|
প্রোবোস্সিডিয়া
বর্গের
এলিফ্যান্টিডি
গোত্রের প্রজাতিসমূহের সাধারণ নাম। মূলত
প্রোবোস্সিডিয়া
বর্গের হাতি বা হাতির মতো প্রাণিকুলের বেশিরভাগ
প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বর্তমানে লোক্সোডোন্টা এবং এলিফাস গোত্রের কিছু প্রজাতি এখনো আফ্রিকা ও
এশিয়ায় পাওয়া যায়। মূলত এই দুই গোত্রের প্রজাতিগুলোই হাতি নামে পরিচিত।
এরা স্তন্যপায়ী এবং উদ্ভিদভোজী। মুখের সম্মুখে ঝুলন্ত শুঁড় থেকে সহজেই অন্যান্য
প্রাণী থেকে এদেরকে পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়। এছাড়া এদের গজদন্ত, স্তম্ভাকার
পা এবং বিশালাকারের কানের জন্য অন্যান্য প্রাণিকুল থেকে সহজে পৃথক করা যায়।
শুঁড়: এদের উপরের ঠোঁট ও নাক যুক্ত হয়ে বিশালকার স্তম্ভের মতো মুখের সামনে
ঝুলে থাকে। এই শুঁড় দিয়ে এরা শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করে। এছাড়া শুঁড়কে এরা হাতের মতো
নানা কাজে ব্যবহার করে। বিশেষ করে গাছের ডালপালা আকর্ষণ করে বা ঘাস, লতাপাতা ইত্যদি
সংগ্রহ করে এবং খাদ্য মুখ প্রবেশের জন্য শুঁড় ব্যবহার করে। স্নানের সময় এরা শুঁড় দিয়ে পানি টেনে
শরীর ভিজায়। এশিয়ান হাতি শুঁড়ের ভিতর ৮.৫ লিটার পানি ধারণ করতে পারে। জলের উপর শুঁড়
তুলে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। আফ্রিকার হাতির শুঁড়ের অগ্রভাগে আঙুলের মতো তুটি বর্ধিত
শক্ত মাংশখণ্ড থাকে। এশিয়ান হাতির এরূপ অাঙুলের মতো একটি খণ্ড থাকে।
শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় শুঁড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া
পরস্পরে প্রতি অনুরাগ স্নেহ প্রকাশের ক্ষেত্রে শুঁড়ের দ্বারা স্পর্শ করে। ভারি ডালা
পালা সরানোর জন্য, গাছের ডালা ভাঙার জন্য শুঁড় ব্যবহার করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতি
প্রায় ৩৫০ কেজি ওজন উত্তোলন করতে পারে।
দাঁত: হাতির মুখের ভিতরে রয়েছে মোট ২৬টি দাঁত। এদের শাবকদের মুখে জন্মের সময়
দুধ দাঁত থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পথে এই দাঁত পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁত উঠে। হাতির
জীবদ্দশায় ছয় বার চর্বন দন্তের পরিবর্তন হয়। এর চর্বন দন্ত প্রথম পরিবর্তন হয় ২-৩ বৎসরের
ভিতরে। ৬ বছর পরে এই দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন চর্বন দন্ত গজায়। ৯-১৫ বৎসর বয়সে তৃতীয়বার
পরিবর্তন ঘটে। চতুর্থবার পরিবর্তন ঘটে ১৮-২৮ বৎসরের ভিতরে। ৪০ বৎসরের ভিতরে
পঞ্চমবার দাঁতের পরিবর্তন হয়। শেষ জীবনে নতুন দাঁত গজায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই দাঁত
থাকে।
কান: এদের কানের পাতা কুলার মতো বিশাল। হাতি কানের পাতা পাখার মতো সঞ্চালন করে
শরীর শীতল করার কাজে ব্যবহার করে। অল্প কম্পাঙ্গের ধ্বনি শ্রবণের জন্য এই প্রসারিত
কানের পাতা বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
গজদন্ত: হস্তি শাবকের ৬-১২ মাস বয়সের ভিতরে দুধের দাঁত পড়ে যাওয়ার পর নতুন
কর্তন দাঁত গজায়। এই সময় উপরের চোয়ালের দ্বিতীয় কর্তন দন্ত বাড়তে বাড়তে দীর্ঘ আকার
ধারণ করে, এই দন্তের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছরে এই দাঁত প্রায় ৭ ইঞ্চি (১৭ সেন্টিমিটার)
পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। নতুন গজানো গজদন্তের বাইরের এনামেল বেশ মশৃণ থাকে। এই দাঁতের
গোড়া চোয়ালের সকেটে দৃঢ়ভাবে আটকানো থাকে। এর বেশিরভাগ অংশ বাইরের দিকে বাঁকা হয়ে
শুঁড়ের দুই পাশ দিয়ে দৃশ্যমান হয়। আফ্রিকান হাতির গজদন্ত প্রায় ৩ মিটার পর্যন্ত হয়ে
থাকে। ওজন হয়ে থাকে ৪৫-৯০ কেজি। এশিয়ান হাতির গজদন্ত অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে থাকে।
হাতি গজদন্ত ব্যবহার করে গাছের গায়ে নিজেদের এলাকার সুনির্দিষ্টকরণে দাগ কাটে।
এছাড়া মাটি খুঁড়ে জল বা লবণ বের করার জন্য এই দাঁত ব্যবহার করে। জঙ্গলে চলার সময় এই
দাঁত ব্যবহার করে চলার পথ পরিষ্কার করে। যুদ্ধের সময় হাতি এই দাঁত অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করে।
ত্বক: হাতির ত্বক বেশ খসখসে। এর পশ্চাৎ ভাগ থেকে মাথা পর্যন্ত প্রায় ১ ইঞ্চি পুরু
ত্বক দিয়ে দেহ ঢাকা থাকে। তবে মুখ, পায়ু, কানের নিচের দিকে চামড়ার পুরুত্ব কম থাকে।
এদের ত্বকের রঙ ধূসর। আফ্রিকার ঝোপ হাতির গায়ের রঙ হাল্কা। তবে আফ্রিকার বুনো হাতির
গায়ের রঙ বেশ গাঢ় হয়। হস্তিশাবকদের দেহে হাল্কা বাদামী বা লালচে পশম থাকে। তবে
প্রাপ্তবয়স্ক হাতির মাথায় লোম দেখা যায় না। এদের
লেজের অগ্রভাগে চুল থাকে।
দেহাভ্যন্তরীণ অংশ: হাতির মস্তিষ্কের ওজন ৩.৫-৫.৫ কেজি। সমগ্র শরীরের তুলনায়
মস্তিষ্ক বেশ ছোট। হৃদপিণ্ডের ওজন ১২-২১ কেজি হয়ে থাকে। শান্তভাবে দাঁড়ানো অবস্থায়
এদের নাড়ির গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩০ বার। কিন্তু মাটিতে শয়ন করার সময় এই গতি দাঁড়ায়
প্রতি সেকেন্ডে ৮ থেকে ১০ বার।
আচরণ:
হাতি দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে। এক একটি দলে ১০-১৫টি হাতি থাকে। মূলত রক্তের সম্পর্কের
হাতিগুলো একটি দলে থাকে। এতে একই বংশের বিভিন্ন বয়সের সদস্য থাকে। প্রতিটি দলে একটি
দলনেতা থাকে। এই দলনেতা অভিজ্ঞতা, শক্তি ও সাহসের দ্বারা দলকে পরিচালিত করে।
খাদ্য: এরা উদ্ভিদভোজী। তৃণভূমিতে এরা ঘাস সুঁড় দিয়ে মুচড়িয়ে দল করে মুখে
তুলে নেয়। এছাড়া কলা জাতীয় নরম গাছ এরা সুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে মাটি থেকে উপড়িয়ে আহার
করে। অন্যান্য বৃক্ষের কচি ডাল-পাতা ভেঙে খায়। এদের খাদ্য তালিকায় ইক্ষু বা নলখাগড়া
জাতীয় উদ্ভিদ ও ফল আহার করতে দেখা যায়। এদের প্রতিদিন প্রায় ১৫০-১৬০ কেজি খাদ্য এবং
সেই সাথে ৪০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়।
প্রজনন
স্ত্রী
হাতি ১০-১২ বৎসরের ভিতরে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়ে উঠে এবং প্রায় ৫০ বৎসর পর্ন্ত
সন্তান জন্ম দিতে পারে। এদের গর্ভধারণ সময় ২২ মাস। প্রায় ৩-৬ বৎসর অন্তর এরা
গর্ভবতী হয় এবং সন্তান প্রসব করে থাকে। যৌন মিলনের ক্ষেত্রে পুরুষ হাতিরা
প্রতিপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
হাতির ব্যবহার: মানুষ বন্য হাতিকে পোষ মানিয়ে নানা গৃহপালিত প্রাচীন কাল
থেকে। এই সময় থেকে কাঠ জাতীয় ভারি মালমাল স্থানান্তর, উত্তোলনে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া
বিভিন্ন সার্কাস দলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাতিকে খেলা দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক সময় যুদ্ধে হাতি ব্যবহার করা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের
দিকে রচিত মহাভারতে কুরুক্ষেত্রে হস্তিবাহিনী ব্যবহারের বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ
থেকে জানা যায়- এক
অক্ষৌহিণী সেনাদলে ব্যবহৃত হতো
২১৮৭০টি হাতি।
[সূত্র :
অক্ষৌহিণী-পরিমাণ।
দ্বিতীয় অধ্যায়। আদিপর্ব। মহাভারত]
আফ্রিকান ঝোপ-হাতি |
আফ্রিকান বুনো হাতি |
ভারতীয় হাতি |
শ্রীলঙ্কার হাতি |
সুমাত্রার হাতি |
বোর্নিও হাতি |
উপগণ:
recki
এই গণের একটি উপগণ হলো
recki।
এই উপগণকে
Elephas recki
নামে চিহ্নিত করা হয়। এই
গণের হাতির সাথে এশিয়ার হাতির (Elephas
maximus) যথেষ্ঠ মিল পাওয়া যায়।
তবে আকারে ছিল বিশাল। বিজ্ঞানী M. Beden
পাঁচ ধরণের হাতিকে এই উপগণের প্রজাতি
হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো−
উল্লেখ্য এই প্রজাতির
সবগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
থাইল্যান্ডের শ্বেত হস্তী |
শ্বেত হস্তী
(white
elephant)
কোনো কোনো হাতি গায়ের রঙ সাদাটে
দেখায়। এদেরকে সাধারণভাবে বলা হয় শ্বেত হস্তী । গায়ের রঙ ছাড়া এদের অন্য কোনো
বৈশিষ্ট্য দ্বারা পৃথক প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। তাছাড়া এই হাতি খুব বেশি
দেখাও যায় না। এই বিশেষ গায়ের রঙের হাতি লাউস, কম্বোডিয়া, ভিয়েৎনাম, মিয়ানমার,
থাইল্যান্ড ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কদাচিৎ দেখা যায়। থাইল্যান্ডের রাজার কাছে
১১টি শ্বেত হস্তী রয়েছে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, এই হাতি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছ। পারশ্যের সাসানিয়ান রাজা
খসরুর সেনাবাহিনীতে শ্বেত হস্তী ছিল। আরব সেনাবাহিনীর আক্রমণে এই হাতি নিহত হয়েছিল।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়- দেবরাজ ইন্দ্রের ঐরাবত নামক হস্তীর গায়ের
রঙ ছিল সাদা।
সূত্র: