বাংলা গানের ধারা
ভূমিকা
কালানুক্রমিক সূচি
এমন কোনো নৃগোষ্ঠী নেই যাদের ভাষা এবং গান নেই। উভয়ই যোগাযোগের মাধ্যম। উভয়ই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। সুরের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা আছে, ভাষার তো আছেই। তবে প্রকৃতি ভিন্ন। ভাষার সাথে সঙ্গীতের (গীত-বাদ্য-নৃত্য) সম্পর্ক সহদরের মতো। তাই ভাব প্রকাশের এই মাধ্যম দুটিকে উপলব্ধি করার জন্য উভয়েরই প্রয়োজন।

যে সকল গানের বাণী অংশ বাংলা ভাষায় রচিত, সে সকল গানের সাধারণ নাম 'বাংলা গান'। এই সংজ্ঞানুসারে বাংলা গানের প্রাথমিকভাবে দুটি উপাদান পাওয়া যায়। এর একটি হলো বাংলা ভাষায় রচিত গানের বাণী। অপরটি হলো- সুর ও ছন্দ। এই বিচারে বলা যায়, বাণীই সুর ও ছন্দের সুসমন্বয়ে গান হয়ে ওঠে। অবশ্য সঙ্গীতজ্ঞরা বলেন যথার্থ গান হতে হলে- একটি স্থায়ী ও কমপক্ষে একটি অন্তরা থাকতেই হয়। এর কম হলে সেটা গানের ছটা হতে পারে, গান হয়ে উঠবে না।

যে কোনো গানের আরও কিছু সহায়ক উপকরণের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম উপকরণ হলো- বাদ্যযন্ত্র। পরিবেশিত গানকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার প্রয়োজনে সুর যন্ত্র ও তালযন্ত্রের কথা ভাবতেই হয়। তাই বাংলা গানের আলোচনায় কিছু বাদ্যযন্ত্রের কথা অনিবার্যভাবে চলেই আসে। এ সব বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় রয়েছে- একতারা, সারিন্দা, ঢোল, মন্দিরা ইত্যাদির মতো দেশী বাদ্যযন্ত্র। আবার বাংলার বাইরের বাদ্যযন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালা ইত্যাদি। তাই নিঃসন্দেহে বাদ্যযন্ত্র বাংলা গানের ধারায় আপনা-আপনি চলে আসে। গীত-বাদ্যের এই সমারোহের বাইরে থেকে যায় নানা ধরেনের নাচ। এর ভিতরে রয়েছে বাংলার আদিম নাচ থেকে শাস্ত্রীয় নাচ এবং ইউরোপীয় নাচ। এসব নাচের বাণী ফুটে ওঠে দেহভঙ্গিমা এবং নানা রূপ মুদ্রার সমন্বয়ে। নাচের ভাষা ইঙ্গিত ভাষা। এই ভাষা মানুষের মুখ নিঃসৃত প্রাকৃতিক ভাষায় প্রকাশ পায় না। তাই নাচকে বাংলা গানের ধারার বাইরেই রাখতে হয়।

বাংলা গানের উৎপত্তির কথা উপস্থাপন করতে গেলে, প্রথমেই চলে আসে বাংলাভাষার ইতিবৃত্তের বিষয়। প্রশ্ন জাগে উৎপত্তির বিচারে গান আগে না ভাষা আগে। কেউ কারো আগে নয়। উভয়ই সহদোরা। উভয়ই একই সাথে বিকশিত হয়েছে মানবসভ্যতার ক্রমবিবরণের ধারায়। ভাষা ও সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। যখন আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের আবির্ভাব ঘটেনি। তারও আগে থেকে হোমো গণের আদিম প্রজাতিদের মধ্যে ভাষা ও সঙ্গীতের উদ্ভব হয়েছিল।
ধারণা করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। এরপর ধীরে ধীরে ধীরে এরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। কালের ক্রমবিবর্তনের ধারায় মানুষের দৈহিক রূপ নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বিবর্তিত হয়েছে মানুষের সাংস্কৃতিক উপকরণের। এর ভিতরে রয়েছে, ভাষা, সঙ্গীত, পোশাক, আচরণ ইত্যাদি সবই।

ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে- ভারতবর্ষে আগত আর্য-অনার্যদের সংমিশ্রণে বাঙালি তার মিশ্র দৈহিক রূপ পেয়েছে। একই সাথে পেয়েছে তার ভাষা ও সঙ্গীত। বিবর্তনের ইতিহাসের পিছনের দীর্ঘ পথকে বাদ যদি শুধু বাংলা ভাষার সূচনালগ্নকে খোঁজার চেষ্টা করা যায়, তা হলে তা অসম্ভব একটি প্রচেষ্টা হবে মাত্র। কারণ যেকোনো প্রজাতির শিশুর জন্মের মতো ভাষা ও সঙ্গীত কোনো সুনির্দিষ্ট দিনে জন্মলাভ করেছে বলে দাবি করা যায় না। এক্ষেত্রে মোটা দাগে অনুমান করা যায় মাত্র।

ভারতবর্ষের ভাষা ও গানের বিকাশ: আদি-কাল থেকে বৈদিককাল
ধারণা করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেটবর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো গণের অন্তর্গত
Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। উল্লেখ্য আগে মনে করা হতো, দুই লক্ষ বৎসর আগে আদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ইথিওপিয়া অঞ্চলে।

সেই আদি মানবগোষ্ঠীর সুসংগঠিত ভাষা বা সঙ্গীত ছিল না। তারা কৃষি কাজ জানতো না। তাদের খাদ্য তালিকায় ছিল বনজ ফলমূল আর বন্যপ্রাণী। প্রকৃতপক্ষেই তারা ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল প্রকৃতির সন্তান। ক্রমে ক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আফ্রিকা থেকে মানুষ অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। অন্য দলটি ইরিত্রিয়ার ভিতর দিয়ে লোহিত সাগর পার হয়ে আফ্রিকা সংলগ্ন এশিয়ায় ইয়েমেন অঞ্চলে প্রবেশ করে। এদের অগ্রগামী দল এই সময়ের ভিতর আরব উপদ্বীপ ও পারশ্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার থাকে ১ লক্ষ বৎসরের ভিতরে। এরপর এদের কিছু মানুষ মঙ্গোলিয়া ঘুরে চীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। অপর দলটি পারশ্য হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ভারতবর্ষে এরা প্রবেশ করে প্রায় প্রায় ৭৫-৬০ হাজার বৎসর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। নৃ-বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন নেগ্রিটো।

এই যুগে নেগ্রিটোরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়, দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। নেগ্রিটোদের ভাষা কেমন ছিল তা জানার কোনো সুযোগ নেই।

এর পরবর্তী যে দল ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, তাদেরকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে অভিহিত করা হয়। প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা ভারতবর্ষে কোন সময় প্রবেশ করেছিল, তা সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না। ধারণা করা এরা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়ে। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে চলে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামানে চলে গিয়েছিল। এই অনুমান করা হয়, কারণ আন্দমানে নেগ্রিটোদের অন্ততঃ ১২টি গোষ্ঠী অস্তিত্ব এখনো রয়েছে।

ভারতের মূল-ভূখণ্ডে টিকে থাকা নেগ্রোটোদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে, এরা নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের ভাষা ছিল। এদের ভাষা-পরিবারকে ভাষা বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার। এই পরিবারে ভাষা উপ-পরিবার হলো- মুণ্ডা। বঙ্গদেশে এই ভাষা-উপরিবারের সদ্স্য হলো সাঁওতালি, মুণ্ডারি, কোল ইত্যাদি। আদিবাসী সাঁওতালদের ভাষা আছে, গানও আছে। এরা নাচতে জানে, বাদ্যও বাজাতে পারে। বাংলাভাষার আদি রূপ গড়ে উঠেছিল এই প্রাকৃতজনের ভাষা চর্চার ভিতরে। বাংলা সঙ্গীতের আদি বিকাশ ঘটেছিল এদের মাধ্যমে।

ক্রমবিবর্তনের ধারায় আদিবাসী সাঁওতালদের সাথে বাঙালির দৈহিক রূপ, ভাষাগত রূপের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। তারপরে এই দুটি নিদর্শনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক ক্রমবিকাশের ধারায়, পূজা, ব্রত, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং সঙ্গীত উপস্থাপনায় সাঁওতালি প্রভাব বিশেষভাবে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঝুমুর গান-এর মতো সাওতাঁলি গান ও নাচের কথা বললে, উৎসরে বিচারে সাঁওতালি সঙ্গীতধারাকে মনে করিয়ে দেয়।

এরপরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলীয়'রা। আর্যদের আসার আগে নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড় এবং মোঙ্গলীয়'রা ভারতবর্ষে একটি মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি করেছিল। এদেরকে মোটা দাগে অনার্য বা প্রাকৃতজনগোষ্ঠী বলা হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারীদের বলা যেতে পারে পূর্ব-ভারতীয় প্রাকৃত জন। এদের ভিতর নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড-দের প্রভাব বেশি। ধারণা করা যায়, রক্তের মিশ্রণের পাশাপাশি এদের ভাষা ও সঙ্গীত নতুন রূপ লাভ করেছিল।

ভারতে সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে অনুপ্রবেশ করেছিল আর্য-ভাষাবাষীরা। এদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং মিশ্র ধারার লোকসঙ্গীত।

বৈদিক ও লোকগান
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০-১৫০০ অব্দের ভিতরে আর্যরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। এরা ইরান থেকে যে ভাষা ও ধর্মবিশ্বাস সাথে নিয়ে এসেছিল, পরবর্তী ৩০০ বৎসরের ভিতরে তার পরিবর্তন ঘটলো। উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে এই আগত এই জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দের দিকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের ভিতরে এই পরিবর্তিত ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। এও ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের ভিতরে বেদের সকল শ্লোক রচিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সকল শ্লোককে চারটিভাগে ভাগ করে নাম দিলেন ঋক্, সাম, যজু, অথর্ব। বেদের এই ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীর নাম দিয়েছেন বৈদিক ভাষা। বৈদিক ঋষিরা মন্ত্রপাঠ করতেন কাব্যের ছন্দে। তাতে সুর ছিল, ছন্দও ছিল। ছন্দের চাল ছিল কাব্যের মাত্রা ধরে। সুর ছিল মানবকণ্ঠের অবিভাজ্য ধ্বনির উপর ভাসমান। গোড়াতে সে সুর ছিল একটি একঘেঁয়ে ধারায়। সে সুরকে স্বরের বিচারে বলতে গেলে বলতে হয় এক স্বরস্থানের সুর। ঋষিরা এমন গানের নাম দিয়েছিলেন আর্চিক। পরে স্বরস্থান পরিবর্তন করে তৈরি হলো তিনটি ধাপ। ধাপ তিনটি হলো
  • উদাত্ত : স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে নিচু। একালের উদারার মতো।
  • স্বরিত : স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর-উচ্চারণের মতো। একালের মুদারার মতো।
  • উদাত্ত : স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু। একালের তারার মতো।
স্বরস্থানের ভিতরে ধীরে ধীরে একটি একটি করে সঙ্গীতোপযোগী শব্দ স্থান পেতো থাকলো। এইভাবে একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে ভারতীয় ঋষিরা নাম দিলেন স্বর। সঙ্গীতরত্নাকরের মতে― 'শ্রুতিসমূহের অনন্তর অনুরণনাত্মক যে স্নিগ্ধ ধ্বনি উৎপন্ন হয়, যে ধ্বনির অপর কোনও সহকারী কারণের অপেক্ষা না করিয়া স্বতই শ্রোতার চিত্তরঞ্জন করে তাহাকেই স্বর বলে।' তবে বৈদিক সঙ্গীতজ্ঞরা সাতটি শুদ্ধ স্বরের নামককরণ করেছিলেন- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ক্রুষ্ট ও অতিস্বার্য। সেকালের লৌকিক গানে এই স্বরগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশ পেয়েছিল। এই লৌকিক স্বরগুলো হলোহলো― ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। যাজ্ঞবল্ক্য ও অন্যান্য ঋষিদের মতে অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত উদাত্ত থেকে নিষাদ ও গান্ধার স্বরিত থেকে ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চমের সৃষ্টি হয়েছিল।

বৈদিকযুগের পরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল গান্ধর্ব গানের ভিতর দিয়ে। বৈদিক যুগের পরে- মহাকাব্যিক অধ্যায় (রামায়ণ মহাভারত), পৌরাণিক গ্রন্থাদি (মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, বায়ু পুরাণ, অগ্নিপুরাণ ইত্যাদ) ও শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদিতে (নারদীয় শিক্ষা, নাট্যশাস্ত্র, বৃহদ্দেশী ইত্যাদি) গান্ধর্ব গানের পরিচয় পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থাদির অনুসরণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংঙ্গীত বিকাশের যে ক্রমধারা পাওয়া যায়, তা হলো-
  • বৈদিক যুগ (১২০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ): বৈদিক গানের সূচনা। সাধারণভাবে বৈদিক গান সামগান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই সময়ের ভিতরে উদ্ভব হয়েছিল সাতটি শুদ্ধ স্বর।
     
  • মহাকাব্যিক ও বৌদ্ধ যুগ (৬০০-০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ): রামায়ণ রচিত হয়েছিল ৬০০-০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে। এই সময়কে গান্ধর্ব গানের আদি পর্ব হিসেবে মান্য করা হয়। এই সময়ে গ্রাম, মূর্চ্ছনার উৎপত্তি হয়েছিল। বৈদিক সামগানের পাশাপাশি এই সময়ে অনার্য-লোকসঙ্গীত ও আর্যপল্লীর লৌকিকগান ছিল। গান্ধর্বদের সঙ্গীতচর্চার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল- শাস্ত্রীয় তথা মার্গ সঙ্গীত এবং লৌকিক বা দেশী গান।

    বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রে ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বুদ্ধের পূর্বজনমের কাহিনি অনুসারে  লিখিত হয়েছিল 'জাতক' নামক বহু গল্প। কোনো কোনো জাতকে সেকালের গানের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সময়ের প্রধান ধারার গান ছিল গান্ধর্ব গান।

    উত্তরভারতে ১৬টি মহাজনপদ নাম পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধের  এবং মহাবীরের জন্মের আগে, এই সকল মহজনপদের নাম পাওয়া যায়– 'ভগবতীসূত্র' এবং 'অঙ্গুত্তরনিকাই' নামক দুটি গ্রন্থে। এই জনপদগুলো বিস্তৃত ছিল কাবুল থেকে দাক্ষিণাত্যের গোদাবরী নদী পর্যন্ত। এই জনপদগুলো হলো– কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি বা বৃজি, মল্ল বা মালব, চেদী, বৎস বা বংশ, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, শুরসেন, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার ও কম্বোজ। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য রাজ্যগুলো ছিল– কপিলাবস্তুর শাক্য রাজ্য, রামগ্রামের কোলিয় রাজ্য, পিপপ্পলিবনের মৌর্য রাজ্য, ভগ্গ ও আল্লাকাপ্পার বুলি রাজ্য, কেশপুত্তের কালামস রাজ্য, বৈশালীর লিচ্ছবি রাজ্য, মিথিলার বিদেহ রাজ্য। উল্লিখিত মহাজনপদগুলোরে ভিতরে ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলের নাম পাওয়া যায় না। যেমন— আসাম, বঙ্গদেশ, উড়িষ্যা, গুজরাট, সিন্ধু, পাঞ্জাব ইত্যাদির নাম নেই। ধারণা করা যায়, বুদ্ধের সময় ভারতের আসাম, বঙ্গদেশ এবং উড়িষ্যা অঞ্চলে ছোটো ছোটো রাজ্য ছিল। আর মহাজনপদের রাজারা উত্তর-ভারতের কয়েকটি অংশ জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়াই করেছে এবং জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তাদের বিষয় ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এই সকল রাজ্যের নামকরণে ভাষার কোনো ভূমিকা ছিল না।  ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। এই জনপদগুলোর নাম ছিল— গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, পুণ্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্র, রাঢ়। এই জনপদগুলোই অখণ্ড বঙ্গদেশের আদিরূপ ছিল।

    খ্রিষ্ট-পূর্ব সপ্তম শতকে ষোড়শ মহাজনপদগুলোর ভিতরে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ভিতর সৃষ্টি হয় চারটি মহাজনপদ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এই চারটি জনপদ হলো− কোশল, অবন্তী, বৎস এবং মগধ। পরে এই রাজটি রাজ্যের ভিতর সার্বভৌম রাজত্ব লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মগধ এই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে সার্বভৌম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বৌদ্ধমহাবংশ থেকে জানা যায়, মগধের একজন দুর্বল রাজা ছিলেন ভট্টিয় বা মহাপদ্ম। অঙ্গরাজ তাঁকে পরাজিত করে, মগধকে অঙ্গের করদ রাজ্যে পরিণত করেন। এই মহাপদ্মের পর মাত্র পনের বৎসর বয়সে  বিম্বিসারর মগধের রাজা হন। সিংহলী প্রাচীন গ্রন্থমতে বিম্বিসার রাজা হয়েছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫৪ অব্দে তিনি তাঁর পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শুরুতে তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেন। সেই সময়ের অঙ্গরাজ্যের রাজা উদয়নকে পরাজিত করে বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করেন। এই সময় মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ। বিম্বিসারের রাজত্বের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৫ অব্দে। এই বিচারে বলা হয়, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০ (মতান্তরে ৫৫৮) অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৪৯৩ অব্দের দিকে। কথিত আছে বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু (৪৯৩-৪৬২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) রাজ্যলোভে পিতা বিম্বিসারকে উপবাস করিয়ে হত্যা করেন। অজাতশত্রু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর, ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে 'প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি' অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময় বঙ্গদেশে উল্লেখযোগ্য রাজা বা তার রাজত্বের কথা জানা যায় না।

    মহাভারতের যুগ  হিসেবে ধরা হয় ৪০০-৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই সময়ের প্রধান ধারার গান ছিল গান্ধর্ব গান। মহাভারতে এই সময়ের গানের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।
    মহাভারতের সূত্রে বঙ্গদেশের কথা জানা যায় একটি জনপদ বা রাজ্য হিসেবে। সেকালের বঙ্গদেশের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং ভাষারীতি কি ছিল তা জানা যায় না। যদি বঙ্গরাজ্যের অধিবাসীদের আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে বঙ্গভাষার উৎপত্তি হয়েছিল ধরা যেতে পারে। কিন্তু এই সূত্র ধরে অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্মের সূত্রে কোনো ভাষার নাম পাওয়া যায় না। মহাভারতে আমলে উত্তর ভারতের আর্যদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। কিন্তু আদিবাসী বা অনার্যদের ভাষা ছিল ভিন্নতর। অঞ্চলভেদে আদিবাসীদের ভাষার ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল।

    বঙ্গরাজ্যের একটি বড় সাক্ষ্য মেলে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সূত্রে। আলেকজান্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতের দিকে যাত্রা করেন। আর খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে তিনি সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এরপর পূর্ব-ভারতে অগ্রসর হোয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন আক্রমণ থেকে বঙ্গদেশ তথআ গঙ্গারিডাই  রাজ্যে কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়ে।  আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও বন্ধু সেলুকাসের রাজত্বকালে গ্রিক দূত হিসাবে মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ ) ভারতে এসেছিলেন। তাঁর মতে—

    'গঙ্গারিডাই রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশী রাজ্যের কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়ে আতংকগ্রস্ত থাকিত'।

    'ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না' - ডিওডোরাস (৯০-৩০খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ)

    অনেকে মনে করেন গঙ্গারিডাই ছিল নন্দরাজের অধীনস্থ একটি রাজ্য। নন্দরাজের পতনের পর এই রাজ্য চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ হয়। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপি থেকে অনুমান করা যায়, উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধন খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩-৩২৪ অব্দের দিকে চন্দ্রগুপ্তের অধিকারে এসেছিল। সেই সূত্রে বঙ্গদেশ ধীরে ধীরে মৌর্যবংশের শাসনাধীন চলে যায়। চন্দ্রগুপ্তের পরে রাজ হন যথাক্রমে বিন্দুসার (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০-২৭৩ অব্দ) ও অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দ)। উল্লেখ্য রাজত্বকালে বৌদ্ধ তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। নানা গ্রন্থে এরূপ পরস্পর বিরোধী তথ্যের দ্বারা অশোকের পরের রাজাদের ইতিহাস সাজানো মুশকিল। এর ভিতর দিয়ে যতটুকু জানা যায়, তা হলো সম্প্রতি নামক একজন অশোকের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন। সম্প্রতির পুত্র ছিলেন বৃহস্পতি। সালিশুক নামক আরও একজন রাজার নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত সালিশুক এবং বৃহস্পতি একই ব্যক্তি ছিলেন। পুরাণ ও বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত থেকে জানা যায়, মৌর্যবংশের শেষ রাজা ছিলেন বৃহদ্রথ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। এরই ভিতর দিয়ে মৌর্য বংশের শাসনের অবসান হয় এবং পুষ্যামিত্রের মাধ্যমে শুঙ্গ বংশীয়দের রাজত্ব শুরু হয়।

    এই রাজবংশের শেষ রাজা দেবভূতি খ্রিষ্টপূর্ব ৮২ অব্দে রাজত্ব গ্রহণ করেন। দেবভূতি নারীদের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তাঁর মন্ত্রী বাসুদেবের প্ররোচনায় এক পরিচারিকার হাতে তিনি নিহত হন। এই হত্যার ভিতর দিয়ে শুঙ্গদের ১১২ বছরের শুঙ্গ বংশীয়দের রাজত্বের অবসান হয়। এরপর শুরু হয় কান্ব রাজবংশ (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩-২৮ অব্দ) রাজত্ব। এই সময় দেশীয় রাজাদের কোন্দলের ফলে, ভারতে একক শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠিত হয় নি। এই সুযোগে বিদেশীরা ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক, শক, পহ্লব, কুষাণ। ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কুষাণ জাতির রাজা কনিষ্ক একটি শক্তিশালী রাজত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সময় ব্রাহ্মীলিপি ক্রম পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে কুষাণ লিপিতে পরিবর্তিত হয়েছিল। এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের চতুর্থ এবং শেষ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সময়।

    দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন ও উত্তর আর্যাবর্তে কুষাণ সাম্রাজ্য পতনের পর খ্রিষ্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে গুপ্তবংশীয় রাজগণ ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পূর্ব ভারত ও উত্তর প্রদেশেই এঁরা রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। এ যাবত প্রাপ্ত এদের মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয় যে, গুপ্তরাজারা উত্তর প্রদেশ থেকেই তাদের ক্ষমতা বিস্তার আরম্ভ করেন। এই বংশের আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষে অথবা চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোনো ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, কিন্তু কোথায় তিনি রাজত্ব করতেন সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না।  ৬৭৫ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিং ভারতবর্ষ ভ্রমণ করতে আসেন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, তাঁর ভারত-ভ্রমণের প্রায় ২৫ বৎসর আগে, মহারাজা শ্রীগুপ্ত চৈনিক ধর্মযাজকের জন্য় নালন্দার ২৪০ মাইল পূর্বে একটি ধর্মমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এটি চীনের মন্দির নামে পরিচিত। নালন্দার পূর্বদিক বলতে বঙ্গদেশ বুঝায়। এই অর্থে অনেকে গুপ্তরাজ্য বঙ্গদেশে ছিল বলে মনে করে থাকেন। সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটেছিল বঙ্গদেশে।

    এই বংশের পতন ঘটেছিল ৫১০ খ্রিষ্টাব্দের পরে। তবে ঠিক কোন সময়ে গুপ্তরাজ্য সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছিল, তা জানা যায় নি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রাদেশিক শাসক এবং হুনদের আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্য বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল যশোধর্মণের রাজ্য বিস্তার। এই বঙ্গদেশে দুটি  স্বাধীন এবং শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই রাজ্য দুটি হলো গৌড় এবং বঙ্গ। মূলত রাজা শশাঙ্ক উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তবংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। এরপরে ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। গঞ্জামের তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, শশাঙ্কের ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন।

    ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর, সুযোগ্য শাসকের অভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কোনো সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ বৎসর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘোর অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময়ের এই অবস্থাকে মাৎসন্যায় নামে অভিহিত করা হয়। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কনৌজের রাজা যশোবর্মণ, বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অধিকাংশ অংশই দখল করে নেন। এই সময় কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কিছুটা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সকল ভিন্নদেশী শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, সেই সময় বাংলাদেশের প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। এই গোপাল থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপাল তাঁর রাজত্ব শুরু করেন। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাল বংশ বাংলাদেশ শাসন করেছিল।

    বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বঙ্গদেশের জনপদগুলোকে নানারূপ বর্ণনায় পাওয়া যায়। ঐতেরিয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্রদেরকে উত্তরবঙ্গের বর্বর অধিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায় ধর্মসূত্রের রচয়িতা বৌদ্ধায়নের গ্রন্থ থেকে। কালক্রমে এই সকল অঞ্চলের জনগোষ্ঠী আর্যদের আচার আচরণের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে। মহাভারতে পুণ্ড্র ও বঙ্গের অধিবাসীদের 'সুজাত' ক্ষত্রিয় নামে অভিহিত করা হয়েছে। রামায়ণে বঙ্গকে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময়ে বঙ্গের ক্ষত্রিয়দের সাথে অযোধ্যার ক্ষত্রিয়দের রাজনৈতিক সুসম্পর্ক ছিল। মহাভারতের বন পর্বে দেখা যায়, ভীমের কাছে পুণ্ড্র, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্তের রাজারা পরাজিত হয়েছিলেন। জৈন গ্রন্থ 'উপাঙ্গ'-এ আর্যসভ্যতার তালিকায় বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।  দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বঙ্গ-অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এ গ্রন্থে। জৈন গ্রন্থ মতে, তাঁদের ধর্মগুরু মহাবীরের সাথে রাঢ় অঞ্চলের মানুষ হীন আচরণ করেছিল।

    খ্রিষ্টীয় ৫ম শতাব্দীর দিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেরর  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। সেই সাথে এই সব অঞ্চলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তোয়াক্কা না করে, আঞ্চল ভিত্তিক লোকগানের বিকাশ ঘটেছিল। বিভিন্ন সামবেদ থেকে পৌরাণিক যুগের গ্রন্থাদি অনুসরণে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও, ভারতের লোকগানসমূহের ক্রমবিবর্তনের ধারা সম্পর্কে কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। কারণ লোকগানসমূহের কোনো লিখিত গ্রন্থাদি পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বাংলা গানের বিষয়াঙ্গ ও সুরাঙ্গের সূত্রে বাংলা গানের বিকাশের ঘটেছিল। এই সূত্রেই তৈরি হয়েছিল- বাংলা গানের আদি গান 'চর্যাগীতি‌'।

্রাক্-চর্যাগীতি পর্যয়ে গ্রাম ও মূর্চ্ছনার সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল- জাতিরাগ, গ্রামরাগ, ধ্রুবা গান এবং প্রবন্ধগান। এই প্রবন্ধ গান থেকে উৎপত্তি ঘটেছিল চর্যাগীতি


সূত্র :

চর্যাগীতি পদাবলী, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৫
চর্যাগীতি পরিক্রমা। দে'জ সংস্করণ। জানুয়ারি ২০০৫।
চর্যাগীতিকোষ। নীলরতন সেন সম্পাদিত। সাহিত্যলোক। কলকাতা। জানুয়ারি ২০০১।
বড়ুচণ্ডীদাসের কাব্য । মুহম্মদ আব্দুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত। স্টুডেন্ট ওয়েজ। আশ্বিন ১৩৮৮ সন।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা
। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স।
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। কথাশিল্পী প্রকাশ। বৈশাখ ১৩৭২
ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস (তৃতীয় ভাগ)। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। শ্রাবণ ১৩৯৪।
বায়ুপুরাণ। পঞ্চানন তরজকরত্ন সম্পাদিত। নবভাত পাবলিশার্স, কলকাতা। দ্বিতীয় নবভারত সংস্করণ। আষাঢ় ১৪১৮।

মার্কেণ্ডে পুরাণ। মহেশচন্দ্র পাল-কর্তৃতক সঙ্কলিত ও প্রকাশিত। উপনিষৎ কার্যালয়, কলকাতা। মাঘ ১৮১২ শকাব্দ।
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর শ।
সামবেদ সংহিতা। অনুবাদ ও সম্পাদনা: শ্রীপরিতোষ ঠাকুর। হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা। অষ্টম মুদ্রণ, ২০ জুলাই ২০০১
হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোঁহা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৩২৩ 
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit