চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ইতিহাস

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা।
স্থানাঙ্ক: ২৪°২২  হতে ২৪°৫৭ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭°৫৫`হতে ৮৮°২৩ `পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই চাঁপাই নবাবগঞ্জের নাম, এর বিকাশের সাথে রয়েছে বঙ্গদেশের কালানুক্রমিক ইতিহাসের সাথে।

ঐতিহাসিকভাবে রাজশাহী বিভাগের, রাজশাহী সদর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বৃহত্তর বগুড়া এবং রংপুর বিভাগের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত সমগ্র অঞ্চল হলো বরেন্দ্র এলাকা। এই কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে চাঁপাই নবাবগঞ্জের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে।

একসময় উত্তরবঙ্গের সিংহভাগ এলাকা পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধারণা করা হয়, গঙ্গানদীর পূর্বভাগে পূণ্ড্রবর্ধন ছিল। এর রাজধানীর নাম পুণ্ড্রনগর। বর্তমানে এই স্থানটি মহাস্থানগড় নামে খ্যাত। এই জনপদের দক্ষিণে পদ্মা, পূর্বে করতোয়া (মতান্তরে যমুনা) এবং পশ্চিমে গঙ্গা নদী ছিল। এই বিচারে প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলই পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০ অব্দের দিকে এই অঞ্চল নন্দরাজের শাসনাধীন ছিল। পরো নন্দরাজকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত পাটালীপুত্রের রাজা হন। এই সময় পুণ্ড্রবর্ধন চন্দ্রগুপ্ত-এর শাসনধীনে চলে আসে। গুপ্তবংশের রাজত্বকালে পুণ্ড্রবর্ধন একটি প্রদেশে পরিণত হয়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পুরো পুণ্ড্রবর্ধনকে কয়েকটি বিষয় (জেলা) ভাগ করা হয়। প্রতিটি বিষয় আবার বীথি ও মণ্ডল নামক প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এই সময় পুণ্ড্রবর্ধন শাসিত হতো প্রাদেশিক শাসনকর্তার দ্বারা।

রাজা শশাঙ্ক উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তরাজবংশের শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। গঞ্জামের তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, শশাঙ্ক ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ। ধারণা করা হয়
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গা'র (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে কর্ণসুবর্ণ ছিল।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাজ্য সম্রাট হর্ষবর্ধন ও তাঁর মিত্র কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার অধীনে চলে যায়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে গৌড়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে 'মাৎস্যনায়' নামের শতবর্ষব্যাপী এক অন্ধকার ও অরাজক যুগের সূচনা হয়। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গৌড় রাজ্যে ' মাৎস্যনায়' যুগের অবসান ঘটে এবং পাল রাজবংশের শাসনামল শুরু। এই রাজবংশের প্রথম পাল রাজা ছিলেন গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ)

১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজবংশের উনিশতম রাজা গোবিন্দপাল
সেনরাজবংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লালসেন কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। এরপর পাল সাম্রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় সেন রাজবংশের রাজত্ব।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি,  সেন রাজবংশের তৃতীয় রাজা
লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে নদীয়া জয় করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। এরপর খুব ঘন ঘন শাসক পরিবর্তনের সূত্রে বঙ্গদেশ একটি অস্থির সময়ের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করতে থাকে। এর অবসান ঘটে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহের রাজত্ব লাভের পর। বাংলার এই অস্থির সময়ের ভিতরে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই ১২০৪ থেকে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দের এই সময়কে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শাসনামলে বাংলা ভাষাভাষী ভূখণ্ডের অধিকাংশই ‘বাঙ্গালা’ নামের একক রাষ্ট্রের অধীনে আসে। ১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সুলতান হামজা শাহ  মৃত্যবরণ করেন। এরপর গণেশ নামক একজন জমিদার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। এই সময় শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ নামে একজন নামে মাত্র সুলতান ছিলেন। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সুলতান হন। এই সময় গণেশ ফিরোজশাহকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। এই সূত্রে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এবং শুরু হয় রাজা গণেশের রাজত্বকাল।  ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গণেশ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেব রাজত্ব লাভ করেন।  পরে জালালউদ্দিন মুসলমানদের আমিরদের সহায়তায় মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে সিংহাসন দখল করেন। জালালউদ্দিন পূর্ববঙ্গ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ প্রায় সমগ্র বাংলা অধিকার কৱতে সক্ষম হন। ১৪৩১ 'খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র সামস্‌উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তাঁর কুশাসনে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময় সাদি খাঁ এবং নাসির খাঁ নামক দুইজন আমির তাঁকে হত্যা করেন। পরে এই দুই হত্যাকারী আমির পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং উভয়ই নিহত হন। এরপর অন্যান্য আমিরর ইলিয়াস শাহ বংশের নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসান। এর ফলে ইলিয়াস শাহী বংশের রাত্বকাল দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয়। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন তাঁর পুত্র রুকনদ্দিন বরবক। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বরবক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল চট্টগ্রাম, যশোহর, খুলনা ও বাখেরগঞ্জ অঞ্চলকে নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রুকনদ্দিন-এর পুত্র সামসউদ্দিন রাজত্ব লাভ করেন। তিনি রাজত্ব করেন ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।  

১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দে
মুজফ্‌ফর নামক এক হাবসী  ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু কুশাসনের জন্য বাংলায় আবার ঘোরতর অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই কারণে এদের শাসনামলকেও অন্ধকারযুগ বলা হয়। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাবসি শাসন চলে। এই সময় রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা মুজফ্ফরকে হত্যা করে। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ বসেন।

গৌড় তথা বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ধরা হয় হুসেনশাহী রাজবংশের শাসনকালকে। মধ্যযুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ নরপতি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ বসেন। এর দ্বারা সূচিত হয়েছিল,  হুসেনশাহী রাজবংশের এবং এঁর রাজত্বকালেই(১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলটি গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছি। আর সেই গৌরবের সাক্ষী হিসেবে আজও টিকে আছে গৌড়ের বিখ্যাত ছোট সোনা মসজিদ

১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে  হুসেন শাহ-এর পুত্র মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসন লাভ করেন তাঁর পুত্র নসরৎ শাহউত্তর-পশ্চিম ভারতে মোগলদের ক্ষমতা ক্রমন্বয়ে বৃদ্ধির কারণে নসরৎ শাহ শঙ্কিত ছিলেন। এই সময় মোগলদের দ্বারা বিতারিত আফগানদের নিয়ে তিনি একটি মোগলবিরোধী সংঘ গড়ে তোলেন। তিনি জৌনপুরের লোহানী বংশীয় সুলতান বাহার খাঁ লোহানী, বিহারের শের খাঁ ও লোদী বংশের মাহমুদ খাঁর সাথে যুক্তি করে এই সংঘকে জোরদার করেন।

১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট বাবর পাণিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করে পূর্ব-ভারতের দিকে অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। এই সময় এই সংঘ মোগলদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাবর নসরৎ শাহকে তাঁর আনুগত্যের দাবি করেন। নসরৎ শাহ এই দাবি না মেনে নানাভাবে বাবরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাবর তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে- বাংলার দিকে অগ্রসর হন। ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে উভয় রাজশক্তির মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নসরৎ শাহ পরাজিত হন। এরপর মৌখিকভাবে তিনি বাবরের আনুগত্য স্বীকার করেন।

বাবরের সাথে সন্ধি হওয়ার পর, নসরৎ শাহ অসম রাজ্য আক্রমণ করে। কিন্তু এই যুদ্ধে সুলতানের বাহিনী পরাজিত হয়। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাবরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হুমায়ুন সম্রাট হন। এই সময়  মোগল বিরোধী রাজশক্তিগুলোকে একত্রিত করার জন্য, গুজরাটের বাহাদুর শাহের সাথে পরামর্শ শুরু করেন। কিন্তু ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ।

১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ। ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন।

এই সময় বিহারের লোহানী আমিররা শের শাহ-এর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, শেরশাহকে আক্রমণ করার জন্য সুলতান মাহমুদ শাহকে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। সুরজগড়ের যুদ্ধে শের খাঁ সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর শের খাঁ সমগ্র বিহারের সুলতান হয়ে উঠেন।

১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। প্রথমে তিনি বাংলার কিছু অংশ দখল করেন। এই সময় মাহমুদ শাহ শেরখাঁকে ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সন্ধি করেন। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেরখাঁ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অধিকার করেন। এবং শেষ পর্যন্ত মাহমুদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বাংলা থেকে বিতারিত করেন। এর ফলে বাংলাদেশে হুসেনশাহী রাজবংশের শাসনের অবসান হয়। এরপর শুরু হয় শের শাহ-এর রাজত্ব কাল।  ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসন কর্তা বিদ্রোহ করলে, তা দমন করেন। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য, তিনি বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভাজিত করেন। এই সরকারগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন 'কাজী-ফজল' নামক জনৈক কর্মচারির উপর।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের মৃত্যুর পর, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ সিংহাসন লাভ করেন।

সিংহাসন লাভের পর তিনি নামগ্রহণ করেন ইসলাম খাঁ। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাতে আর কোনো বিদ্রোহ হয় নি। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ ইসলাম খাঁ'র মৃত্যুর পর, বাংলার সুর-শাসক মহম্মদ খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জৌনপুর দখল করেন। এরপর আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলে, ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু তাঁকে বাধা দেন। যুদ্ধে মহম্মদ শাহ পরাজিত হলে, মহম্মদ শাহ আদিল নিজ অনুচর শাহবাজ খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু অচিরেই মহম্মদ খাঁর পুত্র খিজির খাঁ পরাস্ত করেন এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে পরাজিত করে আগ্রার সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর পলায়মান আদিল শাহকে সুরকগড়ের কাছে পরাজিত ও হত্যা করেন। ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর অধিকার করেন। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রথম গিয়াসউদ্দিন মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর, তাঁর এক আমির তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে ১ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কর্‌রানী এই গিয়াজউদ্দিনকে পরাজিত করে বাংলায় কররানী রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করে। এর ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে শেরশাহ সুরি রাজবংশের শাসন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

কর্‌রানী রাজবংশের এই রাজবংশের সুলতান সুলেমান আকবরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে বাংলা তখন ছিল মোগলদের করদ রাজ্য। সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আকবর দাউদকে দমন করার জন্য, সেনাপতি টোডরমল এবং মুনিম খাঁকে পাঠান। এদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের তুকারই সমরক্ষেত্রে। এই যুদ্ধে উভয় বাহিনীই চূড়ান্ত জয়লাভে ব্যর্থ হয়। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দাউদ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর বাংলাতে মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখনও আফগান শাসকরাই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। মুনিম খাঁ-এর মৃত্যুর পর মোগল শিবিরে ভাঙন ধরে। এই সময় অনেকেই মোগল শিবির ত্যাগ করে দিল্লীতে চলে যায়। এই অবসরে মীর্জা হাকিম নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। ক্রমে ক্রমে বাংলা ও বিহার মোগল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্যুত হয়। আকবর মীর্জা হাকিম ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য টোডরমল এবং মানসিংহকে পাঠান। মূল দমনের কাজটি করেন টোডরমল। আর মীর্জা হাকিম-এর সাম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সাথে থাকেন মানিসিংহ। উভয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা আবার মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় ও পাণ্ডুয়া অঞ্চলে মহামারী আকারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে।  এই সময় এই অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু পল্লী ও নগরগুলো জনহীন হয়ে পড়ে।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের বেশিরভাগ এলাকা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। শাহাজাদা মুহম্মদ সুজার (১৬৩১-৫৯ খ্রি) বেশ কিছু কীর্তি চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে। তাঁর কাছারী বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার ফিরোজপুরে। তাঁর সময় গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রঃ) এখানে আসেন। সুবাদার সুজা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান। পরে শাহ নেয়ামতুল্লাহ গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন।।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) পর থেকে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে, বাংলা নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করে। নবাব মুরশিদকুলি খাঁর (১৭১৭-১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সময় বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। এই স্থানান্তরের সময় বর্তমান নবাবগঞ্জ এলাকায় এঁরা বিশ্রাম নিতেন। ফলে এই অঞ্চলে গঞ্জ বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটে। নবাবদের গঞ্জ হিসেবে স্থানটি নবাবগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া সে সময় নবাবগঞ্জ এলাকা নবাবদের মৃগয়াভূমি হিসেবে মুর্শিদাবাদের অভিজাত মহলে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেছিল কথিত আছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সরফরাজ খাঁ (১৭৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দ) একবার শিকারে এসে যে স্থানটিতে ছাউনি ফেলেছিলেন, সে জায়গাটিই পরে নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে (১৭৪০-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে) এই অঞ্চলের নবাবগঞ্জ সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ধারণা করা হয়, সে সময় এর অবস্থান ছিল বর্তমান সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায়।

এই অঞ্চলে ব্যাপক জনবসতি গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে বর্গীর হাঙ্গামার বিরাট ভূমিকা। উল্লেখ্য, ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্গীর হাঙ্গামা শুরু হয় এবং তা ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এই সময় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকজন ব্যাপকভাবে এ এলাকায় এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। এর ফলে স্থানটি এক কর্মব্যস্ত জনপদে পরিণত হয়। কালক্রমে নবাবগঞ্জের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

নবাবগঞ্জ কেন চাঁপাই নবাবগঞ্জ হয়ে উঠলো, এর পিছনে দুটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্প দুটি হলো

১. বর্তমান নবাবগঞ্জ শহর থেকে ৫/৬ মাইল দুরে মহেশপুর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। নবাব আমলে এই গ্রামে চম্পাবতী মতান্তরে 'চম্পারাণী' বা 'চম্পাবাঈ' নামে এক সুন্দরী নৃত্যপটিয়সী বাস করতেন। তাঁর নৃত্যের খ্যাতি আশেপাশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি নবাবদের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। তাঁর নামানুসারে এই জায়গার নাম 'চাঁপাই' হয় । ।

২. এই অঞ্চল রাজা লখিন্দরের বাসভূমি ছিল। লখিন্দরের রাজধানীর নাম ছিল চম্পক। অবশ্য এই চম্পক নগরীর প্রকৃত অবস্থান কোথায় ছিল এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। নবাবগঞ্জ জেলায় চসাই, চান্দপুর, বেহুলা গ্রাম ও বেহুলা নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। বেহুলা নদী বর্তমানে মালদহ জেলায় প্রবাহিত হলেও দেশবিভাগ-পূর্বকালে চাঁপাই, মালদহ জেলার অধীনে ছিল। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ) মনে করেন, বেহুলা তার স্বামীকে ভেলায় নিয়ে মহানন্দার উজান বেয়ে ভেসে গিয়ে ছিলেন। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫-১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) 'বাঙলা সাহিত্যের কথা' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বর্ণিত লাউসেনের শত্রুরা জামুতিনগর দিয়ে গৌড়ে প্রবেশ করে। বর্তমান ভোলাহাট উপজেলার জামবাড়িয়া পূর্বে জামুতিনগর নামে পরিচিত ছিল। এসবের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো গবেষক চাঁপাইকে বেহুলার শ্বশুরবাড়ি চম্পকনগর বলে স্থির করেছেন এবং মত দিয়েছেন যে, চম্পক নাম থেকেই চাঁপাই নামের উৎপত্তি।

তবে অঞ্চলটি চাঁপাই এবং নবাবগঞ্জ মিলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ হয়ে উঠেছিল আরও পরে।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশী নবাব সিরাজদৌল্লা'র পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বীজ রোপিত হয়। এর ফলে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী অংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ যে গুরুত্ব বহন করত, তাতে ভাটা পড়ে।

পলাশীযুদ্ধের পর প্রায় ৮ বছর পরেও উত্তর বঙ্গ কোম্পানির শাসনের বাইরে ছিল। এই সময় মুসলমান ফৌজদার মীর করম আলী এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল ঘোড়াঘাট। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই ফৌজদারের বিরুদ্ধে কোম্পানির সেনাপতি কোর্টিল অভিযান চালায়। এই যুদ্ধে করম আলী পরাজিত হলে, ঘোড়াঘাট-সহ সমগ্র উত্তরাঞ্চল কোম্পানির অধীনে আসে। এই সময় উত্তর বঙ্গের বিস্তৃত কোম্পানির শাসিত  অঞ্চলের প্রশাসনি কেন্দ্র ছিল ঘোড়াঘাট। কোম্পানির শাসনামলে ঘোড়াঘাট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে নতুন প্রশাসনিক শহর হিসেবে দিনাজপুর গড়ে উঠে। কালক্রমে ঘোড়াঘাট হয়ে ওঠে দিনাজপুরের অন্তর্গত একটি প্রশাসনিক এলাকা মাত্র। এই সময় দিনাজপুরের অধীনে ছিল পাবনা, বগুড়া, মালদা, রাজশাহী, রংপুর এবং পূর্ণিয়া জেলার বেশকিছু অংশ। ১৮৫৭-৬১ সালের জরিপ অনুসারে দিনাজপুরের আয়তন ছিল ৪,৫৮৬ বর্গমাইল (১১,৮৮০ বর্গকিমি)।

প্রশাসনিক ও আইন প্রয়োগের সুবিধার্থে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডের জেলার ধাঁচে, জেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই সূত্রে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর থেকে রংপুর ও রাজশাহীকে প্রশাসনিক জেলাতে পরিণত করা হয়। আর ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্ণৌতি, বাজিন্নাতাবাদ, তেজপুর, পানজারা, ঘোড়াঘাট, বারবকাবাদ ও বাজুহা, এই ছয়টি সরকারের অংশ নিয়ে তৈরি হয় ঘোড়াঘাট জেলা গঠিত হয়। তবে এর প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে দিনাজপুর শহরই ব্যবহৃত হতো।

উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের প্রান্তীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর ভিতরে ছিল খুলনা, যশোহর, পাবনা, বগুড়া। এছাড়া রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ এর অধীনে ছিল। এই সময় পূর্ণিয়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পায়। তাই কোম্পানি একটি বিশেষ প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের অন্তর্গত মালদাকে একটি থানায় পরিণত করে। ক্রমে ক্রমে মালদা প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। এই সূত্রে ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণিয়া জেলা থেকে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, কালিয়াচক, গুরগুরিক: রাজশাহী জেলা থেকে রহনপুর ও চাঁপাই নামক স্থান, দিনাজপুর জেলা থেকে মালদা, ইংরেজ বাজার ও বামনগোলা নিয়ে একটি নতুন জেলা তৈরি করা হয়। এই জেলার সদর দফতর করা হয় মালদাকে। প্রথমাবস্থায় এই জেলার থানার সংখ্যা ছিল ৯টি। পরে এর সাথে আরও ১৫টি থানা যুক্ত করা হয়। এই জেলাটি তখন ছিল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এই জেলার নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর ছিল না। ফলে মালদা প্রথম সারির জেলা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ম্যজিস্ট্রেট কালক্টের নিয়োগ দেওয়া হলে, মালদা পূর্ণ জেলায় পরিণত হয়। মালদহ জেলার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ছিলেন র‌্যাভেন শ।

এ সময় শিবগঞ্জ ও কালিয়াচক থানা দুটিকে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। নবাবগঞ্জ তখন শিবগঞ্জ থানার অধীনে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল মাত্র। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সেফ চৌকি শিবগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে নবাবগঞ্জ থানায় উন্নীত হয়। থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই নবাবগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী থানাগুলো নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মহকুমা গঠনের পরিকল্পনা ও প্রয়াস চলতে থাকে। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নবাবগঞ্জ  অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চল বিহারের ভাগলপুরের বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জন ওয়ার্ড কমিশনারের সমন্বয়ে নবাবগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের সময় তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চলটি আবার অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় নবাবগঞ্জ মালদহ জেলার অন্তর্গত ছিল।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাবগঞ্জে সাবরেজিস্ট্রি অফিস স্থাপিত হলে এখানে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি কাজকর্মের সুবিধার জন্য ‘চাঁপাই’ গ্রামে অবস্থিত ডাকঘরটি নবাবগঞ্জ শহরে স্থানান্তর করা হয়। তখন এর নাম রাখা হয় চাঁপাই নবাবগঞ্জ। সে সময় থেকেই নবাবগঞ্জ শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাগের সময় র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে নবাবগঞ্জ এবং তার পার্শ্ববর্তী শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর থানাকে মালদহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শাসন ব্যবস্থার সুবিধার্থে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর রাজশাহী জেলার একটি থানা ও দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত পোরশা থানাসহ একটি নতুন মহকুমার সৃষ্টি হয়। এইসময় নবাবগঞ্জ শহরে মহকুমা সদর দপ্তর স্থাপিত হয় । এই নতুন মহকুমার নাম রাখা হয় ‘নবাবগঞ্জ’। নবাবগঞ্জ মহকুমা ঘোষিত হওয়ার পর প্রথম মহকুমা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আহমদ চৌধুরী, ইপিসিএস (১৯৪৮-১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ)।

 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীর অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক ও স্বতঃস্ফূর্ত। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে পাকবাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়। ১০ই ডিসেম্বর তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা মহানন্দা নদীর অপর পাড় থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য অগ্রসর হন। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামানের নির্দেশে প্রায় পঞ্চাশজন যোদ্ধার এই দলের নেতৃত্ব দেন। মহানন্দা তীরের বারঘরিয়া গ্রামে এসে উপস্থিত হলেও ১৩ই ডিসেম্বরের পূর্বে তিনি নদী পার হয়ে শহরে প্রবেশ করতে পারে ননি। ঐদিন রাতে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর তাঁর বাহিনীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে শহর আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি নিজে একটি অংশের নেতৃত্বে থাকেন এবং সহযোদ্ধাদেরকে নিয়ে গভীর রাতে মহানন্দা পেরিয়ে শহরের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হন। রেহাইচর নামক স্থানে শত্রুসেনাদের সঙ্গে তাঁর লড়াই হয়। বীরদর্পে যুদ্ধ করে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যখন পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদেরকে রণাঙ্গন থেকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করছিলেন, তখনই শত্রুর নির্মম বুলেট এসে তাঁর কপালে বিদ্ধ হয়। শহীদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও সাহসী রণপরিকল্পনার কারণে ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন। শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করা হয়।

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, নবাবগঞ্জ রাজশাহী জেলার মহকুমা হিসেবেই থেকে যায়। ১৯৮২  খ্রিষ্টাব্দে থানাগুলোকে উপজেলা এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করেন। এই সূত্রে নবাবগঞ্জের ৫টি থানাকে (শিবগঞ্জ, নাচোল, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নবাবগঞ্জ সদর) উপজেলায় উন্নীত হয়। আর চাঁপাই নবাবগঞ্জকে জেলায় উন্নীত করা হয়।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ নবাবগঞ্জকে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক মন্ত্রী মেজর জেনারেল এম. শামসুল হক চাঁপাইনবানগঞ্জ জেলা উদ্বোধন করেন। নবাবগঞ্জ জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হন এ. কে. শামছুল হক। তিনি ০১.০৩.১৯৮৪ খ্রিঃ থেকে ০৮.০৮.১৯৮৫ খ্রিঃ পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। জেলাবাসীর দাবির মুখে ২০০১ সালের ১লা আগস্ট সরকারিভাবে নবাবগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাখা হয়।

 


সূত্র :
http://www.chapainawabganj.gov.bd/node/207795
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।