বাঘ
বৃহৎ বিড়াল পরিবারে প্যান্থেরা গণের একটি প্রজাতি। ১৭৫৮ সালে লিনিয়াস (Linnaeus) এর নামকরণ করেছিলেন Felis tigris । ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী  Reginald Innes Pocock বাঘকে Panthera গণের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন থেকে এর নামকরণ করা হয়- Panthera tigris

সেনোজোয়িক যুগের অন্তর্গত কোয়ান্টারি অধিযুগের প্রথম অন্তঃযুগ প্লেইস্টোসিন অন্তঃযুগ (২৫.৮ লক্ষ -১১.৭ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) শুরুর দিকের একটি বিড়ালসদৃশ প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল চীনে। ১৯২৪ সালে Otto Zdansky এর নামকরণ করেছিলেন Felis paneosinensis। পরে এর নামকরণ করা হয়- Panthera palaeosinensis। প্রথম দিকে ধারণা করা হয়েছিল, এই প্রজাতিটি বর্তমান বাঘের পূর্ব-পুরুষ। আকারের বিচারে বর্তমান বাঘের চেয়ে এই প্রজাতিটি অনেকটাই ছোট ছিল। এদের খুলির দৈর্ঘ্য ছিল ২৬২ মিলিমিটার। ম্যাণ্ডিবলের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৯ মিলিমিটার। এরা দেখতে ছিল অনেকটা জাগুয়ারের মতো। তবে অনেকেই এই প্রজাতিটিকে বাঘের যথার্থ পূর্বপুরুষ হিসাবে স্বীকার করেন না। বাঘের সত্যিকারের পূর্বপূরুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় Panthera tigris trinilensis নামক প্রজাতিটিকে। সাধারণভাবে এই প্রজাতির বাঘকে বলা হয় ট্রিনিল বাঘ (Trinil Tiger, বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris trinilensis)। উল্লেখ্য ট্রিনিল হলো- পূর্ব-জাভার বেঙ্গাওয়ান সোলো নদীর তীরবর্তী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ক্ষেত্র। এখান থেকে এই বাঘের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল বিধায় এর সাধারণ নাম দেওয়া হয়েছিল ট্রিনিল বাঘ। এরা ১২,০০,০০০ বৎসর আগে ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও চীনের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করতো। ধার করা হয় ট্রিনিল বাঘ জাভা বাঘের প্রত্যক্ষ পূর্ব-পূরুষ। প্রায় ৫০ হাজার বৎসর আগে এই বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১১,৭০০ বৎসর পূর্বে বাঘ উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেছিল। এছাড়া একই সময়ে ধীরে ধীরে বাঘ চীন, জাপান, রাশিয়া, তুরস্ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। গত ১০০ বৎসরের ভিতরে এই বিশাল অঞ্চলের ৯৩ ভাগ এলাকা থেকে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

বর্তমানে এই প্রজাতির বিভিন্ন উপপ্রজাতি যে সকল অঞ্চলে পাওয়া যায়
বা পাওয়া যেতো তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো।

 

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার
বাংলাতে সাধারণভাবে বাঘ বলতে
সুন্দরবন-এর বাঘকে আদর্শ ধরা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris tigris। ১৯২৯ সালে এর নামকরণ করেছিলেন- Pocock। এই বাঘ সুন্দরবন ছাড়াও পাওয়া যায় নেপাল ও ভুটান অঞ্চলে। বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় পশু।

দৈহিক গড়ন :
রা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের উর্ধ্বভাগ হলুদ বা হাল্কা কমলা এবং নিচের দিকে সাদা। তবে এর উপ রয়েছে কালো বর্ণের রেখা। এই দাগকে বাংলাতে বলা হয় ডোরাকাটা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২৭০-৩১০ সেন্টিমিটার বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ২৪০-২৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ২০০-২৬০ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ১২০-১৬০ কিলোগ্রাম। খুলির মাপ ৩৩০- ৩৭৫ মিলিমিটার।

এই বাঘের আরও একটি প্রকরণ হলো সাদা বাঘ। এই বাঘ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চিড়িয়াখানা ছাড়া এই বাঘ প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখাই যায় না। এদের মূল বিচরণভূমি ছিল- আসাম, বঙ্গ এবং বিহারের গভীর জঙ্গলে। সুন্দরবনে এদের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নাই।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। সুন্দরবন অঞ্চলে এদের প্রধান শিকার হরিণ, বন্য শুকর খরগো। অন্যান্য অঞ্চলে এদের শিকার তালিকায় রয়েছে- গোজাতীয় প্রাণী, হরিণ জাতীয় প্রাণী, খরগোশ ইত্যাদি। সুযোগ পেলে এরা লেপার্ড, নেকড়ে, শিয়াল জাতীয় শিকারী প্রাণীকেও শিকার করে। একমাত্র বয়স্ক হাতি ও গণ্ডার ছাড়া বাকি সকল প্রাণীকেই এরা শিকার করতে পারে। কিন্তু প্রখ্যাত শিকারি জিম করবেটের বর্ণনানুসারে জানা যায় একবার দুটো বাঘ একটি হাতিকে হত্যা করেছিল। বাঘ সাধারণ দলবদ্ধ মানুষকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু একা পেলে মানুষকে আক্রমণ করে। কখনো কখনো কোনো কোনো বাঘ মানুষের মাংসের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে মানুষ-খেকো বাঘে পরিণত হয়।

এরা শিকারের গলা বরাবর আক্রমণ করে শ্বাসরুদ্ধ করে বা ঘাড় মটকিয়ে হত্যা করে। এরপর কোনো নিরাপদ স্থানে শিকারকৃত প্রাণী টেনে নিয়ে যায়। শিকারের পর এরা প্রায় ১৮-৪০ কেজি পর্যন্ত মাংস গ্রহণ করে। বড় প্রাণী হত্যার পর অবশিষ্ট মাংস এরা লুকিয়ে রাখে।

প্রজনন : পুরুষ বাঘ ৪-৫ বৎসরে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। বাঘিনীর ক্ষেত্রে সময় লাগে ৩-৪ বৎসর। এদের প্রজননকাল নভেম্বর থেকে এপ্রিল। বাঘিনী ১০৪ থেকে ১০৬ দিন গর্ভধারণের পর ১ থেকে ৪টি পর্যন্ত শাবক প্রসব করে। বাঘিনী ঘন ঘাসের বনে, ঝোপে বা গুহায় শাবকদের লুকিয়ে রাখে। এই সময় বাঘিনী পরম যত্নে শাবকদের লালন পালন করে। এই সময় বাঘিনী এতটাই হিংস্র হয়ে থাকে, যে এদের চেয়ে শক্তিশালী বাঘও এদের এড়িয়ে চলে।

জন্মের সময় শাবকগুলোর চোখ এবং কান বন্ধ থাকে।  জন্মের ২-৩ সপ্তাহ পর শাবকদের দুধদাঁত পড়ে এবং এরপর  স্থায়ী দাঁত গজাতে থাকে। ৩-৬ সপ্তাহ পর এরা অল্প অল্প করে মাংস খাওয়া শুরু করে। ৫-৬ মাস পর এরা মায়ের শিকারের সময় অনুসরণ করে এবং মায়ের তত্ত্বাবধানে শাবকরা শিকার করা শিখতে থাকে। ২-৩ বৎসর পর্যন্ত শাবকগুলো মায়ের সাথে বিচরণ করে, এরপর এরা মাতৃ-আশ্রয় ত্যাগ করে নিজেদের স্বাধীন জীবন শুরু করে। এই সময়ের ভিতর বাঘিনী কোনো বাঘের সাথে মিলিত হয় না।

ইন্দো-চীনা বাঘ
Panthera tigris corbetti উপ-প্রজাতির বাঘের সাধারণ নাম ইন্দো-চীনা বাঘ (Indochinese Tiger)  ১৯৬৮ সালে এর নামকরণ করেছিলেন- Mazák। প্রখ্যাত শিকারি এবং বাঘ বিশেষজ্ঞ জিম করবেট (Jim Corbett) -এর নামানুসারে এই উপপ্রজাতির নামকরণ করা হয়। এই বাঘ পাওয়া যায়- কম্বোডিয়া, চীন, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েৎনামে।

দৈহিক গড়ন :রা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের উর্ধ্বভাগ গাঢ় কমলা এবং নিচের দিকে সাদা। তবে এর উপর রয়েছে গাঢ় কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২৫৫-২৮৫ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ২২৫-২৫৫ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ১৫০-১৯০ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ১১০-১৪০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। এরা পাহাড়ী অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে পটু। এরা সাধারণত মধ্যমাকারের গরু জাতীয় প্রাণী, সকল ধরণের হরিণ, বন্য শুকর শিকার করে। এ ছাড়া ছোট প্রাণীর ভিতর খরগো, বনবিড়াল, শিয়াল ইত্যাদিও শিকার করে।

প্রজনন : রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো।
ব্যাপক হত্যার কারণে এই বাঘ বর্তমানে বিপন্ন।

মালয় বাঘ
Panthera tigris jacksoni উপ-প্রজাতির বাঘের সাধারণ নাম মালয় বাঘ (Malayan Tiger) ২০০৪ সালে এর নামকরণ করেছিলেন- Luo et al। এই বাঘ পাওয়া যায়- মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে।

দৈহিক গড়ন : এরা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের উর্ধ্বভাগ গাঢ় কমলা এবং নিচের দিকে সাদা। তবে এর উপর রয়েছে গাঢ় কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। সকল প্রকার জীবিত বাঘের ভিতরে এই বাঘ সবচেয়ে ছোট । এদের পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২৩৫ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ১২০-১০০ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ১০০-৮০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। এরা সাধারণত মধ্যমাকারের গরু জাতীয় প্রাণী, সকল ধরণের হরিণ, বন্য শুকর, হাতির বাচ্চা শিকার করে। এ ছাড়া ছোট প্রাণীর ভিতর খরগোষ, বনবিড়াল, শিয়াল ইত্যাদিও শিকার করে।

প্রজনন : রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো।

সুমাত্রার  বাঘ
Panthera tigris sumatrae উপ-প্রজাতির বাঘের সাধারণ নাম সুমাত্রার বাঘ (Sumatran tiger)  ১৯২৯ সালে এর নামকরণ করেছিলেন-Pocock।  এই বাঘ পাওয়া যায়- ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে পাওয়া যায়।
 
দৈহিক গড়ন : এরা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের উর্ধ্বভাগ গাঢ় কমলা এবং নিচের দিকে সাদা। তবে এর উপর রয়েছে গাঢ় কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। সকল প্রকার বাঘের ভিতরে ছোট বাঘ হলো মালয় বাঘ। ছোটোর বিচারে সুমাত্রা বাঘ দ্বিতীয় স্থানে। এদের পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২৪৫ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ১২০-১০০ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ১০০-৮০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। আকার এবং ওজন কমের কারণে এরা দ্রুত জঙ্গলের ভিতর চলাচল করতে পারে। এরা পানিতে অত্যন্ত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। এরা সাধারণত মধ্যমাকারের গরু জাতীয় প্রাণী, সকল ধরণের হরিণ, বন্য শুকর, হাতির বাচ্চা শিকার করে। এ ছাড়া ছোট প্রাণীর ভিতর খরগো, বনবিড়াল, শিয়াল, বানর, ওরাংওটাং, মাছ ইত্যাদিও শিকার করে।

প্রজনন : রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো।

সাইবেরিয়ার বাঘ
বিভিন্ন উপ-প্রজাতির বাঘের ভিতর সাইবেরিয়ার বাঘ (Siberian tiger) সবচেয়ে বড়। এর বৈজ্ঞানিক নাম- Panthera tigris altaica ১৮৮৪ সালে এর নামকরণ করেছিলেন-Temminck। এর অন্যান্য নাম আমুর বাঘ, মাঞ্চুরিয়ার বাঘ, আল্টাইক বাঘ, কোরিয়ান বাঘ, উত্তর-চীনের বাঘ। এদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র রাশিয়ার সিখোতে-আলিন (Sikhote-Alin) পার্বত্য এলাকায়। রাশিয়ার পূর্ব সাইবেরিয়া অঞ্চলে এক সময় প্রচুর এই বাঘ ছিল, এই কারণে এই বাঘ সাধারণ মানুষের কাছে সাইবেরিয়ার বাঘ নামে প্রচলিত। প্রায় ১০,০০০ বৎসর আগে পূর্ব চীন থেকে সিল্ক রোডের মাধ্যমে এই বাঘের পূর্ব-পুরুষ মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। এরই কিছু অংশ পূর্ব-সাইবেরিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

দৈহিক গড়ন : এরা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের সামনের দিকের উর্ধ্বভাগের রঙ লালচে কমলা আর পিছনের দিকের উপরের ভাগের রঙ হলদেটে এবং নিচের দিকে সাদা। এর উপর রয়েছে কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। পুরুষ বাঘের মাথা ও শরীরের দৈর্ঘ্য ১৯৫ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ১৬০ সেন্টিমিটার। পুরুষ বাঘের লেজের দৈর্ঘ্য ৯৯ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর লেজের দৈর্ঘ্য ৯১ সেন্টিমিটার।  ওজন পুরুষ বাঘ ২২৭ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ২০০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। এরা সাধারণত সকল ধরনের গরু জাতীয় প্রাণী, সকল ধরনের হরিণ, বন্য শুকর, শিকার করে। এ ছাড়া ছোট প্রাণীর ভিতর খরগো, বনবিড়াল, শিয়াল, বানর, মাছ ইত্যাদিও শিকার করে।

প্রজনন : পুরুষ বাঘ ৪-৫ বৎসরে  প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। বাঘিনীর ক্ষেত্রে সময় লাগে ৩-৪ বৎসর। বৎসরের যে কোনো সময় যৌনমিলন হতে পারে। এই সময় বাঘ ও বাঘিনী ৫-৬ দিন একত্রে বসবাস করে। গর্ভধারণের পর বাঘিনী একাকী জীবনযাপন শুরু করে। তিন থেকে সাড়ে তিন মাস গর্ভধারণের পর দুই থেকে ৬টি বাচ্চা প্রসব করে। বাঘিনী ঘন ঘাসের বনে, ঝোপে বা গুহায় লুকিয়ে রাখে। এই সময় বাঘিনী পরম যত্নে শাবকদের লালন পালন করে

জন্মের সময় শাবকগুলোর চোখ এবং কান বন্ধ থাকে। জন্মের ২-৩ সপ্তাহ পর শাবকদের দুধদাঁত পড়ে, এরপর স্থায়ী দাঁত গজাতে থাকে। ৩-৬ সপ্তাহ পর এরা অল্প অল্প করে মাংস খেতে শুরু করে। ৫-৬ মাস পর এর মায়ের শিকারের সময় অনুসরণ করে এবং মায়ের তত্ত্বাবধানে শাবকরা শিকার করা শিখতে থাকে। ২-৩ বৎসর পর্যন্ত শাবকগুলো মায়ের সাথে বিচরণ করে এরপর এরা মাতৃ-আশ্রয় ত্যাগ করে নিজেদের স্বাধীন জীবন শুরু করে। এই সময়ের ভিতর বাঘিনী কোনো বাঘের সাথে মিলিত হয় না।

কাস্পিয়ান বাঘ
এর সাধারণ নাম কাস্পিয়ান বাঘ (
Caspian tiger)। এর অন্যান্য নাম তুরান বাঘ (Turan tiger) , হাইসেনিয়ান বাঘ (Hyrcanian tiger)। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris virgata। ১৮১৫ সালে এর নামকরণ করেন Illiger। বর্তমানে এটি একটি বিলুপ্ত উপ-প্রজাতিটি। এই বাঘের বিচরণক্ষেত্র ছিল কাস্পিয়ান সাগের পশ্চিম ও দক্ষিণ উপকূল থেকে তুরস্ক ও ইরান পর্যন্ত। অপর দিকে মধ্য এশিয়া থেকে চীনের টাকলা মাকান মরুঅঞ্চল পর্যন্ত এরা বসবাস করতো। ধারণা করা হয়, প্রায় ১০,০০০ বৎসর আগে পূর্ব চীন থেকে সিল্ক রোডের মাধ্যমে এই বাঘের পূর্ব-পুরুষ মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করেছিল।

দৈহিক গড়ন : এদের দেহের উর্ধ্বভাগের রঙ লালচে ছিল কমলা এবং নিচের দিকে সাদা। এর উপর ছিল কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। আকারের বিচারে ছিল সাইবেরিয়ার বাঘের চেয় সামান্য ছোটো।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের বিচারে কাস্পিয়ান বাঘ সাইবেরিয়া বাঘের অনুরূপ ছিল।

দক্ষিণ চীনের বাঘ
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে এই বাঘ পাওয়া যায়। এই কারণের এর সাধারণ নাম দক্ষিণ চীনের বাঘ (South China tiger)। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris amoyensis। ১৯০৫ সালে এর নামকরণ করেছিলেন Hilzheime। এর অন্যান্য নাম আময় বাঘ (Amoy) বা জিয়ামেন বাঘ (Xiamen tiger)। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থ পর্যন্ত হংকংসহ সমগ্র দক্ষিণ চীন। বর্তমানে দক্ষিণ পার্বত্য এলাকায় কিছু বাঘ দেখা যায়।  পৃথিবীর ১০টি বিপন্ন প্রাণীর ভিতর এই বাঘকে বিবেচনা করা হয়।

দৈহিক গড়ন : এরা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের সামনের দিকের উর্ধ্বভাগের রঙ লালচে কমলা আর পিছনের দিকের উপরের ভাগের রঙ হলদেটে এবং নিচের দিকে সাদা। এর উপর রয়েছে কালো বর্ণের রেখা। তবে বাংলা বাঘের চেয়ে এই দাগ বেশ ছোটো। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। দৈহিক গড়নের বিচারে বাংলা বাঘ  বা সাইবেরিয়ার বাঘের চেয়ে বেশ ছোট। পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২২০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ১২৫-১৭৫ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ১০০-১২০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : এরা সাধারণত একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকারও করে একা। এরা সাধারণত মাঝারি আকারের গরু জাতীয় প্রাণী, সকল ধরনের হরিণ ও ছাগল জাতীয় প্রাণী বন্য শুকর শিকার করে। এ ছাড়া ছোট প্রাণীর ভিতর খরগো, বনবিড়াল, শিয়াল, বানর, মাছ, পতঙ্গ ইত্যাদিও শিকার করে। এরা ঘন্টার পর ঘন্টা শিকারকে অনুসরণ করে। হাল্কা শরীর এবং আকারে ছোটো হওয়ার জন্য বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারে। এদের গড় দৌড়ের গতি ৩৫ মাইল/ঘণ্টা। কিন্তু এই গতিতে এরা দীর্ঘ সময় দৌড়াতে পারে না। সে কারণে দ্রুত গতির হরিণ অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা পায়। অন্যান্য বাঘের চেয়ে মানুষ খেকো হিসাবে এই বাঘের দুর্নাম বেশি।

প্রজনন : রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো।

বালির বাঘ
ইন্দোনেশিয়ার বালি নামক দ্বীপের বাঘ। বালি ভাষায় বালির বাঘ (Bali tiger) বলা হয় স্যামং। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris balica। ১৯১২ সালে এর নামকরণ করেছিলেন Schwarz। এই বাঘটিকে বর্তমানে বাঘের বিলুপ্ত উপ-প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর সর্বশেষ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে।

দৈহিক গড়ন : এরা চতুস্পদী, পায়ের গড়ন বিড়াল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো। এদের দেহের উপরিভাগের রঙ লালচে হলুদ বর্ণের, নিচের দিকে সাদা। এর উপর উলম্ব কালো বর্ণের রেখা রয়েছে। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। এ যাবৎকালে যত ধরনের বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে- তাদের ভিতর সবচেয়ে ছোট আকারে বাঘ হলো- বালির বাঘ। পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২২০-২৩০ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ছিল ১৯৫-২০০ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ৯০-১০০ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ৬৫-৮০ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : আকারে ছোট হওয়ার কারণে এরা সাধারণত মাঝারি আকারের পশু শিকার করতো। এদের প্রধান শিকার ছিল বিভিন্ন ধরনের হরিণ, বন্য শুকর, বন মোরগ, বৃহৎ জঙ্গল গিরগিটি, খরগোশ ইত্যাদি। বালি দ্বীপে এদের একমাত্র হত্যাকারী ছিল মানুষ।

প্রজনন :এদের গর্ভধারণ কাল ছিল ১৪-১৫ সপ্তাহ। প্রতিবার ২-৩টি বাচ্চা প্রসব করতো। জন্মের সময় বাচ্চাদের ওজন হত ২-৩ পাউন্ড। জন্মের সময় বাচ্চাগুলো অন্ধ থাকতো। ১৮-২৪ মাস পর্যন্ত মায়ের সাথে সাথে বাচ্চাগুলো থাকতো। এরপর এরা স্বাধীন জীবন বেছে নিত। এদের জীবনকাল ছিল- ৮-১০ বৎসর।

 জাভার বাঘ
ইন্দোনেশিয়ার জাভা নামক দ্বীপের বাঘ। সাধারণ নাম জাভার বাঘ (Javan tiger)। এর বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris sondaica। ১৮৪৪ সালে এর নামকরণ করেছিলেন Temminck। এই বাঘটিকে বর্তমানে বাঘের বিলুপ্ত উপ-প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অষ্টাদশ শতকে জাভা অঞ্চলে এই বাঘ সংখ্যায় অনেক ছিল। পরে এই অঞ্চলে ক্রমে ক্রমে মনুষ্য বসতির হার বাড়তে থাকলে এই বাঘের চারণক্ষেত্রে এবং শিকারের ঘাটতি দেখা দেয়। একই সাথে ব্যাপক নিধনের ফলে এই বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যায়।

দৈহিক গড়ন : এদের দেহের উপরিভাগের রঙ ছিল লালচে হলুদ বর্ণের, নিচের দিকে ছিল সাদা। এর উপর ছিল উলম্ব কালো বর্ণের রেখা। লেজে এই দাগ বলয়ের মতো। এ যাবৎকালে যত ধরনের বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের ভিতর সবচেয়ে ছোট আকারে বাঘ হলো বালির বাঘ। এই বাঘ বালি বাঘের চেয়ে একটু বড়। পুরুষ বাঘের লেজসহ দৈর্ঘ্য ২০৫-২৪৫ সেন্টিমিটার। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৫-২২৫ সেন্টিমিটার। ওজন পুরুষ বাঘ ১০০-১৪১ কিলোগ্রাম, বাঘিনী ৭৫-১১৫ কিলোগ্রাম।

শিকার এবং আহার : আকারে ছোট হওয়ার কারণে এরা সাধারণত মাঝারি আকারের পশু শিকার করতো। এদের প্রধান শিকার ছিল বিভিন্ন ধরণের হরিণ, বন্য শুকর, বন মোরগ, বৃহৎ জঙ্গল গিরগিটি ইত্যাদি।


তথ্যসূত্র :
http://bigcatrescue.org
http://animals.nationalgeographic.com/

http://www.indiantiger.org/
http://www.theanimalfiles.com/mammals/carnivores/tiger.html
http://www.white-tigers.org/
en.wikipedia.org/wiki/Tiger