত্র দান করবেন।
কৌতুহলবশতঃ কুমারী অবস্থাতেই একবার ইনি
সূর্য
দেবতাকে ডেকে বসেন এবং
সূর্যদেবের
সাথে মিলনের ফলে ইনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন।
যথা সময়ে ইনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলে,
লোকলজ্জার ভয়ে সেই পুত্রকে একটি পাত্রে রেখে জলে ভাসিয়ে দেন।
এই মহাভারতে পুত্রই
কর্ণ
নামে খ্যাতি লাভ করেন।
[মহাভারত,
আদিপর্ব:
একাধিকশতাধিকশততম অধ্যায়। কুন্তীর প্রতি দুর্ব্বাসার বর। কুন্তী-গর্ভে কর্ণের জন্ম।]
পরবর্তী কালে রাজা
কুন্তিভোজ
এঁর জন্য স্বয়ংবরা সভার আয়োজন করেন।
এই সভায় কুন্তী
পাণ্ডুর গলায় মালা দেন।
উল্লেখ্য এ ছাড়া
পাণ্ডু
পরে আরও একটি বিবাহ করেছিলেন।
পাণ্ডুর এই স্ত্রীর নাম ছিল
মাদ্রী।
বিবাহের একমাস পর
পাণ্ডু
দিগ্বিজয়ে বের হন এবং বিভিন্ন দেশ জয় করেন।
এর কিছুদিন পর ইনি কুন্তী ও
মাদ্রীকে সাথে নিয়ে
হিমালয়-এর [পর্বতমালা]
দক্ষিণ দিকের অরণ্যময় অংশে
যান।
একদিন
কিন্দম
মুনি হরিণের রূপ ধরে, ওই বনে এক হরিণীর সাথে সঙ্গমে রত হন।
সেই সময়
পাণ্ডু
সঙ্গমরত হরিণযুগলকে বাণ দ্বারা বিদ্ধ করেন।
এর ফলে হরিণরূপী
কিন্দম
মুনি নিহত হন।
মৃত্যুর পূর্বে
কিন্দম
পাণ্ডুকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, কোনো নারীর সাথে সঙ্গমে রত
হলে, পাণ্ডু মৃত্যুবরণ করবেন।
[মহাভারত,
আদিপর্ব:
দ্বাদশতাধিকশততম
অধ্যায়। কুন্তীর স্বয়ংবর। কুন্তীসহ পাণ্ডুর বিবাহ।]
[মহাভারত,
আদিপর্ব:
ত্রয়োদশধিকশততম
অধ্যায়। মাদ্রীসহ মাণ্ডুর বিবাহ। পাণ্ডুর দিগ্বিজয়।]
[মহাভারত,
আদিপর্ব:
চতুর্দ্দশাধিকশততম
অধ্যায়। পাণ্ডুর বনবিহার।]
[মহাভারত,
আদিপর্ব:
অষ্টাদশাধিকশততম অধ্যায়। পাণ্ডুর প্রতি মৃগরূপী মুনির শাপ]
এই অভিশাপের কারণে,
মাদ্রী
এবং
কুন্তী
উভয়ই স্বামী-সংসর্গ থেকে বঞ্চিত হন।
নিঃসন্তান দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য,
পাণ্ডুর অনুরোধে
কুন্তী
তিনজন দেবতার সাথে মিলিত হন এবং তিনটি
সন্তান লাভ করেন।
কুন্তী
প্রথমে ধর্মকে আহ্বান করে শতশৃঙ্গ পর্বতে মিলিত হন।
এই মিলনের ফলে কুন্তীর দ্বিতীয় পুত্র এবং প্রথম পাণ্ডব
যুধিষ্ঠিরের
জন্ম হয়।
এরপর
পাণ্ডুর অনুরোধে কুন্তী যথাক্রমে
বায়ু (পবন)
ও
ইন্দ্রের
সাথে মিলিত হন।
এই মিলনের ফলে তিনি আরও দুটি পুত্র লাভ করেন।
এঁরা হলেন যথাক্রমে
ভীম
ও
অর্জুন।
এরপর মাদ্রী
সপত্নীর মতো সন্তান কামনা করলে,
পাণ্ডুর
অনুরোধে কুন্তী এই মন্ত্রটি একবারের জন্য
মাদ্রীকে দান করেন।
ফলে মাদ্রী,
অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের
ঔরসে
নকুল
ও
সহদেব
নামে দুটি সন্তান লাভ করে।
এই পাঁচটি সন্তান পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ বলে এই পাঁচপুত্রকে পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো।
এর কিছুদিন পর একদিন
পাণ্ডু
অত্যন্ত কামার্ত অবস্থায় মাদ্রীর সাথে
মিলিত হন।
এবং সঙ্গমরত অবস্থায় ইনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরে কুন্তী এসে সকল বিষয় অবগত হয়ে স্বামীর সাথে সহমৃতা হতে চান।
কিন্তু
মাদ্রী
সকল দোষ নিজের মনে করে নিজেই সহমৃতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন।
ইনি তাঁর দুই পুত্র
নকুল
ও
সহদেবকে কুন্তীর হাতে সমর্পণ করে সহমৃতা হন।
রাজধানীতে ফিরে তিনি সন্তানদের নিয়ে
ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে থাকা শুরু
করেন।
এই সময় পঞ্চপাণ্ডব ধৃতরাষ্ট্রের একশত সন্তানের সাথে দ্রোণাচর্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণ
করেন।
অস্ত্রশিক্ষা শেষে কর্ণ অর্জুনের সকল অস্ত্রকৌশল দেখান এবং অর্জুনকে দ্বন্দ্ব
যুদ্ধে আহ্বান করেন।
এই সময় ভ্রাতৃবিরোধ আশঙ্কায় কুন্তী মূচ্ছিত হয়ে পড়েন।
পাণ্ডবদের শক্তিবৃদ্ধি দেখে দুর্যোধন যখন পঞ্চপাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য জতুগৃহে প্রেরণ করেন, তখন কুন্তী এঁদের সাথে ছিলেন। কিন্তু বিদুরের সহায়তায় এঁরা রক্ষা পান। বিদুরের প্রেরিত নৌকা যোগে এরা নদী পার হয়ে এক জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এই সময় ক্লান্ত হয়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ভীম একা সকলকে পাহারা দেন। এইখানকার হিড়িম্ব নামক এক রাক্ষস এদের মাংস খাওয়ার জন্য তাঁর বোন হিড়িম্বাকে পাঠান। কিন্তু হিড়িম্বা ভীমের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হিড়িম্বের অভিসন্ধির কথা বলে দেন। বোনের বিলম্ব দেখে হিড়িম্ব নিজে এলে, ভীম তাঁকে হত্যা করেন। পরে কুন্তীর অনুমতি নিয়ে হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন। এরপর সন্তানদের সাথে কুন্তী একচক্রা নগরীতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের আশ্রয়ে উঠে আসেন। এই নগরীতে বক নামক রাক্ষস প্রতিদিন নগরীর একজন করে মানুষ ভক্ষণ করতো। পাণ্ডবরা যেদিন ব্রাহ্মণের ঘরে আশ্রয় নেন, সেদিনই উক্ত ব্রাহ্মণকে রাক্ষসের আহার করার কথা ছিল। কুন্তী উক্ত ব্রাহ্মণের পরিবর্তে রাক্ষসের কাছে ভীমকে পাঠান। ভীম উক্ত রাক্ষসকে হত্যা করে একচক্রাবাসীদেরকে রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
এই নগরীতে থাকাকালীন সময়ে পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভার কথা জানতে পারেন। উক্ত সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে লাভ করলে- সভায় আহুত অন্যান্যরা পাণ্ডবদের আক্রমণ করে। পাণ্ডবরা যুদ্ধে সকলকে পরাজিত করে দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে কুন্তী'র কাছে আসেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব যখন ঘরে ফেরেন, তখন কুন্তীর ঘরের মধ্যে ছিলেন। পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তাঁরা একটি অপূর্ব সামগ্রী ভিক্ষা করে এনেছেন। কুন্তী না দেখেই বলেন,- তোমরা সকলে মিলে সেই জিনিস ভোগ কর। এরপর দ্রৌপদীকে দেখে ইনি বিব্রত হয়ে পড়েন। পরে ব্যাসের বিধান মতে- পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন।
এর কিছুদিন পর ধৃতরাষ্ট্র পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী এবং কুন্তীকে হস্তিনাপুরে নিয়ে আসেন। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থ নগর প্রতিষ্ঠা করে পৃথক রাজত্ব করতে থাকেন। শকুনীর কপট পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির হেরে গিয়ে ১২ বত্সর বনবাস ও ১ বত্সর অজ্ঞাতবাসের শাস্তি হিসাবে রাজধানী ত্যাগ করলে- কুন্তী বিদুরের কাছে আশ্রয় নেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে এসে কুন্তীর সাথে দেখা করেন। এই সময় কুন্তী কৃষ্ণের মারফত পঞ্চপাণ্ডবদেরকে ক্ষত্রিয়ের ন্যায় যুদ্ধ করে রাজ্য উদ্ধার করতে আদেশ দেন।
যুদ্ধের পূর্বে কুন্তী গঙ্গাতীরে কর্ণকে পুত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন এবং তাঁকে পাণ্ডবপক্ষে যোগদানের অনুরোধ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কর্ণ উক্ত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও কুন্তীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে- অর্জুন ছাড়া অন্য কোন পাণ্ডবকে তিনি হত্যা করবেন না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর পাণ্ডবরা সবার মৃতদেহ সত্কারের সময় কুন্তী তাঁদের কাছে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করে তাঁর উদ্দেশ্যেও তর্পণ করতে অনুরোধ করেন। এতে যুধিষ্ঠির ক্ষিপ্ত হয়ে অভিশাপ দেন যে- স্ত্রী জাতি কোন বিষয়ই গোপন রাখতে পারবে না।
যুদ্ধ শেষে রাজ্যলাভের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞশেষে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সাথে শতযূপ আশ্রমে গমন করেন। এখানে মাসে একবার আহার গ্রহণ করে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এই সময় বনের দাবানলে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সাথে ইনি মৃত্যুবরণ করেন।