ভাস্কর্য
Sculpture
ভাস্কর্য হলো— দৃশ্যশিল্পের এমন একটি শাখা, যাতে শক্ত বা প্লাস্টিক (
plastic)
উপাদানের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক(উচ্চতা/গভীরতা দৈর্ঘ্য × প্রস্থ) অবয়বকে উপস্থাপন করা হয়।
ভাস্কর্য আমাদের অভিজ্ঞতা এবং বোধকে নানাভাবে উজ্জীবিত করে। এর মাধ্যমে আমরা আনন্দ-বেদনার উপলব্ধি পাই;
ভাস্কর্য আমাদেরকে বিস্মিত করে, সচেতন করে, স্মৃতিকাতরতাকে জাগ্রত করে কিম্বা নতুন স্বপ্ন দেখানো শেখায়। এভাবে
আমাদের জীবনের ভাস্কর্য একটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে এবং একই সাথে
ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ককে নিবিড় করে তোলে। ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের
ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। একই সাথে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় দর্শন বা
কথকথা, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ক্রমবিবর্তনের ধারাকে অনুধাবন করা যায়।
ভাস্কর্যের শুরু হয়েছিল কবে থেকে, তা দিনক্ষণ ধরে যথাযথভাবে বলা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, পাথর যুগের শুরু
দিকে ভাস্কর্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া ভাস্কর্য নমুনা অনুসারে যদি কালানুক্রমিক সূচি তৈরি করা যায়,
তাহলে- তালিকার প্রথমেই পাওয়া যায় নারীমূর্তি।
ধারণা করা হয়, মানুষের মূর্তি
তৈরি শুরু থেকেই প্রেম, যৌনতা, সৌন্দর্য এবং উর্বর্তার দেবী হিসেবে নারীমূর্তি পূজিতা হয়েছে
বিভিন্ন সভ্যতায়। ভাষা এবং সংস্কৃতির কারণে এই দেবী নানা নামে নানা ভাবে পূজিতা
হয়েছে। এই সূত্রে
ভেনাস
আদিম দশা ছিল মাতৃদেবী।
এর শুরু হয়েছিল সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক হোমো গণের কতিপয় প্রজাতির আদিম ভাবনা থেকে। এই মাতৃদেবীর মূর্তির
প্রতি ভক্তি বা পূজার সূচনা হয়েছিল সম্ভবত ৫ থেকে ৩ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস-দের
আমল থেকে।
হোমো ইরেক্টাসদের
ভিতরেও মাতৃদেবীর পূজা ছিল। এর প্রাচীনতম দুটি উদাহরণ হলো-
বেরেখাত রানের ভেনাস:
২,৩০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
হোমো ইরেক্টাসদের
সৃষ্ট আদিম মাতৃদেবী। পাথরের তৈরি। স্থান বর্তমান ইস্রায়েল অধিকৃত গোলন মালভূমি।
এরপর শুরু হয়েছিল
হোমো স্যাপিয়েন্সরা
আদিম দল
ক্রো-ম্যাগনানদের আমল।
এদের দ্বারা সৃষ্ট চারটি সভ্যতায়
ভেনাস
তৈরির ধারা অব্যাহত ছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন প্রাণী এবং মানুষ ও প্রাণীর
সংমিশ্রিত রূপ।
ভাস্কর্যের উপাদান যাকে অবলম্বন করে ভাস্কর্য তৈরি করা হয় এবং যা দ্বারা তৈরি করা হয়, উভয়ই ভাস্কর্যের
উপাদান। এই বিচারে ভাস্কর্য হলো বিমূর্ত এবং মূর্তের একটি যুগপৎ উপস্থাপন। একজন
ভাস্কর যে ভাবনাটি তাঁর চেতনার ভিতরে ধারণ করেন, তা হলো বিমূর্ত। এটি ভাস্করের
চেতনার ভিতরে জন্ম নেয় এবং নানন্দনিকভাবে উপস্থাপনের
জন্য তাঁকে উজ্জীবিত করে। ভাস্কর
যখন সেই ভাবনাকে কোনো ত্রিমাত্রিক অবয়বের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করেন, তখন তা ভাস্কর্য
হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে ভাস্কর নিজেই ঠিক করে নেন, কোনো বস্তু দিয়ে তাঁর ভাবনাকে মূর্ত
করে তুলবেন। ত্রিমাত্রিক বস্তুজগতে ভাস্করর্যের উপাদান কঠিন বস্তু।
ভাস্কর্যেশিল্পে এর সাধারণ নাম
প্লাস্টিক (plastic)।
একালের কৃত্রিম পেট্রোকেমিক্যাল যৌগিক
পদার্থের সাথে একে মিলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না।
মূলত
ভাস্কর্যশিল্পে ব্যবহৃত প্লাস্টিক হতে পারে কৃত্রিম বা প্রকৃতি থেকে পাওয়া যে কোনো
কঠিন বস্তু। এই জাতীয় কঠিন বস্তুকে কেটে, খোদাই করে বা ঢালাই করে, কাঙ্ক্ষিত অবয়ব
দান করা যায়। এই বিচারে ভাস্কর্যশিলপের প্লাস্টিক হতে পারে প্রাকৃতিক উপাদান- কাঠ, পাথর, মাটি, নানা ধরনের ধাতু ইত্যাদি।
শুরুর দিকে ভাস্কর্যের উপকরণ ছিল পাথর। পরে উপকরণ হিসেবে
যুক্ত হয়েছিল হাতির দাঁত ও অস্থি। এর সাথে ছিল মাটি, কাঠ। মানুষ ধাতুর ব্যবহার
শেখার পর যুক্ত হয়েছিল- নানা ধরনের ধাতু।
ভাস্কর্যের প্রকরণ ভাস্কর্যে গঠন কৌশলের মূল দিক হলো একটি
ত্রিমাত্রিক অবয়বকে সুস্থিরভাবে উপস্থাপন করা। সাধারণত ভাস্কর্য শিল্পী তাঁর
সৃষ্টিকে এমনভাবে তৈরি করেন, যেন শিল্পকর্মটি উলম্বভাবে উপস্থাপন করা যায়। কোনো
বিশেষ আদর্শে কোনো শিল্পী কোনো ভাস্কর্যকে অনুভূমিক বা তীর্যক ভঙ্গিতে তৈরি করতে
পারেন। কিন্তু সেখানেই ত্রিমাত্রিক রূপটিকে প্রাধান্য দিতেই হয়। এক্ষেত্রে কোনো
ভাস্কর্য কোনো বিশেষ তলের উপর ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে, আবার কোনো একক অখণ্ড উপাদনের তৈরি
ভাস্কর্য কারো সাহায্য ছাড়াই উপস্থাপিত হতে পারে। ভাস্কর্য উপস্থাপনের এই
প্রক্রিয়াটি পুরোটাই, ভাস্কর্য কিভাবে উপস্থাপন হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। এই
বিচারে যে কোনো ভাস্কর্যের উপস্থাপনের কৌশলকে দুটি ভাগে
ভাগ করা হয়ে থাকে। এই ভাগ দুটি হলো―
মিকেল্যাঞ্জেলো'র ডেভিড. ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দ।
১. স্ব-নির্ভর উপস্থাপন : ইংরেজিতে এই জাতীয় উপস্থাপনকে বলা হয়
free-standing
।
এই জাতীয় ভাস্কর্যটি অন্যের সাহায্য ছাড়াই উপস্থাপিত হয়। এর ভার ভূমিতে সঞ্চালিত
হয়, এর পাদদেশ দ্বারা। এর আরও একটি অন্যতম
বৈশিষ্ট্য হলো, এর চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। এই কারণে একে অনেক সময় বলা হয়-
sculpture
in the round
। ফলে
সত্যিকারের ত্রিমাত্রিক রূপটি পাওয়া যায়, এই জাতীয় উপস্থাপনের মাধ্যমে। [উদাহরণ : ১৫০৪
খ্রিষ্টাব্দে মিকেল্যাঞ্জেলো'র তৈরি ডেভিড নামক মূর্তি।]
২. পর-নির্ভর উপস্থাপন : এই জাতীয় উপস্থাপনে একটি প্রেক্ষাপট থাকে এবং এর
উপরে ভাস্কর্যটি থাকে। ভাস্কর্যের পরিভাষায় একে বলা হয়
(রিলিফ)।
ল্যাটিন ক্রিয়াপদ
levo
(উত্থিত করা) থেকে বর্তমান
relief
শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে
একটি প্রেক্ষাপটকে খোদাই করে কোনো অবয়বকে উপস্থাপন করা হয় এবং এই অবয়বটি ওই
প্রেক্ষাপটের সাথে যুক্ত থাকে এবং পুরো অবয়বের ভার বহন করে। অবয়বকে ভালোভাবে
উপস্থাপনের জন্য এক্ষত্রের প্রেক্ষাপটকে সমতল করা হয়।
ভাস্কর্য তৈরির প্রক্রিয়া
ভাস্কর্য নানাভাবে তৈরি যায়। বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করে ভাস্কর্যের জন্য নির্বাচিত
উপাদানের উপর। যে সকল পদার্থ গলিয়ে নতুন রূপ দেওয়া যায় না, সে সকল পদার্থ দিয়ে
ভাস্কর্য তৈরি করার ক্ষেত্রে, খোদাই বা ছাঁটাই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন- পাথর,
হাতির দাঁত। কিন্তু কাঠের মতো সামগ্রীতে খোদাই করে বা বাইরে থেকে উচ্চ চাপে ছাপ
ফেলে ভাস্কর্য তৈরি করা যায়। তার বা এই জাতীয় নমনীয় পদার্থকে বিভিন্ন রূপ দিয়ে
ভাস্কর্য করা যায়। আবার ধাতু, সিমেন্ট জাতীয় পদার্থের ঢালাই করে ভাস্কর্য তৈরি করা
যায়। ভাস্কর্য তৈরির এই সকল প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন‒
মোরাভানি'র ভেনাস:
২৪থেকে ২২ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
ক্রো-ম্যাগনানদের দ্বারা
সৃষ্ট পাথুরে
ম্যামোথের দাঁত দিয়ে তৈরি ভেনাসের মূর্তি।মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছে
স্লোভাকিয়ার
মোরাভানির মূর্তি।
ব্রাসেম্পোয়ি'র ভেনাস
২৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
দিকেক্রো-ম্যাগনানদের
দ্বিতীয়
স্তরের গ্রাভিটিয়ান
সভ্যতা.
ম্যমোথের দাঁতের উপর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল নারীমূর্তি।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে এটি পাওয়া
গিয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের
ব্রাসেম্পোয়ি অঞ্চলে।
গাগারিনো'র ভেনাস ২২-২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
দিকেক্রো-ম্যাগনানদের
দ্বিতীয়
স্তরের গ্রাভিটিয়ান
সভ্যতার
রাশিয়ায় প্রাপ্ত ৮টি ভেনাস।
আভ্ডিভো ভেনাস :
২১-২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
ক্রো-ম্যাগনানদের
দ্বিতীয় স্তরের গ্রাভিটিয়ান সভ্যতার রাশিয়ার আড্ডিভো অঞ্চলের ভেনাস।
জারায়িস্ক ভেনাস:২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
ক্রো-ম্যাগনানদের
দ্বিতীয় স্তরের গ্রাভিটিয়ান সভ্যতার রাশিয়ায় প্রাপ্ত ভেনাস।
মাল্টা ভেনাস
: ২০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
ক্রো-ম্যাগনানদের
দ্বিতীয় স্তরের গ্রাভিটিয়ান সভ্যতার রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের ভেনাস।
এলিসিভিচি'র ভেনাস:১৪ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকেক্রো-ম্যাগনানদের
তৃতীয়
স্তরের সলুট্রিয়ান
সভ্যতায়
প্রায়
১৪ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ম্যামোথের দাঁত
কেটেকুটে এটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে এটি পাওয়া
গিয়েছিল রাশিয়ার সুডোস্ট নদীর তীরে- এলিসিভিচি প্রত্নক্ষেত্রে।