হিন্দুকুশ
মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা।

এটি হিমালয় পর্বতমালার একটি উপ-পর্বতমালা। একে পামির পর্বতমালা এবং কারাকোরাম পর্বতমালার একটি অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে এর বেশিরভাগ অংশ আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের অন্তর্গত। 

নামকরণ: ফার্সি ভাষায় কুশ শব্দটির অর্থ 'হত্যা করা'। একসময় প্রাচীনকালে ভারতের হিন্দু ক্রীতদাসদেরকে এই পর্বতমালার মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। এই পথের রুক্ষ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বেশিরভাগ ক্রীতদাসের মৃত্যু হতো। এই কারণে এই পার্বত্য পথকে হিন্দুকুশ বলা হতো। পরবর্তী সময় এই পার্বত্য অঞ্চলটি হিন্দুকুশ নামে পরিচিতি লাভ করে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, হিন্দুকুশ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন মধ্যযুগীয় পরিব্রাজক ইবন বতুতা।

ভূতাত্ত্বিক ক্রমবিবর্তন: প্রায় ৫৭ কোটি পূর্বাব্দের দিকে কিছু ক্ষুদ্র মহাদেশ যুক্ত হয়ে গোণ্ড্‌ওয়ানা মহা-মহাদেশটির তৈরি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে এই মহাদেশ দুটি বড় খণ্ডে পরিণত হয়। এই ভাগ দুটিকে চিহ্নিত করা হয় পূর্ব গোণ্ড্‌ওয়ানা এবং পশ্চিম গোণ্ড্‌ওয়ানা নামে। ৫১-৫০ কোটি পূর্বাব্দে এই দুই অংশ একত্রিত হয়ে তৈরি হয় বিশাল গোণ্ড্‌ওয়ানা মহা-মহাদেশ। ওর্ডোভিসিয়ান অধিযুগের ৪৫ কোটি ৮০ লক্ষ বৎসরের দিকে এই মহাদেশের ভিতরে ছিল- চীনের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ, এ্যান্টার্ক্টিকা, ভারতবর্ষ, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা

১৮ কোটি ৪০ লক্ষ পূর্বাব্দে,  গোণ্ড্‌ওয়ানার মধ্যাঞ্চলের আফ্রিকা অংশ থেকে এ্যান্টার্ক্টিকা, মাদাগাস্কার, ভারতবর্ষ এবং  অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পৃথক হয়ে গিয়েছিল। মেসোজোয়িক যুগ-এর অন্তর্গত ট্রায়াসিক অধিযুগের শুরুতে (২৫ কোটি বৎসর আগে) এই বৃহৎ মহা-মহাদেশটি অখণ্ড ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল। মূলত ২০ কোটি বৎসর আগে উভয় মহা-মহাদেশটি স্পষ্টভাবে পৃথক ভূখণ্ড হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মেসোজোয়িক যুগ-এর অন্তর্গত জুরাসিক অধিযুগে (২০ কোটি বৎসর আগে) গোণ্ড্‌ওয়ানার উত্তর আফ্রিকা অংশের সাথে যুক্ত ছিল এ্যান্টাক্টিকা। পাত সঞ্চালন মতে, ভারতীয় পাতটি এই সময় আদি গোণ্ড্‌ওয়ানা মহাদেশের সাথে যুক্ত ছিল।

প্রায় ১৪ কোটি বৎসর আগে ভারতীয় পাত যুক্ত হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া, এ্যান্টার্ক্টিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা। সাথে। ৯ কোটি বৎসর আগে আবার ভারত উপমহাদেশ গোণ্ডোয়ানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় এই পাতের সাথে মাদাগাস্কার যুক্ত ছিল। পরে মাদাগাস্কার থেকে ভারতীয় পাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় ৭ কোটি বৎসর আগে ক্রেটাসিয়াস অধিযুগে  ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেট প্রতি বৎসর ১৫ সেন্টিমিটার বেগে ইউরেশীয় প্লেটের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতীয় পাত বাৎসরিক ২০ সেন্টিমিটার গতিতে উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং সেনোজোয়িক যুগে ইউরেশিয়ার পাতের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় চলে আসে। সেনোজোয়িক যুগের নিওজেন অন্তঃযুগের শুরুর দিকে, ২ কোটি ৩০ লক্ষ ৩০ হাজার বৎসর আগে উভয় পাতের প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং দ্রুত হিমালয় পর্বতমালার উত্থান ঘটতে থাকে। নেপাল ও তিব্বতের পার্বত্য উপত্যাকা, মায়ানমারের আরাকান উচ্চভূমি, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপূঞ্জ এবং বঙ্গোপসাগরের আদিরূপ তৈরি হয়ে যায়। এই সংঘর্ষের সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল পামির মালভূমি, কারকোরাম পরবতমালা এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা।

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক: ৩৬°১৪'৪৫" উত্তর ৭১°৫০'৩৮" পূর্ব।
ভৌগোলিক অবস্থান: আফগানিস্তানের সীমান্তের পামির পর্বতমালা থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং তাজিকিস্তান পর্যন্ত প্রায় ১০০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। তবে পর্বতমালাটির বেশির ভাগ উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে অবস্থিত। পামির উপত্যাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এই পর্বতমালা শুরু হয়ে কাবুলের পশ্চিমে কোহ-ই বাবা পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। এই অঞ্চলে হিন্দুকুশকে কাবুল উপত্যাকা এবং আমুদরিয়ার বিভাজক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দুকুশের ২৫০ কিলোমিটারকে আফগানিস্তানের সীমানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমুদরিয়ার উপনদী অব্-ই-পঞ্জা এর উৎসের কাছে হিন্দকুশের মধ্যবর্তী আফগানিস্তানের সীমান্তের দূরত্ব মাত্র দশ মাইল।

হিন্দুকুশের পর্বতসমূহ
এই পর্বতমালায় রয়েছে অসংখ্য পর্বত, ছোটো ছোটো পাহাড় ও টিলা। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তিরিচমির। এর উচ্চতা ৭,৩৯০ মিটার। এই শৃঙ্গটি পাকিস্তানের অন্তর্গত।

গিরিপথ: আমবদারয়া ও চিত্রলের অববাহিকার মধ্যে হিন্দুকুশের বেশকিছু গিরিপথ রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে এসকল গিরিপথ প্রাচীনকাল থেকে কাফিরিস্তান, বাদক্‌শান, কাবুল, তুর্কিস্তান, চীন ও ভারতবর্ষের মধ্যে যোগাযোগের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

নদী: হিন্দুকুশের শিখরে অবাস্থত তুযারাবৃত হ্রদ থেকে অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছে। এসকল ঝর্ণার মিলিত জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়েছে  চিত্রল ও হনুজা নদী।

ঐতিহাসিক পরিচিতি:
বৈদিক সাহিত্যে হিন্দকুশের নদী ও অধিবাসীদের উল্লেখ আছে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময় কাবুল উপত্যাকা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌর্য ও গুপ্ত শাসনামলে এই অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল। সম্রাট অশোক কণিষ্কের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটেলে, সাম্রাজ্য বিস্তারের সুবাদে হিন্দুকুশের দক্ষিণ ও পূর্বভাগের আফগানিস্তান মোগল শাসনের অধীনে ছিল। সে সময়ে হিন্দুকুশকে ভারতবর্ষরের প্রাকৃতিক সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক- ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত হিন্দুকুশের দ্বারা বিভক্ত হয়।

হিন্দুকুশ অঞ্চলের ভাষা: এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কোনও কোনও জনগোষ্ঠী ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের আর্যশাখার দারদীয় উপশাখার ভাষাতে কথা বলে। এর মধ্যে  পশ্‌তু বা পেখতুন' ভাষা। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাষাগুলো হল- কাফির (বশ্‌গলি), প্রেসুন, খোবার (চিত্রালী), সীনা, কোহিস্তানি ইত্যাদি। আর্মেনিয়া ও ইওরোপে কাথিত জপসিদের উপভাষা হিন্দুকুশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে।