জীবন
life
সমার্থক শব্দাবলি : প্রাণ।
জীবজগতের ভিত্তি হলো প্রাণ বা জীবন। মূলত জীব হলো ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতের এমন একটি সত্তা, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চেষ্টা করে এবং নিজের অনুরূপ সত্তাকে সৃষ্টি করতে পারে। আর জীব যে ক্ষমতার দ্বারা তার অস্তিত্বকে রক্ষা করে প্রকৃতিতে জীবন্ত দশায় হিসেবে টিকে থাকে তাকেই প্রাণ বা জীবন বলা হয়। জীব দেহগতভাবে নিজে ত্রিমাত্রিক জগতের সত্তা হলেও প্রাণ বিমূর্ত। জীবের দৈহিক কার্যক্রমের সম্মিলিত একটি শক্তি হিসাবে প্রাণের প্রকাশ পায়। যখন জীব এই ক্ষমতা হারায়, তখন তাকে প্রাণ বা প্রাণশক্তি হারায় বলে বিবেচনা করা হয়। প্রাণশক্তি হারানো সত্তাকে মৃত বলা হয়।
দর্শন বা ধর্মের বিচারে প্রাণকে একটি
অতীন্দ্রিয় শক্তি বিচার করা হয়। ধর্মে প্রাণকে পরমসত্ত্বা (আল্লাহ, সদাপ্রভু,
ব্রহ্ম অর্থে) দ্বারা প্রদেয় একটি শক্তি হিসাবে হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ধর্মে
বলা হয়, এই শক্তি যখন দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তখন তা পরমসত্তার কাছে নীত হয় এবং
জীবের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু জীববিজ্ঞানে প্রাণকে একটি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু
মৃত্যু হলে জীবের প্রাণশক্তি জীবদেহকে ত্যাগ করে কোথায় যায়, তা বিচার করে না।
জীব তার জীবদ্দশায় প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রকৃতির নানারকম প্রতিকূল অবস্থার
সাথে সংগ্রাম করে। এর ফলে জীব তার দৈহিক শক্তি হারাতে থাকে এবং দেহাংশের কিছু ক্ষতি
হয়। এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জীব তার শরীরের উপযোগী কিছু পদার্থ তার
শরীরের ভিতর গ্রহণ করে থাকে। এই সকল পদার্থকে জীবের জন্য খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা
হয়। আবার জীবন ধারণের জন্য জীব এমন কিছু পদার্থকে শরীরের ভিতর টেনে নেয়, যা তার
জৈবিক কার্যকলাপে বা জীবের দেহ গঠনে সাহায্য করে বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কোনো
দেহাংশের উপাদান হিসাবে কাজ করে না। যেমন- বাতাসের অক্সিজেন।
জীব অনুরূপ কোন জীব থেকে জন্মলাভ করে। এই জন্মলাভের পর প্রতিটি জীব পূর্ণাঙ্গতা লাভের জন্য কিছু সময় নেয়। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তারা পূর্ণ জীবে পরিণত হয়। এই বৃদ্ধি ঘটে তার দেহের বাইরে এবং ভিতরে। জীবদেহের ভিতরের অংশের বৃদ্ধি ঘটার মধ্যে তার দেহ সম্পূর্ণরূপে দেহকার্যের উপযোগী হয়ে উঠে। দেহের বাইরের আবরণেও এর প্রভাব পড়ে। দেহের ভিতরের অংশ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রভাব পড়ে দেহের সার্বিক আকারের উপর। একে সাধারণত দেহগত আকার বৃদ্ধি বলা হয়। এক্ষেত্রে জীবদেহ কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা নির্ভর করে, তার দেহস্থ জিন-সঙ্কেত-এর উপর।
সকল জীবের প্রাণশক্তি আছে, কিন্তু দেহগত
বৈশিষ্ট্যার সকল ধরনের প্রাণের কার্যক্রম একই রকমভাবে সকল জীবে প্রকাশ পায় না।
জীবের দেহগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে জীবন নানা ধরনের হয়।
জীবনের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তন
৪০০ কোটি
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর আদি সমুদ্রের জলে নানা ধরনের দ্রবাদি মিশে গিয়ে
একধরনের জটিল দ্রবণ তৈরি করেছিল। এই সময় অতি
অতি-বেগুনি রশ্মি, পৃথিবীর বাইরে থেকে আসা নানা ধরনের মহাজাগিতক
রশ্মি, পার্থিব মেঘে থেকে সৃষ্ট মহাবজ্রপাত এবং তৎকালীন
সমুদ্রজলের চাপ ও তাপের প্রভাবে সাগরজলের
রাসায়নিক উপকরণগুলোতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু সকল রাসায়নিক পদার্থই
জীবজগতের আদি উপকরণ ছিল না। জীবদেহগঠনে যে সকল অণু তৈরি হয়েছিল, তাদেরকে বলা হয়
জৈবঅণুজীবের
(biomolecule)।
হেডিন কালের শেষভাগে পৃথিবীর আদিম মহাসমুদ্রে এসে যে সকল যৌগিক বা যৌগমূলক পদার্থের
সৃষ্টি হয়েছিল, তার সবগুলো জীবজগতের আদি উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
প্রকৃতপক্ষে সে সময়ে জীবদেহগঠনের সহায়ক যে সকল অণু তৈরি হয়েছিল, তাদেরকে বলা হয়
জৈব-অণু (biomolecule)।
সাধারণভাবে দেখা যায় এ সকল
জৈব-অণুতে
২৫টিরও বেশি মৌলিক পদার্থ থাকে। তবে এর ভিতরে ছয়টি মৌলিক পদার্থকে জৈবঅণুর সাধারণ
উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা। এ সকল মৌলিক পদার্থের ইংরেজি বানানের আদ্যাক্ষর নিয়ে যে
শব্দসংক্ষেপ করা হয়েছে- তা হলো CHNOPS (carbon,
hydrogen, nitrogen, oxygen, phosphorus, and sulfur)।
জৈবঅণুর সবচেয়ে সরল
জৈবযৌগ
তৈরি হয়
হাইড্রোজেন ও
কার্বন
দিয়ে। জৈবযৌগের প্রাথমিক সদস্য হলো
মিথেন। চার
হাত বিশিষ্ট
কার্বন, যখন এক হাত বিশিষ্ট
হাইড্রোজেনের সাথে মিলিত হয়, তখন একটি মিথেনের জন্য চারটি হাইড্রোজেনের প্রয়োজন
হয়। এই কারণে, মিথেনের রাসায়নিক প্রতীক হয়
(CH4)।
কার্বনের
সাথে
হাইড্রোজেনের বন্ধুত্ব হতে পারে নানা ধরনের এবং বন্ধুত্বের প্রকৃতি অনুসারে
এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও হয় নানা ধরনের। সাধারণভাবে হাইড্রোজেন ও কার্বনের
বন্ধুত্বের দ্বারা সৃষ্ট অণুগুলিকে
হাইড্রোকার্বন বলা হয়। আবার কোনো
হাইড্রোকার্বনের সাথে যখন অন্য কোনো মৌলিক পদার্থ যুক্ত হয়, তখন নবাগত এই
অতিথির সূত্রে নতুন অণু তৈরি হয়। এক্ষেত্রেও অতিথির প্রকৃতি অনুসারে
হাইড্রোকার্বনগুলো নতুন শ্রেণিগত রূপ পায়।
আদিম মহাসমুদ্রের জলের অনুকুল পরিবেশে এই
জৈব-অণুগুলোর
ভিতরে অন্য পদার্থের সাথে আসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল নানা ভাবে। ফলে তৈরি হয়েছিল নানা
ধরনের যৌগিক পদার্থ। এর ভিতরে কিছু অণু তৈরি হয়েছিল কার্বন ভিত্তিক। কার্বনের সাথে
বিশেষ কিছু অন্য পদার্থের মিলনে তৈরি হয়েছিল, নানা ধরনের জৈব
কার্যকরীমূলক। এর ফলে
জৈব-অণুগুলো নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। জৈব-অণুর ক্ষেত্রে মোট ছয়টি
কার্যকরীমূলক বিশেষভাবে
চিহ্নিত করা হয়েছে।
অক্সিজেন,
নাইট্রোজেন,
ফসফরাস এবং
সালফাইটের সাথে কার্বনের বন্ধন সৃষ্টির বিবেচনায় একে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই
ভাগগুলো হলো-
অক্সিজেন ও কার্বন বন্ধন: এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকের ভিত্তি হলো অক্সিজেন ও কার্বনের বন্ধন। কার্বনের সাথে অক্সিজেনের বন্ধন তিনভাবে সংঘটিত হয়েছিল। এ সকল কার্যকরীমূলককে এদের প্রকৃতি অনুসারে তিনভাগে ভাগ করা হয়।
১.কার্বোনিল (Carbonyl): এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক এককভাবে অক্সিজেনের সাথে মিলিত হয়। এক্ষেত্রে অক্সিজেন দুটি বাহু কারবনের দুটি বাহুকে অধিকার। রসায়নবিজ্ঞানে এর প্রতীক ব্যবহার করা হয় C=O।
২. হাইড্রোক্সিল (Hydroxyl): এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকে অক্সিজেনের সাথে থাকে হাইড্রোজেন। মূলত একটি অক্সিজেন ও একটি হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে −OH মূলক সৃষ্টি করে। এই মূলকই কার্বনের সাথে মিলিত হয়ে জৈবযৌগের সৃষ্টি করে।
৩. কার্বোক্সিল (Carboxyl): এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকে থাকে কার্বন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন। এতে একই কার্বনের সাথে কার্বনিল ও হাইড্রোক্সিল যুক্ত হয়। এর সাধারণ সংকেত HO−C=O। সাধারণভাবে এই সংকেত প্রকাশ করা হয় (-COOH) হিসেবে।
নাইট্রোজেন ও কার্বন বন্ধন: এই শ্রেণির কার্যকরীমূলকে থাকে কার্বন ও নাইট্রোজেনের সাথে মিলিত হয়। এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক নানা ধরনের হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে -NH2 মূলকটি α কার্বনের সাথে যুক্ত হওয়ার সূত্রে যে জৈবঅণু সৃষ্টি করে, কার্যকরী মূলকের বিচারে তাকে বলা হয় এ্যামিনো (Amino)।
সালফার ও কার্বন বন্ধন: এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক তৈরি হয় সালফার বা গন্ধকের সাথে কার্বনের বন্ধনে। গন্ধকের যোজ্যতা ২ বা ৬। এই মূলকের সাধারণ সংকেত -SH। এর সালফার কার্বনের সাথে যুক্ত হয়ে জৈবঅণু তৈরি করে। জৈবঅণুর বিচারে এই কার্যকরীমূলকের সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয় সালফ্হাইড্রিল (Sulfhydryl) নামে।
ফসফরাস ও কার্বন বন্ধন: এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক তৈরি হয় কার্বনের সাথে ফসফরাসের বন্ধনে। ফসফেটের যোজ্যতা ৫। অক্সিজেনের সাথে ফসফরাসের বন্ধনে তৈরি হয় ফসফেট (PO43−)। এই ফসফেটের ফসফরাসের সাথে কার্বনের সংযোগ ঘটে।
হাইড্রোজেনের সাথে ফসফেটের সম্মিলনে সৃষ্টি হয় ফসফরিক এ্যাসিড (H3PO4 )। এই এ্যাসিড থেকে একটি হাইড্রোজেনের বিচ্যুতি ঘটলে তা (H2PO4− ) আয়োনিত অবস্থায় পৌঁছায়। এই অবস্থায় পুনরায় আয়োনিত হলে, এর অবস্থা হয়- (HPO42− )। পর্যাক্রমিক ধারায় এই যৌগটি থেকে ফসফেট (PO43−) তৈরি হয়েছে। এই শ্রেণির কার্যকরীমূলক দেখা যায় ডিএনএ, আরএনএ এবং কিছু লিপিড-এ।জৈবঅণুর আদি উপাদান হলো এ্যামিনো এ্যাসিড।
৪১০-৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আদি মহাসাগের জলে দ্রবীভূত মৌলিক পদার্থের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের জৈবযৌগ। শুরুর দিকে এদের ভিতরে এ সকল জৈবযৌগের ভিতরে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। কিন্তু এদেরই দ্বারা সৃষ্ট কার্যকরীমূলকগুলো নানা যৌগের সাথে মিলিত হয়েছিল পর্যায়ক্রমে। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল জীবজগতের আদিম উপাদান এ্যামিনো এ্যাসিড।
হেডিন কালের শেষের দিকে এই জাতীয় সরল এ্যামিনো এ্যাসিড তৈরি হয়েছিল প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু এই এ্যাসিডগুলো দীর্ঘ দিন স্বাধীনভাবে থাকতে পারলো না। তৎকালীন সমুদ্রজলের তাপ, অতি-বেগুনি রশ্মি ছাড়াও নানা ধরনের মহাজাগতিক রশ্মি ইত্যাদি মিলে এ্যাসিডগুলোর ভিতরে নতুন রাসায়নিক আসক্তির জন্ম দিয়েছিল। এর ফলে এ্যামিনো এ্যাসিডগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হওয়া শুরু করেছিল। প্রাথমিকভাবে দুটি এ্যামিনো এ্যাসিডের মিলনে তৈরি হয়েছিল যে দীর্ঘ অণু, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ডিপেপটাইড। এই জাতীয় এ্যামিনো এ্যাসিডের উদাহরণ হিসেবে গ্লাইসিলগ্লাসিন (Glycylglycine) -এর উল্লেখ করা যেতে পারে। মূলত দুটি গ্লাইসিন নামক এমিনো এ্যাসিড মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছিল গ্লাইসিলগ্লাসিন (Glycylglycine)। উল্লেখ্য যে বন্ধনের দ্বারা দুটি এ্যামিনো এ্যাসিড যুক্ত থাকে, তাকে বলা হয় পেপটাইড বন্ধন।
এক সময় মনে করা হতো যে, এ্যামিনো এ্যাসিডের মতো জটিল অণু রসায়নাগারে তৈরি করা অসম্ভব। কিন্তু ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছাত্র স্ট্যানলি মিলার এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। আদি সমুদ্রে নানা ধরনের এ্যামিনো এ্যাসিড তৈরি হয়েছিল প্রাকৃতিক নিয়মে। স্ট্যানলি মাত্র এক ধরনের এ্যামিনো এ্যাসিড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আদি সাগরজলে কত ধরনের এ্যামনো এ্যাসিড তৈরি হয়েছিল, তা জানা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় ৫০০ ধরনের এ্যামিনো এ্যাসিডকে তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
এ্যামিনো এ্যাসিড থেকে প্রোটিন
ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই এ্যামিনো এ্যাসিড থেকে তৈরি হলো প্রোটিন নামক জীবজগতের অপর একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ক্রমিক পেপটাইড বন্ধনের দ্বারা দীর্ঘ এ্যামিনো এ্যাসিড সৃষ্টি হলে- রসায়নবিদ্যায় তাকে পলিপেপটাইড নামে অভিহিত করা হয়। প্রকৃত পক্ষে এই নামটি প্রোটিনেরই নামান্তর। সাধারণত ৫০টিরও বেশি এ্যামিনো এ্যাসিড আব্দ্ধ হয়ে যে পলিপেপটাইড অণু তৈরি হয়, তাকে জৈব রসায়নে প্রোটিন নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত এ্যামিনো এ্যাসিড সরল শৃঙ্খল হিসেবে বিরাজ করে। কিন্তু প্রোটিনে একাধিক পলি-এ্যামিনো এ্যাসিড শিকল একটি বিশেষবন্ধনের দ্বারা সমান্তরালভাবে বিরাজ করে। ফলে শৃঙ্খলাবদ্ধ এ্যামিনো এ্যাসিডগুলো কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী হয়ে যায়। এই কারণে প্রোটিনের ধর্ম এ্যামিনো এ্যাসিডের সাধারণ ধর্মকে অতিক্রম করে। এই কারণে প্রোটিনকে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আদি সাগরজলে একদিকে যখন এ্যামিনো এ্যাসিডের পলিমারের দ্বারা তৈরি হচ্ছিল প্রোটিন, সেই সময় হাইড্রোকার্বেনর অন্য একটি ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল নিউক্লেইক এ্যাসিড। আর এই দুটি জৈব-অণুর সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নিউক্লিয়োপ্রোটিন (Nucleoprotein)। মূলত এই নিউক্লিয়োপ্রোটিন গঠনের মধ্য দিয়ে জীবজগত সৃষ্টির নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। বিশেষ করে নিউক্লিয়োপ্রোটিনের অন্যতম অংশ নিউক্লিক এ্যাসিড বংশগতির ধারকের ভূমিকা গ্রহণ করলে- জৈব-অণু হয়ে উঠলো জীবের আদি সদস্য। গাঠনিক বিন্যাসের বিচারে এই জৈব-অণুকে দুটি ধারায় ভাগ করা হয়। এর একটি হলো আরএনএ, অপরটি ডিএনএ।
হেডিনকালের এই জড়জগতের এই দশা থেকে কিভাবে জীবজগতের সৃষ্টি হলো- এ নিয়ে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে জীবজগতের নানা ধরনের নমুনা বিশ্লেষণের সূত্রে আরএন-কে জীবনের সূচনা পর্ব বলা হয়। পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক আদি পর্বকে যেমন বলা হয় হেডেন কাল। তেমনি জীবজগতের আদি পর্বকে বলা হয়- আরএনএ জগৎ।
নাইট্রোজেন ভিত্তিক নিউক্লেইক এ্যাসিড
আদি সাগরজলে একদিকে যখন এ্যামিনো এ্যাসিডের পলিমারের দ্বারা তৈরি হচ্ছিল প্রোটিন,
সেই সময়
ফসফরিক এ্যাসিড, নানা ধরনের চিনি, নাইট্রোজেন ঘটিত ক্ষারক (পিউরিন ও পিরামিডিন)
তৈরি হয়েছিল। আদি সমূদ্রের উপযুক্ত পরিবেশে ফসফরিক
এ্যাসিড, চিনি এবং পিউরিন ও পিরিমিডিন ক্ষারকের পুনঃআবর্তন দ্বারা গঠিত বিশাল
আকারের শিকলাবদ্ধ জৈব অণু বিশেষ। এই বিশেষ ধরনের অণুই হলো-
নিউক্লেইক এ্যাসিড।
নিউক্লিয়োপ্রোটিনের উদ্ভব
বিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্ট
প্রোটিন
আর
এই সময় বৃষ্টিপাত হয়েছিল দীর্ঘসময় ধরে। ভূভগের উপর পানির চাপসহ প্রবল স্রোতের
কারণে মহা-মহাদেশটির বিভাজনকে সহজ করে দিয়েছিল। বৃষ্টিপাতের ফলে বাতাসের
নিউক্লেইক এ্যাসিড উৎপন্ন হয়েছিল সাগর জলে। জলপ্রবাহের সূত্রে এরা পরস্পরের
সংস্পর্শে এলে- উভয়ের রাসায়নিক আসক্তির সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল নিউক্লিয়োপ্রোটিন (Nucleoprotein)।
মূলত এই নিউক্লিয়োপ্রোটিন গঠনের মধ্য দিয়ে জীবজগত সৃষ্টির নবদিগন্ত উন্মোচিত
হয়েছিল। বিশেষ করে নিউক্লিয়োপ্রোটিনের অন্যতম অংশ নিউক্লিক এ্যাসিড বংশগতির ধারকের
ভূমিকা গ্রহণ করলে- জৈব-অণু হয়ে উঠলো জীবের আদি সদস্য।
এই জটিল অণুগুলোর ভিতর ছিল
এই এ্যাসিডে
বংশগত তথ্য সংরক্ষণ করা ও সুনির্দিষ্ট প্রোটিন অণু তৈরি করার ক্ষমতার সূত্রে এক
ধরনের আক্ষেপ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসায়নিক আসক্তির সূত্রে এই এ্যাসিডগুলো গড়ে তুলেছিল
আরএনএ
[ribonucleic acid (RNA)]
।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন
আরএনএ জগতের সূচনার ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিল জীবজগতের প্রকৃত যাত্রাপথ। এই ধারণা
অবলম্বন করে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন জীববিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার রিখ
(Alexander Rich (November 15, 1924 – April 27,
2015) প্রথম একটি কল্প-প্রস্তাবনা
উপস্থাপন করেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অপর মার্কিন জীববিজ্ঞানী ওয়াল্টার গিলবার্ট
(Walter
Gilbert) এই
ধারণার সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত করেন। যদিও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে,
আরএনএ-ভিত্তিক জীব সৃষ্টির আগেও অন্য ধরনের জীব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত
প্রমাণ ও ব্যাখ্যার সূত্রে 'আরএনএ জগৎ' ধারণা অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত।
আরএনএ মূলত
জীবের বংশগতি নির্ধারক জটিল অনুর দ্বারা গঠিত
দীর্ঘ পলিমার বিশেষ। এর মূল উপাদান
নিউক্লেইক এ্যাসিড ।
Phoebus Levene নামক একজন রাশিয়ান বায়োকেমিষ্ট ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি ইস্ট
থেকে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট একটি শর্করা অনু নিষ্কাষণ করেন এবং এর নাম দেন রাইবোজ
(Ribose)।
সেখান থেকে এই নিউক্লিক এসিডের নামকরণ করা হয়েছে। এই
এ্যাসিড একটি দীর্ঘ পলিমার দ্বার গঠিত হয়। এর ভিত্তি নাইট্রোজেন ভিত্তিক অণু, আর এর
কাঠামো তৈরি হয়েছিল চিনি-ফসফেট ঘটিত অণুর সমন্বয়ে।
জীবের বংশগতি নির্ধারক আরও একটি উপকরণ সৃষ্টি হয়েছিল এই সময়। একে বলা হয় ডিএনএ[deoxyribonucleic acid (DNA)]
ডিএনএ-কে
সাধারণভাবে বলা যায়-
জীবের বংশগতি নির্ধারক জটিল অনুর দ্বারা গঠিত
দীর্ঘ পলিমার বিশেষ।
সু-প্রাণকেন্দ্রিক
কোষ (Eukaryotic
cell)-এর
নিউক্লিয়াসে ডিএনএ থাকে। পক্ষান্তরে
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ (
Prokaryotes)
ডিএনএ কোষে সাইটোপ্লাজমে থাকে।
যেমন ব্যাকটেরিয়া। উৎসেচকের (enzyme)
মত ডিএনএ অধিকাংশ জৈবরসায়ন বিক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেয় না। মূলত, বিভিন্ন উৎসেচক
ডিএন-তে কার্যকরী ভূমিকা রেখে তথ্য নকল করে এবং আরো বহু ডিএনএ তৈরি করে।
প্রাথমিক বিশ্লেষণ ডিএনএ-কে দুটি প্রধান উপাদান
হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই উপাদান দুটি হলো−
ডিএনএ
মেরুদণ্ড:
এই অংশটি ডিএনএর দুটি প্রান্তে সুতার মতো থাকে। এর মূল উপাদান হলো চিনি এবং
ফসফেট ভিত্তিক দীর্ঘ অণু। একে অনেক সময় ডিএনএ সূত্র বলা হয়। এর মূল উপাদান হলো
চিনি
ডিঅক্সিরাইবোজ (C5H10O4)।
ভিত্তি: দুটি ক্ষারের সমন্বয়ে গঠিত দীর্ঘাকার অণু ডিএন-এর ভিত্তি। এই কারণে একে বলা হয় জোড়া ভিত্তি (Base pairs)। মূলত চারটি ক্ষার পর্যায়ক্রমে জোড়া বেঁধে বেঁধে থাকে। এই চারটি ক্ষার হলো−
A= adenine (এডেনিন, C5H5N5)
G =guanine (গুয়ানিন C5H5N5O)
C=cytosine (সাইটোসিন
T=thymine (থাইমিন
একটি শিকলের ভিত্তি বা
(Base)- এর নির্দিষ্ট অবস্থানের হাইড্রোজেন পরমাণুটি পজিটিভ চার্জ ধারণ করে। আবার অন্য শিকলের নির্দিষ্ট অবস্থানের অক্সিজেন অথবা নাইট্রোজেন পরমাণুটি নিগেটিভ চার্জ ধারণ করে থাকে। তখন এই দুই বিপরীত মুখী চার্জের মধ্যে আকর্ষণের ফলে উভয় শিকল বাধা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে দুর্বল হাইড্রোজেন-বন্ধন কাজ করে। এই কারণে কোষ বিভাজনের সময় সহজেই দুটি শিকল পৃথক হতে পারে।নিউক্লিওসাইড: কোনো ক্ষার যখন চিনির ডিএনএ সূত্রের চিনির অণুর সাথে যুক্ত থাকে, তখন তাকে বলা হয় নিউক্লিওসাইড।
নিউক্লিওটাইড : কোনো ক্ষার যখন ডিএনএ সূত্রের একটি চিনি ও এক বা একাধিক ফসফেট অণুর সাথে যুক্ত থাকে তাকে বলে নিউক্লিওটাইড।
ডিঅক্সিরাইবোজ ফসফেট গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে পাশাপাশি ডিঅক্সিরাইবোজ -এর মধ্যে তৃতীয় ও পঞ্চম কার্বন পরমাণুর স্থানে ফসফোডিয়েসটার বন্ধন গঠন করে। এই অপ্রতিসম বন্ধন বোঝায় যে ডিএনএ অণুর মেরু বা দিক আছে। দ্বৈত হেলিক্সে এক সূত্রের নিউক্লিওটাইডের দিক অন্য সূত্রের ঠিক বিপরীত দিকে থাকে। ডিএনএ সূত্রের এই ধরনের বিন্যাসকে প্রতিসমান্তরাল বলে। ডিএনএর অপ্রতিসম প্রান্তকে বলে ৫’ (ফাইভ প্রাইম) এবং ৩’ (থ্রি প্রাইম) প্রান্ত। ডিএনএ ও আরএনএর মধ্যকার একটি প্রধান পার্থক্য হলো চিনিতে, যেখানে ডিএনএতে ২-ডিঅক্সিরাইবোজ ব্যবহৃত হয় সেখানে আরএনএতে আরেকটি পেন্টোজ চিনি রাইবোজ ব্যবহৃত হয়।
ডিএনএ শিকলের যে অংশটি বংশগতির সংকেত বহন করে সেই অংস কে বলে জিন (GENE)। এর বাকি অংশ বংশগতির সংকেতকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন প্রজাতির বংশগতির সংকেত একটি সুদৃঢ় প্যাকেটের মতো থাকে। একে জীববিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ক্রোমোজোম (Chromosome)। এই প্যাকেট সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে হিস্টোন (Histone) নামক এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন। প্রতিটি প্রজাতির ক্রোমোজোম নির্দিষ্ট সংখ্যায় থাকে। যেমন হোমো স্যাপিয়েন্স তথা মানুষের ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া। মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি কোষের প্রাণকেন্দ্রের ভিতর প্রায় ৩০০ কোটি বেজ পেয়ারযুক্ত ডিএনএ কুণ্ডলিত আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ মিটার।
ডিএন-এর মধ্যে রক্ষিত বংশগতির সঙ্কেত অনুসারে প্রতিটি প্রজাতি প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে টিকে থাকার পথ খুঁজে পায়। এক্ষেত্রে এই সঙ্কেত যথাসম্ভব পরিবেশ উপযোগী শারীরীক পরিবর্তন ঘটায়। দীর্ঘদিন ধরে এই শারীরীক পরিবর্তন যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে প্রজাতির ডিএন-এর ভিতর তা লিখিত হয়ে যায়। প্রজাতির এই সূক্ষ্ম শারীরীক পরিবর্তনের সূত্রে আরও কিছু পরিবর্তন ঘটে। বিষয়টি বংশ পরম্পরায় চলতে চলতে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। প্রথমদিকের প্রজন্মের সাথে আদি প্রজন্মের এই পার্থক্য ধরা পড়ে না। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দুটি পৃথক প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কোনো প্রজাতি যদি এই বংশগতির সংকেত বংশধরদের পাঠাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নবজাতক মৃত্যুবরণ করে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, এক সময় পুরো প্রজাতিটিই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জীবের ক্রমবিকাশ ও শ্রেণিকরণ
৪০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সাগরজলে
এ্যামিনো এ্যাসিড সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জীব সৃষ্টির সূত্রপাত হয়েছিল। ক্রমবিবর্তনের
ধারায় ৪০০-৩৯০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আরএনএ ভিত্তিক জীবকণিকার বিকাশ ঘটেছিল এই সময়ের
ভিতরে।
এই জীবকণিকা থেকেই
উদ্ভব হয়েছিল প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ
এবং এই জাতীয় কোষ ভিত্তিক জীব।
এই কোষে সুসংগঠিত ডিএনএ, মাইটোকণ্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, লাইসোজোম, গলজি বস্তু ছিল না। সেকালের এই কোষের আকার এক থেকে দশ মাইক্রোমিটার (µm) এর মধ্যে ছিল।
৩৯০-৩৬০
কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
ভিতরে
প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-ভিত্তিক
আদি জীবকণিকা থেকে ব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমানে ব্যাক্টেরিয়াকে
জীবস্বক্ষেত্র
(Domain)
হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই সময়ের ভিতরে জীবকোষেরই একটি প্রজাতি
থেকে
আর্কেব্যাক্টেরিয়া উদ্ভব ঘটেছিল।
প্রায় ৩০০
কোটি খ্রিষ্টপূ্বাব্দের পুরানো জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে, এই ব্যাক্টেরিয়ার
পূর্বপুরুষদের অস্তিত্বের কথা জানা গেছে।
এদের দেহে শক্তি উৎপন্ন হতো গ্লাওকোলাইসিস
(Glycolysis)
প্রক্রিয়া। এই
প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শক্তি জীবকণিকাগুলোর ভিতরে সঞ্চালিত হতো।
আদি পৃথিবীর কর্দমাক্ত
পরিবেশে এরা সবুজ এবং
লোহিতনীল
বর্ণের গন্ধক অঞ্চলে বসবাস করতো এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া হাইড্রোজেন
সালফাইড ব্যবহার করতো। ফলে অক্সিজেনের পরিবর্তে এরা বাতাসে গন্ধক পরিত্যাগ
করতো। এই কারণে এদের শরীরের চিনি তৈরি হতো না।
ফলে অক্সিজেনের পরিবর্তে এরা বাতাসে গন্ধক পরিত্যাগ
করতো। এই কারণে এদের শরীরের চিনি তৈরি হতো না।
৩৬০-৩৫০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে প্রাক্-প্রাণকেন্দ্রিক কোষ-ভিত্তিক আদি জীবকণিকা থেকে উদ্ভব হয়েছিল আর্কিয়া জীবস্বক্ষেত্রের প্রজাতিসমূহ। এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে দুটি আদি স্বক্ষেত্র পৃথক হয়ে গিয়েছিল। এই বিচারে জীবের শ্রেণিকরণের রূপটি দাঁড়ায়-