এই নাটকের জন্য তিনি গোলকনাথের সহায়তায় একটি ঝুমুর দল থেকে ১০ জন অভিনেতা ও ৩ জন অভিনেত্রী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর(শুক্রবার ১৪ অগ্রহায়ণ ১২০২), তাঁর অনূদিত নাটক দুটি মঞ্চস্থ হয়। প্রথম বার নাটক মঞ্চস্থ করার সময়, দর্শক হয়েছিল প্রায় ২০০ জন। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ (সোমাবার, ১১ চৈত্র ১২০২) নাটক ২টি পুনরায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। দ্বিতীয় বারে দর্শক হয়েছিল প্রায় ৩০০ জন।
সম্ভবত বাংলা নাটকের এই দুটি গানই প্রথম। এই দুটি গানে
লেবেদফ নিজে
সুরারোপ করেছিলেন। লক্ষ্যণীয়
বিষয় বাংলা নাটকের শুরু থেকেই গান সংযোজিত হয়েছিল।
লেবেদেফ
গানের বাণী নিয়েছিলেন ভারতচন্দ্রের কাব্যগ্রন্থ থেকে, আর সুর করেছিলেন
ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণে। এই নাটক
মঞ্চস্থের সূত্রে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা তাঁর
সাফল্যকে সুনজরে দেখেন নি। ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংরেজরা সীন পেন্টার এবং মিস্টার হে নামক
দুজন রাজকর্মচারীরকে দিয়ে এই রঙ্গমঞ্চ পুড়িয়ে দেন। এরপর নানা কারণে তিন ঋণের জালে
জড়িয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে আদালতে যেতে হয়। পরে ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ
কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করেন।
হেরাসিম
লেবেদেফের চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন আর
কোনো বাংলা নাটক তৈরি বা মঞ্চস্থ হয় নি। ফলে তাঁর নাটক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত
হয়েছিল। সে সময়ে কলকাতার বাঙালি বাবুরা মেতে উঠেছিলেন যাত্রাপালা, পাঁচালি, কবিগান, আখড়াই গান, টপ্পা,
হাফ আখড়াই গান নিয়ে। সেই সাথে ছিল কীর্তন, জারির মতো আধা লোকগান। বাউল, ভাটিয়ালি,
ঝুমুর, ভাওয়াইয়া অঞ্চল বিশেষে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হলেও কলকাতায় এর বিশেষ প্রভাব ছিল না। তবে
কখনো কখনো বাবুরা তাঁদের জলসা ঘরে বৈঠকী বা দরবারি ঝুমুর বা এই জাতীয় গানের আসর বসাতেন। ফলে তখনও থিয়েটারের গান পৃথক
কোনো মর্যাদায় স্থান করে নিতে পারে নি।
গান হিসেবে বিকশিত হয়ে চলেছিল। ভারতবর্ষকে সুচারুরূপ শাসন এবং শোষণের জন্য, ইংরেজরা
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট
উইলিয়াম কলেজের স্থাপন করে। এই সময় এই কলেজে আরবি, হিন্দুস্তানি, ফারসি, সংস্কৃত
ও বাংলা ভাষা শেখানো হতো। ইংরেজি
ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে ছিল না। তাই
ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রাধাকান্ত দেব ইংরেজি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন।
এই সূত্রে উচ্চতর ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বদ্দিনাথ মুখোপাধ্যায়। এক্ষেত্রে
তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড। ১৮১৬
খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে, বদ্দিনাথের বাসায় এ বিষয়ে একটি সভা হয়। এই সূত্রে ১৮১৭
খ্রিষ্টাব্দে
রাজা রামমোহন রায়
পূর্ববর্তী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু
কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজ থেকে ইংরেজি নাটকের সাথে বাঙালি পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে।
একই সাথে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা যাত্রা, কবিগান, কথক, পাঁচালিকে নিতান্তই গেঁয়ো
আমোদ-প্রমোদ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। এই সময় বাংলা নাটকের জন্য নব্য শিক্ষিতরা
রঙ্গমঞ্চের অভাব অনুভব করতে থাকে। এ নিয়ে সেকালের 'সমাচার চন্দ্রিকা', 'সমাচার
দর্পণ' প্রভৃতি পত্রিকায় বিস্তর লেখা চালাচালি চলছিল।
এরপর দীর্ঘ পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে কিছু নাটক রচিত হয়েছিল।
এসকল নাটকে পরমার্থ-বিষয়ক দীর্ঘ বক্তৃতা যুক্ত করায়, নাটকের বিচারে তা একঘেঁয়ি
সংলাপে পরিণত হয়েছিল। তবে এই নাটকগুলো অভিনয়যোগ্য ছিল না। এই জাতীয় নাটকের ভিতরে
ছিল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'প্রবোধচন্দ্রোদয়' নাটকের অনুবাদ 'আত্মতত্ত্ব
কৌমুদী' নামে। এছাড়া ছিল এই বছরে প্রকাশিত 'হাস্যার্ণব' নামক প্রহসন।
সখের নাট্যশালা
বাঙালি বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প-রসিকজনের ভিতরে নাট্যচর্চার আকাঙ্ক্ষা থেকে সখের
নাট্যদল ও নাট্যশালার উদ্ভব হয়েছিল। এই নাট্যশালাগুলোর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মূলত
সেকালের অভিজাত ধনবান ব্যক্তিরা। এই উদ্যোমের পিছনে এঁদের কোনো পেশাদারী মনোভাব ছিল
না। নিতান্তই সখের বশে তাঁরা নবতর নাট্য-আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, ইংরেজদের
নাট্যশালা অনুসরণে। প্রথম দিকে ইংরেজদের কেউ কেউ এই কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে
পড়েছিলেন। এঁরা নাট্য-পরিচালনা, অভিনয়-শিক্ষণের পাশাপাশি নিজেরাও অভিনয় করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়- প্রথম সখের নাট্যশালা
হিন্দু
থিয়েটার-এর সংস্কৃতজ্ঞ ইংরেজ পণ্ডিত এইচ. এইচ. উইলসন-এর কথা। উল্লেখ্য, উইলসন
ইংরেজদের চৌরঙ্গী থিয়েটারের তিনি উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নব্য তরুণ বাঙালির
শিক্ষক ছিলেন।
হিন্দু
থিয়েটার-এর প্রথম নাটক উত্তররামচরিত' সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ এবং
অভিনয় করেছিলেন উইলসন।
সখের নাট্যশালার সূত্রপাত ঘটেছিল ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের
হিন্দু
থিয়েটার-এর মাধ্যমে। এরপর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সখের নাট্যশালা গড়ে
উঠেছিল। এদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য নাট্যশালাগুল ছিল-
এরপর নাটক রচনার একটি প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এর সূচনা হয়েছিল ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রামতারক ভট্টাচার্য অভিজ্ঞান শকুন্তলার অনুবাদ। এর পরের বছর, ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহর্ষের রত্নাবলী অবলম্বনে নীলমণি পাল রচনা করেন 'রত্নাবলী নাটিকা'। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাওয়া যায় যোগেন্দ্রচন্দ্রগুপ্তের 'কীরত্তিবিলাস', তারাচরণ শিকাদারের 'ভদ্রার্জুন'। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে হরচন্দ্র ঘোষ শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিস অবলম্বনে রচনা করে 'ভানুমতী চিত্তবিলাস। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কালীপ্রসন্ন সিংহ রচনা করেন 'বাবু নাটক'। এরই ভিতরে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল 'ওরিয়েন্টাল থিয়েটার'।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জুলাই, শনিবার এই নাট্যশালায় প্রথম অভিনীত হয় 'রত্নাবলী'।
শ্রীহর্ষের রত্নাবলী অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। এই
নাটকটি বেলাগাছিয়া নাট্যশালায় প্রায় ছয়-সাত বার অভিনীত হয়েছিল। ইংরেজদের জন্য এই
নাটকের একটি অনুবাদ তৈরি করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই অনুবাদ পুস্তকাকারে
প্রকাশিত হয়েছিল। এই নাট্যশালার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, মধুসূদন লেখেন 'শর্মিষ্ঠা'
নাটক। এই নাটকটি এই নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা
সেপ্টেম্বর। এর ষষ্ঠ এবং শেষ অভিনয় হয়েছিল এই বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর। শর্মিষ্ঠার
পরে এই নাট্যশালায় আর কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয় নি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা
ঈশ্বরচন্দ্রের অকাল মৃত্যুর পর, এই নাট্যশালা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
পেশাদার নাট্যশালা
সূত্র :