রাজা ও অরূপরতন
নাটক
অধরা অরূপকে রূপের ভিতর দিয়ে ধরার
আকাঙ্ক্ষার সূত্রে ১৩১৫ বঙ্গাব্দে (১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথ রচনা
করেছিলেন 'শারদোৎসব'। বোলপুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রদের দিয়ে মঞ্চস্থ করার জন্য
তিনি রচনা করেছিলেন এই নাটকটি। কিন্তু এই নাটকটি রচনা করে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাঁর এই অতৃপ্ত মনকে উসকে
দিয়েছিল বিশ্বভারতীর অধ্যাপকবৃন্দ। এরই মধ্যে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৭ বঙ্গাব্দ) অসুস্থ হয়ে
রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন শিলাইদহে কাটান। এই অবসরে তিনি রাজা
নাটকটি রচনায় হাত দেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ নভেম্বর একটি চিঠিতে এই নাটকটি
সম্পর্কে তাঁর মনোভাব অজিতকুমার চক্রবর্তীকে জানান এই ভাবে-
রীতিমত নাটক যাকে বলে তা নয়, শারদোৎসব জাতের জিনিসটা। গল্পের সূত্রটি সূক্ষ্ম। তারি দ্বারা কতকগুলো গান বাঁধা।
রাজা নাটকের আখ্যান-উৎস
রবীন্দ্রনাথ ১৩১৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৪৯ বৎসর বয়সে 'রাজা' নাটক শেষ করেন। এই নাটকের কাহিনি তিনি গ্রহণ করেছিলেন ড রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদিত 'The Sanskrit Buddhist Literature Of Nepal' নামক গ্রন্থের 'Kusa Jataka' গল্প অবলম্বনে। এই গল্পটির বিস্তৃত পাঠ রয়েছে এই গ্রন্থের ১৪২-১৪৫ পৃষ্ঠায়। গল্পটি শুরু হয়েছে বারানসির রাজা সুবন্ধু'র ইক্ষাকু নামক পুত্রের জন্মরহস্য দিয়ে। উল্লেখ্য অলৌকিক ভাবে তার শয্যাকক্ষের ইক্ষুতে পরিণত হয়েছিল এবং সেই ইক্ষু থেকে ইক্ষাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সুবন্ধুর মৃত্যুর পর রাজা হন ইক্ষাকু। বহু রাণী থাকা সত্বেও ইক্ষাকু কোনো পুত্র সন্তান লাভ করতে পারেন নি। তাই পুত্র সন্তানের আশায় তিনি জ্ঞানী ব্যাক্তিদের পরামর্শ নেন। জ্ঞানী ব্যাক্তিদের কথা মতে- এক পক্ষকালের ভিতরে তিনবার রাণীদের রাজপ্রাসাদের বাইরে এসে সাধারণ মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেন। অলিন্দা নামক প্রধান মহিষী ছাড়া সকল মহিষী এই সুযোগ নিয়ে প্রাসাদের বাইরে যান। এই সময় ইক্ষাকুর ঊর্ধ্বতন তেত্রিশতম পূর্বপুরুষ স্বর্গে ইন্দ্রত্ব লাভ করে স্বর্গের অধিপতি হিসেবে ছিলেন। তিনি ইক্ষাকুর এই লজ্জাজনক বিধিতে ব্যথিত হয়ে, ব্রাহ্মণের বেশে রাজার কাছে অলিন্দাকে প্রার্থনা করেন। রাজা প্রার্থনা মঞ্জুর করলে, ব্রাহ্মণ অলিন্দাকে নিয়ে প্রাসাদ থেকে দূরে অবস্থিত একটি ভাঙা বাড়িতে নিয়ে আসেন। অলিন্দা ব্রাহ্মণের পা ধুয়ে দেন এবং সম্পূর্ণ নগ্না হয়ে তাঁর সামনে দাড়িয়ে থাকেন। কিন্তু অলিন্দা কিছুতই তাঁর দেহ ভোগের সুযোগ দিলেন না। পরদিন ভোরে ব্রাহ্মণ তাঁর ছদ্মবেশ ত্যাগ করে নিজ মূর্তি ধারণ করেন। অলিন্দার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে, ব্রাহ্মণ একটি ঔষধ দিলেন এবং বললেন যে এই ঔষধ জলে মিশিয়ে খেলে তার বন্ধ্যাত্ব দূর করবে। তিনি আরও জানালেন যে, এই ঔষধ খেলে অলিন্দা পুত্র সন্তান লাভ করবে, কিন্তু তাঁর সন্তুষ্ট না করার জন্য পুত্র কদাকার হবে। অলিন্দা প্রাসাদে এসে রাজাকে সব খুলে বলেন। রাজা এই ঔষধ সকল রাণীদের মধ্যে ভাগ করে দেন। এই ঔষধ খেয়ে ৫০০ জন রাণী পুত্র সন্তান প্রসব করেন। এর ভিতরে অলিন্দার পুত্র হন কদাকার। রাজা এই কদাকার সন্তানের নাম রাখেন কুশ বা শুদ্ধকুশ। কদাকার হওয়ার কারণে রাজা কুশকে পছ্ন্দ করতেন না। কিন্তু কুশ তাঁর বুদ্ধি দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। এবং শৈষ পর্যন্ত তিনি রাজ্য লাভ করেন।
রাজ্যাভিষেকের পর ইক্ষাকু কান্যকুব্জের রাজকন্যা সুদর্শনার সাথে কুশের বিবাহের প্রস্তাব দেন। যথাসময়ে কুশের অনুপস্থিতিতেই তাঁকে পাত্র বিবেচনা কান্যকুব্জে সুদর্শনার বিবাহ হয়। রাণী অলিন্দা জানতেন যে, কুশের কদাকার রূপ দেখে, সুদর্শনা আত্মহত্যা করবে। তাই কুলপ্রথার কথা বলে, মাটির নিচে অন্ধকার ঘরে বাসরঘরের ব্যবস্থা করেন। সুদর্শনা স্বামীকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। এই সময় অলিন্দা তাঁর এক সতীনপুত্রকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে কুশকে রাজছত্রধারী হিসেবে রাখেন। সুদর্শনা ছদ্মরাজাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং রাজছত্রধারী কুশকে ঘৃণা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে একদিন রাজোদ্যানে কুশকে দেখতে পেয়ে দানব ভেবে পালিয়ে যান।
এর কিছুদিন পর নগরীতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে, কুশের চেষ্টায় নগর রক্ষা পায়। এক সময় সুদর্শনা জানতে পারেন যে, ওই দানবই তাঁর স্বামী। এরপর তিনি অলিন্দার অনুমতি নিয়ে কান্যকুব্জে ফিরে যান। আর রাজা তাঁর এক সৎভাইকে রাজপ্রতিনিধি করে একটি বীণা হতে উত্তর দিকে যাত্রা করেন। তিনি কান্যকুব্জে পৌঁছে রন্ধনকার্যে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়ে রাজার পাকশালায় স্থান করে নেন। সেখানে তিনি স্ত্রীকে বশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
এই সময় সুদর্শনা স্বামীগৃহ ত্যাগ করেছেন, এই কথা ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে বিবাহ করার জন্য সাতজন সামন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাজা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে, সামন্তরা রাজধানী দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এরপর রাজা সুদর্শনাকে তিরস্কার করেন এবং বলেন যে, যুদ্ধ পরাজিত হলে, তিনি তাঁকে সাত টুকরো করে, সাত সামন্তের হাতে তুলে দেবেন। উপায়ন্তর না দেখে সুদর্শনা তাঁর স্বামীর কাছে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করেন। রাজা এই সুদর্শনার পিতার পক্ষে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেন। সুদর্শনার পিতা জামাতার পরিচয় পেয়ে তাঁকে সমাদর করেন। এরপর রাজা সামন্তদের প্রতিরোধ করার জন্য রওনা দেন। হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তাঁর দানবীয় চেহারা নিয়ে হাজির হন এবং বিকট স্বরে চিৎকার করেন। সামন্তরা তাঁর চেহারা এবং হুঙ্কার শুনে ভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বশীভূতা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নিজ রাজ্যের দিকে অগ্রসর হন। পথে একটি নদীতে রাজা তাঁর কুৎসিত রূপের জন্য আত্মহত্যার উদ্যোগ নিলে, ইন্দ্র তাঁর জ্যোতিরস নামক দুর্লভ রত্নহার উপহার দিয়ে বলেন যে- এই মালা পরলে, তিনি সুদর্শন পুরুষে পরিণত হবেন এবং মালাকে কাপড়ে ঢেকে দিলে আবার কুৎসিত হয়ে যাবেন। এরপর রত্নহার পরিহিত অবস্থায় সুদর্শনার সামনে উপস্থিত হলে, তাঁর রূপ দেখে মুগ্ধ হন।'
কুশ-জাতকের এই গল্প অবলম্বনে রবীন্দ্র রাজা নাটক লেখা শুরু করেছিলেন- ১৩১৭ বঙ্গাব্দের কর্তিক মাসে। এই নাটকটির দুটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। পাণ্ডুলিপি দুটি হলো- Ms 143 ও Ms. 148 । পাণ্ডুলিপি দুটি বর্তমানে রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।
Ms 143:
এটি রাজা নাটকের প্রথম পাণ্ডুলিপি।
এই নাটকটি ফুলস্কেপ মাপের সাদা কাগজে লেখা
হয়েছিল। পৃষ্ঠাগুলো লম্বাভাবে দুই ভাগে ভাগ করে বাম দিকে লেখা হয়েছিল। কিছু কিছু
পাতার ডান দিকে সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয়েছিল কিছু লেখা।
Ms 148:
এটি
রাজা নাটকের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি। রবীন্দ্রনাথ এই পাণ্ডুলিপিতে দৃশ্য ও গানের
পরিবর্তন করেছিলেন।
উভয় পাণ্ডুলিপিকে পরিমার্জিত করে এই নাটকটির নতুন যে রূপ দেন, তা ১৩১৭ বঙ্গাব্দের
পৌষ মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। [প্রথম সংস্করণ]
গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান পাব্লিশিং হাউস থেকে। এই নাটকের দৃশ্য
পরিকল্পনায় ব্যবহার করা হয়েছ অঙ্কবাচক চিহ্ন। এই সংস্করণে মোট ২২টি গান ব্যবহৃত
হয়েছিল। নিচে দৃশ্যানুসারে গানের তালিকা তুলে ধরা হলো-
১ [গান সংখ্যা ৫]
১. আজি দখিন-দুয়ার খোলা [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
২. যেখানে রূপের প্রভা [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা] [তথ্য]
৩.আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ][তথ্য]
৪. আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে [বাউলের গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ][তথ্য]
৫. তোরা যে যা বলিস ভাই [পাগলের] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ][তথ্য]
২. [গান সংখ্যা ৩]১. খোলো খোলো দ্বার [সুরঙ্গমার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
প্রথম পাণ্ডুলিপিতে গানটি প্রথম দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।
২. এ যে মোর আবরণ [সুরঙ্গমার] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
৩. কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে [সুরঙ্গমার গান] [নমুনা] [তথ্য]
৩. [গান সংখ্যা ৪]
১. আজি কমলমুকুলদল খুলিল [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা] [তথ্য]
২. মোদের কিছু নাই রে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
৩. মম চিত্তে নিতি নৃত্যে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
৪. বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
৪. [গান সংখ্যা ১]
১. বিরহ মধুর হল আজি [সুদর্শনার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
৫. [গান সংখ্যা ৪]
১. যা ছিল কালো-ধলো [বাউলের গান] [নমুনা] [তথ্য]
২. আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা [ঠাকুরদাদার গান] [তথ্য] [নমুনা]
৩. আমার ঘুর লেগেছে— তাধিন্ তাধিন্ [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা][তথ্য]
৪. পুষ্প ফুটে কোন্ কুঞ্জবনে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা] [তথ্য]
৬. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
৭. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
৮. [গান সংখ্যা ২]
১. আমারে তুমি কিসের ছলে পাঠাবে দূরে [সুরঙ্গমার গান] [নমুনা] [তথ্য]
২. আমি তোমার প্রেমে হব [সুরঙ্গমার গান] [নমুনা][তথ্য]
৯. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১০. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১১. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১২. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১৩. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১৪. [গান সংখ্যা ১]
১. এ অন্ধকার ডুবাও [সুদর্শনার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ][তথ্য]
১৫. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১৬. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১৭. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
১৮. [গান সংখ্যা ১]
১. আমার সকল নিয়ে বসে [ঠাকুরদাদার গান] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ] [তথ্য]
১৯. [গান সংখ্যা ১]
১. ভোর হল বিভাবরী, পথ হল অবসান [সুরঙ্গমা] [তথ্য][নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ]
২০. [এই দৃশ্যে কোনো গান ব্যবহৃত হয় নি]
তথ্যসূত্র:
The Sanskrit Buddhist Literature Of Nepal/Rajendralala Mitra. LL.D.C.I.E/The Asiatice Society Of Bengal, 57, Park Street. 1882.
রাজা। প্রথম সংস্করণ [ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, পৌষ ১৩১৭ বঙ্গাব্দ।
রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি