২৬
বৎসর অতিক্রান্ত বয়স
উল্লেখ্য এই দুটি গান মুকুন্দদাসের রচিত 'পল্লীসেবা'
যাত্রাপালার মুদ্রিত পাঠে পাওয়া যায়। মুকুন্দদাসের অনুরোধে তাঁর যাত্রাপালায় নজরুল তাঁর রচিত
কয়েকটি বৈপ্লবিক গান পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি
যাত্রা আসরে গান গাইতে নেমেছিলেন- গেরুয়া রঙের জামা, পাগড়ী পড়ে। ২৫-৩১ মে ১৯২৫ (১১-
১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২) হুগলির গঙ্গাচরায় একটি সভা করেছিলেন। এই সভায় নজরুলের
সাথে গান্ধীজির দ্বিতীয়বার দেখা হয়। নজরুল এই অনুষ্ঠানে গানটি
হারমোনিয়াম সহযোগে গানটি পরিবেশন করেছিলেন। মাহফুজুর
রহমান খান তিনি তাঁর 'কুড়িগ্রামে কবি নজরুল ও নজরুলের সন্নিধানে' প্রবন্ধে
লিখেছেন- '....আজ না-চাওয়া পথ দিয়ে কে এলে,
[সূত্র: 'কুড়িগ্রামে কবি নজরুল ও নজরুলের সন্নিধানে'।
মাহফুজুর রহমান খান। নজরুল স্মৃতিচারণ। নজরুল একাডেমী ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ
১৪০২। পৃষ্ঠা: ১৯৩]
নজরুল ইসলামের ২৬ বৎসর
অতিক্রান্ত বয়স শুরু হয়েছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ (সোমবার ২৫ মে ১৯২৫
খ্রিষ্টাব্দ) থেকে। শেষ হয়েছিল ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩ (সোমবার, ২৪ মে ১৯২৬)
।
এই বছরের শুরু থেকেই নজরুল হুগলীতে সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। অন্যান্য রচনার
পাশাপাশি এই সময় তিনি গানও রচনা করেছেন। এ সকল গানের পিছনে ছিল নানা ধরণের
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এ ছাড়া ছিল তাঁর কিছু শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের
উদ্দেশ্য রচিত শ্রদ্ধার্ঘ। এ গানগুলোর উপলক্ষ ছিল, মহাত্মা গান্ধীর হুগলি আগমন
উপলক্ষে রচিত গান, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে রচিত গান, অমর
নামক এক স্বেচ্ছাসেবকের স্মরণে রচিত গান।এছাড়া ছিল কৃষকদের জন্য গান,
হিন্দু-মুসলামানের জাতি-ভেদের উপর গান। এই বছরেই তাঁর গান প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে
প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিল এইচএমভি। গানটির শিল্পী ছিলেন হরেন্দ্রনাথ দত্ত।
এই বছরের বছরের মাঝামাঝি সময়ে নজরুলের সাথে চারণকবি
মুকুন্দদাসের সাক্ষাৎ হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় তাঁর কাজী নজরুল
গ্রন্থে [ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা-১২, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৩,
পৃষ্ঠা: ৭৯-৮০]
'১৯২৫ সালের মাঝামঝি হুগলিতে বিদ্যামন্দিরের বিপ্লবী
যুবকদের চেষ্টায় "মুকুন্দদাসের যাত্রা" অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল, চকবাজারের
বারোয়ারী তলায়। যাত্রা হয় একাদিক্রমে প্রায় সাত দিন। এই সময় নজরুল ছিলেন তাঁর
চকবাজারের বাড়িতে, সেই সময় মুকুন্দদাশের সাঙ্গের তাঁর শিষ্য কালীকৃষ্ণ য়ট্টও
অভিনয় করতেন'।
এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নজরুল মুকুন্দদাসের অনুরোধে, তাঁর
রচিত 'পল্লীসেবা' যাত্রাপালায় দুটি গান গাইবার অনুরোধ করেছিলেন। নজরুল তাতে সম্মতিও
দিয়েছিলেন। নজরুলের পূর্ব-রচিত- গান দুটি ছিল-
নজরুলের সাঙ্গে মুকুন্দদাসের এই সময় দেখা হয়। নজরুল তাঁদের বিরাট দলবলদের একদিন
নিমন্ত্রণ করেছিলেন। যে কয়দিন মুকুন্দদাস হুগলীতে ছিলেন, সে কয়দিনই তিনি
প্রত্যহ সকাল বেলা নজরুলের বাড়িতে গিয়ে কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে নানা বিষয়ে আলোচনা
করতে করতে করতে মশগুল হয়ে যেতেন।'
দ্রষ্টব্য:
চারণ কবি
মুকুন্দ দাস (রচনা সম্ভার সহ)। জয় গোস্বামী।
মুকুন্দদাসে গ্রন্থাবলী। বসুমতী
সাহিত্য মন্দির
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নজরুলের ২৫ বৎসর অতিক্রান্ত
বয়সের শেষের দিকে গান্ধীজি বঙ্গদেশে আসেন। গান্ধীজির কালানুক্রমিক জীবনী
থেকে জানা যায়, এই বছরের মে-জুন মাস পর্যন্ত তিনি বোম্বে এবং আহমেদাবাদ অঞ্চলে
ছিলেন। গান্ধীজি কলকাতায় এসেছিলেন ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসের ১ তারিখে
(শুক্রবার ১৮ বৈশাখ ১৩৩২)। এরপর
২ মে (শনিবার ১৯ বৈশাখ
১৩৩২)
বৈশাখ তারিখে তিনি চলে যান ফরিদপুরে। সে সময়ে ফরিদপুরের অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কংগ্রেস
অধিবেশনে যোগদান করেন। সময়টা ছিল মে মাসের ২-৩ তারিখে (শনিবার-রবিবার ১৯-২০ বৈশাখ
১৩৩১ বঙ্গাব্দ)। সেখান
থেকে ৫ মে (মঙ্গলবার ২২ বৈশাখ ১৩৩২) আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল
পরিদর্শনের জন্য ৮ মে (শুক্রবার ২৫ বৈশাখ ১৩৩২) কলকাতা ত্যাগ করে মালিকান্দা যান। দীর্ঘ পরিভ্রমণ
শেষে তিনি কলকাতা ফিরে আসেন ২৪ মে (রবিবার ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২) তারিখে।
[সূত্র:
Gandhi 1915-1948/A Detailed of Choronlogy/compiled by C.B.Dalal. First
Edition 1971]
২৬শে মে (মঙ্গলবার ১২ জ্যৈষ্ঠ
১৩৩২), গান্ধীজি হুগলি ভ্রমণ করবেন এমন সিদ্ধান্তের কথা
কংগ্রেস কর্মীদের জানানো হয়েছিল। গান্ধীজির আগমন উপলক্ষে হুগলীর স্থানীয় কংগ্রেস
কমিটি, একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করে। সে সময়ে হুগলী কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক ছিলেন
নগেন্দ্র মুখার্জী। তিনি গান্ধীজির আগমন উপলক্ষে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক
নির্বাচিত হন।
২৫শে মে (সোমবার ১১ জ্যৈষ্ঠ
১৩৩২) ছিল নজরুলের ২৭তম জন্মদিন। এদিন তিনি গান্ধীজির আগমন উপলক্ষে নানা কাজে
ব্যস্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে নজরুল কলকাতা থেকে আগত তাঁর পরিচিত জনদের তাঁর বাড়িতে থাকার
ব্যবস্থা করেছিলেন এবং এ কথা তাঁদের জানিয়ে রেখেছিলেন। কলকাতা থেকে আগত
অতিথিরা ২৫মে বিকাল বেলা রেলযোগে হুগলীতে আসেন এবং নজরুলের বাড়িতে ওঠেন। এই সময় এই
দলে ছিলেন মাহফুজুর রহমান খান। তিনি তাঁর 'কুড়িগ্রামে কবি নজরুল ও নজরুলের
সন্নিধানে' প্রবন্ধে লিখেছেন- নজরুল ২৬ মে সকাল বেলায় গান্ধীজির হুগলি আগমন
উলক্ষে একটি গান রচনা করেছিলেন। এই গানটি হলো-
কালানুক্রমিকের বিচারে এটি নজরুলের সঙ্গীতজীবনের দ্বিতীয় পর্বের ৬৭ সংখ্যক গান।
ফণি-মনসা
প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি '
বাংলায় মহাত্মা'
শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
গানটির সাথে কবিতাটির রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে-
'হুগলি/জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১'। বিজলী পত্রিকার ৫ম বর্ষ ২৬ সংখ্যা (জ্যৈষ্ঠ
১৩৩২) গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশকালের স্থানে ১৩৩২ বঙ্গাব্দ এর পরিবর্তে ভুলক্রমে ১৩৩১
লেখা হয়েছিল। পরে এই ভুল তারিখটিই
অনেকে উল্লেখ করেছেন। যেমন-
১. মুজফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইসলাম/স্মৃতিকথা' গ্রন্থে লিখেছেন '১৯২৪ সালে
হুগলীতেই প্রথম গান্ধীজীর সঙ্গে নজরুলের মুখোমুখী পরিচয় হয়েছিল। তাঁর আগমন
উপলক্ষে সে গান ও কবিতা রচনা করেছিলেন।' [ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট
লিমিটেড, সেপ্টেম্বর ২০০৯। পৃষ্ঠা: ১৯০]
২. অরুণকুমার বসু তাঁর 'নজরুল জীবনী' গ্রন্থে লিখেছেন- '১৯২৪ -এর মাঝামাঝি
মোহনদাস গান্ধজি সময়ে কি কারণে যেন হুগলিতে এসেছিলেন। চাঁদনী ঘাটের সভায় তাঁকে
বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হলো। সে সভায় নজরুলের সদ্যরচিত গান স্বয়ং কবিকণ্ঠে
পরিবেশিত হয়েছিল: আজ না-চাওয়ার পথ দিয়ে কে এলে...।' [পশ্চিম বাংলা আকাদেমি,
জানুয়ারি ২০০০। পৃষ্ঠা ১৩৩]
'হুগলি/জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১' -এর খ্রিষ্টাব্দ দাঁড়ায় মে-জুন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
গান্ধীজির কালানুক্রমিক জীবনী থেকে জানা যায়, এই বছরের মে-জুন মাস পর্যন্ত
গান্ধীজি
বোম্বে এবং আহমেদাবাদ অঞ্চলে ছিলেন।
[সূত্র:
Gandhi 1915-1948/A Detailed of Choronlogy/compiled by C.B.Dalal. First
Edition 1971]
তাই
তাই মুজফ্ফর আহমেদ এবং অরুণকুমার বসুর উল্লেখ করা এ গানটির রচনাকাল, ১৯২৪
খ্রিষ্টাব্দ গ্রহণ করা যায় না। এই বিচারে এ গানটির রচনাকাল গ্রহণ করা হলো-
জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ (মে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ )।
জুন ১৯২৫ (১৮ জ্যৈষ্ঠ-১৬ আষাঢ় ১৩৩২)
ঐ কংস কারার দ্বার ঠেলে।
গান শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্য হইতে তুমুল ধ্বনি
উঠিল। কবি তাঁহার "চরকার গান"টি গাহিতে শুরু করিলেনঃ
"ঘোর-
ঘোর্ রে ঘোর্
ঘোর্ রে আমার সাধের চর্কা ঘোর।
ঐ স্বরাজ রথের আগমনী শুনি চাকার
শব্দে তোর॥
'চরকার গান' গাহিবার সময় আনন্দে আতিশয্যে দুই তিনবার গান্ধী কবির পিঠ
চাপড়াইয়া দিলেন।...'
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ অব্দি নজরুল হুগলিতেই ছিলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২রা আষাঢ় (মঙ্গলবার,
১৬ জুন ১৯২৫) দার্জিলিঙে মৃত্যুবরণ করেন।
চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর এই বেদনার
প্রকাশ ঘটেছিল আষাঢ় মাসে রচিত ৩টি গান ও দুটি কবিতায়।
এগুলো হলো-
'দেশবন্ধু যখন মারা যান তখন কবি এই বাড়িতেই ছিলেন। দেশবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে কৰি কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল থেকে দশ মিনিটের মধ্যে একটা 'অর্ঘ্য' বলে গান লিখে সুর দিয়ে বিদ্যামন্দিরে এলেন-উল্লেখ্য, ১৮ই জুন (বৃহস্পতিবার ৪ আষাঢ় ১৩৩২) চিত্তরঞ্জন দাশের মরদেহ দার্জিলিং থেকে ট্রেনযোগে নৈহাটি আসে। নজরুল দেশবন্ধুর শবাধারে রচনাটি মালার সঙ্গে অর্ঘ্যস্বরূপ জুড়ে দিয়েছিলেন।
গানটি এই-
"হায় চির ভোলা; হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া..." ... এই গানটি লেখেন ১৩৩২ সালের ৩রা আষাঢ়। দেশবন্ধুর শবাধারে রচনাটি মালার সঙ্গে অর্ঘ্যস্বরূপ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল নৈহাটি স্টেশনে।'
'...ঐদিনই বিশেষ কারণে আড়িয়াদহের একটি উৎসবে যোগদানের জন্য রওনা হন। শ্রীফণিভূষণের সঙ্গে পরে আরও একটি গান লেখেন "অকাল সন্ধ্যা" নাম দিয়ে ৬ই আষাঢ়। ওখান থেকে ফিরেই দেখেন হুগলীর নেতৃতস্থানীয় ও স্বেচ্ছাসেবকরা শোকে স্তব্ধ হয়ে আছেন। কবি খালি পায়ে ঢুকে আবেগের সঙ্গে গানটি গাইতে লাগলেন খালি গলায়-উল্লেখিত দুটি গানের পর তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণে দুটি কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতা দুটি হলো-
" খোলো মা দুয়ার খোলো
প্রভাত সন্ধ্যা হলো,
দুপুরেই ডুবলো দিবাকর গো।"...'
এই মাসের প্রথম দিনেই চিত্তরঞ্জন দাশের স্মরণে শেষ গান রচনা করেছিলেন। গানটি হলো-
'নজরুল নির্দিষ্ট দিনে রওনা হন। তিনি তাঁর সঙ্গে আমাকে (প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় আমরা যাত্রা করি। সারারাত কবি গানে গানে মাতিয়ে রাখেন যাত্রীদের। বাঁকুড়া স্টেশনে যখন গাড়ি আসে তখন বেলা প্রায় আটটা। সারিবদ্ধ তরুণ সৈনিক মালকোছা মারা, প্রত্যেকের হাতে বড় লাঠি। ছাত্রদের সামনে সৌম্যমূর্তি ব্রাউন ও তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। কবি যখন স্টেশনে পদার্পণ করলেন তখন প্রথমেই ব্রাউন দম্পতি হাত জোড় করে তাঁকে নমস্কার জানালেন। ব্রাউন সাহেবের পিছনে জাতীয় পতাকা হাতে বাহিনীর নেতা ছবির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। ব্রাউন সাহেব হাসিমুখে কবির হাতে হাত দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতেই পতাকা বাহক পতাকা উর্ধে তুলে বন্দেমাতরম ধ্বনি করলেন, সারিবদ্ধ বাহিনী হাতের লাঠি তুলে কাঁধের উপর রেখে দুপা এগিয়ে এসে বন্দেমাতরম ধ্বনির সঙ্গে কবিকে স্বাগত করল। কবির মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম বড় বড় চোখ দুটি চক চক করছে আর মুখখানি রক্তাভা ধারণ করেছে।প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের এই রচনা থেকে জানা যায়, নজরুল এক সময় ভাবাবেগে উত্তেজিত হয়ে, এই আবৃত্তিতে যোগদান করেন। এরপর মাতৃসমা এক মহিলা তাঁকে রক্তচন্দনের ফোঁটা দেন এবং একজন তরুণ তাঁকে জবা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন। যদিও নজরুলে স্টেশন থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রাউন সাহেব মোটর গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় যুবকেরা তাঁদের লাঠি দিয়ে মাচান তৈরি করে, তার উপর নজরুলকে বসিয়ে- 'ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের' আবৃত্তি করতে করতে রওনা দেন। এই ভাবে প্রায় ১ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এঁরা সবাই ছাত্রাবাসে পৌঁছান।
ব্রাউন সাহেবের হাতে বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ 'বিষের বাঁশী' খানা দেখলাম। আর শ্রীমতী ব্রাউনের হাতে ছিল বাজেয়াপ্ত 'ভাঙ্গার গান'।'
...এরপর কবিকে স্টেশনের বিশ্রামাগারে নিয়ে গিয়ে জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়। ভিতর থেকে শুনতে পাওয়া গেল বাইরে মন্ত্র গুঞ্জরনের মতো স্বেচ্ছাসৈনিকেরা বারে বারে আবৃত্তি
করছে-
"ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের
দামাল ছেলে কামাল ভাই।"
'ধূমকেতু'তে চড়ে আমার আর একবার বাংলার পিলে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গোবরমন্ত (সরকার) সাহেব পেছনে ভীষণ লেগেছে। কোনো ক্রমেই একে উঠতে দেবে না।'
'রবীন্দ্রনাথ, একবার নজরুলকে তলওয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন তিনি সত্যই, কিন্তু কথাটা নানান জনে নানান ভাবে লিখেছেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এক জায়গায় কথাটা লিখেছেন। আমি নজরুলের মুখে যা শুনেছিলেম তা হচ্ছে এই যে সাক্ষাতের প্রথম দিনেই রবীন্দ্রনাথ কথাটা নজরুলকে বলেছিলেন। তখনও তিনি ভাবেন নি যে নজরুল গভীর ভাবে রাজনীতিক সংগ্রামে বিশ্বাসী। নজরুল কবি, কাবাচর্চাই তার পেশা হওয়া উচিত, তার মানে রাজনীতিতে তার যাওয়া, উচিত নয়, -এই সব ভেবেই তিনি তলওয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছার কথাটা বলেছিলেন। অন্তত, নজরুল তাই বুঝেছিল। রবীন্দ্রনাথ শুধু ওই কথা বলেই চুপ করে যান নি। তিনি তার সঙ্গে একটি প্রস্তাবও দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, নজরুল শান্তিনিকেতনে চলুক। সেখানে সে ছেলেদের কিছু কিছু ড্রিল শেখাবে আর গান শিখবে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।'
'...বাহার! তোমার দুখানা চিঠি পেলাম আজকেরটা নিয়ে। উত্তর দিতে পারিনি 'তার কারণ আমি বারো তেরো দিন হতে বড্ড অসুস্থ। দেশ-উদ্ধার-কল্পে পাড়া-গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে পচা পাটের জল আর মশার কামড় খেয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে বাড়ি ফিরি। মধ্যে একদিন অবস্থা যায়-যায় হয়ে উঠেছিল, একদিন ভীষণ রক্তবমন হতে থাকে হঠাৎ, সে দিন সাত-আট আগে।
রক্তবমন বন্ধ হয়েছে, কিন্তু বড়ো দুর্বল- এখনও শয্যাগত। জ্বর আসছিল রোজ, আজ ছেড়েছে। এত রক্ত পড়ত এক একবার, যে নালা দিয়ে জলের মতো বয়ে যেত, যাক, বিপদের ক্ষণ কেটে গেছে। তাছাড়া আমিও এত সহজে 'বিছানায় শুয়ে মরতে রাজি নই।...'
[দ্রষ্টব্য: ৬ অক্টোবর, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ (২০ অক্টোবর ১৯২৫), হবীবুল্লাহ বাহার-কে লেখা পত্র। [পত্র]
এই মাসে প্রকাশিত হয় নজরুলের সপ্তম কাব্যগ্রন্থ পূবের হাওয়া।
...'লাঙল'-এর ফাল আমার হাতে- 'লাঙল'-এর শুধু বা কাঠেরটাই বেরোয় প্রথমবার। শুধু একটা 'কৃষাণের গান’ দিয়েছি।'এই মাসে আরও নজরুল একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। কবিতাটি হলো-
গান: ওঠ্ রে চাষী, জগদ্বাসী, ধর্ কষে লাঙল [তথ্য]
শিরোনাম: কৃষাণের গান। যদিও মুরলীধর বসুকে লেখা চিঠির সূত্রে ধারণা করা যায়, গানটি ' লাঙল পত্রিকা'র প্রথম সংখ্যার জন্য লিখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল- গানটি প্রকাশিত হয়েছিল- উক্ত পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় ['বুধবার, ৮ই পৌষ ১৩৩২। কৃষাণের গান। পৃষ্ঠা ৪।] সর্বহারা- কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গানের সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে 'হুগলি/অগ্রহায়ণ ১৩৩২'।
[ আন্ওয়ার হোসেন খানকে লেখা পত্র। [পত্র]১লা পৌষ (১৬ ডিসেম্বর) থেকে 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের মুখপত্র' হিসেবে ' লাঙল ' নামক একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশনা শুরু হয় ।এছাড়া সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ এই মাসে প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক 'লাঙল'-এর প্রকাশ
এই মাসে নজরুল 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের মুখপত্র' হিসেবে 'লাঙল' নামক একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। দ্বাদশ সংখ্যায় মুখপত্রের পরিচয় দেওয়া হয়- 'বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক-দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র'।
পত্রিকাটি নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলেও সম্পাদকের নাম ছিল-শ্রীমণিভূষণ মুখোপাধ্যায়। আর প্রধান পরিচালক হিসেবে নাম ছাপা হতো- নজরুল ইসলাম। ত্রয়োদশ সংখ্যা থেকে নতুন সম্পাদকের নাম পাওয়া যায়- শ্রীগঙ্গাধর বিশ্বাস।
প্রকাশকের ঠিকানা ছিল- ১৫নং নয়ানচাঁদ দত্তের ষ্ট্রীট-মেট্কাফ প্রেসে মুদ্রিত এবং ৩৭নং হ্যারিসন রোড্ হইতে প্রকাশিত। মূদ্রাকর ও প্রকাশক- শ্রীমণিভূষণ মুখোপাধ্যায়।
পত্রিকটির প্রথম সংখ্যার প্রকাশের তারিখ ছিল- ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১লা পৌষ (বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে)। এটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ (বৃহস্পতিবার ১৫ এপ্রিল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ) পত্রিকাটির পঞ্চদশ সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট থেকে মুজাফ্ফর আহমেদ গণবাণী নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই সময় 'লাঙল' এই পত্রিকার সাথে একীভূত হয়ে যায়।
প্রথম দিকে পত্রিকার প্রথম পাতায় গরু ও লাঙলের সাহায্যে ভূমি চাষ করছেন, এমন একজন কৃষকের ছবি বৃত্তাকার ব্লকে আবদ্ধ ছবি ছাপা হতো। এর নিচে চণ্ডীদাসের একটি কাব্য-উক্তি মুদ্রিত হতো- 'শুনহ মানুষ ভাই-/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।' এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৬। পত্রিকাটির দশম সংখ্যা থেকে পূর্বের কৃষকের ছবিটির পরিবর্তে নতুন ছবি ব্যবহৃত হয়ে। দ্বাদশ সংখ্যা থেকে কৃষকের ছবি বাদ দেওয়া হয়েছিল।
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫
ডিসেম্বর (শুক্রবার ১০ পৌষ ১৩৩২)
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থটি পুস্তিকাকের প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশক মৌলভী শামসুদ্দীন
হুসেন, বেঙ্গল পাবলিশিং হোম, ৫ নূর মহম্মদ লেন, কলিকাতা। ১৫ নম্বর নয়ান চাঁদ [দত্ত]
স্ট্রিট, কলিকাতা, মেটকাফ প্রেসে শ্রীমণিভূষণ মুখার্জী কর্তৃক মুদ্রিত।
উল্লেখ্য, ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১ পৌষ (বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ), 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের মুখপত্র' হিসেবে 'লাঙল' নামক একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়। এর প্রথম খণ্ড। বিশেষ সংখ্যায় (প্রথম সংখ্যা) 'সাম্যবাদী' কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ৫-১০। পরে এসব কবিতার সংকলন হিসেবে 'সাম্যবাদী' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল।
ইতিমধ্যে এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
জানুয়ারি ১৯২৬ (১৬ পৌষ-১৭ মাঘ ১৩৩২)
জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে (রবিবার ১৯ পৌষ ১৩৩২) নজরুল ইসলাম হুগলী থেকে বসবাসের জন্য কৃষ্ণনগরে চলে আসেন।
উল্লেখ্য, হুগলীতে থাকার সময় নজরুলের আর্থিক কষ্ট চরমে পৌঁছেছিল।
এই সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন হেমন্তকুমার সরকার।
তিনি 'রায় চাঁদ প্রেম চাঁদ' বৃত্তি পাওয়া সুশিক্ষিত মানুষ। এছাড়া সুভাষ বসুর সহপাঠী
ও সহকর্মী হিসেবে অনেকের প্রিয়ভাজন ছিলেন। এক সময় চিত্তরঞ্জন দাশের কর্মসচিব হিসেবে
কাজ করেছেন। হুগলীতে নজরুলের প্রচুর দেনা হয়েছিল। তিনি সেসব পরিশোধ করে, নজরুলকে
কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসেন। কৃষ্ণনগরে আসার পর হেমন্ত সরকারে মা নীরদবরণী দেবী মায়ের মতো
করে নজরুলকে অভ্যর্থনা করে ঘরে বরণ করেণ করেছিলেন। পরে গোয়ালপাটি মহল্লার মদন
সরকারের বাড়িতে নজরুলের সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি নজরুলকে
আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন- তোমার লেখার ভাবনা, সংসারের ভাবনা ভাবতে হবে না। সে ভাবনা
আমার'। এই সময় নজরুলকে বাসা ভাড়া দিতে হত না। এমন কি নজরুল ও তাঁর পরিবারের জন্য
খাবারে খরচও হেমন্ত সরকার দিতেন।
৫ই জানুয়ারি রচনা করেন মুক্তিকাম কবিতা।
৭ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল 'লাঙল' পত্রিকার প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সংখ্যা।
'কবি নজরুল ইসলাম পীড়িত অবস্থায় কৃষ্ণনগরে আছেন। তাঁর ঠিকানা- কৃষ্ণনগর, নদীয়া।'
নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন সুষ্ঠভাবে যাতে সম্পন্ন হ্য়, সে জন্য একটি সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। এবং এই মাসের শেষের দিকে তিনি এঁদের প্রশিক্ষণ দেন। এই বাহিনীর প্রধান অধিনায়ক ছিলেন নজরুল এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত।
ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ (১৭ মাঘ-১৬ ফাল্গুন
১৩৩২)
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,
জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে
নজরুল কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের
কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান ছিলেন এবং
স্বেচ্ছাসেবকদের কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষণ দেন। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ৬-৭
ফেব্রুয়ারি (২৩-২৪ মাঘ ১৩৩২)। উক্ত অনুষ্ঠানে নজরুল স্বরচিত দুটি গান পরিবেশন করেন।
এর ভিতরে
এর ভিতরে 'ওঠ্ রে চাষী, জগদ্বাসী, ধর্ কষে লাঙল' গানটি পূর্বেই রচিত হয়েছিল। এই
অনুষ্ঠানের জন্য রচনা নিম্নোক্ত গানটি রচনা করেছিলেন। গানটি হলো-
এই মাসের শুরুতে প্রকাশিত হয়েছিল লাঙল পত্রিকার সপ্তম সংখ্যা
৪. 'কবি নজরুল ইসলাম পরিচালিত -"লাঙল" পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্ররূপে আপতত গ্রহণ করা হউক এবং শ্রীযুত হেমন্তকুমার সরকার সম্পাদিত নদীয়ার "জাগরণ" পত্রিকা ও মৌলবী রজুবুদ্দীন তরফদার প্রতিষ্ঠিত বগুড়ার "প্রজাবাহিণী" নিখিল বঙ্গীয় প্রজাসম্মিলনীর মুখপত্ররূপে গণ্য হউক।'
প্রস্তাবক: বিজয়কান্ত রায় চৌধুরী (নদীয়া)
সমর্থক: আফতাব হোসেন জোয়ার্দার (নদীয়া)
'কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব কৃষ্ণনগরেই থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে চিঠি-পত্র তাঁকে [পোঃ কৃষ্ণনগর জিলা নদীয়া ঠিকানাতেই লিখতে হবে। "লাঙল"- অফিসের ঠিকানায় তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে পত্র লিখলে সে পত্র সময় মত তিনি পাবেন না।
এ ছাড়া এই মাসে রচিত একটি কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। কবিতাটি হলো-
'গত ১১ই ও ১২ই মার্চ্চ তারিখে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সহরে মৎস্যজীবী সম্মিলনীর তৃতীয় অধিবেশন হয়। ১০ই মার্চ্চ সন্ধ্যায় সভাপতি শ্রীযুত হেমন্তকুমার সরকার মহাশয় ষ্টীমার যোগে আসেন। তাঁর সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম শ্রীযুত বসন্তকুমার মজুমদার ও শ্রীমতী হেমপ্রভা মজুমদার ছিলেন। ষ্টীমার ঘাটে অভ্যর্থনার জন্য প্রায় ৫ হাজার লোক উপস্থিত হইয়াছিলেন। ... কাজী সাহেবের গানে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই গানটি ছিল-
কলকাতায় দাঙ্গা
১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১৯শে চৈত্র (শুক্রবার, ২ এপ্রিল ১৯২৬), কলকাতায় আর্যসমাজীরা রাজরাজেশ্বরী
দেবীর মিছিল বের হয়।
এদিন ছিল মুসলমানদের জুম্মার দিন। রাজরাজেশ্বরী পূজা বঙ্গদেশে প্রায় অচল। এই সময়
স্থানীয় আর্যসমাজীদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য পূজা না থাকায়, অপ্রচলিত এই পূজা এবং সেই
সাথে মিছিল করেছিল শুধু দাঙ্গা বাধানোর জন্য। আর্যসমাজীরা পূর্বের পরিকল্পনা
অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, শুক্রবারে জুমার নামাজের সময় তাঁরা শাঁখ এবং ঢাক-ঢোল
বাজিয়ে রাজরাজেশ্বরী দেবীর মিছিল নিয়ে মসজিদের পাশ দিয়ে যাবে। এই
সংবাদ মুসলমানরা আগে থেকেই জানতে পেরে লাঠি-সোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকে। বাধা আসতে পারে
এই বিবেচনায় হিন্দু ফলে রাজরাজেশ্বরী দেবীর মিছিল অগ্রসর হলে, দাঙ্গার
সূত্রপাত হয়। উল্লেখ্য এই দাঙ্গা প্রথমে শুরু হয়েছিল আর্যসমাজীদের উগ্রপন্থী এবং
অবাঙালি মুসলমানদের ভিতরে। পরে অন্যান্য হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমাদের মধ্যে ছড়িয়ে
পড়ে।
জুমার নামাজের পর, প্রাথমিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্য বাকবিতণ্ডা হয়েছিল। কিন্তু
উভয় পক্ষের উস্কানিতে তা দাঙ্গায় রূপ লাভ করেছিল পৌনে চারটার দিকে। এতে প্রায়
শতাধিক লোক আহত হন এবং ৫ জন নিহত হন। এ বিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল '
The Bengalee
'
পত্রিকার ৩ এপ্রিল ১৯২৬ সংখ্যায়। নজরুল-পরিচালিত গঙ্গাধর সম্পাদিত 'লাঙল'
পত্রিকার প্রথম খণ্ড, ১৪শ সংখ্যায় (২৫ শে চৈত্র ১৩৩২, ৮ই এপ্রিল ১৯২৬) 'কলকাতায়
দাঙ্গা' শিরোনামে এই সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত তথ্য জানা যায়।।।
কলকাতায় এই ঘটনা ঘটার সময়, সম্ভবত ১০ই এপ্রিলের (শনিবার ২৭ চৈত্র
১৩৩২) আগেই নজরুল মাদারীপুর থেকে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন। এই দিন কালিকলম পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠি থেকে শ্রীহট্ট যুব সম্মিলনীতে নজরুলের যোগদানের ইচ্ছার কথা জানা যায়।
[শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে
লেখা পত্র [পত্র]
প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়। ফণি-মনসা প্রথম সংস্করণ [শ্রাবণ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ (জুলাই ১৯২৭)] কবিতাটি 'প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কবিতাটির সাথে রচনার স্থান ও কাল উল্লেখ আছে- 'কৃষ্ণনগর, ৩০শে চৈত্র ১৩৩২' (মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল ১৯২৬)
সিলেটে অবস্থানকালে জিন্দাবাজারের দক্ষিণ সীমায় কংগ্রেস আয়োজিত সভায় অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। এই সভায় তিনি কংগ্রসের স্বপক্ষে ভাষণ দেন। এই সভার কয়েকদিন পর তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং রমণীমোহনের দাসের বাড়িতে অবস্থান করেন। ফলে এই সময় তিনি এখানকার অন্য কোনো সভা-সমিতির অনুষ্ঠানে আর যোগ দিতে পারেন নি।
অসুস্থ নজরুলকে বিশেষ সেবা যত্নের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চৌহাট্টার সুধীরেন্দ্র
নারায়ণ সিংহ মজুমদার ও বলাকা পত্রিকার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন দাশ। এই সময় নজরুল ভক্ত
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও দেওয়ান একলিমুর রাজা নজরুলের সাথে সাক্ষাৎ। উল্লেখ্য পরবর্তী
সময়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অতীত জীবনের স্মৃতি গ্রন্থে নজরুল সম্পরজকে মূল্যবান
তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
এই অসুস্থতার মধ্যে তিনি সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ মজুমদারের ভ্রাতুষ্পুত্রী লীলাবতী
সিংহ মজুমদারকে তিনি গানের তালিম দেন। সম্ভবত ২৬শে এপ্রিল (১৩ বৈশাখ ১৩৩৩) পর্যন্ত তিনি সিলেটে ছিলেন।
নজরুল কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে সিলেট রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন
উবেদউল্লাহ।
এর ভিতরে প্রকাশিত হয়েছিল নবম ও প্রথম কিশোর কাব্য 'ঝিঙেফুল'।
গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল- বীর বাদলকে'। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো হলো-
এই মাসেই লাঙল পত্রিকার শেষ এবং ১৫শ সংখ্যা।
এই মাসে রেকর্ড নজরুলের রচিত দুটি গান প্রকাশিত হয়েছিল। গান দুটি হলো-
১-২৪মে ১৯২৬ (১৮ বৈশাখ- ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ও ২৩ মে (৭ ও ৮ জ্যৈষ্ঠ) তারিখে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে
অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় প্রদেশিক কংগ্রেসর বার্ষিক সম্মেলন। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন
যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠানটি হয়েছেল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে। নজরুল এই
সম্মেলন সুসম্পন্ন করার জন্য নজরুল সম্পৃক্ত হন। এই অনুষ্ঠানের ১৯শে মে (বুধবার ৫ জ্যৈষ্ঠ
১৩৩৩)
এই অনুষ্ঠান তিনি দুটি নতুন গান পরিবেশন করেন। গান দুটি হলো-