সিংহ
Lion

প্রাণীজগতের বিড়াল পরিবার তথা ফেলিডি গোত্রের অন্তর্গত প্যান্থেরা গণের প্রজাতি বিশেষ। গণের দুটি উপপ্রজাতি বর্তমানে পশ্চিম আফ্রিকা, উত্তর-মধ্য আফ্রিকা এবং ভারতে পাওয়া যায়।
৫৯.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভিতরে প্যান্থেরিনায়ি উপগোত্র থেকে  এই গণের প্রজাতিসমূহের উদ্ভব হয়েছিল। এই উপবর্গের ভিতরে রয়েছে বাঘ, সিংহ, চিতা, তুষার চিতা, জাগুয়ার, কালো প্যান্থার, সাদা প্যান্থার।

প্যান্থেরা গণের আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়ার উত্তরাঞ্চল। Panthera blytheae-কে এই গণের প্রাচীনতম প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়। ৫৯.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এদের আবির্ভাব হয়েছিল এবং ৪১ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এদের করোটির গঠন ছিল অনেকটা তুষার চিতার মতো। এই গণ থেকে প্রায় ২৫.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আধুনিক সিংহের আবির্ভাব ঘটেছিল।

যদিও সিংহকে বনের রাজা বলা হয়, কিন্তু সিংহ গভীর জঙ্গলের প্রাণী নয়। এরা ঘাসে ঢাকা আধা-জঙ্গুলের এলাকায় বাস করে। এরা শিকারকে খোলা প্রান্তরে দলবদ্ধভাবে শিকার করে। বাঘের মতো এরা এককভাবে খুব বড় প্রাণীকে শিকার করতে পারে না।

সংখ্যাধিক্যের বিচারে আফ্রিকার বনাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সিংহ দেখা যায়। এর সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০। অন্যদিকে ভারতের গুজরাট অঞ্চলে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহের সংখ্যা ছিল
মাত্র ৪১১টি।

এদের গড় আয় ১৩ বৎসর। তবে কোনো কোনো সিংহ প্রায় ২৩ বৎসর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

পুরুষ সিংহের ওজন হয় ১৫০ এবং ২৫০ কিলোগ্রাম (৩৩০ এবং ৫৫০ পাউণ্ড)। কোনো কোনো সিংহের ২৭০ কেজি (৬০০ পাউন্ড) অবধি হয়ে থাকে। সিংহীদের ওজন  সাধারণত ১২০ থেকে ১৮২ কেজি (২৬৫ থেকে ৪০১ পা) মধ্যে দেখা যায়।  এর গড় দৈর্ঘ্য মাথা থেকে দেহের পশ্চাৎদেশ পর্যন্ত প্রায় ২.৪৭-২.৮৪ মিটার (৮.১-৯.৩ ফুট)।

এদের গায়ের রঙ ধূসর-পিঙ্গল। একমাত্র পুরুষ সিংহের মাথা ও ঘাড় জুড়ে লম্বা ও ঘন চুল দেখা যায়। এগুলোকে কেশর বলা হয়।  বিড়াল প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে একমাত্র সিংহেরই লেজের একেবারে শেষ প্রান্তে পশমের গুচ্ছ দেখা যায়। এই গোছার মাধ্যমে সিংহ দেলর অন্যাদের কাছে বার্তা দিয়ে থাকে।

বিড়াল পরিবারের যত প্রজাতি আছে তার মধ্যে সিংহের গর্জনই সব চেয়ে জোড়ালো। এর গর্জন ১১৪ ডেসিবল পর্যন্ত উঠতে পারে। এই গর্জন রাত্রি বেলা প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেতে পারে। সিংহের ভোকাল কর্ড চতুর্ভুজ আকারের এবং চ্যাপটা হওয়ার কারণে এরূপ জোরালো শব্দ তৈরি হয়ে থাকে।

সিংহ দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। এক একটি দলে দশ থেকে চল্লিশটি পর্যন্ত সিংহ দেখা যায়। প্রত্যেক দলের নিজস্ব অঞ্চল আছে। সিংহ কখনো তাদের অঞ্চলে অন্য মাংসাশী প্রাণী ঢোকা পছন্দ করে না। সংখ্যার বিচারে একটি দল প্রায় ২৬০ বর্গকিলোমিটার (১০০ বর্গমাইল) নিজেদের অধিকারে রাখার চেষ্টা করে।

এরা শিকারের সময় ঘণ্টায় ৫০ মাইল গতিতে দৌড়তে পারে। তবে এই গতিতে এরা বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারে না। তাই শিকারের কাছে গিয়ে এদের আক্রমণ করতে হয়। এরা আক্রমণের সময় সামনের পায়ের থাবা এবং মুখ ব্যবহার করে। আক্রমণের সময় এরা প্রায় ৬৫০ পাউন্ডের জোরালো কামড় বসাতে পারে। 

দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণের সূত্রে বিশালকার বন্য মহিষ, জিরাফ, জেব্রা, শুকর ইত্যাদি শিকার করে। অনেক সময় ছোট ছোট হাতিও এরা শিকার করে থাকে। একটি পুরুষ সিংহ দিনে প্রায় ৪০ কেজি মাংস খায়। অন্য দিকে স্ত্রী সিংহের প্রয়োজন হয় ২৫ কেজি।

রাতের অন্ধকারে এরা মানুষের চেয়ে এরা অনেক ভালো দেখতে পারে। দেখার জন্য মানুষের চোখে যত আলোর প্রয়োজন হয় তার ছয় ভাগের এক ভাগ আলোতেই সিংহ দেখতে পায়।

শ্রবণশক্তি অত্যন্ত তীব্র- সিংহের শ্রবণশক্তি অত্যন্ত তীব্র। এরা যেদিক থেকে শব্দ আসে কান সেদিকে ঘোরাতে পারে। ফলে নানা কৌণিক দূরত্বের শব্দ এরা শুনতে পারে।

শিশু সিংহ জন্মের পর অন্ধ থাকে। প্রায় ১ সপ্তাহ বয়সে চোখ খুলতে পারে এবং তবে ভালোভাবে দেখতে শিখতে প্রায় ২ সপ্তাহ লেগে যায়। সিংহ শাবকরা ২ থেকে ৩ বছর বয়সে প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে তরুণী।
 

শ্বেত সিংহ
এটি একটি বিরল ধরনের সিংহ। এটি দক্ষিণ আফ্রিকান সিংহের একটি ধরন। দক্ষিণ আফ্রিকার টিম্বাভাটি অঞ্চলে এরা বাস করছে। স্থানীয়দের মধ্যে এদেরকে ঐশ্বরিক সিংহ হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের সাদা বর্ণ তৈরি হয় এক ধরনের অ্যালবিনিজম সৃষ্টিকারী প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে। শ্বেত সিংহের বর্ণ সোনালী থেকে প্রায় সাদা হতে পারে। এই রঙের পরিবর্তন তাদের টিকে থাকার কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে বলে মনে হয় না।  বর্তমানে এই শ্বেত সিংহ বিভিন্ন চিড়ায়াখানায় প্রতোপালনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।