খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে পারশ্য থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল আর্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী। ভারতে নবাগত আর্যদের দ্বারা পত্তন ঘটেছিল- ভারতীয় আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠী। এদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সঙ্গীত। এই সঙ্গীতকে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে ভারতীয়-আর্য সঙ্গীত।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে
৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে
ভারতীয়-আর্য সঙ্গীতের আদি রূপ গড়ে উঠছিল। এই সময়ের ভিতরে
বিকশিত ধর্মসঙ্গীতকে সাধারণভাবে বলা হয় বৈদিক গান। এসকল গানের সংকলনই হলো সামবেদ।
আর এই সংকলনের গানগুলোই হলো
সাম গান।
লৌকিক গান, লোক গান এবং সামগানের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের আদিরূপ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎপত্তিতে বিশেষ অবদান ছিল গান্ধর্বদের। এদের
দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল গ্রাম, মূর্চ্ছনা, জাতিরাগ, গ্রামরাগ, ধ্রুবাগান, প্রবন্ধগান।
৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আদি রাগসমূহের উৎপত্তি ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারতীয় উল্লেখিত মতাদর্শ বঙ্গদেশের সনাতন
ধর্মাবলম্বীদের উপর অল্পবিস্তর প্রভাব ফেললেও বাংলা গানে তার প্রভাব ততটা পড়ে নি।
এই সময়ে বাংলাসঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- প্রবলতর হয়ে দেখা দিয়েছিল বৈষ্ণবধর্ম
এবং বৈষ্ণবসঙ্গীত। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পরে বঙ্গদেশে মুসলমান সুফি সাধকদের
সংস্পর্শে আসে বাউলরা। এই সব সুফিবাদীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে
সুফিবাদ বাংলার বাউলদের প্রভাবিত করেছিল।
ভক্তিমার্গের ভজন রচনায় প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন মীরা
(১৪৯৮-১৫৪৮)। উত্তরভারতের রাজস্থান ও গুজরাটে মীরার ভজন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভক্তিসঙ্গীতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন সুরদাস। এই নামে কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পীর নাম পাওয়া
যায়। দিল্লী এলাকার সুরদাস (১৪৭৮-? খ্রিষ্টাব্দ) বৈষ্ণবপন্থী বৈরাগী। এই সময় এই
অঞ্চলে ধ্রুপদধর্মী বিষ্ণুপদ নামক গানের প্রচলন ছিল। সুরদাস এর বাইরে লৌকিক সুরে
প্রায় দুই হাজার ধর্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। অপর সুরদাস (১৫৩০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ)
ছিলেন কাশীবাসী। তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের ভক্ত। তিনি বহু বৈষ্ণবসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ভারতীয় সনাতন সঙ্গীতের শ্রেণিকরণ
এসকল গানের বিষয়াঙ্গ হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল ধর্মসঙ্গীত। আদি বৈদিক তথা
সাম গানের
পাশাপাশি বিকশিত পৌরাণিক যুগের গান। এসকল গানে বৈদিক দেবদেবীর পাশাপাশি স্থান
পেয়েছিল পৌরাণিক গান।
গৌতম বুদ্ধের
(জন্ম: ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ,
মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ধর্মীয় দর্শনের উপর
ভিত্তি করে গড়ে উঠা ধর্মীয় মতবাদ, সনাতন ধর্মেকে ভিন্নতর দর্শনের সন্ধান দিয়েছিল।
সেই সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের ভাবগত বিষয়ের নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছিল।
বুদ্ধের
মৃত্যর পর, তাঁর পূর্বজন্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত গ্রন্থ জাতক লিখিত হয়েছিল
আনুমানিক ৩৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। প্রায় ৫০০টি জাতকের মধ্যে ১৫টি জাতকে গান
সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতকগুলো হলো- নৃত্য, ভেরীবাদক, বিশ্বম্ভর, কুশ,
অসদৃশ্য, সর্বদ্রষ্ট, গুপ্তিল, ভদ্রঘট, বীণাস্থূণা, চুল্লু-প্রলোভন, ক্ষান্তিবাদি,
কাকবতী, শঙ্খ, মৎস, বিদুরপণ্ডিত।
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দীর ভিতরে আদি
পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল। এই সময় শাক্তধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল। শাক্তধর্মের
বিকাশের সূত্রে পৌরাণিক কথকতা রচিত হলেও শাক্তসঙ্গীত হয়তো ততটা বিকশিত হয় নি। কিন্তু
খ্রিষ্টীয় ৭ম থেকে ১১শ শতাব্দীর ভিতরে বৌদ্ধ মহাযান বিকাশের মধ্যেই মগধাঞ্চলে
শাক্তধর্ম প্রবল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এরই ভিতরে বৌদ্ধ সহজযানের
প্রভাবে রচিত হয়েছিল আদি চর্যাগীতি। ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বঙ্গদেশে
বৌদ্ধসঙ্গীতের
বিকাশ ঘটেছিল 'চর্যাগীতি'র
মাধ্যমে। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষার
বৌদ্ধসঙ্গীতের
রচিত হয়েছিল অনিবদ্ধ
প্রবন্ধগান
হিসেবে 'চর্যাগীতি'।
চর্যাগীতির পরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে একটি বড় ধরনে ধাক্কা লাগে ইখতিয়ার
উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি বাংলা-অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকের এই
বখতিয়ার খিলজির গৌড় দখলের পর, শুরু হয় বাংলার আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই
অস্থিরতা ছিল অনুমানিক ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা
গানের কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। নমুনা না পাওয়ার সূত্রে এই সময়কে
বাংলা গানের
অন্ধকারযুগ বলা হলেও, এই সময়ে বাংলার লোকসমাজে গানের চর্চা একেবারই ছিল না, এ
কথা মানা যায় না। তবে নমুনাবিহীন লোকসঙ্গীত সম্পর্কে এ বিষয়ে অনুমান করা যায় না।
রাজা-রাজায় যুদ্ধে নাগরিক গান ক্ষতগ্রস্থ হয়েছিল এ কথা মানতেই হয়।
১২০৪ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ভারতের দাক্ষিণ্যত্যে অদ্বৈতবাদী মতবাদ,
দ্বৈতদ্বৈত বৈষ্ণবতত্ত্ব, দ্বৈত বেদান্ত ইত্যদি মতবাদের সৃষ্টি হয়। যার
ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল বাংলা ধর্মসঙ্গীতে। এই মৌলিক মতবাদগুলোর প্রবক্তারা ছিলেন।
বাংলা ভাষা-সঙ্গীতের এই অন্ধকারযুগের
শুরুতেই
লক্ষণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) রাজসভাকবি
জয়দেব-এর
রচিত হয়েছিল সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দ। অন্ধকার যুগের
পরবর্তী সময়ে কবি জয়দেবের রচিত এই কাব্যগ্রন্থ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্য ও
সঙ্গীতকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিল। বিশেষ করে
বিদ্যাপতির পদাবলী এবং বড়ুচণ্ডীদাসের
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাধ্যমে বাংলার বৈষ্ণবসঙ্গীত আদিপর্ব শুরু হয়েছিল। এই সূত্রে
নাগরিক গান হিসেবে
কীর্তনের
বিকাশ শুরু হয়েছিল।
সহজিয়া বৌদ্ধ মতাদর্শ এবং শৈব তান্ত্রিক ভাবনা সংমিশ্রণে আদি
বাউল ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে।
গোড়ার দিকে এই ধর্মে ছিল পরমাত্মা ও জীবাত্মার বিশ্বাস। ধ্যানের ভিতর দিয়ে
পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ার যোগাচারের সাথে যুক্ত হয়েছিল বামাচারী সাধনা।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে নবতর ধর্মদর্শন এবং সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল কবীর (১৩৯৮-১৫১৮) ভক্তি
আন্দোলনের সূত্রে। ইসলামী সুফি দর্শনের সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা ও গান মুখে মুখে ছড়িয়ে
পড়েছিল। বিশেষ করে- তাঁর গান উত্তর ভারতের কাশী, দিল্লী, পাঞ্জাব, রাজাস্থান,
গুজরাট, বিহার, বাংলা হয়ে উড়িষ্যা অবধি ছড়িয়ে পড়ে। কবীরের ধর্মদর্শন বিশেষভাবে
প্রভাবিত করেছিল শিখ ধর্মের প্রবর্তক
গুরুনানককে
(১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) । গুরুনানকের ধর্ম প্রচারণায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল গান।
এই ধর্মাদর্শে রচিত গানগুলোকে সাধারণভাবে
শিখসঙ্গীত
বলা হয়। শিখসঙ্গীতের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নানদেবের রচিত গান।
এই ধারায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তন
করেছিলেন
শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ -১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর প্রবর্তিত
নামকীর্তন, বৈষ্ণবসমাজে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া এই সময়ে
পদাবলীকীর্তনই ধীরে ধীরে লীলাকীর্তনে রূপলাভ করেছিলে। তবে নরোত্তম দাস ঠাকুর (আনুমানিক ১৪৬৬-১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দ) খেতুরীতে আশ্রমের
মহোৎসবে পরিবেশিত লীলাকীর্তন উৎকৃষ্ট মানে পৌঁছেছিল। পরবর্তীকালে তাঁর রচিত পদকীর্তন
অনুসারে কীর্তন-ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ধারাগুলো
হলো- গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী, ঝাড়খণ্ডী এবং ঢপ্। নরোত্তম দাসের
আদি ধারাটি ‘গড়ানহাটি’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।
একেশ্বরবাদী ভাবধারায় বৈষ্ণব সঙ্গীতের নতুন দর্শন দিয়েছিলেন আসামের শঙ্করদেব
(১৪৮৯-১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর ধর্মদর্শনে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের দাসত্বভাবই প্রাধান্য
পেয়েছে। তিনি নাম-ঘর স্থাপন করে তাতে নামকীর্তন বিধির প্রচলন করেছিলেন। ভাগবত
অবলম্বনে তিনি বরগীত (নামঘোষা) রচনা করেছিলেন। তাঁর অনুসরণে মাধবদেব (১৪৯০
খ্রিষ্টাব্দ-?) প্রায় হাজার খানেক বরগীতি রচনা করেছিলেন।
বাংলা কীর্তনের ধারায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন- রায় রামানন্দ, স্বরূপ দামোদর, নরহরি
সরকার, অদ্বৈতাচার্য, রামানন্দ বসু, মুকুন্দ দত্ত, গোবিন্দঘোষ প্রমুখ।
তুলসী দাস (১৫২৩-১৬২৩) মূলত ছিলেন রামভক্ত। সেই অর্থে তাঁর গানও বৈষ্ণবধর্মী। তাঁর
রচিত দোহাবলী ও গীতাবলী বিশেষ উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আহমেদাবাদ,
জৌনপুর অঞ্চলের ভক্তিবাদী গানের রচয়িতা দাদু (১৫৪৪-১৬০৩) ছিলেন দোহাবলীর রচয়িতা।
তিনি বঙ্গদেশ ভ্রমণের সময় বাউল-সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রীতি গড়ে উঠেছিল।
মধ্যযুগীয় ধর্মসঙ্গীতের
কীর্তনের
ধারার পাশাপাশি মঙ্গলকাব্য যে ধারাটি বিকশিত হয়েছিল, তার ভিতরে রাধা-কৃষ্ণের বাইরে
শিব, দুর্গা, মনসা প্রভৃতি দেবদেবীর মহিমা রচিত হয়েছিল। মূলত মঙ্গলকাব্যের সূত্রেই
বাংলা গানে
শাক্ত সঙ্গীতের শুরু হয়েছিল। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে
রামপ্রসাদ সেন
(১৭২০-১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
শাক্তসঙ্গীতের
নবতর
ধারার শুভ সূচনা
করেন।
রামপ্রসাদ সেন
ছিলেন মূলত কালীসাধক। তিনি অধিকাংশ সময় কালী সাধনায় মগ্ন থাকতেন। কালীকে তিনি
যেভাবে উপলব্ধি করেছেন, তারই প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে।
দৈবশক্তির কাছে নিজেকে সেবক রূপে নিবেদিত করার প্রথাগত ভক্তিবাদের সনাতন রীতিকে
ভেঙে দিয়ে, দেবী মাতৃরূপ কখনো কন্যারূপে উপস্থাপন করেছেন। তাই
তাঁর শাক্তসঙ্গীতে
ফুটে উঠেছে
মাতা-সন্তানের গভীর
ভালোবাসা। নদিয়ার মহারাজ
কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে
তাঁকে সভাকবির মর্যাদা দেন।
খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাউলতত্ত্বের একটি নবতর বিশেষ ধারার উদ্ভব হয় আউল
চাঁদ ফকিরের মাধ্যমে। তাঁর এই পথ বর্তমানে
কর্তাভজা
নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মের উপনিষদ ভিত্তিক জ্ঞানের আলোকে
রাজা
রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩
খ্রিষ্টাব্দের)
প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী
ব্রাহ্মধর্ম-দর্শন প্রচার করেন। তিনি এই ধর্মের
প্রচার প্রসারে জন্য রচনা করেছিলেন
ব্রহ্মসঙ্গীত। ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী অনেকে ব্রহ্মসঙ্গীত
রচনা করেছিলেন।