হিন্দু থিয়েটার
খ্রিষ্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম সখের নাট্যশালা। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
[দ্রষ্টব্য: বাংলা থিয়েটার]

উল্লেখ্য, ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের হেরাসিম লেবেদেফ কলকাতায় দুটি বাংলায় অনূদিত নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। লেবেদেফের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন আর কোনো বাংলা নাটক তৈরি বা মঞ্চস্থ হয় নি। ফলে বাংলা অভিনয়শিল্পে তাঁর নাটক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। সে সময়ে বাঙালিরা মেতেছিল- যাত্রাপালা, পাঁচালি, কবিগান, আখড়াই, টপ্পা, হাফ আখড়াই গান নিয়ে। সেই সাথে ছিল কীর্তন, জারির মতো আধা লোকগান। বাউল, ভাটিয়ালি, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া ছিল আঞ্চলিক গান হিসেবে বিকশিত হয়ে চলেছিল।

ভারতবর্ষকে সুচারুরূপ শাসন এবং শোষণের জন্য, ইংরেজরা ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে। এই সময় এই কলেজে  আরবি, হিন্দুস্তানি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখানো হতো। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে ছিল না। তাই ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রাধাকান্ত দেব ইংরেজি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। এই সূত্রে উচ্চতর ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বদ্দিনাথ মুখোপাধ্যায়। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে, বদ্দিনাথের বাসায় এ বিষয়ে  একটি সভা হয়। এই সূত্রে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় পূর্ববর্তী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজ থেকে ইংরেজি নাটকের সাথে বাঙালি পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। একই সাথে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা যাত্রা, কবিগান, কথক, পাঁচালিকে নিতান্তই গেঁয়ো আমোদ-প্রমোদ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। এই সময় বাংলা নাটকের জন্য নব্য শিক্ষিতরা রঙ্গমঞ্চের অভাব অনুভব করতে থাকে। এ নিয়ে সেকালের ' সমাচার চন্দ্রিকা', 'সমাচার দর্পণ' প্রভৃতি পত্রিকায় বিস্তর লেখা চালাচালি চলছিল।

এই ভাবনার ভিতর দিয়ে প্রসন্নকুমার চট্ট্যোপাধ্যায় তাঁর নারকেলডাঙার বাড়িতে 'হিন্দু থিয়েটার' নামে একটি রঙ্গালয় তৈরি করেন। ঠিক পেশাদারী নাট্যশালা নয় বলে একে সাধারণভাবে বলা হয় সখের নাট্যশালা। এই থিয়েটারের পরিচালনায় ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, কৃষচন্দ্র দত্ত, গঙ্গানারায়ণ সেন, মাধব মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, তারাঠাদ চক্রবর্তী প্রমুখ ধনী অভিজাত বাঙালিরা। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়া ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ ইংরেজ পণ্ডিত এইচ. এইচ. উইলসন। উল্লেখ্য, উইলসন  ইংরেজদের  চৌরঙ্গী থিয়েটারের তিনি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নব্য তরুণ বাঙালির শিক্ষক ছিলেন।

১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের শেষার্ধে এই নাট্যশালাটি প্রস্তুত হয় এবং ১৪ ডিসেম্বর এই মঞ্চে প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথম নাটকটি ছিল-
ভবভূতির রচিত সংস্কৃত নাটক 'উত্তরারামচরিত'-এর ইংরেজি অনুবাদ। অনুবাদ করেছিলেন এইচ. এইচ. উইলসন। উল্লেখ্য, উইলসন নিজে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অভিনয়ের নাট্যশিক্ষকও ছিলেন। একই রাত্রে এই নাটকের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল শেক্সপীয়রের 'জুলিয়াস সীজার' নাটকের পঞ্চম অঙ্কটি। এই অঙ্কটি মূল ইংরেজিতেই অভিনীত হয়েছিল।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ এই মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল 'নাথিং সুপারফ্লুয়াস' নামক একটি প্রহসন। এই নাটকের প্রধান চরিত্র সুলতান, সালিন গফর, সাদি ও সুন্দরী গুলনেয়ার। গুলনেয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জনৈক অভিনেতা।

এই নাটক বা প্রহসন দেখে ইংরেজরা খুশি হয়েছিল, কিন্তু বাঙালির মনে তা দাগ কাটে নি। ফলে অচিরেই এই নাট্যমঞ্চ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।


সূত্র: