২৭ বৎসর অতিক্রান্ত বয়স
নজরুল ইসলামের ২৭ বৎসর অতিক্রান্ত বয়স শুরু হয়েছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (মঙ্গলবার ২৫ মে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে। শেষ হয়েছিল ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (শনিবার ২৩ মে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ)।


নজরুলের ২৭তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। বছরের শুরু থেকেই তিনি ব্যস্ত ছিলেন সংগঠন-ভিত্তি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে।

১৮-৩১ মে ১৯২৬ (১১ -১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের শেষ সপ্তাহ কৃষ্ণনগরে ছিলেন। তবে মে মাসের শেষ কয়েকদিনে তিনি তাঁর রচিত কোনো রচনার সন্ধান পাওয়া যায় নি। হেমন্তকুমার সরকারের সাথে ঘরোয়াভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, কোনো আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম ছিল না বলে, উভয়ই নিরুপদ্র সময় কাটিয়েছেন বলেই ধারণা করা যায়।

জুন ১৯২৬ (১৮ জ্যৈষ্ঠ-১৬ আষাঢ় ১৩৩৩)
এরপর রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রথম ঢাকা আসেন। সম্ভবত জুন মাসের ২৪ তারিখের (বৃহস্পতিবার, ১০ আষাঢ় ১৩৩৩) দিকে হেমন্তকুমার সরকারে সাথে ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও স্বরাজ দলের স্থানীয় নেতা ডাক্তার মোহিনীমোহন দাসের ঢাকা কোর্ট সংলগ্ন বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। এখানে তাঁর সাথে ঢাকার মুসলমান  সাহিত্যিকদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এঁরা ছিলেন আব্দুল কাদের, মোহাম্মদ কাসেম, আব্দুল মজিদ প্রমুখ।

২৭শে জুন (রবিবার ১৪ আষাঢ় ১৩৩৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাসে মুসলিম সাহিত্য-সমাজের চতুর্থ বর্ষের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে নজরুল দৃঢ়তার সাথে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য রক্ষার কথা বলেন এবং ''কাণ্ডারী হুঁশিয়ারী' 'ছাত্রদলের গান' এবং ' কৃষাণের গান' পরিবেশন করেন। এই সময় গণবাণীর সাথে নজরুলের সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল।

জুলাই ১৯২৬ (১৭ আষাঢ়-১৫ শ্রাবণ ১৩৩৩)
জুলাই মাসের ২ তারিখে নারায়ণ নজরুল ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এসেছিলেন। সেখানে তিনি সদ্য পরিচিত মোহাম্মদ কাশেমের আতিথ্য গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ কাশেমের সম্পাদনায় 'অভিযান; নামক একটি পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন চলছিল। নজরুল এই পত্রিকার জন্য 'অভিযান' নামক একটি কবিতা রচনা করেন। ২৫শে জুলাই নজরুল হেমন্তকুমার সরকারের সাথে চট্টগ্রাম যান। এঁরা দুই জনই চট্টগ্রামের ডাক-বাংলোতে উঠেছিলেন। চট্টগ্রামের পৌঁছার পর, সেখানকার বিশিষ্ট লেখকবৃন্দ, বুদ্ধিজীবীমহল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নজরুলকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। পরে হেমন্তকুমার সরকার চট্টগ্রাম থেকে একাই ফিরে আসেন। আর নজরুল হবীবুল্লাহ বাহারের নিমন্ত্রণে তাঁর তামাকুমণ্ডীর 'আজিজ-মঞ্জিলে' ওঠেন। সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে হবীবুল্লাহ বাহারের বোন শামসুন নাহারের সাথে। ক্রমে ক্রমে এই তিনজনের ভিতরে বিশেষ সখ্য গড়ে উঠে। এরই সূত্রে তিনি লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি প্রেমের কবিতা। এই কবিতাগুলো হলো- চট্টগ্রামে থাকাকালে নজরুল তাঁর  দ্বাদশ কাব্যগ্রন্থ 'সিন্ধু-হিন্দোল'-এর রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। চট্টগ্রামে সমুদ্র-দর্শনে অভিভূত কবি প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন সিন্ধু। তিন পর্বে রচিত এই কবিতাটি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গ পরিচিতি। আগষ্ট ১৯২৬ (১৬ শ্রাবণ-১৪ ভাদ্র ১৩৩৩)
এই মাসের শুরু থেকেই নজরুল চট্টগ্রামে কাটান।

১ আগষ্ট (রবিবার, ১৬ শ্রাবণ ১৩৩৩), হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সাথে নজরুল ফেনী যান। এঁদের সাথে ছিলেন কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষক ছিলেন। ফেনীর স্থানীয় নজরুল ভক্তরা সেখানকার ইসলামিয়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশে নজরুল ব্রিটিশ-বিরোধী এব দেশী ধনিক শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। এবং এই বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এরপর তিনি 'কারার ঐ লৌহ কপাট', ওঠ রে চাষী' 'দুর্গমগিরি কান্তার মরু' ইত্যাদি গান শোনান। এছাড়া 'বিদ্রোহী' কবিতার কিছু অংশ আবৃত্তি করে শোনান।

২ আগষ্ট (সোমবার, ১৭ শ্রাবণ ১৩৩৩) নজরুল চট্টগ্রামে রচনা করেন সিন্ধু, তৃতীয় তরঙ্গ কবিতা। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই নজরুল চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন। ১০ই আগষ্ট ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ (মঙ্গলবার, ২৫ শ্রাবণ ১৩৩৩) তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন।

১১ আগষ্ট ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ (বুধবার, ২৬ শ্রাবণ ১৩৩৩) সকাল বেলায় শামসুন নাহার মাহমুদ-কে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন।  [পত্র]

১২ আগষ্ট ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ (বৃহস্পতিবার, ২৭ শ্রাবণ ১৩৩৩) প্রকাশিত হয়েছিল গণবাণী নামক পত্রিকা। চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ দলের অন্যতম মুখপত্র সাপ্তাহিক 'আত্মশক্তি' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক গোপাললাল স্যান্যালকে একটি চিঠি লেখেন। এই লেখাটি উক্ত পত্রিকার '২০ আগষ্ট ১৯২৬' (শুক্রবার, ৩ ভাদ্র ১৩৩৩) সংখ্যায় 'পুস্তক-পরিচয়' বিভাগে তারানাথ রাস 'তারা-রা ছদ্মনামে বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপত্র 'গণবাণীর সমালোচনা করেন। তারই জবাবে নজরুল একটি পত্র রচনা করেছিলেন। পত্রটির সাথে তারিখে উল্লেখ ছিল ৮ ভাদ্র ১৩৩৩। অর্থৎ বুধবার, ২৫ আগষ্ট ১৯২৬।।
        [গোপাললাল সান্যাল-কে পত্র [পত্র]

২৫ আগষ্ট গণবাণী পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছিল মন্দির ও মসজিদ প্রবন্ধ। এই মাসে পূবে রচিত একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি হলো- এই মাসে কৃষ্ণনগরের নজরুলের একমাত্র আশ্রয়দাতা এবং অবলম্বন হেমন্তকুমার সরকার স্থায়ী বসবাসের জন্য কলকাতা চলে যান। এই সময় হেমন্ত দত্তগুপ্তের সহায়তায় নজরুল কৃষ্ণনগরের গোলাপপট্টির বাসা ছেড়ে চাঁদ সড়ক এলাকার 'গ্রস কটেজ'-এ চলে আসেন।

সেপ্টেম্বর ১৯২৬ (১৫ ভাদ্র-১৩ আশ্বিন ১৩৩৩)

ডা আবুল কাসেমের আমন্ত্রণে খুলনায় গিয়েছিলেন আগষ্ট মাসে।  সেখানকার দৌলতপুর কলেজে নজরুকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। নজরুল মাসে তিনি  সেখান থেকে তিনি খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, দৌলতপুর, বনগ্রাম প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে সেপ্টেম্বরের শুরুতে কলকাতা আসেন। এখানে তিনি ৩৭ হ্যারিসন রোডস্থ  গণবাণী  পত্রিকা অফিসে উঠেন। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে তিনি বিরজাসুন্দরীর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি হলো-

৯ সেপ্টেম্বর তারিখে (শনিবার, ২২ ভাদ্র ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগরে আসেন। কৃষ্ণনগরের বাড়িতে তিনি পৌঁছেছিলেন অতি-প্রত্যুষে। বাড়িতে পৌঁছে তিনি জানলেন, তাঁর বাড়িতে পৌঁছার কিছুক্ষণ আগে ভোর ৬টায় তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদের (বুলবুল) জন্ম হয়েছে।  বুলবুলের জন্মের সংবাদ তিনি একই দিনে মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, ব্রজবিহারী বর্মণ ও মুরলীধর বসুকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন।

সকল চিঠিতেই নজরুল ভুল তারিখ অর্থাৎ '৯-১০-২৬'  লিখেছিলেন।
  • ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ। ব্রজবিহারী বর্মণ-কে [পত্র]
  • ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ। মুরলীধর বসু-কে [পত্র]
    এই চিঠিতে কবিতাটির ও স্বরলিপিটার প্রুফ পাঠিয়ো, যদি সম্ভব হয়!...' উল্লেখ আছে। নজরুল রচনাবলী (নজরুল-জন্মশতবর্ষ সংস্করণ) নবম খণ্ডে এই চিঠির কবিতা ও স্বরলিপি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে- 'পত্রটি মুরলীধর বসুকে লিখিত। নজরুলের "দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার' গানটি এবং ঐ গানের কবিকৃত স্বরলিপি প্রথম বর্ষের ১৩৩৩ আশ্বিন সংখ্যা 'কালিকলমে' প্রকাশিত হয়। ঐ সংখ্যায় তাঁর 'অনামিকা' কবিতাও ছিল। প্রথম বর্ষের ভাদ্র সংখ্যা 'কালিকলমে' লেখরাজ সামন্ত ছদ্মনামে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় “শুটকি ও ফূপি" গল্পটি লেখেন।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ ((রবিবার, ৯ আশ্বিন, ১৩৩৩) নজরুল রচনা করেছিলেন একটি কবিতা। এটি হলো-

এই মাসে রচিত ও প্রকাশিত অন্যান্য কবিতা

  • যা শত্রু পরে পরে ফণী মনসা কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে-' কৃষ্ণনগর, আশ্বিন, ১৩৩৩'। মুজফ্ফর আহমদ তাঁর কাজী নজরুল ইসলাম: স্মতিকথা' গ্রন্থে এই কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট হিসেব উল্লেখ করেছেন-

    '১৯২৬ সালে ইংল্যাণ্ডের জেনেরেল ধর্মঘট উপলক্ষেও নজরুল ইস্‌লাম 'যা শক্র পরে পরে?' নাম দিয়ে কবিতা লিখেছিল । এই কবিতার ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিক ভ্রাত্রীয়তা ফুটে না উঠে তাতে প্রকাশ পেয়েছে শুধু জাতীয়তাবাদ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাকে বাদ দিয়ে সে এই কবিতাটিও লিখতে পারে নি। কবিতাটি প্রথমে বর্ধমানের 'শক্তি' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল (আশ্বিন, ১৩৩৩)। তা থেকে ১৯২৬ সালের ১২ই অক্টোবর তারিখের 'গণবাণী'তে তা উদ্ধৃত হয়েছিল।'

এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা

  • অনামিকা। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সাথে কবিতাটি রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- চট্টগ্রাম ২৭ জুলাই ১৯২৬। কবিতাটি 'কালি ও-কলম' পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এই মাসে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
  • দুর্দিনের যাত্রী। নজরুলের তৃতীয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'ধূমকেতু' পত্রিকায় যে সকল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তারই অধিকাংশ প্রবন্ধ নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির প্রকাশক: নজরুল ইসলাম। প্রিন্টার: অমূল্যচন্দ্র ভট্টাচার্য, ভট্টাচার্য প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ৪ বৃন্দাবন পাল বাই লেন, কলকাতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৪। মূল্য ছয় আনা। পুস্তকটিতে প্রকাশকালের উল্লেখ ছিল না। এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলো ছিলো-
  1. মোরা সবাই স্বাধীন মোরা সবাই স্বাধীন মোরা সবাই রাজা [ধূমকেতু প্রথমবর্ষ। চতুর্থ সংখ্যা (৫ ভাদ্র ১৩২৯, মঙ্গলবার ২২ আগষ্ট ১৯২২) সম্পাদকীয়।
  2. আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল [ধূমকেতু। প্রথম বর্ষ। পঞ্চম সংখ্যা (৮ ভাদ্র ১৩২৯, শুক্রবার ২৫ আগষ্ট ১৯২২)। সম্পাদকীয়]
  3. তুবড়ি বাঁশির ডাক [ধূমকেতু। প্রথম বর্ষ। ষষ্ঠ সংখ্যার (১২ ভাদ্র ১৩২৯, মঙ্গলবার ২৯ আগষ্ট ১৯২২)। সম্পাদকীয়।
  4. মেয়্ ভুখা হুঁ [ ধূমকেতু [পত্রিকার প্রথম বর্ষ। নবম সংখ্যার (২৯ ভাদ্র ১৩২৯, শুক্রবার ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২২) সম্পাদকীয়]
  5. আমি সৈনিক [ধূমকেতু। প্রথম বর্ষ। অষ্টাদশ সংখ্যা (১৪ কার্তিক ১৩২৯, মঙ্গলবার ৩১ অক্টোবর ১৯২২)। সম্পাদকীয়।
  6. পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ? [ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম বর্ষ। নবম সংখ্যার (২৯ ভাদ্র ১৩২৯, শুক্রবার ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২২)।
  7. স্বাগত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বীরেন্দ্র শাসমলের কারামুক্তি উপলক্ষে রচিত।

অক্টোবর ১৯২৬ (১৪ আশ্বিন-১৪ কার্তিক ১৩৩৩)
এই মাসে নজরুল ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী হিসেবে নজরুল অংশ গ্রহণ করেন। এই সংবাদটি পাওয়া যায়, গণবাণী  পত্রিকার '২৫ আশ্বিন ১৩৩৩' (মঙ্গলবার ১২ অক্টোবর ১৯২৬) সংখ্যায়। এই নির্বাচনে নজরুল প্রচারণায় মাঠে নামেন। তিনি স্বরাজ দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। এই উপলক্ষে তিনি ঢাকার গাজীপুর, জয়দেবপুর, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ভ্রমণ করেন। মূলত এই অঞ্চলের জন্য মুসলমানদের জন্য ছিল দুটি সংরক্ষিত আসন। এই নির্বাচনে নজরুলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিলেন- ঢাকার নবাব বাড়ির আব্দুল করিম, টাঙ্গাইলের জমিদার আব্দুল হালিম গজনবি, বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও মফিজউদ্দিন আহমেদ। এই নির্বাচনের প্রার্থী হতে নজরুলের ঘনিষ্ট বন্ধুরা নিষেধ করেছিলেন।

২৮ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার, ১১ কার্তিক ১৩৩৩), নির্বাচনের জন্য নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় আসেন। এই নির্বাচনের জন্য বিধানচন্দ্র রায় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নজরুলকে ৩০০ টাকা দেন। এরপর তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন এবং এই ব্যয়বহুল নির্বাচনী প্রচারণায় নামার উদ্যোগ নেন। 

২৯ অক্টোবর (শুক্রবার, ১২ কার্তিক ১৩৩৩), কলকাতায় নজরুল আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় তিনি আব্দুল হালিম এবং মুজফ্‌ফর আহমদকে নিয়ে কৃষ্ণনগরে ফেরেন।

৩০ অক্টোবর (শনিবার, ১৩ কার্তিক ১৩৩৩), কৃষ্ণনগরে থাকাবস্থায় নজরুলের বাসায় আব্দুল হালিমের ভাই শামসুদ্দীন হোসয়ন মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, শামসুদ্দীন হোসয়ন ছিলেন নজরুলের বিশেষ বন্ধু। এই মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর,  আব্দুল হালিম এবং মুজফ্‌ফর আহমদ কলকাতায় ফিরে যান। কিন্তু তিনি নির্বাচন সংক্রান্ত টেলিগ্রাম পেয়ে নজরুল পূর্ববঙ্গে রওনা দেন।

ঢাকা সফরের আগেই ফরিদপুরের নামজাদা পীর বাদশাহ মিঞার কাছে যান। কারণ, এই সময় বিভিন্ন কবিতা রচনা এবং হিন্দু পরিবারের বিবাহের পূর্ব-বঙ্গের সাধারণ মুসলমানদের কাছে নজরুল কাফের হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এই কুৎসা-মোচনের জন্য বাদশাহ মিঞার কাছে গিয়েছিলেন। বাদশা মিঞাকে তাঁর স্বপক্ষে লিখিত বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বাদশা মিঞা নজরুলের পক্ষে একটি ফতোয়া জারি করেন। এই ফতোয়া 'বাদশা-পীরের পয়গাম' শিরোনাম সাপ্তাহিক সওগাতের '৩ নভেম্বর ১৯২৬' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এইব ফতোয়া নিয়ে সফরের শুরুতেই তিনি ফরিদপুরে যান এবং কবি জসিমউদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। ফরিদপুরের প্রচারণায় গিয়ে বুঝতে পারলেন যে, সেখানকার স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা তমিজউদ্দীনের দল সমর্থন দেবেন তাঁর প্রতিপক্ষ বরিশালের জমিদার ইসমাইলকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, জসিমউদ্দীনের রচিত 'ঠাকুর-বাড়ির অঙিনায়' গ্রন্থে।

৩১ অক্টোবর (রবিবার, ১৪ কার্তিক ১৩৩৩), তিনি দ্বিতীয় বার ঢাকা সফর করেন। এবারের ঢাকা সফরে তিনি সৈয়দ শাহ ইউসুফের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় তাঁর বাসা ছিল ৫২ বেচারাম দেউড়ির বাড়ির মসজিদের কাছে।

এই মাসে রচিত ও প্রকাশিত নতুন কবিতা

  • অগ্রহায়ণ সওগাত জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতাটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ ছিল- 'কলিকাতা ১০ কার্তিক ১৩৩৩' (বুধবার, ২৭ অক্টোবর ১৯২৬)।
  • চাদনি রাতে। নির্বাচনী সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। এই সময় ঢাকার আশপাশে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালান। জয়দেবপুরে নির্বাচনী প্রচারণায় যাওয়ার পথে তিনি এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন। পরে তিনি অভিযান পত্রিকার 'কার্তিক ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশের জন্য কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কবিতাটি অপ্রকাশিত থেকে যায়। পরে জয়তী পত্রিকার বৈশাখ ১৩৩৭ সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার আগেই সিন্ধু-হিন্দোল গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।]
  • অতল পথের যাত্রী [বঙ্গবাণী। কার্তিক ১৩৩৩] সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।]

এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত কবিতা

  • গোপন প্রিয়া। সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সাথে কবিতাটি রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- চট্টগ্রাম ২৮ জুলাই ১৯২৬। কবিতাটি 'কালি-কলম' পত্রিকার 'কার্তিক ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

এই মাসে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ

  • সর্বহারা। বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকা অনুসারে সর্বহারা নামক কবিতা ও গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর মাসে (সোমবার, ৮ কার্তিক ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশক ব্রজবিহারী বর্মণ রায়, বর্মণ পাবলিশিং হাউস, ১০৩ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কলিকাতা। মুদ্রাকর: শশীভূষণ পাল, মেটকাফ প্রেস, ১৫ নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিট, কলিকাতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২+৬৪। মূল্য এক টাকা ছয় আনা।

    এই সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত কবিতা ও গান ছিল ১২টি। এগুলো হলো-
  1. সাম্যবাদী । ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গ্রন্থটি পুস্তিকাকের প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১ পৌষ (বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ), 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের মুখপত্র' হিসেবে 'লাঙল' নামক একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়। এর প্রথম খণ্ড। বিশেষ সংখ্যায় (প্রথম সংখ্যা) 'সাম্যবাদী' কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এসব কবিতার সংকলন হিসেবে 'সাম্যবাদী' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর মাসে (সোমবার, ৮ কার্তিক ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ), প্রকাশিত সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
  2. ফরিয়াদ [হুগলি ৭ আশ্বিন, ১৩৩২]
  3. আমার কৈফিয়ৎ [বিজলী আশ্বিন ১৩৩২]
  4. গোকুল নাগ [হুগলি ৩০শে কার্তিক ১৩৩২ ]
  5. কৃষাণের গান [হুগলি অগ্রহায়ণ, ১৩৩২]
  6. শ্রমিকের গান [কৃষ্ণনগর, ২০শে মাঘ, ১৩৩২]
  7. ধীবরদের গান [কৃষ্ণনগর ২৪ ফাল্গুন, ১৩৩২]
  8. সর্বহারা [লাঙল অফিস, কলিকাতা ২৪শে চৈত্র ১৩৩২। সওগাত 'আশ্বিন ১৩৩৩' সংখ্যা]
  9. ছাত্রদলের গান [কৃষ্ণনগর ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩ ]
  10. কাণ্ডারী হুঁশিয়ার [কৃষ্ণনগর ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩]
  11. উৎসর্গ [মা (বিরজাসুন্দরী দেবী)-র শ্রীচরণারবিন্দে] [৩৭ হ্যারিসন রোড,
    কলিকাতা, ১৬ ভাদ্র ১৩৩৩ ]
  12. প্রার্থনা [কবিতাটি প্রথম সর্বহারা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল]
নভেম্বর ১৯২৬ (১৫ কার্তিক-১৪ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩)
নির্বাচনী সফর শেষে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন ২৩শে নভেম্বর (মঙ্গলবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩)। ২৯শে নভেম্বর (সোমবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩) এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়। নজরুল খুব খারাপভাবে পরাজিত হন এবং তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করেন বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আব্দুল হালিম চৌধুরী।

নজরুল রচিত বাংলা গজলের সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণের সূত্রে ফার্সি ও উর্দু গজলের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। কিছু কিছু ফার্সি গজলের অনুবাদও করেছিলেন। তখন হয়তো গান হিসেবে বাংলায় গজলের ভাবনা ছিল না। মূলত ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের গজল রচনার সূত্রপাত হয়েছিল দীওয়ান-ই-হাফিজ অনুবাদের সূত্রে। তবে এসকল মৌলিক নয় এবং তাতে সুরারোপ করেন নি। মৌলিক গজল-গান হিসেবে প্রথম রচিত হয়েছিল- ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। গানটি হলো- রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনীতে ছায়ানটে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সাথে রচনার তারিখ উল্লেখ আছে- দৌলতপুর, কুমিল্লা, বৈশাখ ১৩২৮। গানটি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশত নজরুল-গীতিকা'র প্রথম সংস্করণে গজল শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ২৬টি গজল।

 তাই হয়তো ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের আগ-পর্যন্ত তিনি গজল-গান রচনায় হাত দেন নি। তাঁর এই ইচ্ছাকে উসকে দিয়েছিল মিশরে নৃত্যশিল্পী মিস ফরিদা। নজরুল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যে কলকাতার এ্যালবার্ট হলে মুহম্মদ নাসিরুদ্দিন ও মইনুদ্দীনের সাথে মিস ফরিদা'র নাচ ও গান উপভোগ করেছিলেন। এর ভিতরে মিস ফরিদা'র গাওয়া উর্দু গজল 'কিসকি খায়রো ম্যঁয় সাজনে' শুনে বাংলায় গজল রচনায় উৎসাহ বোধ করেন। এই উৎসাহ থেকে তৎক্ষণাৎ কোনো গজল রচনা করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। সম্ভবত বাংলা গজল রচনার উৎসাহ সাময়িকভাবে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর নির্বাচনী উৎসাহের নিচে।




২৩শে নভেম্বরের নির্বাচনী প্রচারণ শেষে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন বিপর্যস্ত অবস্থায়। ২৯শে নভেম্বরে নির্বাচনের পরাজয় তাঁর এই বিপর্যস্ত  মানসিক বিষণ্ণতাকে আরও তীব্রতর করে তুলেছিল। এর সাথে যুক্ত হয়ৈছিল আর্থিক সংকট। অচিরেই তিনি বিষণ্ণতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলেন। তিনি সকল গ্লানিকে মুছে ফেলে রোমান্টিক গজল রচনায় হাত দিয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর এ ভাবনা ছিল যে, এই গজলগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, নগদপ্রাপ্তি ঘটবে। এই সময় নজরুল প্রথম দিকে রক্ত-আমাশয় এবং পরে ম্যালেরিয়া রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় তিনি গজল রচনা করেই সময় কাটান। এই অবস্থার ভিতরে ২৪শে নভেম্বর (বুধবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩) তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গজল ' বাগিচায় বুলবুলি তুই দিসনে আসি দোল'। অবশ্য, অনেকে মিস ফরিদা'র গাওয়া গজলটির অনুসরণে 'আসে বসন্ত ফুল বনে' গানটিকে তাঁর রচিত প্রথম গজল হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু সওগাত পত্রিকার 'পৌষ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায়  প্রকাশিত এই গানটির নিচে স্থান তারিখ উল্লেখ আছে- 'কৃষ্ণনগর, ২৮ অগ্রহায়ণ ৩৩'। 

উল্লিখিত গান দুটির বেশ আগে
  • বাগিচায় বুলবুলি তুই [তথ্য]
    রচনার স্থান ও কাল:
    কৃষ্ণনগর, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৩৩৩'  (২৪ নভেম্বর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ)
    প্রথম প্রকাশ: কল্লোল। মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (মার্চ ১৯২৭) সংখ্যা। রাগ: ভৈরবী। তাল: পোস্তা।
     
  • দারিদ্র। কল্লোল পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পরে কল্লোল পত্রিকা থেকে 'সওগাত' পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩' সংখ্যায় পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ' সিন্ধু-হিন্দোল ' কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

    এই কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট পাওয়া মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে । তিনি লিখেছেন-
    'নজরুল ইসলাম তখন কৃষ্ণনগরে থাকত, আমি আরও ক'জনের সঙ্গে থাকতাম ওয়ার্কার্স এও পেজাণ্টস্‌ পাটির আফিসে- কলকাতার ৩৭, হারিসন রোডে (এখন নাম মহাত্মা গান্ধী রোড )। আমাদের অফিস হতে পটুয়াটোলা লেনে “কল্লোলের” আফিস নিকটে ছিল। একদিন কি কারণে নজরুল কলকাতায় এসে আবার কৃষ্ণনগরে ফিরে যাচ্ছিল। তার আগে সে একবার আমাদের আফিসে এলো। কলকাতায় আসলে আমাদের আফিসে সে আসতই। যাওয়ার আগে আমার হাতে সে “দারিদ্র্যের” পাগুলিপিখানা দিয়ে বল্ল, “এটা ভাই তুমি 'কল্লোল' অফিসে পৌঁছিয়ে দিও। আমি এবার আর সেখানে যাব না। দিনেশরঞ্জন দাশ মনিঅর্ডারযোগে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন। একটি কবিতাও চেয়েছিলেন সেই সঙ্গে। এই কবিতাটি বড় দুঃখে লিখেছি।” বলা বাহুল্য, আমি কবিতাটি “কল্লোল” আফিসে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেম এবং তা ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের (খ্রীস্টীয় হিসাবে ১৯২৬ সালের নবেম্বর মাসের ) “কল্লোলে” ছাপাও হয়েছিল। কল্লোলে ছাপা হওয়ার কয়েকদিন আগেই কবিতাটি” রচিত হয়েছিল।"
  • সিন্ধু, প্রথম তরঙ্গ [কালি ও কলম। অগ্রহায়ণ ১৩৩৩]
  • অগ্রহায়ণ সওগাত [সওগাত। অগ্রহায়ণ ১৩৩৩]
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচনা
  • যা শত্রু পরে পরেফণী মনসা কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে-' কৃষ্ণনগর, আশ্বিন, ১৩৩৩'। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর তারিখের 'গণবাণী'তে প্রকাশিত হয়েছিল।'

ডিসেম্বর ১৯২৬ (১৫ অগ্রহায়ণ -১৬ পৌষ ১৩৩৩)
এই মাসের শুরু থেকেই নজরুল প্রথম দিকে রক্ত-আমাশয় এবং পরে ম্যালেরিয়া রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি বেশকিছু কবিতা ও গান রচনা করেন।

৭ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার ২১শে অগ্রহায়ণ)
প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে রচনা করলেন নজরুল সওগাত পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যার জন্য একটি কবিতা 'খালেদ'।

  • খালেদ। এই কবিতাটি 'বার্ষিক সওগাত' পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত কবিতাটির সাথে রচনার তারিখ উল্লেখ ছিল- 'কৃষ্ণনগর, ২১শে অগ্রহায়ণ '৩৩' [মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর ১৯২৬]। কবিতাটি নজরুল রচনা করেছিলেন সওগাত পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যার জন্য। পরে কবিতাটি জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

১১ ডিসেম্বর (শনিবার ২৫ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩)

  • বার্ষিক সওগাত। এই কবিতাটি 'বার্ষিক সওগাত' পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত কবিতাটির সাথে রচনার তারিখ উল্লেখ ছিল- 'কৃষ্ণনগর, ২৫শে অগ্রহায়ণ '৩৩' [শনিবার, ১১ ডিসেম্বর ১৯২৬]। কবিতাটি নজরুল রচনা করেছিলেন সওগাত পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যার জন্য। পরে কবিতাটি জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৩৩)

  • আসে বসন্ত ফুলবনে  [তথ্য]
    সওগাত পত্রিকার 'পৌষ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় গানটির রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- ' কৃষ্ণনগর, ২৮ অগ্রহায়ণ ৩৩' [মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৬]। গানটির পাদটীকায় উল্লেখ ছিল-  'বিখ্যাত উর্দু গজল ' 'কিস্‌কে খেরামে নাজ্‌নে কবর্‌মে দিল্ হিলা দিয়া'।

    উল্লেখ্য, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে মিশরের নৃত্যশিল্পী মিস্ ফরিদা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিলেন। নজরুল কলকাতার এ্যালবার্ট হলে মুহম্মদ নাসিরুদ্দিন ও মইনুদ্দীনের সাথে মিস ফরিদা'র নাচ ও গান উপভোগ করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে ফরিদার পরিবেশিত উর্দু গজল "কিসকি খায়রো ম্যাঁয় না জানি, মেঁ দিল হিলা দিয়া" শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তিনি এই গজল গানের সুরের কাঠামো অনুসরণ কের ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২৮ অগ্রহায়ণ কৃষ্ণনগরে এই বাংলা গজলটি লিখেছিলেন। এই কারণে এই সুরাঙ্গের বিচারে গানটিকে 'গজল-ভাঙা' গান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর ১৯২৬ (বৃহস্পতিবার ১ পৌষ ১৩৩৩]

২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩)
৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসুকে লেখা থেকে জানা যায়, নজরুল অসুস্থ অবস্থায় উর্দু গজলের সুরে কয়েকটি বাংলা গজল রচনা করেছিলেন।

  • দুরন্ত বায়ু পূববইয়াঁ [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (মে- জুন ১৯২৭)' সংখ্যায় প্রকাশিত গানটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে-  'কৃষ্ণনগর, ১ পৌষ ১৩৩৩' [বৃহস্পতিবার ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯২৬)।

    এ সকল গজলের ভিতরে এই গানটি ছিল। গানটির পাদটীকায় উল্লেখ ছিল-  'উর্দু গজল নাজ্‌ভি হোতা রহে হোতি রহে বে-দাদ্-ভি'-সুর। উল্লেখ্য, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণে মিশরের নৃত্যশিল্পী মিস্ ফরিদা কলকাতার আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছিলেন। সেই নৃত্যানুষ্ঠান নজরুল দেখেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানর শ্রুত উর্দু গজলের সুরে তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।
     
  • মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (জানুয়ারি-ফেরুয়ারি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এ সময় অসুস্থ অবস্থায় তিনি কৃষ্ণনগরে ছিলেন। কৃষ্ণনগর, ১১ পৌষ ১৩৩৩ (রবিবার ২৬শে ডিসেম্বর ১৯২৬)

এর ভিতরে নজরুল কোনো এক কারণে নজরুল কলকাতায় এসেছিলেন এবং আসার পর আবার শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই সময় গ্রন্থ-প্রকাশক ব্রজবিহারীর সাথে দেখা করেন। অসুস্থ শরীরে কলকাতা ত্যাগের আগে তিনি একটি ছেলের হাতে ব্রজবিহারীকে ২৫টাকা পাঠানোর অনুরোধ করে চিঠি লিখে পাঠান।
        [ ব্রজবিহারী বর্‌মণ-কে [‌মণ-কে [পত্র]
 
ব্রজমোহন ২৫ টাকা পাঠতে পারেন নি। এই সময় ব্রজবিহারী নিজেও অসুবিধার মধ্যে ছিলেন। তবে ১৫টাকা পাঠাতে পেরেছিলেন। তাঁর এই টাকা প্রাপ্তি এবং তাঁর অসুস্থতার কথা জনা যায় ২০শে ডিসেম্বর (সোমবার, ৫ পৌষ ১৩৩৩)  নজরুলের ব্রজবিহারী বর্মণের কাছে পাঠানো চিঠি থেকে।
        [ব্রজবিহারী বর্‌মণ-কে [পত্র]

২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসুকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠি থেকে জানা যায় প্রায় মাসখানে জ্বরে ভুগে, জ্বর থেকে দিন চারেকের জন্য রেহাই পেয়েছেন। চিঠিতে যথারীতি তাঁর আর্থিক দুরবস্থার কথা জানা যায়। চিঠি থেকে আরও জানা যায় এই সময় তিনি উর্দু গজলের সুরে দুএকটি বাংলা গজল রচনা করছেন। তার দু'একটি সওগাত পত্রিকায় পাঠিয়েছেন। সওগাতের বাইরে বঙ্গবাণী, কালকলমে পত্রিকাতে পাঠিয়ে অর্থ উপর্জানের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এ চিঠি থেকে জানা যায় তখন প্রতিটি কবিতার জন্য পত্রিকা থেকে ১০ টাকা পাওয়া যেতো। এ ব্যাপারে চিঠিতে তিনি মুরলীধর বসুর সাহায্য কামনা করেছেন। 
        [মুরলীধর বসু-কে [পত্র]

২০শে ডিসেম্বর (সোমবার, ৫ পৌষ ১৩৩৩) রাত্রি ১১টা ৪৫ মিনিটে মিসেস এম রহমান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে নজরুল ৩০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার ১৫ পৌষ, ১৩৩৩) একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি হলো।

  • মিসেস এম. রহমান। সওগাত পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৩৩ সংখ্যায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এর পাদটীকায় লেখা ছিল- 'গত ২০শে ডিসেম্বর (১৯২৬) সোমবার রাত্রি ১১টা ৪৫ মিনিটের সময় জান্নাত বাসিনী হইয়াছেন। মিসেস এম রহমানের পূর্ণনাম মুসাম্মাৎ মাসুদা খাতুন।..."
    জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এই কবিতাটির রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ ছিল- কৃষ্ণনগর,
    ১৫ পৌষ, ১৩৩৩ (বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ১৯২৬)।

    মিসেস এম. রহমান কবিতাটি রচনার সময় সম্পর্কে জানা যায় ৩০ ডিসেম্বরে নজরুলের লেখা সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরু উদ্দিনের কাছে লেখা চিঠি থেকে। চিঠির শুরুতেই আছে- 'এখন রাত্রি। এই মাত্র ‘মিসেস এম. রহমান’শীর্ষক কবিতাটি শেষ করে আপনাকে এই চিঠি লিখছি।'
            [মোহম্মদ নাসিরু উদ্দিন-কে লেখা পত্র]

জানুয়ারি ১৯২৭ (১৭ পৌষ-১৭ মাঘ ১৩৩৩)
এই মাসে নজরুল মোটামুটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন নি। ২রা জানুয়ারি (রবিবার ১৮ পৌষ ১৩৩৩), কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসু-কে চিঠিতে নজরুল মুরলীধর বসুকে লিখেছিলেন-' আমার জ্বর আসে কিস্তিবন্দি হারে। দ্বিতীয় কিস্তির সময় কখন আসে – কে জানে।'
            [মুরলীধর বসু-কে [পত্র]

৩রা জানুয়ারি (সোমবার ১৯ পৌষ ১৩৩৩), কৃষ্ণনগর থেকে শচীন কর-কে একটি চিঠি লেখেন।  চিঠিতে প্রাণতোষ ভট্টাচার্য এই সময় নজরুলের সাথে দেখা করার জন্য কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। এই চিঠি থেকে শচীন কর ভালো কবিতা লেখা শুরু করেছেন, তা নজরুল বেশ রসিয়ে প্রশংসা করে লিখেছিলেন-

 স্নেহের হাবুল!
    তুই এবার এলিনে, আসলে বড়ো খুশি হতুম। তোকে দেখবার ইচ্ছা ছিল, দেখিনি অনেকদিন তোদের; কিন্তু তোর চেয়েও তোর মাঝে যে কবি-শিশুটি দিনের পর দিন বড়ো হয়ে উঠেছে তাকে দেখবার বেশি ইচ্ছা ছিল। একদিন তাকে দেখবই, তখন হয়তো সে রীতিমতো ঘোড়দৌড় করছে দেখব। কিন্তু মানুষের ঘোড়দৌড় দেখার চেয়ে শিশুর হাঁটি-হাঁটি পা-পা দেখতে অধিক ভালো লাগে।...'

                শচীন কর-কে লেখা [পত্র]

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে 'সওগাত' পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই মাসের ১৩ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার ২৯ পৌষ ১৩৩৩), এই বার্ষিক সওগাত পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে সওগাত অফিসে একটি উৎসব করা হয়। অসুস্থতার জন্য নজরুল এই অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেন নি।

২৪শে জানুয়ারি (সোমবার, ১০ মাঘ ১৩৩৩), পুলিশ কমিশনার টেগার্ট সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার জন্য, চিফ সেক্রেটারির কাছে সুপারিশ করেছিলেন।

কলকাতায় গিয়ে নজরুল জ্বরে আক্রান্ত হন। কৃষ্ণনগরে ফিরে আসার পর জ্বর থেকে মুক্তি পান। এই সময় কৃষ্ণনগর থেকে নজরুল মুরালীধর বসুকে লেখা চিঠিতে তাঁর এই জ্বর মুক্তির কথা জানা যায়। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন- ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ ২৫ জানুয়ারি-তে (মঙ্গলবার, ১১ মাঘ ১৩৩৩)।
            [মুরলীধর বসু-কে  লেখা পত্র]

এই মাসে প্রকাশিত নতুন রচনা

  • মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় (জানুয়ারি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এ সময় অসুস্থ অবস্থায় তিনি কৃষ্ণনগরে ছিলেন। উল্লেখ্য, ২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসুকে লেখা থেকে জানা যায়, নজরুল অসুস্থ অবস্থায় উর্দু গজলের সুরে কয়েকটি বাংলা গজল রচনা করেছিলেন। এ সকল গজলের ভিতরে এই গানটি ছিল।
পূর্বে রচিত বা প্রকাশিত কবিতা ও গান, যা এই মাসে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল।
  • বার্ষিক সওগাত। 'বার্ষিক সওগাত' 'মাঘ ১৩৩৩' প্রকাশিত হয়েছিল।
  • খালেদ। 'বার্ষিক সওগাত' 'মাঘ ১৩৩৩'  প্রকাশিত হয়েছিল।
  • জগলুল পাশা 'বার্ষিক সওগাত' 'মাঘ ১৩৩৩'  প্রকাশিত হয়েছিল।
  • দারিদ্র। কল্লোল পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩৩৩' সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পরে কল্লোল পত্রিকা থেকে 'সওগাত' পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩' সংখ্যায় পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল।
  • বাগিচায় বুলবুলি তুই [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (মার্চ ১৯২৭) সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, উক্ত পত্রিকায় রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ ছিল- 'কৃষ্ণনগর, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৩৩৩'  (২৪ নভেম্বর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ)।
ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ (১৮ মাঘ-১৭ ফাল্গুন)
এই মাসে নজরুল ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। যাওয়ার আগে কৃষ্ণনগর থেকে ১০ ই ফেব্রুয়ারি দুটি চিঠি লেখেন। চিঠি দুটি হলো-
  • প্রথম পত্র: মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন-কে লিখিত [পত্র]
    এই পত্র থেকে জানা যায় যে, নজরুল জ্বরাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। এই জ্বর থেকে মুক্ত হয়েছেন আগের দিন অর্থাৎ ৯ই ফেব্রুয়ারি। চিঠি থেকে জানা যায়, নজরুল 'গাজী আব্দুল করিম' নামক একটি কবিতা রচনা পূর্বে কোনো এক সময় শুরু করেছিলেন, কিন্তু অসুস্থতার জন্য শেষ করতে পারেন নি। চিঠিতে লিখেছেন 'আজ বা কাল শেষ করবো ইচ্ছা আছে।' নজরুল রচনাবলী (নজরুল-জন্মশতবর্ষ সংস্করণ) ৯ম খণ্ডে কবিতাটির মাত্র চারটি চরণ পাওয়া যায়। চরণ চারটি হলো-

                            গাজী আব্দুল করিম

                    বন্দি! তোমায় বন্দনা করি
                                লহ এ অর্ঘ্য তাজ
                    তব পরাজয় লজ্জা দিয়াছে
                                বিশ্বজয়ারে আজ।

        এছাড়া এই চিঠিতে সওগাত পত্রিকার নাসির উদ্দীনকে যে কবিতা পাঠাবেন সেটা জানা যায়।
     
  • দ্বিতীয় পত্র: আবুল হোসেন কে লিখেছিলেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ'-এর প্রথম বার্ষিক সম্মলন হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করার জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে আমন্ত্রণ করা হয়। নজরুল এই সম্মেলনে যোগাদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন এই পত্র মারফতে।
            [ আবুল হুসেন-কে লিখিত পত্র]
     
  • বসিয়া বিজনে কেন একা মনে [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'ফাল্গুন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ  (ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যা। শিরোনাম: গজল

    এই মাসের শেষের দিকে নজরুল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। এবং তিনি বন্ধুদের সাথে চাবড়ির বিলে হাঁস শিকারে গিয়েছিলেন। 
     
  • আমারে চোখ ইশারায় [তথ্য]
    কল্লোল পত্রিকার 'চৈত্র ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ  (ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।  রচনার স্থান ও রচনাকাল উল্লেখ নেই ।
দিলীপকুমার রায়ের ইউরোপ যাত্রার প্রাক্কালে, নজরুল ১৬ই ফেব্রুয়ারি (৪ ফাল্গুন ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতায় আসেন। এই দিন তিনি দিলীপকুমার রায়ের উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন 'সুর-কুমার' কবিতাটি।
  • সুরকুমার ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার সাথে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে ' কলিকাতা। ৪ ফাল্গুন, ১৩৩৩'।  খ্রিষ্টাব্দের বিচারে 'মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭'।
এই মাসেই ঢাকাতে মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে নজরুল ঢাকায় যান। এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল মিলনায়তনে। নজরুল উৎসবে যোগদানের জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে গোয়ালন্দ পার হয়ে নদী পার হওয়ার সময়, পদ্মার বুকে 'খোশ্ আমদেদ' শিরোনামের গানটি রচনা করেন।  গানটি হলো-
  • আসিলে কে গো অতিথি [তথ্য]
    জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে গানটি 'খোশ্ আমদেদ' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গানটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- 'পদ্মা/২৭-২-২৭'। বঙ্গাব্দের হিসেবে '১৫ ফাল্গুন, ১৩৩৩ '।
  • মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে নজরুল
    ২৭ ফেব্রুয়ারি (রবিবার, ১৫ ফাল্গুন ১৩৩৩) বিকেলের দিকে নজরুল ঢাকা পৌঁছান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে কাজী আব্দুল ওয়াদুদ  প্রবন্ধ পাঠের পর, নজরুল পরিবেশন করেছিলেন- 'খোশ্ আমদেদ' শিরোনামের গানটি। এরপর তিনি প্রধান অতিথির ভাষণ দেন।

    ২৮ ফেব্রুয়ারি (সোমবার, ১৬ ফাল্গুন ১৩৩৩) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অধিবেশনের শুরু হয়েছিল, নজরুলের গজল গানের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি আবৃত্তি করে শোনান 'খালেদ' কবিতা। এই সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন স্যার এ এফ রহমান আর সভাপতিত্ব করেছিলেন মৌঃ তসদ্দুক আহমদ।

    মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের মুখপত্র প্রকাশিত হয়েছিল 'শিখা' শিরনামে। এর পরিশিষ্ট অংশে এই সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ মুদ্রিত হয়েছিল।

    এই মাসে পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা

    • সওগাত। ফাল্গুন ১৩৩৩ (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯২৭)
      গান: দুরন্ত বায়ু পূববইয়াঁ [তথ্য]

মার্চ ১৯২৭ (১৭ ফাল্গুন- ১৭ চৈত্র ১৩৩৩)
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে শেষ হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর তিনি রাত্রে ঢাকায় থেকে যান। পরের দিন অর্থাৎ ১ মার্চ (মঙ্গলবার, ১৭ ফাল্গুন ১৩৩৩), সম্মেলন মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মাহমুদ হাসান নজরুলকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। এই দিন চট্টগ্রামের দিদারুল আলমের সম্পাদিত মাসিক 'যুগের আলো' পত্রিকার জন্য, যুগের আলো শিরোনামে নজরুল আট পংক্তির একটি কবিতা রচনা করেছিলেন।

  • যুগের আলো। ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই গ্রন্থে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- ঢাকা/১৭ ফাল্গুন, ১৩৩৩।  কবিতাটি যুগের আলো পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১লা মার্চ নজরুল ঢাকা ত্যাগ করে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন। এরপর তাঁর পুত্রের অন্নপ্রাসনের আয়োজনের উদ্যোগ নেন। এবং অনেককে দাওয়াত করেছিলে। এ বিষয়ে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় ১১ই মার্চ (শুক্রবার, ২৭ ফাল্গুন ১৩৩৩) লেখা ব্রজবিহারীকে লেখা একটি পত্র থেকে।
            [ব্রজবিহারী ব্র্মণ-কে পত্র]

১৩ই মার্চ (রবিবার, ২৯ ফাল্গুন ১৩৩৩) নজরুলের পুত্র বুলবুলের  অন্নপ্রাসন হয়। এই অনুষ্ঠানে কলকাতা এবং কৃষ্ণনগরের বন্ধুরা এসেছিলেন। চরম দরিদ্র দশার মধ্যে নজরুল আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেন নি।

২৭শে মার্চ (রবিবার, ১৩ চৈত্র ১৩৩৩), নজরুল একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি হলো-

এই সময় তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে মনে হয়। কারণ, সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন নজরুলের অসুস্থতার কারণে আর্থিক সহায়তার জন্য, মার্চ মাসে কলকাতার আলবার্ট হলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। উল্লেখ্য নজরুল ইসলাম এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার  জন্য কলকাতা এসেছিলেন। এই সময় তিনি ১টি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি হলো-

  • পথের দিশা ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই গ্রন্থে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে-কলিকাতা, ১৬ই চৈত্র, ১৩৩৩ (বুধবার, ৩০ মার্চ ১৯২৭)। 

এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত গান।

  • আসিলে কে গো অতিথি  [তথ্য]
    • শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র)। চৈত্র ১৩৩৩।
    • সওগাত। চৈত্র ১৩৩৩।

এপ্রিল ১৯২৭ (১৮ চৈত্র ১৩৩৩-১৭ বৈশাখ ১৩৩৪)
এই মাসের ১ তারিখে (রবিবার ১৯ চৈত্র ১৩৩৪) কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি ১টি কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাটি হলো-

  • ঈদ মোবারকজিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থে কবিতাটির রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে-'কলিকাতা ১৯ চৈত্র, ১৩৩৩'। কবিতাটি সওগাত পত্রিকার বৈশাখ ১৩৩৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

১৪ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার ১ বৈশাখ ১৩৩৪), বাংলা নবর্ষ উপলক্ষে নজরুল তিনি তিনটি গণসঙ্গীত রচনা করেছিলেন । এই গান তিনটি হলো-  জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত (অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত), ওড়াও ওড়াও লাল নিশান (রক্ত-পতাকার গান) এবং ওরে ও শ্রমিক (জাগর-তূর্য)। এর ভিতরে শেলীর কবিতা অবলম্বনে রচিত 'ওরে ও শ্রমিক (জাগর-তূর্য)' সুরারোপিত হয় নি। নিচে এই দুটি গান ও একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

  • জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত [তথ্য]
    ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] 'অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গানটির সাথে রচনার স্থান ও কালের উল্লেখ আছে- 'কলিকাতা। ১লা বৈশাখ ১৩৩৪' (বৃহস্পতিবার ১৪ এপ্রিল ১৯২৭)। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গণবাণী পত্রিকার '৮ই বৈশাখ ১৯৩৪' সংখ্যায়।

    এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের জন্য লিখিত একটি জাতীয় সঙ্গীতের অনুবাদ। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মূল গানটি কবিতাকারে রচনা করেছিলেন প্রাক্তন ফরাসি কমুনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং গীতিকার ইউগেন পট্টিয়ের Eugène Pottier, ১৮১৬-১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)। এর এক বছর পর, ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েরে ডি গেয়টার ( Pierre De Geyter, ১৮৮৪-১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ) এই কবিতাটিতে সুরারোপ করেন। এই বৎসরের জুলাই মাসে এই গানটি প্রথম পরিবেশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে এই গানটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পিয়েরে এই গানের ৬০০০ কপি মুদ্রিত করে লিফলেট আকারে বাজারে ছাড়েন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গানটি প্রকাশিত হয়েছিল।

    গানটির জনপ্রিয়তা এবং বাণিজ্যিক মূল্য দেখে, পিয়েরের ভাই এ্যাডোলফি ধোকা দিয়ে এই গানের স্বত্বাধিকার দাবি করেন। আদালতে দাবি প্রমাণ করতে না পারায়, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে পিয়েরে তার স্বত্বাধিকার হারান। এর প্রায় ৭-৮ বছর পরে পিয়েরের ভাই তার জালিয়াতি স্বীকার করে একটি চিরকুট রেখে আত্মহত্যা করেন। এরপর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে আদালতে আপিল করে পিয়েরে স্বত্বাধিকার লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই গানটি প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়। পিয়েরে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে হ্যান্স আর বেইয়েরলেইন (Hans R. Beierlein) পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানীতে বিক্রয় করার জন্য ৫,০০০ ডয়েস মার্কে মন্টানা সংস্করণ কিনে নেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, এই গানটির উপর ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাঁর স্বত্বাধিকার উঠে যায়।

    ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই গানটি প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত হলেও, অনূদিত ভাষার তালিকায় বাংলা ছিল না। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ্‌ফর আহমেদ এই গানটির বাংলা অনুবাদের জন্য নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেন। এই বিষয়ে মুজফ্‌ফর আহমেদ-এর রচিত 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে এই বিষয়ে লিখেছেন-
    ১৯২৬ সালে আমি নজরুলকে এই গানটি বাঙলায় তর্‌জমা করতে বলি। তার জন্যে গানের একটি ইংরেজী কপি তো তাকে জোগাড় করে দিতে হবে। চেষ্টা করেও আমি এমন এ্কখানা বই জোগাড় করতে পারলাম না যাতে ব্রিটেনের মজুররা যে তর্‌জমাটা গান, তা পাওয়া যায়। আমেরিকার তর্‌জমাটি পাওয়া গেল আপ্‌টন সিংক্লেয়ারের হেল্‌ (Hell, a Verse Drama) নামক নাটিকায়। ব্রিটেনে গাওয়া তর্‌জমার সঙ্গে দু'টি কিংবা তিনটি শব্দের শুধু তফাৎ। তাতে মানে বদলায়নি, সুর তো নয়ই। আমাদের কেউ তখন ইনটারন্যাশনাল সঙ্গীতের সুর জানতেন না, নজরুলও জানত না। নজরুল আমায় বলল "এর স্বরলিপি (নোটেশন) জোগাড় করে দাও। তা হলে তা যন্ত্রে বাজিয়ে সেই সুরের চৌহুদ্দীর ভিতরে গানটি আমি তর্‌জমা করে দেব।" কিন্তু এই নোটেশন আমাদের কেউ দিতে পারলেন না। শেষে নজরুল একদিন আমাদের আফিসে (৩৭, হ্যারিসন রোডে) আসতেই আমি তাকে বললাম — "নোটেশন ছাড়াই তুমি গানটি অনুবাদ করে দাও। প্রথমে একবার তা "গণবাণী"তে ছাপতে দিই, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়"। তখনই সেখানে বসেই সে গানটির অনুবাদ করে দিল। বাঙলা ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট অনুবাদ তো বটেই, আমার বিশ্বাস ভারতীয় ভাষাগুলিতে যতসব অনুবাদ হয়েছে সে-সবেরও সেরা। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হরীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দী অনুবাদ দেখেছি, তাঁর মনগড়া কথায় তা ভরা। নজরুলের অনুবাদে তার মনগড়া কথা নেই। তর্‌জমা করার পরে নজরুল আবারও আমাদের বলে দিল যে তার পরেও যদি আমরা নোটেশন যোগাড় করে দিই তবে সে গানে সুর-সংযোগ করে দেবে। কিন্তু নোটেশন আমরা আর যোগাড় করতে পারলাম না। ১৯২৭ সালে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপ যাওয়ার পরে তাঁকে একটা ছাপানো নোটেশন পাঠানোর জন্যে লিখেছিলেম। তিনি তখন মস্কোতেও ছিলেন। অনায়াসেই আমাদের তা পাঠাতে পারতেন। তা না করে তিনি পাঠালেন তাঁর নিজের একটি অনুবাদ। এটাও আমরা "গণবাণী"তে ছেপেছিলেম। নজরুল কিন্তু তার তর্জমায় সুর-সংযোগ করার সুযোগ আর পায়নি। ১৯২৯ সালে ফিলিপ স্প্রাট যখন বললেন যে তিনিই স্বরলিপি তৈয়ার করে দিবেন (ফিলিপ স্প্রাট গান জানতেন) তখন আমরা তো বহু বৎসরের জন্যে জেলে চলে গেলাম।...
     
    মূল ফরাসি কবিতা এবং গান ইংরেজি অনুবাদ : শ্রবণ নমুনা
    প্রথম প্রকাশ: The Weekly People, April 26th, 1924.
    Debout, les damnés de la terre
    Debout, les forçats de la faim
    La raison tonne en son cratère
    C'est l'éruption de la fin
    Du passé faisons table rase
    Foule esclave, debout, debout
    Le monde va changer de base
    Nous ne sommes rien, soyons tout
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :|

    Il n'est pas de sauveurs suprêmes
    Ni Dieu, ni César, ni tribun
    Producteurs, sauvons-nous nous-mêmes
    Décrétons le salut commun
    Pour que le voleur rende gorge
    Pour tirer l'esprit du cachot
    Soufflons nous-mêmes notre forge
    Battons le fer quand il est chaud
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :|

    L'État comprime et la loi triche
    L'impôt saigne le malheureux
    Nul devoir ne s'impose au riche
    Le droit du pauvre est un mot creux
    C'est assez, languir en tutelle
    L'égalité veut d'autres lois
    Pas de droits sans devoirs dit-elle
    Égaux, pas de devoirs sans droits
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :|

    Hideux dans leur apothéose
    Les rois de la mine et du rail
    Ont-ils jamais fait autre chose
    Que dévaliser le travail ?
    Dans les coffres-forts de la bande
    Ce qu'il a créé s'est fondu
    En décrétant qu'on le lui rende
    Le peuple ne veut que son dû.
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :| Les rois nous saoulaient de fumées
    Paix entre nous, guerre aux tyrans
    Appliquons la grève aux armées
    Crosse en l'air, et rompons les rangs
    S'ils s'obstinent, ces cannibales
    À faire de nous des héros
    Ils sauront bientôt que nos balles
    Sont pour nos propres généraux
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :|

    Ouvriers, paysans, nous sommes
    Le grand parti des travailleurs
    La terre n'appartient qu'aux hommes
    L'oisif ira loger ailleurs
    Combien de nos chairs se repaissent
    Mais si les corbeaux, les vautours
    Un de ces matins disparaissent
    Le soleil brillera toujours.
    |: C'est la lutte finale
    Groupons-nous, et demain
    L'Internationale
    Sera le genre humain :|
     
    Stand up, damned of the Earth
    Stand up, prisoners of starvation
    Reason thunders in its volcano
    This is the eruption of the end.
    Of the past let us make a clean slate
    Enslaved masses, stand up, stand up.
    The world is about to change its foundation
    We are nothing, let us be all.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :| There are no supreme saviours
    Neither God, nor Caesar, nor tribune.
    Producers, let us save ourselves,
    Decree the common salvation.
    So that the thief expires,
    So that the spirit be pulled from its prison,
    Let us fan our forge ourselves
    Strike the iron while it is hot.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :|

    The State oppresses and the law cheats.
    Tax bleeds the unfortunate.
    No duty is imposed on the rich;
    The rights of the poor is an empty phrase.
    Enough languishing in custody!
    Equality wants other laws:
    No rights without duties, she says,
    Equally, no duties without rights.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :|

    Hideous in their apotheosis
    The kings of the mine and of the rail.
    Have they ever done anything other
    Than steal work?
    Inside the safeboxes of the gang,
    What work had created melted.
    By ordering that they give it back,
    The people want only their due.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :|

    The kings made us drunk with fumes,
    Peace among us, war to the tyrants!
    Let the armies go on strike,
    Stocks in the air, and break ranks.
    If they insist, these cannibals
    On making heroes of us,
    They will know soon that our bullets
    Are for our own generals.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :|

    Workers, peasants, we are
    The great party of labourers.
    The earth belongs only to men;
    The idle will go to reside elsewhere.
    How much of our flesh have they consumed?
    But if these ravens, these vultures
    Disappear one of these days,
    The sun will shine forever.
    |: This is the final struggle
    Let us group together, and tomorrow
    The Internationale
    Will be the human race. :|
  • ওড়াও ওড়াও লাল নিশান [ তথ্য]
    ফণি-মনসা  কাব্যের প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭) 'রক্ত-পতাকার গান' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গানের সাথে রচনাকাল ও স্থানের উল্লেখ আছে  'কলিকাতা। ১লা বৈশাখ ১৩৩৪'। উল্লেখ্য, গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গণবাণী পত্রিকার '১৫ই বৈশাখ ১৯৩৪' সংখ্যায়।

    এটি একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে শ্রমজীবি মানুষের আত্মোৎসর্গের জন্য উদ্দীপনামূলক আন্তর্জাতিক গান। বর্তমানে ব্রিটিশ লেবার পার্টি, আইরিশ জাতীয় সোসাল ডেমোক্রেটিক এন্ড লেবার পার্টি এবং আইরিশ লেবার পার্টির দলীয় সঙ্গীত। পরবর্তী সময়ে এই গানটির অনুবাদ জাপানি কমুনিষ্ট পার্টি এবং কোরিয়ান পিউপল পার্টির গান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

    ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আইরিশ গীতিকার জিম কোনেল গানটি রচনা করেছিলেন। গানটিতে ছিল ছয়টি স্তবক। তবে এর প্রথম স্তবকটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ, নজরুল ইসলাম এই প্রথম স্তবকটির ভাবানুবাদ করেছিলেন।  জিম কোনেলর রচিত গানটির প্রথম স্তবকটি হল-
    The people's flag is deepest red,
    It shrouded oft our martyred dead
    And ere their limbs grew stiff and cold,
    Their hearts' blood dyed its every fold.

    So raise the scarlet standard high,
    Beneath its shade we'll live and die,
    Though cowards flinch and traitors sneer,
    We'll keep the red flag flying here
  • জাগর-তূর্য ফণি-মনসা  কাব্যের প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭) 'জাগর-তূর্য' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গানের সাথে রচনাকাল ও স্থানের উল্লেখ আছে  'কলিকাতা। ১লা বৈশাখ ১৩৩৪'। কবিতাটির শিরোনামের নিচে উল্লেখ আছে 'শেলির-ভাব-অবলম্বনে'।

নজরুল এই সময় প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যায় ছিলেন। ২০ এপ্রিল (বুধবার ৭ বৈশাখ ১৩৩৪) ব্রজবিহারী বর্মণকে লেখা নজরুলের পত্র থেকে জানা যায়।
                 [ব্রজবিহারী বর্‌মণ-কে [পত্র]

এই মাসে পত্রিকায় প্রকাশিত নতুন গান

  •  গণবাণী। বৈশাখ ১৩৩৪
    • জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত [তথ্য]
    • ওড়াও ওড়াও লাল নিশান [ তথ্য]

এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা

১ মে-২৪ মে-১৯২৭ (১৮ বৈশাখ্- ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪)
এই মাসের ২৪ মে'র ভিতরে নজরুলের ৫টি গজল বিভিন্ন পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই মাসে বঙ্গবাণী পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে চিঠি লেখেন। এই পত্রে গজল প্রকাশের বিষয় তাগাদা দিয়ে নজরুল লিখেছিলেন।
        উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে [পত্র]

এই মাসে প্রকাশিত ৫টি নতুন গজল।

  • কল্লোল্। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ (মে ১৯২৭)।
    • এ আঁখি জল মোছ প্রিয়া [তথ্য] নজরুল-কৃত স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত হয়েছিল।
    • দুরন্ত বায়ু পূববইয়াঁ [তথ্য]
    • ভুলি কেমনে আজো যে মনে [তথ্য]
  • বঙ্গবাণী। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ।
    • করুণ কেন অরুণ আঁখি [তথ্য]
    • এত জল ও-কাজল চোখ [তথ্য]
  • সওগাত। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ।
    • কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে [তথ্য]
    • কে বিদেশী বন-উদাসী [তথ্য]

এই মাসে প্রকাশিত নতুন কবিতা

এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত কবিতা

  • জাগর-তূর্য।  ফণি-মনসা  কাব্যের প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭) 'জাগর-তূর্য' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই গানের সাথে রচনাকাল ও স্থানের উল্লেখ আছে  'কলিকাতা। ১লা বৈশাখ ১৩৩৪'। কবিতাটির শিরোনামের নিচে উল্লেখ আছে 'শেলির-ভাব-অবলম্বনে'। গণবাণী পত্রিকার ২২ বৈশাখ ১৩৩৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

ধারণা করা হয়, জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রকাশিত গানগুলো নজরুল রচনা করেছিলেন বৈশাখ মাসের শেষের দিকে। উল্লিখিত গানগুলোর পরে নজরুলের ২৭ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সে আর কোনো নতুন গানের সন্ধান পাওয়া যায় নি।


সূত্র

  • কাজী নজরুল। প্রাণতোষ ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা-১২। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ
  • কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা। মুজফ্‌ফর আহমদ। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-১২। প্রথম সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫।
  • ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়। জসিম উদ্দিন। গ্রন্থপ্রকাশ। কলিকাতা।
  • নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
  • নজরুল তারিখ অভিধান। মাহবুবুল হক। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। জুন ২০১‌০ খ্রিষ্টাব্দ।
  • নজরুল রচনাবলী, জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম-দ্বাদশ খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ঢাকা]
  • নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা। ব্রহ্মমোহন ঠাকুর [কবি নজরুল ইনস্টিটিউট। আষাঢ় ১৪২৫/জুন ২০১৮]
  • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২)।
  • বিদ্রোহী-রণক্লান্ত, নজরুল জীবনী। গোলাম মুরশিদ। প্রথমা, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।