আদি বাউল
গানের বিকাশ
যতদূর জানা যায়, সুলতান
গিয়াসউদ্দিন
আজম শাহ রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ),
শাহ
মুহম্মদ সগীর ইউসুফ-জোলেখা কাব্য
রচনা করেন। এই কাব্যে তিনি বাউর, বাউল, আউল শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন—
বিরহে তাপিত কম্পিত হৃদয়
উরত লোরএ কেশ।
এলিন বয়ান কাতর নয়ান
আউল বাউল বেশ॥
শাহ
মুহম্মদ সগীরের সময়, বাউলদেরকে (বাউর) অস্বাভাবিক, জাতকুলহীন নিচুস্তরের মানুষ
হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সমাজের চোখে হীন এবং স্বভাবে উন্মাদ এমন ব্যক্তিকে বাউল
নামে অভিহিত করা হতো। ইউসুফ-জোলেখা -এর একটি অংশে
এমনভাবেই শাহ মুহম্মদ সগীর বাউলকে উপস্থাপন করেছেন।
সর্বক্ষণ উতরোল চিত্ত আসোয়াস্ত।
নিশি ন পোহা এ তার দিন ন জা এ অস্ত
জদি রাত্রি বিরাম উদয় ভেল ভানু
তার তাপে তাপিত কম্পিত সর্ব তনু॥
হেন গতি মদি জদি নৃপতি দেখিল।
বাউর চরিত্র হেন ভূপতি জানিল॥
লোকাচার জাতিকুল কিছু নাহি ভিত
সদয় উদাস বাস চিত্ত বিচলিত।
ধারণা করা হয়, ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাউল
সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। এই দর্শন গড়ে উঠেছিল বাংলার সনাতন লৌকিক ধর্মবিশ্বাস,
বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শ এবং সুফি দর্শনের সংমিশ্রণে। হয়তো
সেকালের বাউলদের হাতে বাউল দর্শনভিত্তিক বাউল গানের উদ্ভব হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক
সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে এরা বাংলার গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে- পৃথক সম্প্রদায়
হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ফলে শুধু নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা নয়, সেকালের গ্রামীণ
সংস্কৃতি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এই সূত্রে বাউল হয়ে গিয়েছিল ব্রাত্য।
নব্য বিকশিত এই দর্শনের সাধকরা হয়ে উঠেছিলেন সেকালের বৃহত্তর সমাজের ব্রাত্যজনের
গুরু। এদের গান ছিল লোক সুর ও ছন্দে নিবদ্ধ। আত্মরক্ষার কারণেও এদের গানের বাণীতে
এসেছিল আলো-আঁধারের খেলা। মূলত চর্যাপদের 'সন্ধ্যাভাষা' প্রবলভাবে স্থান পেয়েছিল
বাউল গানের বাণীতে।
ইলিয়াস শাহী রাজবংশের প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছিল
হামজা শাহ (১৪০৯-১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে।
১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত বাংলা আবার অস্থির হয়ে উঠছিল, রাজা গণেশ, মুসলমান দরবেশদের বিদ্রোহ,
জালালউদ্দীন, মহেন্দ্রদেব, সামসুদ্দিন আহমেদে সিংহাসনের দ্বন্দ্বে। এরই ভিতরে
১৪১৮-১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর
কবি
কৃত্তিবাস ওঝা অনুবাদ
করেছিলেন রামায়ণ। তবে রচনাকাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। ১৮০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দের
ভিতরে এই গ্রন্থটি শ্রীরামপুর থেকে প্রথম মুদ্রিত হয়। পরে ১৮৩০-৩৪ খ্রিষ্টাব্দের
ভিতরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কা দুই খণ্ডে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছিল।
বাংলা কীর্তনের বিকাশ
কবি জয়দেব
রাজা
লক্ষণসেনের (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে যে রাধা-কৃষ্ণের লীলাভিত্তিক যে
কাহিনি-কাব্যের সূচনা করেছিলেন, তাই নব রূপে বিকশিত হয়ে উঠেছিল ইলিয়াস শাহী
রাজবংশের দুই পর্যায় এবং এর অন্তর্বর্তী শাসনামলে।
বাংলা
কীর্তনের
গানের নবতর দশা শুরু হয়েছিল বিদ্যাপতি ও বড়ুচণ্ডীদাসের হাত ধরে।
বিদ্যাপতি ও তার গান
বিদ্যাপতি ছিলেন মৈথিলী ও বাংলা ভাষার কবি। বিদ্যাপতির জন্মকাল এবং জন্মস্থান নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক আছে। অনেকের মতে ১৩৭০-৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি দ্বারভাঙা জেলার সীতামারী মহকুমার বিম্ফি নামক গ্রামের একটি বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কৌলিক উপাধি ঠক্কুর বা ঠাকুর। বংশপরম্পরায় তাঁদের পরিবার মিথিলার উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ১৩৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি রাজা ভোগেশ্বরের নামে পদ রচনা করেন। ১৪০১-১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিনি কীর্তিলতা, পুরুষপরীক্ষা, গোরক্ষবিজয় নাটক রচনা করেন। ১৪১৫-১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি রচনা করেন কীর্তিপতাকা, শৈবসর্বস্বসার, দানবাক্যাবলী, বিভাগসার। ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিক তিনি রচনা করেন দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী। এর পরে তিনি রচনা করেছিলেন ব্যাড়ীভক্তিতরঙ্গিণী। বাংলাভাষায় রচিত বহু পদ বিদ্যাপতির নামে প্রচলিত রয়েছে। এই সকল কবিতার ভণিতায় বিদ্যাপতির নাম পাওয়া যায়। এই কারণে বিদ্যাপতিকে বাঙালি কবি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে শব্দ-ভাণ্ডারের বিচারে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আরবি, ফার্সি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছিল। কালক্রমে সে সকল শব্দই বাংলাভাষাকে শব্দসম্পদে সমৃদ্ধ করেছে। তাই বিদেশী শব্দের দ্বারা বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে সমৃদ্ধকরণ এবং তার প্রয়োগের বিচারে বিদ্যাপতিকে একটি বিশিষ্ট স্থান দেওয়াই যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের বিচারে বিদ্যাপতিকে যতটা সুদৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা যায়, বাংলা গানের বিচারে ততটা করা যায় না। কারণ, বিদ্যাপতির অধিকাংশ রচনা ছিল নিতান্তই কাব্যধর্মী। তাঁর রচিত পদগুলো ঠিক গান হিসেবে গাও হতো কিনা সে কথা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ এসব পদে রাগ বা তালের নাম নেই। তাঁর পদগুলোর গঠনশৈলী দেখে মনে হয়, হয়তো সেগুলো সুরসহযোগে পরিবেশন করা হতো। তবে কালের বিবর্তনে সে সব সুর হারিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে তাঁর কোনো কোনো পদে সুরারোপ করে পরিবেশন করার হয়েছে। বিশেষ করে বৈষ্ণবদের অনেকে তাঁর গানে কীর্তন সুরে উপস্থাপন করে থাকেন অনেকে। বহুপরে তাঁর এবং গোবিন্দদাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি পদে সুরারোপ করেছিলেন। গানটি হলো-
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর [তথ্য]।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বড়ুচণ্ডীদাস
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) বসন্তরঞ্জন রায় বাঁকুড়া জেলা থেকে বড়ুচণ্ডীদাসের ভণিতায় একটি পুথি আবিষ্কার করেন। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটি বন-বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা নিবাসী দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে ছিল। এই গ্রন্থটি ১৩২৩ বঙ্গাব্দে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়।মধ্যযুগীয় বাংলা-কাব্য। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ) বসন্তরঞ্জন রায় বাঁকুড়া জেলা থেকে বড়ুচণ্ডীদাসের ভণিতায় একটি পুথি আবিষ্কার করেন। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটি বন-বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা নিবাসী দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে ছিল। এই গ্রন্থটি ১৩২৩ বঙ্গাব্দে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়।
বসন্তরায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, মূলগ্রন্থটি তুলোট কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় লিখিত ছিল। পাতার আকার ছিল ১৩.২৫X ৩.৭৫ ইঞ্চি। এই গ্রন্থের প্রথম দুটি পাতা পাওয়া যায় নাই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি বসন্তরায়ের দেওয়া। এ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের ভূমিকায় বসন্তরায় লিখেছিলেন- 'দীর্ঘকাল যাবৎ চণ্ডীদাস বিরচিত কৃষ্ণকীর্তন-এর অস্তিত্ব মাত্র শুনিয়া আসিতেছিলাম। এতোদিনে তাহার সমাধান হইয়া গেল। আমাদের ধারণা আলোচ্য পুথিই কৃষ্ণকীর্তন এবং সেইহেতু উহার অনুকরণ নাম নির্দেশ করা হইল।'
বসন্তরায়ের এই গ্রন্থ আবিষ্কারের পূর্বে- এই গ্রন্থ সম্পর্কে জানা গিয়েছিল, ১৩৮০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত জগবন্ধু ভদ্রের সম্পাদিত 'মহাজন-পদাবলী' (প্রথমখণ্ড), পৃষ্ঠা ৪৬, থেকে জানা যায় ১৩১১ বঙ্গাব্দে ব্রজসুন্দর সান্ন্যাল রচিত চণ্ডীদাস-চরিত গ্রন্থে এবং ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্যের চণ্ডীদাস প্রবন্ধে (নব্যভারত, ফাল্গুন ১৩০০) এই গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। যদিও এঁদের বর্ণিত কৃষ্ণকীর্তন নামক গ্রন্থটিই যে বসন্তরায়ের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় না। ডঃ বিজন বিহারী ভট্টাচার্য এবং ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রন্থের নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ হওয়া উচিৎ বলে দাবি করেছেন।
এই গ্রন্থের বৈদ্যুতিন সংস্করণ করা হলো- মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত বড়ুচণ্ডীদাসের কাব্য (আশ্বিন, ১৩৮৮ সন) অনুসারে।
বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায়, বিদ্যাপতি'র পরবর্তী কবি হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসকে ধরা হয়। আনুমানিক ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর আসল নাম ছিল অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু, গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবির নাম পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণচরিতের রচয়িতা।
১৩১৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ) বসন্তরঞ্জন রায় বাঁকুড়া জেলা থেকে বড়ুচণ্ডীদাসের ভণিতায় একটি পুথি আবিষ্কার করেন। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটি বন-বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী কাঁকিল্যা নিবাসী দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে ছিল। এই গ্রন্থটি ১৩২৩ বঙ্গাব্দে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম কাহিনি কাব্য, যা একই সাথে কাব্য ও গীতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট। গ্রন্থটি গীতগোবিন্দের আদর্শে রচিত। বিষয়বস্তু, বিষয়বস্তুর কাব্যিক উপস্থাপন, রাগ-তালে নিবদ্ধ করার প্রয়াস এই সবই গীতগোবিন্দকে মনে করিয়ে দেয়। এই পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাগ ও তালের দিকে একটু নজর দেব।
শ্রীকৃষ্ণকৃর্তনের রাগ পরিচিতি
- আহের [তাম্বুলখণ্ড-৬। দানখণ্ড-২, ৮। বাণ খণ্ড-২। বংশী খণ্ড-২৯]
- কহু। [বংশী খণ্ড-৩৬। রাধাবিরহ খণ্ড-২০, ২২, ৩৪]
- কহু গুর্জরী [জন্মখণ্ড-৪]
- গুর্জ্জরী [তাম্বুলখণ্ড-১, ৪। দানখণ্ড-১, ১৮, ২৫। ভারখণ্ড-২। বৃন্দাবন খণ্ড-৩, ৮। বাণ খণ্ড-৪। বংশী খণ্ড-৭, ১২, ১৬, ১৮, ৩৫, ৩৭। রাধাবিরহ খণ্ড-২৮, ৪৪]
- ককূ। [ বৃন্দাবন খণ্ড-১৪]
- কানাড়া [তাম্বুলখণ্ড-৫]
- কেদার। [দানখণ্ড-২৩। বংশী খণ্ড-২। রাধাবিরহ খণ্ড-১৬]
- কোড়া। [জন্মখণ্ড-১, ৫, ৬। তাম্বুলখণ্ড-৮। দানখণ্ড-৫, ৯, ১৭, ১৯। বৃন্দাবন খণ্ড-১, ১১। যমুনা খণ্ড-২। বংশী খণ্ড-৫, ১১, ১৫, ১৭, ২২। রাধাবিরহ খণ্ড-৪৩]
- কোড়াদেশ। [রাধাবিরহ খণ্ড-৫২]
- দেশবরাড়ী। [দানখণ্ড-২১। বৃন্দাবন খণ্ড-৪। যমুনা খণ্ড-৩। বংশী খণ্ড-৩০, ৩১, ৩৪। রাধাবিরহ খণ্ড-৭, ৩৯]
- দেশাগ [তাম্বুলখণ্ড-৫, ৯। তাম্বুলখণ্ড-১২। দানখণ্ড-১৫, ১৬, ২৬। ছত্রখণ্ড-২। বৃন্দাবন খণ্ড-৯। কালিয়দমন-৩। বাণ খণ্ড-১। বংশী খণ্ড-১০, ৪০। রাধাবিরহ খণ্ড-৪১, ৪৮]
- ধানুষী । [জন্মখণ্ড-৭। ছত্রখণ্ড-৩। বৃন্দাবন খণ্ড-৫, ১৩। কালিয়দমন-৪। যমুনা খণ্ড-৮। বাণ খণ্ড-৫। বংশী খণ্ড-৯, ৩৮। রাধাবিরহ খণ্ড-৫, ১২, ১৭, ৩৭, ৪২, ৪৬]
- পাহাড়ীআ [তাম্বুলখণ্ড-২, ৩, ৭। দানখণ্ড-১১, ১২, ২০, ২২। নৌকাখণ্ড-৩, ৫, ৬। বৃন্দাবন খণ্ড-১২। যমুনা খণ্ড-১, ১১। বাণ খণ্ড-৩। বংশী খণ্ড-১, ২১, ২৭। রাধাবিরহ খণ্ড-১৮, ৪৭]
- বঙ্গাল। [রাধাবিরহ খণ্ড-১৪]
- বঙ্গালবরাড়ী। [রাধাবিরহ খণ্ড-৩০]
- বরাড়ী [জন্মখণ্ড-২, ৩। তাম্বুলখণ্ড-১১]
- বসন্ত। [ বৃন্দাবন খণ্ড-১০। বাণ খণ্ড-৬]
- বিভাষ। [রাধাবিরহ খণ্ড-১, ৩, ৮, ২৪, ২৬, ৪৯]
- বেলাবলী। [নৌকাখণ্ড-৪। বংশী খণ্ড-২৪, ২৬। রাধাবিরহ খণ্ড-২, ২১]
- ভাটিআলী। [নৌকাখণ্ড-৭। বৃন্দাবন খণ্ড-১৫। কালিয়দমন-২। যমুনা খণ্ড-৭। বংশী খণ্ড-২৫, ২৮, ৩২। রাধাবিরহ খণ্ড-১১]
- ভৈরবী। [বংশী খণ্ড-১৯। রাধাবিরহ খণ্ড-৪, ৬, ৯, ৩১, ৫১]
- মল্লার। [দানখণ্ড-১০। ভারখণ্ড-৫। ছত্রখণ্ড-১। যমুনা খণ্ড-৯। বংশী খণ্ড-২৩। রাধাবিরহ খণ্ড-১৯, ২৯]
- মালব। [দানখণ্ড-৪। [দানখণ্ড-৬, ৭, ২৪। নৌকাখণ্ড-১। ভারখণ্ড-১। বৃন্দাবন খণ্ড-২। কালিয়দমন-১। যমুনা খণ্ড-৫। বংশী খণ্ড-১৪। রাধাবিরহ খণ্ড-১০, ২৩, ৫০]
- মালবশ্রী
- মাহারঠা। [ভারখণ্ড-৩]
- রামগিরী [তাম্বুলখণ্ড-১০। দানখণ্ড-৩, ১৩, ১৪। নৌকাখণ্ড-২। ভারখণ্ড-৪। বৃন্দাবন খণ্ড-৬, ৭। কালিয়দমন-৫। যমুনা খণ্ড-৪, ৬, ১০। বাণ খণ্ড-৭। বংশী খণ্ড-৬, ৮, ১৩, ২০, ৩৩, ৪১, ৩৬। রাধাবিরহ খণ্ড-৪৫]
- ললিত। [রাধাবিরহ খণ্ড-১৩, ১৫, ২৫, ২৭, ৩৩, ৩৮]
- শৌরী। [বংশী খণ্ড-৩৯]
- শ্রী। [বংশী খণ্ড-৩, ৪। রাধাবিরহ খণ্ড-৩২, ৩৫, ৪০।]
- শ্রীরামগিরি।
বড়ুচণ্ডীদাসের পদে অধিকাংশ গানের সাথে একাধিক তাল বা ছন্দের নাম পাওয়া যায়। একাধিক তালে নিবদ্ধ পদগুলো, তালফেরতায় গাওয়া হতো কিনা তর্কসাপেক্ষ। নিচের এই তালগুলোর উল্লেখ করা হলো।
- আঠতাল। [দানখণ্ড-৩। ভারখণ্ড-৪। কালিয়দমন-৫। বাণ খণ্ড-৭। বংশী খণ্ড-১৩, ৩০, ৩১, ৩৬]
- একতালী। [জন্মখণ্ড-৩, ৬। তাম্বুলখণ্ড-১। দানখণ্ড-২, ৬, ৯, ১৭, ১৯, ২১। ছত্রখণ্ড-২। বৃন্দাবন খণ্ড-১, ১০। যমুনা খণ্ড-৮। বাণ খণ্ড-২, ৬। বংশী খণ্ড-৯, ১৫, ২৫, ২৬, ২৯, ৩৮। রাধাবিরহ খণ্ড-৫, ১০, ১৩, ১৫, ১৭, ২৬, ৪৬]
- একতালী। লগনী। [দানখণ্ড-২০ ]
- একতালী। লগনী। দণ্ডক। [বংশী খণ্ড-৩৩]
- একাতলী । দণ্ডক। [যমুনা খণ্ড-১০। বংশী খণ্ড-১]
- একতালী। দণ্ডক। লগনী। [বংশী খণ্ড-২০]
- একতালী। রূপকম্বা [রাধাবিরহ খণ্ড-৪, ২৪]
- একতালী। রূপকম্বা। দণ্ডক। [রাধাবিরহ খণ্ড-৮]
- কুড়ুক্ক। [রাধাবিরহ খণ্ড-২, ৩, ৬, ৯, ৩৮]
- ক্রীড়া। [জন্মখণ্ড-২। তাম্বুলখণ্ড-২। দানখণ্ড-১২, ২২। নৌকাখণ্ড-৫। বৃন্দাবন খণ্ড-১১। যমুনা খণ্ড-১, ১১। বাণ খণ্ড-৩। বংশী খণ্ড-৩, ২১। রাধাবিরহ খণ্ড-১৮, ২৭, ৩৩, ৩৭, ৪২, ৪৩, ৪৮, ৫২]
- ক্রীড়া। দণ্ডক [ বৃন্দাবন খণ্ড-১২]
- ক্রীড়া। লগনী [দানখণ্ড-১]
- ক্রীড়া। লগনী। দণ্ডক। [যমুনা খণ্ড-২। বংশী খণ্ড-১০, ২৭]
- ক্রীড়া। লগনী প্রকিণ্ণক [তাম্বুলখণ্ড-৭।]
- চিত্রক লগনী। একাতালী। [তাম্বুলখণ্ড-৩]
- দণ্ডক। [দানখণ্ড-৫]
- দণ্ডক। একতালী [রাধাবিরহ খণ্ড-৫১]
- দ্রুতমান। একতালী [ভারখণ্ড-৩]
- প্রকীণ্ণ। লগনী। একতালী [নৌকাখণ্ড-৬। রাধাবিরহ খণ্ড-৪৭]
- প্রকীণ্ণক লগনী। লঘুশেখর। [নৌকাখণ্ড-৩]
- প্রকীণ্ণক। চিত্রকং, লগনী, একাতলী। [যমুনা খণ্ড-৬]
- প্রকীণ্ণকং। চিত্রক। লগনী। রূপকং। দণ্ডক [রাধাবিরহ খণ্ড-২৩]
- বিচিত্র। লগনী। একতালী। দণ্ডক [বংশী খণ্ড-৪১]
- যতি [তাম্বুলখণ্ড-৫, বাণ খণ্ড-৪। বংশী খণ্ড-৪, ৬, ৭, ১৮, ১৯, ২২, ২৮। রাধাবিরহ খণ্ড-১২, ২০, ২১, ২৮, ৩২, ৪০, ৪৪, ৪৫]
- যতি । দণ্ডক । [জন্মখণ্ড-১। দানখণ্ড-৭। ভারখণ্ড-২। বৃন্দাবন খণ্ড-৩]
- যতি। চিত্রকং। লগনী। [বংশী খণ্ড-৩৭]
- রূপকং। [জন্মখণ্ড-৪। তাম্বুলখণ্ড-৪, ৮, ১০, ১১, ১২। দানখণ্ড-১১, ১৩, ১৪, ১৮, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬। ছত্রখণ্ড-১। বৃন্দাবন খণ্ড-৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫। কালিয়দমন-২, ৪। যমুনা খণ্ড-৪, ৫, ৭, ৯। বাণ খণ্ড-১। বংশী খণ্ড-২, ৫, ৮, ১২, ১৪, ১৬, ১৭, ২৩, ২৪, ৩২, ৩৪, ৩৫, ৩৯, ৪০। রাধাবিরহ খণ্ড-১৪, ১৬, ১৯, ২৫, ২৯, ৩০, ৩৫]
- রূপকং। লগনী [দানখণ্ড-৪, ১০। নৌকাখণ্ড-২। রাধাবিরহ খণ্ড-৩৪]
- রূপকং। লগনী চিত্রকং। [নৌকাখণ্ড-১]
- রূপকং। লগনী। দণ্ডক [বংশী খণ্ড-৩৬। রাধাবিরহ খণ্ড-৭]
- রূপকং। চিত্রক লগনী। দণ্ডক [ভারখণ্ড-১। ভারখণ্ড-৫]
- রূপকং। বিচিত্র লগনী। দণ্ডক। [বৃন্দাবন খণ্ড-২]
- রূপকং। দণ্ডক [কালিয়দমন-১। রাধাবিরহ খণ্ড-১]
- রূপকং। যতির্ব্বা। [রাধাবিরহ খণ্ড-৩১, ৪৯]
- রূপকং। কাব্যোক্তি প্রকীণ্ণক। লগনী [রাধাবিরহ খণ্ড-৫০]
- লগনী। ক্রীড়া [দানখণ্ড-১৬]
- লঘুশেখর। [জন্মখণ্ড-৭, তাম্বুলখণ্ড-৬। দানখণ্ড-৮, ১৫। নৌকাখণ্ড-৪। ছত্রখণ্ড-৩। বৃন্দাবন খণ্ড-৪। কালিয়দমন-৩। যমুনা খণ্ড-৩। বাণ খণ্ড-৫। বংশী খণ্ড-১১। রাধাবিরহ খণ্ড-১১, ২২, ৩৯, ৪১]
- লঘুশেখর। দণ্ড [জন্মখণ্ড-৫। নৌকাখণ্ড-৭]
নগরকেন্দ্রিক সাহিত্যসঙ্গীতের ধারাকে নতুন যাত্রাপথে প্রবাহিত করেছিলেন বিদ্যাপতি ও বড়ু চণ্ডীদাস। এই সূত্রে বাংলা কীর্তনগানের আদি রূপের বিকাশ ঘটেছিল। ভারতীয় শাস্ত্রী সঙ্গীতের প্রবন্ধ গীতিরীতি প্রবেশ করেছিল চর্যাপদে। বড়ুচণ্ডীদাসে এসে তার পরিবেশন রীতি পাল্টে গিয়েছিল। এই বিশেষ রূপের ভিতর দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী আধা-লোকগান হিসেবে বিকশিত হয়েছিল কীর্তন গান। এর সুর ও ছন্দের কাঠামো ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীসঙ্গীতের ধারায়। এ গানের ভাষা শৈলীতে আঞ্চলিকতার চেয়ে নাগরিক প্রমিতরূপের প্রাধান্য পেয়েছিল সর্বাধিক।
বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায়, বিদ্যাপতি'র পরবর্তী কবি হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাসকে ধরা হয়। আনুমানিক ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর আসল নাম ছিল অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু, গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস নামে একাধিক কবির নাম পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস। তবে বিভিন্ন গবেষকদের মতে বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণচরিতের রচয়িতা।
বাংলা ঝুমুরের বিকাশ
সাঁওতালি ঝুমুর
থেকে বাংলা ঝুমুর সৃষ্টির আদিকাল হিসেবে এই সময়কে বিবেচনা করা হয়। আদি ঝুমুর পর্বে শিল্পী ও শ্রোতারা ছিলেন প্রান্তিক অর্থাৎ নিম্নবর্গের
শ্রমজীবী মানুষ। ধর্ম ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন অন্ত্যজ। এই সময়ে স্থানীয় কূর্মি, মাহাতো, কুমোর, রাজওয়ার, ঘাটাল, হাড়ি, মুচি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঝুমুর। একই
সময় ঝুমুর গান করতেন
সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
বর্তমানে ঝুমুর অঞ্চল বলতে বুঝায় ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহারের মালভূম অঞ্চল।
এই বিচারে ঝুমুর শুধুই পশ্চিম বাংলার লোকসঙ্গীত নয় বরং বলা যায় উত্তরভারতীয় লোকসঙ্গীতের ধারা। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে এর ব্যাপ্তী
বাংলার
রাঢ়অঞ্চল থেকে
সুন্দরবন পর্যন্ত। এর বাইরে পাওয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসামের চা-বাগান ও অন্যান্য অঞ্চলে।
ঝুমুর অঞ্চলের অভিজাত মানুষ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত পৌরাণিক কাহিনী এবং রাগাশ্রয়ী গানের অনুরক্ত ছিল। বিশেষভাবে চর্চিত হয়েছে মুণ্ডা, ওঁরাও, ভূমিজ, মাহাতো, বাগাল, লোধা, কুর্মি, বাউরি জনগোষ্ঠীর ভিতর। মুসলমানদের বঙ্গদেশে আধিপত্য বিস্তারের আগে বাঙালি হিন্দুদের নিম্নবর্গের মানুষদের ভিতরে এই গানের চর্চা ছিল।
সম্ভবত ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা ঝুমুর প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
[দেখুন: ১৪৫০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ]
সূত্র :
পুরাতন বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম।
সুখময় মুখোপাধ্যায়। খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি। ডিসেম্বর ২০০০।
বড়ুচণ্ডীদাসের কাব্য । মুহম্মদ আব্দুল হাই ও আনোয়ার পাশা
সম্পাদিত। স্টুডেন্ট ওয়েজ। আশ্বিন ১৩৮৮ সন।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স, মার্চ ২০০০।
বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস। ক্ষেত্র গুপ্ত। জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন।
ফেব্রুয়ারি ২০০০।
ভারতের ইতিহাস ।
অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। [মৌলিক লাইব্রেরি, কলকাতা, জুন ২০০০]