বাংলা গান
(১৮০০-১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ)

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে বাংলা নাগরিক গানের প্রধান ধারায় পাই- কীর্তন, রামপ্রসাদী, টপ্পা, খেয়াল । একই সাথে পাই এসকল মূলধারার সংমিশ্রণে নানান ধরনের গান। এই ধারায় বাংলা নাগরিক গান সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল বিষয়াঙ্গ ও সুরাঙ্গের ধারায়। এই শতকের বাংলা নাগরিক গানের উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল- হাফ আখড়াই, কথক, টপ্পা-রামপ্রসাদী গান, ধ্রুপদ, যাত্রাগান, থিয়েটারের গান, ব্রহ্মসঙ্গীত। এই ধারার সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ধ্রুপদাঙ্গ, খেয়ালঙ্গ, কীর্তনাঙ্গ, বাউলাঙ্গ ইত্যাদি আধা-শাস্ত্রীয় ও আধা-লোক গান।

হাফ আখড়াই গান
১৭৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে যখন আখড়াই গান অশ্লীল হিসেবে সুধীজনদের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছিল, সে সময় নিধুবাবু আখড়াই গানের অশালীন তকমা সরিয়ে ফেলে, নতুন ধরনের আখড়াই গানের সূচনা করলেন। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিকে তিনি এই নবতর আখড়াই গানের ধারা কলকাতায় প্রচলন করেন। নবতর আখড়াইয়ের দুটি গোষ্ঠী নিধুবাবুর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার শোভাবাজার এবং পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে। তবে এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিযোগিতার সময় নিধুবাবু অংশগ্রহণ করতেন শোভাবাজার গোষ্ঠীর পক্ষে। পাথুরিয়াঘাট গোষ্ঠীর পরিচালনা করতেন শ্রীদাম দাস। পরবর্তী দুই দশক ধরে এই নবতর আখড়াই গান প্রচলিত থাকলেও ক্রমে ক্রমে তা নিষ্প্রভ হয়ে যায়। নিধুবাবুর বারধ্যক্যের কারণে এবং উপযুক্ত পরিচালকের অভাবে নবতর আখড়াই গান গৌরব হারনো শুরু করে। এরই মধ্যে নিধুবাবুর প্রধান শিষ্য মোহনচাঁদ বসু হাফ আখড়াই গানের প্রচলন করেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে বড়বাজারের রামসেবক মল্লিকের বাড়িতে সর্বসাধারণের সামনে প্রথম হাফ-আখড়াই গানের আসর বসেছিল। নিধুবাবু প্রথম দিকে হাফ আখড়াই গানের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, তবু শিষ্যের এই প্রচেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। এই গানে তিনি কবিগানের মতো উত্তর-প্রত্যুত্তর ও সখীসংবাদ যুক্ত করেছিলেন। টপ্পা অঙ্গের আখড়াই গানে ছিল রাগের নানারূপ আলঙ্করিক প্রয়োগ। হাফ আখড়াই গানের শিল্পীরা সেখান থেকে সরে এসে সরল সুরের গান বাঁধতেন। এই গানে অন্তরা থাকত না।  হাফ-আখড়াই গানের পদ রচিত হতো চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, ডবল ফুকা, মেলতা, মহড়া, খাদ, দ্বিতীয় ফুকা, দ্বিতীয় ডবল ফুকা, দ্বিতীয় মেলতা ইত্যাদি এই ধারাক্রমে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে হাফ আখড়াই গান জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
       [সহায়ক পাঠ: হাফ আখড়াই] কথক
নিধুবাবুর (১৭৪১-১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং তাঁর শিষ্যদের দ্বারা টপ্পা যখন কলকাতার নগরকেন্দ্রিক সঙ্গীতজগত নিমগ্ন, সে সময়ে বাংলাগানের ভিন্ন রসের সঞ্চার করলেন শ্রীধর কথকের কথক গান। সুরে সুরে গল্প বলার রীতি প্রচলিত হয়েছিল মধ্যযুগের পাঁচালির সূত্রে। কথক তারই একটি প্রকরণ মাত্র। এই ধারাটি শ্রীধর কথকের (১৮১৬-? খ্রিষ্টাব্দ) আগে থেকেই অল্পবিস্তর ছিল। শ্রীধরের পিতামহ লালচাঁদ বিদ্যাভূষণও কথক ছিলেন। কিন্তু শ্রীধর কথক এই গানকে উচ্চতর সঙ্গীতশৈলীতে পরিণত করেছিলেন। উল্লেখ্য, কথক গানের মতই তিনি টপ্পাতেও সমান কৃতিত্ব দেখান।  দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান গ্রন্থে তার রচিত ১৯৬টি টপ্পা-সহ নানা ধরনের গান পাওয়া যায়। টপ্পা রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় নিধুবাবুর সমতুল্য ছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত তাঁর বহু উৎকৃষ্ট টপ্পা নিধুবাবুর নামে প্রচলিত হয়ে যায়।

টপ্পা মিশ্রিত রামপ্রসাদী গান
সেকালের অনেকেই রামপ্রসাদী সুরে অনেকে শ্যামা সঙ্গীত রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তবে শ্যামসঙ্গীতকে ভিন্ন সুরাঙ্গে উপস্থাপন করেছিলেন কালীসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর রচিত শ্যামা সঙ্গীতের সুরাঙ্গ ছিল  টপ্পাঙ্গের। এর সূত্রপাত হয়েছিল রামপ্রসাদের সূত্রে। এই সুরাঙ্গের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এই গান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই গানগুলো যে সকল রাগে নিবদ্ধ হয়েছে, তা হলো —কালাংড়া, কেদারা, খট, খটকালাংড়া, খট যোগিয়া, খাম্বাজ, গৌরী, ঝিঁঝিট, টোড়ি, টোড়ি ভৈরবী, নট বেলোয়াল, পরজ, পরজকালাংড়া, পুরবি, বিভাস যোগিয়া, বেহাগ, ভৈরব, ভৈরবী, মল্লার, মালসি, মুলতান, যোগিয়া, ললিত ঝিঁঝিট, ললিত যোগিয়া, সিন্ধু, সিন্ধু কাফি, সুরটমল্লার, সোহনী।  এ ছাড়া প্রায় একই রকমের সুরে গান রচনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দেওয়ান রামদুলাল নন্দী (১৭৮৫-১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দ)।

ধ্রুপদ

বাংলা ধ্রুপদের সূত্রপাত ঘটেছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রে। এই ঘরানার আদিপুরুষ পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) এবং এর শিষ্যরা বাংলা ধ্রুপদকে একটি আদর্শ মানে নিয়ে এসেছিলেন। পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন অবাঙালি গুরুদের কাছে। পরে তিনি হিন্দুস্থানী ভাষা ত্যাগ করে বাংলাতে ধ্রুপদ রচনা করেন এবং তা তাঁর শিষ্যদের শেখান। মূলত তাঁর সূত্রেই ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীত জগতে বিষ্ণুপুরে ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল।
যাঁর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী সময়ের ব্রহ্মসঙ্গীত এবং ঠাকুরবাড়ির গানে।

ঠুমরি
আদি ঠুমরি গানের বিকাশ ঘটেছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে। ঠুমরি গানের প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতকে রচিত ফকিরুল্লাহ্‌র রাগদর্পণ গ্রন্থে। সে সময় বারোঁয়া এবং এই জাতীয় রাগে বিশেষ ঢংয়ের গান গাওয়া হতো। এই গান সে সময়ে ঠুমরি নামেই প্রচলিত ছিল। আদি ঠুমরি গানের পদগুলো রচিত হয়েছিল আওধি বা ব্রজভাষায়। পরবর্তী সময়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সকল ভাষাতেই এই গানের পদ রচিত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ্ণৌ-এর নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ্ (১৮২২-১৮৯৭) এই গানকে তাঁর দরবারে স্থান দেন। ফলে নবাবের আনুকুল্যে এই গান দরবারে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হয়। সে সময় দরবারের বাঈজীরা (নৃত্যগীতে পারদর্শিনী শিল্পী) নৃত্য-সহযোগে রাজপুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য এই গান পরিবেশন করতেন। ফলে ঠুমরিতে শৃঙ্গাররসের আধিক্য ঘটে। 

অখণ্ড বঙ্গদেশে বাঈজিদের সূত্রে ঠুমরি গান প্রচলিত হয়। এক্ষেত্রেও নবাব নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ -এর ভূমিকা ছিল। ইংরেজদের চক্রান্তে নবাব, কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। তাঁর এই নির্বাসিত জীবনেও তাঁর অপরিসর দরবারে সঙ্গীতের আসর বসতো। এই সূত্রে দরবারে কথক নৃত্যশিল্পী এবং ঠুমরি শিল্পীরা যোগদান করতেন। নবাব ওয়াজেদ আলী-এর অনুসরণে বঙ্গদেশের অনেকে রাজা-মহারাজাও বায়না করে বাজি আনতেন, কিম্বা স্থায়ীভাবে বাইজি রাখতেন। এক সময় বাইজি রাখাটা কলকাতার বাবু-সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঠুমরি ছড়িয়ে পড়েছিল, বাইজিদের দ্বারা। এই ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়াও এলাহাবাদ, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানেও ঘটেছে। এই সূত্রে বাংলা ঠুমরি গানের উদ্ভব ঘটে ধীরে ধীরে।
    [সহায়ক পাঠ: ঠুমরি]

পাঁচালি
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগান সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল নব্যধারার পাঁচালি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) পাঁচালির এই মিশ্ররূপ দান করেন। এই মিশ্ররীতিতে কবিগানের প্রভাব ছিল অপরিসীম। এছাড়া এর সাথে মিশেছিল কীর্তন, টপ্পার সুরশৈলী। পাঁচালি, কথক ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পালা গানের যাত্রাপালা। দুর্ভাগ্যক্রমে সেকালের যাত্রাপালার কোনো সংকলন পাওয়া যায় না। এরূপ অনেক যাত্রাপালার অধিকারীদের মধ্যে ছিলে রাধারমন সরকার। তাঁর শিষ্য গোপাল উড়ে 'বিদ্যাসুন্দর' পালায় অভিনয় এবং গানে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই ধারায় পরবর্তী সময়ে খ্যাতি পেয়েছিলেন গোবিন্দ অধিকারী, নীলকণ্ঠ মুখুজ্যে প্রমুখ।

যাত্রাগান

যাত্রাগান অভিনয়ধর্মী শিল্পকে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছেছিল। কিন্তু থিয়েটার বলতে যা বুঝায়, তা তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় অভিনয় শিল্পের সূত্রে। এই গানে দেশীয় সুর এবং ভাবাদর্শ ব্যবহৃত হয়েছে নানাভাবে। ইউরোপীয় থিয়েটার থেকে বাংলা থিয়েটার নেওয়া হয়েছিল নতুন আঙ্গিকের মঞ্চসজ্জা। যাত্রা-মঞ্চকে ঘিরে থাকা দর্শকদের থিয়েটার এনে একমুখী করা হয়েছিল। যাত্রা মঞ্চে কোনো পশ্চাৎ-পট ছিল না। এতে থিয়েটারের উইংস বলেও কিছু ছিল না। থিয়েটার এর সবই যুক্ত করা হয়েছিল ইউরোপীয় ধাঁচে। এছাড়া দৃশ্য পরিকল্পনাও ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে। কিন্তু থিয়েটারে ব্যবহৃত গান হয়েছিল বাংলা ঐতিহ্য অনুসারে। সে গানগুলো সুর শৈলীর বিচারে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী গান এবং বাংলার লোকগান বা আধা-লোক গান। এক্ষেত্রে থিয়েটারের গান ছিল যাত্রাপালার গানের উত্তরসূরী।

বাংলা নাটক ও নাটকের গান
বাংলা নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল রুশ নাট্য ও সঙ্গীত শিল্পী হেরাসিম লেবেদেফ (১৭৪৯-১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দ)-এর হাত ধরে। এই সূত্রে তিনি একটি নাট্যমঞ্চেও তৈরি করেছিলেন। তবে এর আগেই কলকাতায় নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়েছিল আরও আগে। তবে বঙ্গদেশে নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়েছিল।

যতদূর জানা যায়, ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দ)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ নামক দ্বিতীয় রঙ্গমঞ্চটিও তৈরি করেছিলবানায় ইংরেজরা। সে আমলে প্রায় এক লাখ রুপি খরচ হয়েছিল মঞ্চটি বানাতে।  ওয়ারেন হেস্টিংস ছাড়া এই মঞ্চ তৈরিতে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন মরিসন, বারওয়েল, এলিজা ইম্পে, হাইভ। বর্তমানে কলকাতার ‘নিউ চায়না মার্কেট’ চত্বরে এই মঞ্চটি তৈরি করা হয়েছিল। এই মঞ্চে অভিনীত
Comedy of Beaux Startagem, Comedy of Foundling, School for Scandal, Mahomet, Like Master Like Man, Citizen প্রভৃতি নাটকগুলো বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। তবে এসব নাটক দেখার সৌভাগ্য খুব কম বাঙালিরই হয়েছিল। কারণ, এ সকল নাটকের অধিকার ছিল শুধু ইউরোপীয়ানদের। এই সময় বাঙালি দর্শকদের জন্য ছিল যাত্রাপালা, পূজা-পার্বনে রঙ মেখে ও মুখোশ পড়ে দেবদেবী'র লীলা-পালা। কোনো কোনো রাজ-বাড়িতে নাট-মন্দির ছিল, সেখানে মাঝে মধ্যে ঝুমুর-গানের আসর বসতো। আর ছিল রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিল জলসা ঘর। সেখানে অবশ্য সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না।

এরপর ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ামের ভেতর জন ব্রিস্ট একটি মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। কথিত আছে ব্রিস্ট এই মঞ্চটি তৈরি করেছিলেন তাঁর স্ত্রী এমা ব্রিস্টের জন্য। ব্রিস্ট মূলত নিজের বাসাবাড়িতেই ছোটো পরিসরে মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। এই মঞ্চের দর্শক ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এবং উচ্চ পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্থানীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না।

রাশিয়ার ইয়ারোস্লাভ্ল্-এর জন্মগ্রহণকারী হেরাসিম লেবেদফ জীবনের শুরুতে বেহালাবাদক হিসেবে রাশিয়ার প্রথম স্থায়ী থিয়েটার দলের প্রতিষ্ঠাতা ফিয়োদর ভোল্কোভ-এর নাট্যদলে যোগদান করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি সঙ্গীতদলের সাথে বেহালাবাদক হিসেবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভিয়েনাতে আসেন। এরপর রুশদের সঙ্গ ত্যাগ করে, ইউরোপের নানাস্থানে ভ্রমণ করেন। পরে তিনি ইংরজেদের সামরিক ব্যান্ড দলে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশ সেনাদলের সাথে ভারতে আসেন। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাহাজে মাদ্রাজে পৌঁছান এবং সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে সেখানকার মেয়র তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। কয়েকটি সঙ্গীত আসরে যোগদান করে তিনি কিছু অর্থ উপার্জনও করেন। কিন্তু মাদ্রাজের রক্ষণশীল সমাজে প্রবেশাধিকার না পেয়ে তিনি ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা আসেন। শুরু দিকে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র বাদক হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বেহালায় ভারতীয় গানের সুর তুলে সবাইকে মুগ্ধ করেন।

এই সময় তিনি স্থানীয় স্কুল শিক্ষক গোলকনাথ দাসকে কিছুদিন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পাঠদান শুরু করেন। বিশেষ করে তিনি গোলকদাসকে বেহালা শিখিয়েছিলেন। বিনিময়ে তিনি গোলকদাসের কাছে বাংলা, সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষা শেখেন। এই সূত্রে তিনি একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। এই গ্রন্থটি ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি রচনা করেন 'অভিধান', 'কথোপকথন গ্রন্থ', 'বীজগণিত', 'বাংলা পঞ্জিকার অংশ', 'ভারতচন্দ্রের কাব্য' একটি আত্মজীবনী।

১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মলিয়ের '
Love of the best docto r' এবং জড্রেলের নাটক ' The Disguise ' বাংলায় অনুবাদ করেন।  'The Disguise এর বাংলা নাম দিয়েছিলেন 'কাল্পনিক সংবদল'। এরপর কলকাতার ডোমতলায় (এজরা স্ট্রিট) একটি রঙ্গমঞ্চ তৈরি করেন। এই নাট্যশালায়া নাটক দুটির মঞ্চস্থ হওয়ার বিষয়ে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের 'ক্যালকাটা গেজেট'-এ ৫ই নভেম্বর একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল।

 

এই নাটকের জন্য তিনি গোলকনাথের সহায়তায় একটি ঝুমুর দল থেকে ১০ জন অভিনেতা ও ৩ জন অভিনেত্রী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর(শুক্রবার ১৪ অগ্রহায়ণ ১২০২), তাঁর অনূদিত নাটক দুটি মঞ্চস্থ হয়। প্রথম বার নাটক মঞ্চস্থ করার সময়, দর্শক হয়েছিল প্রায় ২০০ জন। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ (সোমাবার, ১১ চৈত্র ১২০২) নাটক ২টি পুনরায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। দ্বিতীয় বারে দর্শক হয়েছিল প্রায় ৩০০ জন।

তিনি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরেরদুটি কবিতায় সুর বসিয়ে গানে বানিয়েছিলেন। এই গান দুটি ছিল-
  • গুণসাগর নাগর রায় [তথ্য]
  • প্রাণ কেমন রে করে না দেখে তাহারে

সম্ভবত বাংলা নাটকের এই দুটি গানই প্রথম। এই দুটি গানে লেবেদফ নিজে সুরারোপ করেছিলেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় বাংলা নাটকের শুরু থেকেই গান সংযোজিত হয়েছিল। লেবেদেফ গানের বাণী নিয়েছিলেন ভারতচন্দ্রের কাব্যগ্রন্থ থেকে, আর সুর করেছিলেন ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণে। এই নাটক মঞ্চস্থের সূত্রে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা তাঁর সাফল্যকে সুনজরে দেখেন নি। ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংরেজরা সীন পেন্টার এবং মিস্টার হে নামক দুজন রাজকর্মচারীরকে দিয়ে এই রঙ্গমঞ্চ পুড়িয়ে দেন। এরপর নানা কারণে তিন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে আদালতে যেতে হয়। পরে ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করেন।

হেরাসিম লেবেদেফের চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন আর কোনো বাংলা নাটক তৈরি বা মঞ্চস্থ হয় নি। ফলে তাঁর নাটক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। সে সময়ে কলকাতার বাঙালি বাবুরা মেতে উঠেছিলেন যাত্রাপালা, পাঁচালি, কবিগান, আখড়াই গান, টপ্পা, হাফ আখড়াই গান নিয়ে। সেই সাথে ছিল কীর্তন, জারির মতো আধা লোকগান। বাউল, ভাটিয়ালি, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া অঞ্চল বিশেষে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হলেও কলকাতায় এর বিশেষ প্রভাব ছিল না। তবে কখনো কখনো বাবুরা তাঁদের জলসা ঘরে বৈঠকী বা দরবারি ঝুমুর বা এই জাতীয় গানের আসর বসাতেন। ফলে তখনও থিয়েটারের গান পৃথক কোনো মর্যাদায় স্থান করে নিতে পারে নি। গান হিসেবে বিকশিত হয়ে চলেছিল। ভারতবর্ষকে সুচারুরূপ শাসন এবং শোষণের জন্য, ইংরেজরা ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের স্থাপন করে। এই সময় এই কলেজে  আরবি, হিন্দুস্তানি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখানো হতো। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে ছিল না। তাই ডেভিড হেয়ার এবং রাজা রাধাকান্ত দেব ইংরেজি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। এই সূত্রে উচ্চতর ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বদ্দিনাথ মুখোপাধ্যায়। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে, বদ্দিনাথের বাসায় এ বিষয়ে  একটি সভা হয়। এই সূত্রে ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় পূর্ববর্তী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজ থেকে ইংরেজি নাটকের সাথে বাঙালি পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। একই সাথে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা যাত্রা, কবিগান, কথক, পাঁচালিকে নিতান্তই গেঁয়ো আমোদ-প্রমোদ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। এই সময় বাংলা নাটকের জন্য নব্য শিক্ষিতরা রঙ্গমঞ্চের অভাব অনুভব করতে থাকে। এ নিয়ে সেকালের 'সমাচার চন্দ্রিকা', 'সমাচার দর্পণ' প্রভৃতি পত্রিকায় বিস্তর লেখা চালাচালি চলছিল। এরপর দীর্ঘ পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে কিছু নাটক রচিত হয়েছিল। এসকল নাটকে পরমার্থ-বিষয়ক দীর্ঘ বক্তৃতা যুক্ত করায়, নাটকের বিচারে তা একঘেঁয়ি সংলাপে পরিণত হয়েছিল। তবে এই নাটকগুলো অভিনয়যোগ্য ছিল না। এই জাতীয় নাটকের ভিতরে ছিল ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'প্রবোধচন্দ্রোদয়' নাটকের অনুবাদ 'আত্মতত্ত্ব কৌমুদী' নামে।  এছাড়া ছিল এই বছরে প্রকাশিত 'হাস্যার্ণব' নামক প্রহসন।

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল দুই অঙ্কের নাটক 'কৌতুকসর্ব্বস্ব'। গো্পীনাথ চক্রবর্তীর সংস্কৃত নাটক 'কৌতুকসর্ব্বস্ব' অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন রামচন্দ্র তর্কালঙ্কার। এই ভাবনার ভিতর দিয়ে প্রসন্নকুমার চট্ট্যোপাধ্যায় ' হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। এর দ্বার উন্মোচন হয়েছিল ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর। এই নাট্যশালায় অভিনীত হয়েছিল শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজারের অংশবিশেষ এবং উইলসন-কৃত অনূদিত ভবভূতির 'উত্তররামচরিত'-এর অনুবাদ। বাঙালির হাতে এই নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা হলেও, নাটকের ভাষা ছিল ইংরেজি। এই নাটক দেখে ইংরেজরা খুশি হয়েছিল, কিন্তু বাঙালির মনে তা দাগ কাটে নি। ফলে অচিরেই এই নাট্যমঞ্চ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

এরপর নবীনচন্দ্র বসু, শ্যামবাজারে একটি নাট্যশালা তৈরি করেন। এর নাম ছিল শ্যামবাজার থিয়েটার এই নাট্যশালায় বছরে চার-পাঁচটি নাটক মঞ্চস্থ হতো। এই নাট্যশালায় অভিনীত হতো বাংলা নাটক। এই মঞ্চে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে অভিনীত হয়েছিল 'বিদ্যাসুন্দর' নাটক। এই নাটকে স্ত্রীচরিত্রগুলো মেয়েরাই করেছিল। পত্র-পত্রিকায় এই নাটক সম্পর্কে ভালো-মন্দ দুইই আলোচিত হয়েছিল। 'বিদ্যাসুন্দর'-এর পর বাংলা নাটকের একটি স্বল্প-বিরতি পাওয়া যায় ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

এরপর নাটক রচনার একটি প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এর সূচনা হয়েছিল ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রামতারক ভট্টাচার্য অভিজ্ঞান শকুন্তলার অনুবাদ। এরপরের বছর, ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহর্ষের রত্নাবলী অবলম্বনে নীলমণি পাল রচনা করেন 'রত্নাবলী নাটিকা'। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাওয়া যায় যোগেন্দ্রচন্দ্রগুপ্তের 'কীরত্তিবিলাস', তারাচরণ শিকাদারের 'ভদ্রার্জুন'। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে  হরচন্দ্র ঘোষ শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অফ ভেনিস অবলম্বনে রচনা করে 'ভানুমতী চিত্তবিলাস। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কালীপ্রসন্ন সিংহ রচনা করেন 'বাবু নাটক'।

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বরে 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকা থেকে জানা যায়, যে  সাতু বাবুর বাড়িতে একটি নাট্যশালা ছিল।  ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এই নাট্যশালয় বাড়িতে অভিনীত হয়েছিল, নন্দকুমার রায় রচিত 'অভিজ্ঞান শকুন্তলা'। উল্লেখ্য, ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট (ভাদ্র ১২৬২ বঙ্গাব্দ) মাসে এই নাটকটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে, নূতনবাজারে রামজয় বসাকের বাড়িতে 'কুলিন কুলসর্ব্বস্ব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকটি সেকালে বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর 'মহাশ্বেতা' নাটক অভিনীত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মণিমোহন সরকার এই নাটকটি  রচনা করেছিলেন বাণভট্ট প্রণীত 'কাদম্বরী' গ্রন্থ অবলম্বনে। এই নাটকে নারী চরিত্রগুলো অভিনয় করেছিলেন অভিনেতারা।

সাতউবাবুর বাড়ির এই নাট্যশালা-কেন্দ্রিক নাট্যচর্চার মাঝে আত্মপ্রকাশ করেছিল ' বিদ্যোৎসাহিনী নাট্যশালাযশালা'। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই নাট্যশালা তৈরি হয় এবং এর দ্বারদ্ঘাটন হয় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই এপ্রিল। এই দিনই অভিনীত হয় ভট্টনারায়ণের রচিত 'বেণীসংহার'-এর বাংলা নাট্যরূপ। এই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। এই নাটকে কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেও অভিনয় করেছিলেন। এই অভিনয়ে তিনি বিপুলভাবে প্রশংসিত হন। এর ফলে নাটকের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ জন্মে। এই সূত্রে তিনি কালিদাসের 'বিক্রমোর্ব্বশী'র বাংলা নাট্যরূপ দেন। 'বিদ্যোৎসাহিনী নাট্যমঞ্চে এই নাটকটি অভিনীত হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে নভেম্বর।

পাইকপাড়ার রাজারা তাঁদের কলকাতার বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানের নামানুসারে এই নাট্যশালাটি ' বেলগাছিয়া নাট্যশালা' নামে পরিচিতি লাভ করে। এই নাট্যশালাটি স্থাপিত হয়েছিল পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ। আর এই নাট্যশালা নির্মাণে অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। এই নাট্যশালায় অভিনীত নাটকের সাথে প্রথম যুক্ত করা হয়েছিল দেশীয় ঐকবাদন। সেকালের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী এবং যদুনাথ পাল এই ঐকবাদন পরিচালনা করতেন।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জুলাই, শনিবার এই নাট্যশালায় প্রথম অভিনীত হয় 'রত্নাবলী'। শ্রীহর্ষের রত্নাবলী অবলম্বনে এই নাটকটি রচনা করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। এই নাটকটি বেলাগাছিয়া নাট্যশালায় প্রায় ছয়-সাত বার অভিনীত হয়েছিল। ইংরেজদের জন্য এই নাটকের একটি অনুবাদ তৈরি করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই অনুবাদ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই নাট্যশালার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, মধুসূদন লেখেন 'শর্মিষ্ঠা' নাটক। এই নাটকটি এই নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর। এর ষষ্ঠ এবং শেষ অভিনয় হয়েছিল এই বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর। শর্মিষ্ঠার পরে এই নাট্যশালায় আর কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয় নি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের অকাল মৃত্যুর পর, এই নাট্যশালা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর কলকাতার উৎসাহী কিছু যুবক 'বিধবাদ্বাহ' এবং 'প্রবোধচন্দ্রোদয়' মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেয় অস্থায়ী মঞ্চে। শেষ পর্যন্ত দুটির কোনোটই মঞ্চস্থ হয় নি। তবে বিধবা বিবাহের বিষয় ধরে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে এপ্রিল। এই নাটকটির উদ্যোক্তা ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন ও তার সঙ্গীরা। নাটকটির জন্য মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল চিৎপুরের সিঁদুরিয়া পট্টির রামগোপাল মল্লিকের বাড়িতে। এই মঞ্চের নাম দেওয়া হয়েছিল 'মেট্রোপলিটান থিয়েটার'। এছাড়া অন্যান্য যে নাট্যমঞ্চ সে সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো হলো-
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা, প্যারীমোহন বাবু (১৮৫৪)
শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি (১৮৬৪-১৮৬৭)
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা, ঠাকুরবাড়ি (১৮৬৫-১৮৬৭)
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয় (১৮৬৮-৭৫)
হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৩
ওরিয়েন্টাল থিয়েটার ১৮৭৩
বেঙ্গল থিয়েটার ১৮৭৩-১৮৯০
দি নিউ এরিয়ান থিয়েটার ১৮৭৩-১৮৭৭)
রয়্যাল বেঙ্গল থিয়েটার ১৮৯০-১৯০১
গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৮৩, ১৮৭৭, ১৮৮৬
ন্যাশনাল থিয়েটার ১৮৭৭-‌১৮৮৫

 

রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের অঙ্গ হিসেবে রচিত, পরম ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানের সাধারণ নাম ব্রহ্মসঙ্গীত। এই সঙ্গীতের আদিপুরুষও ছিলেন তিনি। সম্ভবত তিনি যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে বর্ণিত 'ব্রহ্মগীতি' বা 'ব্রহ্মগীতিকা' নামক একপ্রকার সাধনসঙ্গীত থেকে এই নাম গ্রহণ করেছিলেন।
        [সহায়ক পাঠ: ব্রহ্মসঙ্গীত ]
 


সূত্র :