নজরুলসঙ্গীতের
কালানুক্রমিক সূচি
চতুর্থ পর্ব
২০ বছর অতিক্রান্ত বয়স নজরুলের সাহিত্য-চর্চার সূচনা
এবং পল্টন থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন
১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার ২৪শে মে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ১৯ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছিল। আর তাঁর ২০ বৎসরে বয়সের সূচনা হয়েছিল, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (রবিবার ২৫শে মে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। আর ২০ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (শনিবার ২৪শে মে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ)।
হাবিলদার-বেশে নজরুল। |
উল্লেখ্য এই কবিতাটি পরে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ (১৯৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত ' নির্ঝরঝর' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ , ১৯৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।'...কবি নজরুলের প্রথম কবিতা 'ক্ষমা' নামে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ছাপার জন্য করাচী হইতে তিনি আমার নিকট পাঠাইয়া দেন। আমি উক্ত কবিতা, 'ক্ষমা'র পরিবর্তে 'মুক্তি' নাম দিয়া ১৩২৬ সনের শ্রাবণ মাসে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'য় প্রকাশ করি। ইহাই নজরুলে ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা।'
'By the by আপনারা যে 'ক্ষমা' বাদ দিয়ে কবিতাটির 'মুক্তি' নাম দিয়েছেন, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এই রকম দোষগুলি সংশোধন করে নেবেন। বড্ড ছাপার ভুল থাকে, একটু সাবধান হওয়া যায় না কি? আমি ভালো, আপনাদের কুশল সংবাদ দিবেন।' [দেখুন: মূল পত্র]এই পত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি একটি লম্বা চওড়া ‘গাথা’ আর একটি ‘প্রায় দীর্ঘ’ গল্প পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় (কার্তিক সংখ্যা) প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
'...নজরুলের দ্বিতীয় গল্প 'স্বামী-হারা' প্রকাশিত হয় প্রথম বর্ষ দশম সংখ্যা, ভাদ্র, ১৩২৬ সনের 'সওগাতে'...।
কবিতা-সমাধি: সওগাত। আশ্বিন ১৩২৬ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯১৯)। কবিতাটি কোনো কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় নি। এটি বর্তমানে 'অগ্রন্থিত কবিতা' হিসেবে নজরুল রচনাবলীতে পাওয়া যায়।অক্টোবর ১৯১৯ (১৪ আশ্বিন- ১৪ কার্তিক ১৩২৬)২৬)
'...তাঁহার প্রথম গদ্য লেখা ছোটগল্প 'হেনা' আমিই ছাপাইয়াছিলাম ১৩২৬ সনের কার্তিক মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়'।প্রকৃতপক্ষে নজরুলের রচিত প্রথম গদ্য রচনা- ' বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সওগাত পত্রিকার 'জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬' সংখ্যায় এবং এই পত্রিকার দ্বিতীয় গদ্য রচনা স্বামীহারা' প্রকাশিত হয়েছিল সওগাত পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৬ (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯১৯) সংখ্যায়।
'প্রবাসী'তে বেরিয়েছে ' সবুজপত্র '-এ পাঠানো কবিতা, এতে কবিতার মর্যাদা বেড়েছে কী কমেছে, তা আমি ভাবতে পারছি না। ' সবুজপত্র'-এর নিজস্ব আভিজাত্য থাকলেও ' প্রবাসী'র মর্যাদা একটুকও কম নয়। প্রচার আরও বেশি। তা ছাড়া আমি কবিতা লিখেছি, পারসিক কবি হাফেজের মধ্যে বাংলার সবুজ দূর্বা ও জুঁই ফুলের সুবাস আর প্রিয়ার চূর্ণ কুন্তলের যে মৃদু গন্ধের সন্ধান আমি পেয়েছি, সে-সবই তো খাঁটি বাংলার কথা, বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আনন্দরসের পরিপূর্ণ সমারোহ। কত শত বছর আগের পারস্যের কবি, আর কোথায় আজকের সদ্য শিশির-ভেজা সবুজ বাংলা। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের রুক্ষ পরিবেশে মৃত্যু সমারোহের মধ্যে বসে এই যে চিরন্তন প্রেমিক-মনের সমভাব আমি চাক্ষুস করলাম আমার ভাষায়, আমার আপন জন বাঙালিকে সেই কথা জানাবার আকুল আগ্রহই এই এক টুকরো কবিতা হয়ে ফুটে বেরিয়েছে। জানি না জুঁই ফুলের মৃদু গন্ধ ও দূর্বা শ্যামলতা এর মধ্যে ফুটেছে কি-না। তবু বাঙালির সচেতন মনে মানুষের ভাব জীবনের এই একাত্মবোধ যদি জাগাতে পারে তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। অবশ্য বাঙালির কাছে পৌঁছে দেওয়ার ও যোগ্য বাহনে পরিবেশন করবার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার। ...'
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে এই চিঠির একটি জবাব দিয়েছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের 'চলমান-জীবন' গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে ছাপা হয়েছে। চিঠিটি হলো-
'....চুরুলিয়ার লেটুর দলের গান লিখিয়ে ছোকরা নজরুলকে কে-ই বা এক কানাকড়ি দাম দিয়েছে! স্কুল-পালানো ম্যাট্রিক পাশ-না-করা পল্টন-ফেরত বাঙালি ছেলে কী নিয়েই-বা সমাজে প্রতিষ্ঠার আশা করবে! আমার একমাত্র ভরসা মানুষের হৃদয়। হয়তো তা আগাছা বা ঘাসের মতো অঢেল খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলা দেশে তা যে দুর্লভ নয়, তার প্রমাণ আমি এই সুদূরে থেকেও পাচ্ছি। নিঃসঙ্কোচে ও নির্বিকারে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু মন দেওয়া যে স্থান-কাল দূরত্বের ব্যবধান মানে না, তাও উপলব্ধি করছি। ...'
ফেব্রুয়ারি ১৯২০ (১৮ মাঘ- ১৮ ফাল্গুন ১৩২৬)
এই মাসে নজরুল করাচি সেনানিবাসে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাঙালি পল্টনের
প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। তাই ব্রিটিশ সরকার 'বাঙালি পল্টন' ভেঙে
দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই কারণে নজরুল দেশে ফেরার প্রস্তুতিতে সময় কাটান। করাচি
থেকে শৈলজানন্দকে
চিঠিতে জানান-
'...পুরো একটি মাস পরে বেগুনীরঙের কালিতে লেখা একখানি চিঠি পেলাম। নজরুল লিখেছে, তাদের ঊনপঞ্চাশ বায়ুগ্রস্ত বাঙালী পল্টন ভেঙে দেবার কথা চলেছে। ভেঙেই যদি দেয় তো-'বল মা তারা দাঁড়াই কোথা?' আমার সেই পাশ বালিশটা ঘাড়ে তুলে নিয়ে সোজা উঠব গিয়ে তোমার আস্তানায়। তারপর যা থাকে কপালে!'
[সূত্র: 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে'/শৈলজানন্দ।]
এই মাসে তাঁর রচিত
বা প্রকাশিত
কোনো রচনার সন্ধান পাওয়া যায় না।
যুদ্ধ-ফেরত নজরুল ইসলাম। |
আমাদের হোস্টেলে 'অতিথি' হয়ে থাকার কোনও আপত্তি ছিল না। গেস্ট চার্জ মাসের শেষে দিতে হয়। তার ওপর একখানা ফাঁকা সিটও পাওয়া গেছে আমাদের সিটের পাশেই। আনন্দের হাট বসে গেল আমাদের 'রুমে"। নজরুলের সেই মন-মাতানো অফুরস্ত হাসি আর গাঁন, যৌবনোচ্ছল প্রাণের প্রাচুর্য একে একে টেনে আনলে সবাইকে। প্রথমে এলো আমার সেখানকার সহপাঠী বন্ধুরা, তারপর এলেন বয়স্ক শিক্ষকের!
তিন চারটে দিন আমরা হোস্টেল ছেড়ে কোথাও গেলাম না। যাবার সময়ই বা কোথায়? গঙ্গায় স্নান আমার তখন বন্ধ হয়ে গেছে। ম্যালেরিয়ার কথা ভূলেই গেছি।'
কিন্তু এই আনন্দঘন দিন বেশিদিন বজায় ছিল না। হোস্টেলে আসার তিন-চার দিনের মাথায়-
হোস্টেলের সুপারেন্টেড শৈলজানন্দকে জানান যে, নজরুল মুসলমান বলে হোস্টেলের চাকরা
তাঁর এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করছে। তাছাড়া নজরুলের অবস্থানে মেসের অন্যান্য বাসিন্দার
মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। এরপর
শৈলজানন্দ কলকাতার ২০, বাদুরবাগান রো (১ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিট)-তে অবস্থিত
তাঁর মাতামহের একটি খালি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু নজরুল সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে,
৩২ কলেজ স্ট্রিটের '
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'
অফিসে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। পরে
শৈলজানন্দ
তাঁকে '
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র
অফিসে পৌঁছে দিয়ে যান।
মোজাম্মেল হক-এর মত
করাচি থেকে কলকাতায় আসা এবং
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র
অফিসে থাকার ব্যবস্থা সম্পর্কে
মোজাম্মেল হক, তাঁর 'নজরুল ইসলাম ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি' প্রবন্ধে
একটু অন্যভাবে উল্লেখ করেছেন। এই প্রবন্ধে নজরুল যে প্রথমে
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নতুন হোস্টেলে
উঠেছিলেন, তার উল্লেখ নেই। তিনি লিখেছেন-
মুজাফ্ফর আহমদের মত'করাচী সেনানিবাস যখন ভেঙে দেওয়া হয় তখন কাজী নজরুল ইসলাম আমাকে পত্র লেখেন: আমাদের সেনানিবাস ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমি বাঁধনহারা, আমার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কোথায় যাব, কিছুই ঠিক করতে পারছি না।
পত্রোত্তরে আমি জানাইলাম "আপনি করাচী হইতে সোজা কলকাতার ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আপিসে আসিয়া উপস্থিত হন। সেখানে আমার একটি বিশ্রামের কামরা আছে। সেখানে আপনাকে থাকিতে দিব।...
...এই সময় কবি নজরুল ইসলাম ১০ জন সৈনিক ও তাঁহাদের কীট ব্যাগসহ সাহিত্য সমিতির আপিসে আসিয়া হাজির হন। তাঁহারা তাঁহাদের মালপত্রাদি দিয়া সাহিত্য সমিতির পাঠাগার বোঝাই করিয়া ফেলেন। ইহা দেখিয়া আমি কাজী নজরুল ইসলামকে বলিলাম: "কাজী সাহেব, আপনি এসব কি করিয়াছেন। আপনাকে একা আসিতে লিখিলাম, আপনি এতগুলি লোক লইয়া আসিয়া আমার পাঠাগার বন্ধ করিয়া দিলেন।" তিনি উত্তরে বলিলেন: "ভয় পাবেন না, এরা আমার বন্ধু। দু' একদিন পর ওরা সবাই যাবে। আমি একা থাকব।"
মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের মত'...নজরুল ইসলামও কলকাতায় ফিরে এলো এই মার্চ মাসে। আমি আমার 'কাজী নজরুল প্রসঙ্গে' নামক পুস্তকে লিখেছি 'আগেকার কথা মতো নজরুল তার গাঁটরি-বোচকা নিয়ে সোজা ৩২, কলেজ স্ট্রীটের সাহিত্য সমিতির অফিসে এসে উঠল।" এখন এত বছরের পরে দেখতে পাচ্ছি এই কথাটা পুরো সত্য নয়, আধা সত্য মাত্র। নজরুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশন হতে সোজাসুজি ৩২, কলেজ স্ট্রীটের সাহিত্য সমিতির আফিসে চলে আসেন নি। আমি ভেবেছিলেম সে তাই করেছে। শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে" নামক স্মৃতিকথা প্রকাশিত হওয়ার পরে এখন জানতে পারছি যে বেঙ্গলী রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার পরে নজরুল ইসলাম কলকাতায় এসে প্রথমে রামকান্ত বোস স্ট্রীটে শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বোডিং হাউসে এসে উঠেছিল। তিন চার দিন সেখানে সে ছিলও। তার পরে বোডিং হাউসের চাকর জানতে পারে যে নজরুল মুসলমান। সে তার এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করে। তখন শৈলজানন্দ নজরুলকে ২০, বাদুড়বাগান রো'তে (এখন ১, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রীট) তাঁর মাতামহের একটি খালি বাড়ীতে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু সে ৩২, কলেজ স্ট্রীটেই যেতে চাইল। শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সেখানে তাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা ভাবলাম শৈলজানন্দ বুঝি নজরুলকে রেলওয়ে স্টেশন হতে নিয়ে এসেছেন। আশ্চর্য এই যে শৈলজানন্দ কোনো৷ দিন আমায় রামকাস্ত বোস স্ট্রীটের ঘটনার কথা জানান নি, যদিও আমাদের পরিচয় খুবই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। নজরুল ইসলামও কোনো দিন ঘুণাক্ষরেও এই ঘটনার কথা আমায় বলেনি। দু'একবার কেউ কেউ আমায় এই ঘটনার কথা জিজ্ঞাসাও করেছেন । আমি তা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছি।'
'নজরুলের সঙ্গে তখনও আমার সাক্ষাৎকার ঘটে নি। চিঠিপত্রের মাধ্যমেই যেটুকু পরিচয়। তাঁর চেহারা-ছবি সম্পর্কেও কোনো ধারণা ছিল না। সে সময়ে -সম্ভবত ১৩২৬ সালেই হবে, একদিন মিলিটারী ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায়ই নজরুল এসে 'সওগাত' অফিসে হাজির হলেন। 'সওগাত' অফিস ছিল কলকাতার বহুবাজার স্ট্রিটে। স্টেশন থেকে তিনি সোজা 'সওগাত' অফিসেই এসে উঠেছিলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, করাচী থেকে কলকাতা চলে এলাম। এখন যুদ্ধ থেমে গেছে, অতএব অফুরন্ত ছুটি। কলকাতায় থেকে মনপ্রাণ দিয়ে সাহিত্য-চর্চা চলবে। দু'এক কথার পর বললেন আমি এখান থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে যাব।...'
৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অপিস
নানা জনের নানা মত শেষে চূড়ান্তভাবে জানা যায় যে, নজরুল শেষ পর্যন্ত '৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির
অফিসে
আশ্রয় পেয়েছিলেন।
৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের
বঙ্গীয় সাহিত সমিতির
অফিস। |
মোজাম্মেল হক ও
মুজাফ্ফর আহমদ
এর লেখা থেকে '৩২ নং কলেজ স্ট্রীটস্থ '
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'
সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির
আপিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো- ৪৭/১ নম্বর মীর্জাপুর সড়কস্থ বাড়ির নিচ তলার একটি
ছোট ঘরে। মাসিক ভাড়া ছিল ২ টাকা। এই ঘরে
মোজাম্মেল হক
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র ফ্রি রিডিং লাইব্রেরি স্থাপন
করেছিলেন। ক্রমে ক্রমে লাইব্রেরির সদস্য ও পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ৩২ নম্বর
কলেজ স্ট্রিটের ২/৩ কে শীল, এল. এম. এস-এর দোতলার সামনের দিককার বারান্দা-সহ
দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল মাসিক ৬০ টাকায়। এই বাড়ির এই অংশটি বাড়ীর অন্য অংশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।
অফিসে প্রবেশের জন্য রাস্তা থেকে ওপরে উঠে আসার সিঁড়ি ছিল।
সামনের দিককার দু'খানা ঘরের একখানায় ছিল সাহিত্য সমিতির আফিস। আর একখানা ঘর সাহিত্য
সমিতির নিকট হতে মাসিক ২২টাকা হিসেবে ভাড়া নিয়েছিলেন
আফজাল-উল হক সাহেব। উল্লেখ্য,
৩ নম্বর কলেজ স্কোয়ারে কুমিল্লার
আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গ যুক্ত মালিকানায়
আফজাল-উল হক সাহেবের পুস্তকের দোকান ছিল। তার নাম ছিল-
"মোসলেম পাবলিশিং" হাউস।'
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে নজরুল
মুজাফ্ফর আহমদ সাহিত্য সমিতির বাড়ীতে বাস করা
শুরু করেছিলেন ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে।
এই বাড়িতে নজরুল এবং মুজফ্ফর আহমদ একই ঘরে থাকা শুরু করেন মার্চ মাস থেকে। নজরুলের
এই ঘরে বসবাসের আগে এখানে থাকতেন
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। উল্লেখ্য
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
১৯১৯ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
মুজাফ্ফর আহমদ
সাথে বাস করা শুরু করেন। এরপর তিনি ফিয়ার্স লেনে একটা মেডিকেল ছাত্রাবাসের
সুপারেন্টেন্ডের দায়িত্ব পান। এই কারণে তিনি এই আবাস ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর ছেড়ে
যাওয়া জায়গা পেয়েছিলেন নজরুল ইসলাম।
এই সময় নজরুলের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের
একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়-
মুজাফ্ফর আহমদ
তাঁর ' কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে [পৃষ্ঠা: ৪৪] লিখেছেন-
'আমি সাহিত্য সমিতির আফিসের পাশের দিককার একখানা ঘরে থাকতাম। সেই ঘরেই নজরুল ইসলামের জন্যে আর একখানা তখ্ৎপোশ পড়ল। কৌতুহলের বশে আমরা তার গাঁটরি-বোচকা-গুলি খুলে দেখলাম। তাতে তার লেপ তোশক ও পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল। সৈনিক পোশাক তো ছিলই, আর ছিল শিরওয়ানি (আচ্কান), ট্রাউজার্স ও কালো উচু টুপি যা তখনকার দিনে করাচির লোকেরা পরতেন। একটি দূরবীনও (বাইনোকুলার ) ছিল। কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি, ইত্যাদিও ছিল। পুস্তকগুলির মধ্যে ছিল ইরানের মহাকবি হাফিজের দিওয়ানের একখানা খুব বড় সংস্করণ। তাতে মূল পার্সি প্রতি ছত্রের নীচে উর্দু তর্জমা দেওয়া ছিল। অনেক দিন পরে আমারই কারণে নজরুল ইস্লামের এই গ্রন্থখানা, আরও কিছু পুস্তক, কিছু চিঠি-পত্র, অনেক দিনের পুরানো কবিতার খাতা, বিছানা, কিট ব্যাগ সুটকেস্ এবং 'ব্যথার দান' পুস্তকের উৎসর্গে বণিত মাথার কাঁটা খোয়া যায়। মিউজিয়মে রক্ষিত মূল্যবান বস্তুর মতো নজরুল এই কাঁটাটিও রক্ষা করে আসছিল। উৎসর্গে লেখা আছে-
"মানসী আমার !
মাথার কাটা নিয়েছিলুম বলে
ক্ষমা করনি,
তাই বুকের কাটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করলুম।"...;
মুজফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থ [পৃষ্ঠা: ৪৪-৪৫]
থেকে জানা যায়, ৩২ নম্বর
কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে নজরুল এসেছিলেন, সেদিনই সকলের অনুরোধে নজরুল 'পিয়া বিনা মোর
জিয়া না মানে' গানটি পরিবেশন করেছিলেন
আফজাল-উল হকের ঘরে।
উল্লেখ্য
আফজাল-উল হক ছিলেন
শান্তিপুরের
কবি
মোজাম্মেল হকের
পুত্র। এই সময়
আফজাল-উল হক
মোসলেম ভারত নামক একটি নূতন পত্রিকা প্রকাশের জন্য বেশিরভাগ সময় ব্যয়
করতেন। কারণ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশের জন্য এপ্রিল মাস নির্ধারিত হয়ে
গিয়েছিল।
আফজাল-উল হকের ঘরে
গানের আসর শেষ হওয়ার পর, নজরুলের সাথে
মোসলেম ভারত পত্রিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এই আলোচনার সূত্রে নজরুল
মোসলেম ভারতে লেখার জন্য রাজি হন। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে [পৃষ্ঠা: ৫৩] লিখেছেন-
এই রাতেই তহ্মীনা বা বাঁধনহারা গল্পটি প্রকাশের চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে [পৃষ্ঠা: ৫৩] লিখেছেন-
এর আগে তার কয়েকটি লেখা অন্যান্য কাগজে ছাপা
হয়েছিল। নজরুল বলল সে একখানা পত্রোপন্যাস লেখা শুরু
করেছে। তার কখানা পত্র সে যে করাচির সেনানিবাস হতে লিখে
এনেছিল একখানা ফুলস্ক্যাপ ফলিও সাইজের খাতা খুলে আমাদের
তা সে দেখিয়েও দিল। আফজালুল হক সাহেব রাজী হলেন যে
পত্রোপন্যাসখানা তিনি তাঁর কাগজে ছাপাবেন। তার পরে নাম
নিয়ে কথা উঠল। নজরুল বলল, 'তহ্মীনা' কিংবা 'বাঁধনহারা' নাম দিতে পারেন। বলা
বাহুল্য আমাদের 'বাঁধনহারা' নামটিই পসন্দ হলো। নজরুল
কেন পুস্তকখানার 'তহমীন' নাম দিতে চেয়েছিল তা জানিনে,
তার পুস্তকে কোনো মেয়ের নাম 'তহমীনা' আছে বলে তো মনে
পড়ছে না। হয় তো নামটি তার কল্পনায় ছিল। পরে সে মত
পরিবর্তন করেছিল।
নজরুল যেদিন এসেছিল সে রাত্রেই তাকে দিয়ে আফজাল
সাহেবের ঘরে আমরা গান গাইয়ে নিয়েছিলেম একথা আমি আগে
বলেছি। মোসলেম ভারতের কিছু কিছু লেখা প্রেসে চলে
গিয়েছিল। পরের মাসেই তো বা'র হবে কাগজখানা। আমার
সম্মুখে সেই রাত্রেই 'মোসলেম ভারতে' লেখা দেওয়ার বিষয়ে
আফজালুল হক সাহেবের সঙ্গে নজরুলের কথাবার্তা হয়ে গেল।
আফজাল সাহেব সে রাত্রে নজরুলের ওপরে কতটা ভরোসা করতে
পেরেছিলেন তা জানিনে, তবে তার কাছ থেকে লেখা তিনি
চেয়েছিলেন।'
করাচি থেকে ফিরে নজরুল
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের
সাথে দেখা করার জন্য তাঁর অফিসে যান এবং তাঁকে না পেয়ে একটি চিঠি লিখে এসেছিলেন। এই চিঠিটি
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক 'চলমান জীবন'
গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখ করেছেন। চিঠিটি ছিল-
৩২ নং কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার পর, তিনি
চুরুলিয়া
গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে সাত-আটদিন কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
মুজাফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থ
থেকে জানা যায়- মায়ের সাথে নজরুলের কিছু বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। তারপর নজরুল
আর চুরুলিয়াতে যান নি। এমন কি মায়ের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ শুনেও তিনি
মায়ের সাথে দেখা করেন নি।
চুরুলিয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে, নজরুল বর্ধমানে নেমে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের
অফিসে সাব-রেজিস্টার পদের জন্য একটি দরখাস্ত জমা দিয়ে এসেছিলেন। উল্লেখ্য সে সময়ে
পল্টন-ফেরত লেখাপড়া জান সৈনিকদের জন্য সরকার চাকরির সুযোগ দিয়েছিল। কলকাতায়
ফেরার পর, নজরুলের নামে সব-রেজিস্টার পদে চাকরির নিয়োগ-পত্র এসেছিল। কিন্তু
আফজাল-উল হক,
মুজাফ্ফর আহমদ-সহ অনেকেই এই চাকরিতে যোগদানে বাধা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই
চাকরিতে নজরুল যোগদান করেন নি।
নজরুল এই সময় আর্থিক সঙ্কটে ছিলেন। এই সময় তাঁর পাশে
বিশেষভাবে দাঁড়িয়েছিলেন
আফজাল-উল হক ও
মুজাফ্ফর আহমদ।
করাচি থেকে পাঠানো নজরুলের রচনাসমূহ
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা,
সওগাত, নূর,
প্রবাসী
ইত্যাদিতে প্রকাশের সূত্রে বীরভূম
জেলার মাড়গ্রামের অধিবাসী মঈনউদ্দীন হোসয়ন (প্রকৃত নাম আবু আজাহার মহম্মদ কবীর)
নজরুলের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জেনেছিলেন যে, নজরুল কলকাতায় এসে
৩২ নং কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে উঠবেন। সম্ভবত
মুজাফ্ফর আহমদ কলকাতায় নজরুলের আগমন এবং
তাঁর আর্থিক অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন। বিষয়টি জানার পর, রেজিস্ট্রি চিঠিতে
মঈনুদ্দীন নজরুলকে ৫০ টাকা পাঠিয়েছিলেন।
৩২ নং কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে নজরুল থাকার সময়, দলে দলে পল্টন-ফেরত সৈনিকরা আসতেন। মুজফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থ [পৃষ্ঠা:
৪৯] থেকে এদের ভিতরে দুজনের নাম পাওয়া যায়। এঁদের একজন ছিলেন শম্ভু রায় এবং
গোপী। এ্ই গ্রন্থ থেকে পল্টনের সাত হাজার সৈনিকের প্রত্যেকেই নজরুল এবং শম্ভু রায়কে
ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তাঁরা নাচে গানে এই বাসস্থানটিকে হট্টগোলের আখড়া বানিয়ে
ফেলেছিলেন। এ নিয়ে বাড়ির মালিক ডা আর কে শীল মোজাম্মেল হকের কাছে অসন্তোষ
প্রকাশ করেছিলেন। মোজাম্মেল হক বিষয়টি নজরুলকে জানালে, তিনি এবং তাঁর দলবল নিয়ে
আরও দ্বিগুণ উৎসাহে গান-বাজনায় মেতে উঠেছিলেন। [সূত্র: নজরুল ও বঙ্গীয় মুসলমান
সাহিত্য সমিতি। মোজাম্মেল হক]
এই মাসে প্রকাশিত গল্প
এপ্রিল ১৯২০ (১৮ চৈত্র -১৭ বৈশাখ ১৩২৭)
এপ্রিল মাসের পুরো সময়ে তিনি প্রায় কর্মহীন অবস্থায় '
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র
অফিসে কাটান। পল্টন-ফেরত সৈনিকরা একে একে নিজ নিজ বাড়িতে চলে গিয়েছিল। অনেকে
সরকারে আমুকূল্যে চাকরিও পেয়ে গিয়েছিল। এরপর নজরুলের আড্ডা জমে উঠেছিল সাহিত্যিকদের
সাথে। আর্থিক অসুবিধার ভিতরেও নজরুলের নিয়মিত আড্ডা দেওয়াতে কোনো খামতি ছিল না। এই আড্ডার সূত্রে তাঁর
বহু সাহিত্যিক বন্ধু-প্রাপ্তি ঘটেছিল। এই সময় এই অফিসে থাকতেন,
আফজাল-উল হক,
কাজী আব্দুল ওয়াদুদ
।
বাইরে থেকে আড্ডায় যোগ দিতে আসতেন-
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়,
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়,
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রমুখ।
এঁদের অনেকে পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যশ্বষী হয়েছিলেন।
মোসলেম ভারতের প্রকাশ ও নজরুলের সঙ্গীত
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের শুরুর দিকে
আফজাল-উল হক
মোসলেম
ভারত নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
তিনি পত্রিকার প্রচার ও প্রসারের জন্য এই পত্রিকার সম্পাদকের নাম হিসেবে
তাঁর পিতা
মোজাম্মেল হকের
নাম ব্যবহার করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকাটির সম্পাদনা থেকে যাবতীয় কর্মকাণ্ড
পরিচালনা করতেন
আফজাল-উল হক। সে সময়ে
কলকাতার ৩ কলেজ
স্কোয়ারে
আফজাল-উল হকের
'মোসলেম পাবলিশিং হাউস' নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা
ছিল। এটি ছিল তাঁর পত্রিকা প্রকাশের জন্য বাড়তি সুবিধা।
আফজাল-উল হক ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। তাই পত্রিকার কাটতির জন্য যেমন
পিতা
মোজাম্মেল হকের
নাম ব্যবহার করেছিলেন। একই সাথে নজরুলের সৃজনশীল রচনার ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি
করে নিয়েছিলেন। পত্রিকার সম্পাদক
মোজাম্মেল হক
সে সময়ে বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয় থাকলেও নজরুল এই পত্রিকা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন।
ফলে এই
মাসের প্রথম থেকেই তিনি এই পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। পত্রিকাটির
প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল
১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল
১৯২০)।
নজরুলের সঙ্গীত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়
এই মাস থেকে তাঁর
সঙ্গীত-জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সূচনা হয়েছিল। নজরুল তাঁর ১৩ বৎসর বয়সে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে লেটোগানের অঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের
মার্চ মাস পর্যন্ত নজরুল গল্প, কবিতা, সমালোচনা
ইত্যাদি প্রকাশিত হলেও নব পর্যায়ের কোনো গান প্রকাশিত হয় নি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি আবার গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি তৎকালীন প্রধান প্রধান গীতিকারদের সারিতে চলে
আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুরু দিকে প্রথম সারির গীতিকারদের তালিকায় ছিলেন-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,
অতুলপ্রসাদ সেন
এবং
রজনীকান্ত সেন।
এরপর এই ধারার সাথে ধীরে যুক্ত হয়েছিলেন- নজরুল,
অজয় ভট্টাচার্য,
প্রণব রায়,
তুলসী লাহিড়ী,
মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে
ধীরে ধীরে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন পঞ্চগীতিকারদের একজন।
নজরুলের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল '
বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও'- যে গানটি দিয়ে।
বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও [তথ্য]এই গানটি ছাড়া এই মাসে নজরুলের রচিত অন্যান্য যে সকল রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো হলো-
নজরুলের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম গান। গানটি তিনি রচনা করেছিলেন, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির' অফিসে বসবাসের সময়ে।সওগাত পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ (এপ্রিল-মে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। শিরোনাম: 'উদ্বোধন'। রাগ: বসন্ত সোহিনী। তাল দাদরা। এই গানের বিষয়ে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন তাঁর 'সওগাত' ও নজরুল প্রবন্ধে লিখেছেন-
যদিও সওগাত পত্রিকায় গানটির তাল 'দাদরা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে গানটি 'তেওরা' তালে গীত হয়ে থাকে।"...সওগাত ২য় বর্ষ, বৈশাখ, ১৩২৭-এ প্রকাশিত হয় নজরুলের 'উদ্বোধন' শীর্ষক একটি গান। গানটি 'বসন্ত সোহিনী-দাদরা' তালে রচিত। এটিই নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গান। গানটি এই: বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও..."।
লেখাগুলো ছিল-
'...নজরুল ইস্লামের নিকটে কবি হাফিজের 'দিওয়ানের' যে একখানা খুব ভালো সংস্করণ ছিল সে কথা আগে বলেছি। একদিন মঈনুদ্দীন সাহেব আর আমি হাফিজের একটি কবিতা নজরুলকে দেখিয়ে দিয়ে-তা বাঙলায় তর্জমা করতে বলি। কবিতাটির প্রথম পংক্তি ছিল-_
"ইউমফ.-ই-গুম্গশতা বাজ আইয়েদ
ব-কিন্আন্ গম্ মথুর"
নজরুল তার তর্জমা করেছিল-
"দুঃখ কি ভাই হারানো ইউসফ্
কিনানে আবার আসিবে ফিরে"।
হতাশা ভোলানোর কবিতা। পুরো কবিতাটি মাসিক কাগজে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু পরে নজরুল তাতে অনেক পরিবর্তন করেছে এবং হাফিজের ভাবাবলম্বনে লিখিত কবিতা হিসাবে তা পুস্তকে স্থান পেয়েছে।'
এই গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল
'মোসলেম
ভারত
' পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ (মে-জুন ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ) সংখ্যায়। এর শিরোনাম ছিল 'বোধন'।
হাফিজের গজল 'য়ুসোফে গম্ গশতা বাজ আয়েদ বৎ-কিন্ আন গম্ মখোর' ভাবছায়া অবলম্বনে
গানটি রচনা করেছিলেন। সুর-নির্দেশ ছিল- যেদিন সুনীল ভারতবর্ষ জলধি হইতে উঠিলে জননি
[দ্বিজেন্দ্রলাল রায়]
[তথ্য]
বিষের বাঁশী
প্রথম সংস্করণে (শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ। আগষ্ট ১৯২৪) গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল '
বোধন
শিরোনামে।
এই নজরুলের ২০ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষদিন পর্যন্ত আবাসস্থল ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিস। এই সময় লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর অর্থ সঙ্কট কিছুটা কেটে গিয়েছিল। মোসলেম ভারত-এর জন্য প্রচুর সময় দিতেন। এর পাশাপাশি নিয়মিত আড্ডা এবং লেখালেখিও চলছিল। তবে নিয়মিত আড্ডার মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছিল। যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তাঁর ২১ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শুরু থেকেই।