কাজী নজরুল ইসলামের '১৯২১ সনে
শ্রীযুত বীরেন সেন (কাজীর এবং আমাদের সকলের 'রাঙা দা') তখন কুমিল্লা জাতীয়
বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কাজী নজরুল কান্দিরপাড় তাঁরই বাড়ীতে থাকেন। প্রিন্স্ অব
ওয়েল্সের ভারত-ভ্রমণ উপলক্ষে কংগ্রেস-ঘোষিত হরতাল-পালনের জন্য (২১শে
নভেম্বর) একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ নিয়েই তাঁর সাথে দেখা করি 'রাঙা দা'র
বাড়ীতে। তিনি তা তো দিলেনই, অধিকন্তু কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে মিছিলের সঙ্গে
তিনি নিজেও গাইলেন: পরে
ধূমকেতু পত্রিকার নপ্রথমবর্ষ। দ্বিতীয় সংখ্যায় [৩০ শ্রাবণ ১৩২৯, মঙ্গলবার, ১৫
আগষ্ট ১৯২২] 'জাগরণী গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর
ভাঙার গান
প্রথম সংস্করণে (শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
শিরোনাম:
জাগরণী।
২২ বৎসর অতিক্রান্ত বয়স
১৩২৮
বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গলবার ২৪শে মে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) ২২ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (বৃহস্পতি
বার ২৫শে মে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) ২২ বৎসরের সূচনা হয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১০ই জ্যৈষ্ঠ (বুধবার ২৪শে মে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলের ২২ বৎসর পূর্ণ হয়েছিল।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শেষে (এপ্রিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি
আলী আকবর খানের
সাথে চট্টগ্রাম মেল-ট্রেনে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সম্ভবত এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে (সোমবার, ২২ চৈত্র ১৩২৮)
আলী আকবর খান কবিকে সাথে নিয়ে, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ওঠেন।
উল্লেখ্য, ইন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তৎকালীন কুমিল্লার কোট অব্ ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর
ছিলেন।
৫ এপ্রিল (মঙ্গলবার, ২৩ চৈত্র ১৩২৮) আলী আকবর খান নজরুলকে সাথে নিয়ে, কুমিল্লা শহর থেকে তাঁর গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরের যান। সেখানে
নজরুলের সাথে আলী আকবর খানের ভাগ্নী
সৈয়দা খাতুনের
পরিচয় এবং প্রণয় ঘটে। নজরুল এঁর নাম রেখেছিলেন
নার্গিস। ২১ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের
শেষ-প্রান্ত পার হয়েছিল
সৈয়দা খাতুনের-এর সাথে প্রণয়ের মধ্য দিয়ে। ১০ই জ্যৈষ্ঠ
((২৪শে মে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ)
পর্যন্ত তিনি কুমিল্লার দৌলতপুরেই কাটান।
২৫-৩১ মে ১৯২১
(১১- ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮)
নজরুলের ২২ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের প্রথম সপ্তাহ কেটেছিল
কুমিল্লার দৌলতপুরে। তিনি তখন সৈয়দা খাতুনের
প্রণয়-মোহে ডুবে ছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয়তমার নাম দিয়েছিলেন নার্গিস
(স্বর্গীয় ফুল)।
এই সময়ে তিনি সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক
ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। নার্গিসের সাথে প্রণয়ের সূত্রে কোনো কবিতা রচনা
করেছিলেন কিনা তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে এর কাছকাছি সময়ে তাঁর রচিত বেশ কিছু কবিতা পাওয়া যায়।
সে সূত্রে ধারণা করা হয়, হয়তো এই কবিতাগুলো নার্গিসকে নিয়েই লেখা।
জুন ১৯২১
(১৮ জ্যৈষ্ঠ- ১৬
আষাঢ় ১৩২৮)
নজরুলের প্রণয় ও প্রথম বিবাহ
শেষ পর্যন্ত
১৭ই জুন (শুক্রবার ৩রা আষাঢ়) কুমিল্লার
দৌলতপুরে, নজরুল ইসলামের সাথে নার্গিসের বিবাহের
দিন ধার্য হয়। এই বিবাহের সংবাদ নজরুল কলকাতায় তাঁর
বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। অধিকাংশ ঘনিষ্ট বন্ধুই এই বিবাহকে সমর্থন করতে পারেন নি। বিশেষ করে
পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায় এবং
মুজাফ্ফর আহমদ এই বিবাহের ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিবাহের
সংবাদ পেয়ে ৫ জুন (রবিবার, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮)
পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলকে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে তিনি তাঁর অসন্তুষ্টির কথা স্পষ্টই জানিয়েছিলেন।
[সূত্র:
৫ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে লেখা পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন। এই চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়
নি। তবে এই অজ্ঞাত চিঠির উত্তরে
পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায় আরও একটি উত্তর দিয়েছিলেন।
চিঠি জানা যায়, যে তিনি অগত্য নজরুলের এই বিবাহকে মেনে নিয়েছিলেন।
পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায় এই চিঠি লিখেছিলেন ২৫ জ্যৈষ্ঠ (বুধবার ৮ জুন)।
[সূত্র:
২৫
জ্যৈষ্ঠ (৮ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলকে লেখা পবিত্র
গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
নজরুল এই বিবাহের দিন ধার্য হয়েছে এই খবর, ৭ জুন (মঙ্গলবার
২৪ জ্যৈষ্ঠ) নজরুল মোহাম্মদ
ওয়াজেদ আলীকে জানিয়েছিলেন।
১১ জুন (শনিবার ২৮শে জ্যৈষ্ঠ ),
আলী আকবর
একটি নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। এই পত্রটি
আলী আকবর খানের নামে মুদ্রিত হয়েছিল।
অরুণকুমার বসু তাঁর 'নজরুল জীবনী' গ্রন্থ থেকে
পত্রে মূল বয়ান তুলে ধরা হলো
'এ বিশ্বনিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্নকল্যাণ আঁখি
অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে...তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে
আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আরা খানমের
বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস-প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশবিখ্যাত পরমপুরুষ, আভিজাত্যগৌরবে গৌরাবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ
সাহেবের দেশবিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি, দৈনিক
নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে,
বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার
দরকার নেই। এই আনন্দঘন চিরশিশুকে যে দেশের সকল লেখকলেখিকা, সকল কবি-যুবকরা
ভালোবাস দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের
মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে, এর চেয়ে বড়ো পরিচয় তার আর নেই।
এই চিঠি
আলী আকবর খানের
নামে লিখিত হলেও, মুজাফ্ফর আহমদের ধারণা
চিঠিটি খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন নজরুল নিজেই। মুজাফ্ফর আহমদ এই নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছিলেন নজরুলের
আক্দের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর। তিনি এই চিঠি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সম্ভবত '
মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি' দেখে। মুজাফ্ফর আহমদ এই দাবিকে অহঙ্কারের প্রকাশ হিসেবে
বিবেচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে পরে (২৬ জুন, রবিবার ১২ আষাঢ়) মুজাফ্ফর আহমদ নজরুলকে একটি পত্র
পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য পত্রিকান্তরে, নজরুল- আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণ পত্রের ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। নজরুলের এই প্রতিক্রিয়াটি ছাপা হয়েছিল- সাপ্তাহিক
বিজলী পত্রিকার ২২শে জুলাই (৬ জুলাই) সংখ্যায়।
আপনারা আমার বন্ধু, বড়ো আপনার জন। আমার এ গৌরব, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে
আনন্দ করে আমার এ কুটিরখানিকে পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।...বিয়ের
দিন আগামী ৩রা আষাঢ় শুক্রবার নিশীথ রাতে...আরজ
বিনীত আলী আকবর খান
[সূত্র:
১২ আষাঢ় (২৬ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলকে লেখা মোজাফ্ফর আহমেদের চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ১৩ই জুন (মঙ্গলবার, ৩০
জ্যৈষ্ঠ) নজরুলকে চিঠি লিখেছিলেন। মূলত এটা ছিল,
৭ জুন (বুধবার ২৪ জ্যৈষ্ঠ) মোহাম্মদ
ওয়াজেদ আলীকে লেখা নজরুলের চিঠির উত্তর। উত্তরটি ওয়াজেদ আলী লিখেছিলেন-
কলকাতার ২৯, আপার সার্কুলার রোডস্থ 'মোহাম্মদী পত্রিকার অফিস থেকে। চিঠিতে
নজরুলের বিবাহের সংবাদে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
[সূত্র: ৩০
জ্যৈষ্ঠ (১৩ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলকে লেখা মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
নজরুল এই চিঠির উত্তরও দিয়েছিলেন। ওয়াজেদ আলীর এই চিঠি নজরুল পেয়েছিলেন ১৪ই জুন (মঙ্গলবার ৩১
জ্যৈষ্ঠ)। এর উত্তরে
১৬ জুন (বৃহস্পতিবার ২রা আষাঢ়), ওয়াজেদ আলী নজরুলকে লিখেছিলেন যে, এই বিবাহের
খবর পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন।
[সূত্র:
২রা আষাঢ়
(১৪ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) নজরুলকে লেখা মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর চিঠি। কবি পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
যথারীতি
১৭ই জুন ১৯২১ (শুক্রবার
৩রা আষাঢ় ১৩২৮) কুমিল্লার
দৌলতপুরে, নজরুল ইসলামের সাথে
নার্গিসের আক্দ আসর
বসে দৌলতপুরস্থ
আলী আকবর খানের বাসায়। এই অনুষ্ঠানে আলী আকবর খান কুমিল্লা থেকে
সপরিবারে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে ইন্দ্রকুমারের পরিবারের প্রায় সকলেই দৌলতপুরে
গিয়েছিলেন। মুজাফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইস্লাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের সাথে আর যাঁরা দৌলতপুর গিয়েছিলেন তাঁর একটি তালিকা পাওয়া যায়। এঁরা
ছিলেন- ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বিরজাসুন্দরী দেবী (ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী),
বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে, বীরেন্দ্রকুমারের স্ত্রী, বীরেন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের শিশুপুত্র প্রবীরকুমার সেনগুপ্ত, গিরিবালা দেবী (বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বিধবা জ্যেঠী মা),
কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা (গিরিবালা দেবীর ১৩ বছরের কন্যা), কুমারী কমলা সেনগুপ্তা
(ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ১২ বছরের মেয়ে), অঞ্জলি সেনগুপ্তা ওর্ফে জটু (ইন্দ্রকুমারের
৬ বছরের শিশুকন্যা) ও সন্তোষকুমার সেন (জ্ঞাতি কিশোর)। এ ছাড়া এই বিবাহে উপস্থিত
ছিলেন- দৌলতপুরের পার্শ্বস্থ বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্র লোচন মজুমদার
এবং বাঙ্গোরা হাই স্কুলের হেড মাস্টার বাবু মোহন মজুমদার।
আক্দের আসরে প্রথম তর্ক শুরু হয় কাবিনের শর্ত নিয়ে। এছাড়া কন্যাপক্ষ
থেকে দাবি করা হয় যে, বিবাহের পর নজরুলকে ঘর-জামাই হয়ে থাকতে হবে।
এই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উপস্থিত হলে, নজরুল বিবাহ-আসর থেকে
উঠে আসেন। অনেকে মনে করেন যে, আকদ সম্পন্ন হওয়ার আগেই নজরুল বিবাহের আসর ত্যাগ করেছিলেন।
এই কারণে সন্দেহ হয়, আদৌও নজরুলের সাথে নার্গিসের আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়েছিল কিনা।
বিয়ের আসর ত্যাগ করে, নজরুল প্রায় ১১ মাইল কাদা-বিছানো পথে হেঁটে
১৮ই জুন (শনিবার,
৪ঠা আষাঢ়) সকাল বেলায় কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেছিলেন।
বিবাহ-বিচ্ছেদ
বিবাহ-অনুষ্ঠান ছেড়ে আসার পর, ১৮ই জুন
১৯২১ (শনিবার,
৪ঠা আষাঢ় ১৩২৮) গভীর রাতে নৌকাযোগে আলী আকবর খানের
অগ্রজের সাথে বিরজাসুন্দরী দৌলতপুর ত্যাগ করেন। এই সময় নজরুলের ফেলে যাওয়া
জিনিসপত্র তিনি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য আলী আকবর খান নজরুলের কিছু কাগজপত্র রেখে
দিয়েছিলেন।
নজরুলের সাথে নার্গিসের আর দেখা হয় নি। প্রশ্ন রয়ে গেছে নজরুল কি নার্গিসকে মুসলিম
আইন মতে তালাক দিয়েছিলেন? এখন পর্যন্ত কোনো তালাক নামা পাওয়া যায় নি। মুজফ্ফর
আহমদের মতে- যথাযথ আক্দ সম্পন্ন হয় নি, তাই বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি অবান্তর।
মুসলিম আইন মতে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রীর মোহরানা প্রদান করতে হয়। সে রকম দাবি আলী
আকবর করেছিলেন কিনা এমন সংবাদও পাওয়া যায় না। বিয়ের আসর থেকে ওঠে আসা ক্ষুব্ধ
নজরুলকে- বিরজাসুন্দরী বিয়েটা মেনে নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা মানেন
নি।
এই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর, নজরুল আলী আকবর খানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির ভাষা
এবং তারিখ নিয়ে মুজাফ্ফর আহমেদ সংশয় প্রকাশ করেছেন, তাঁর 'কাজী নজরুল স্মৃতিকথা'
গ্রন্থে। এই চিঠিতে তারিখ ও স্থানের উল্লেখ ছিল 'কান্দিরপাড়, কুমিল্লা
23rd July,
1921
(বিকেল বেলা)'। বাস্তবে এই সময়
মুজাফ্ফর আহমদ ছিলেন কলকাতায়। সম্ভবত
এই চিঠিটি লেখা হয়েছিল ২৩শে জুন (বৃহস্পতিবার, ৯ আষাঢ়)। [চিঠি:
২৩ জুন আলী আকবর খানকে লেখা নজরুলের চিঠি]
কুমিল্লা থেকে নজরুলের নতুন কর্মজীবনের শুরু
১৮ই জুন ১৯২১ (শনিবার,
৪ঠা আষাঢ় ১৩২৮) নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় ফিরে আসেন। এই সময়ে
অসহযোগ আন্দোলন চলছিল সারা ভারত জুড়ে। এর ধাক্কা লেগেছিল কুমিল্লায়। কুমিল্লা শহরে
তখন সভা, শোভাযাত্রায় মুখর ছিল। এই অবস্থায় তিনটি গান রচনা করেছিলেন। এই গান তিনটির
সাথে সুনির্দিষ্ট তারিখে উল্লেখ পাওয়া যায় না। এর ভিতরে 'বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'য় প্রকাশিত ৩টি গানের
সাথে রচনার স্থান উল্লেখ ছিল- কান্দিরপাড়, কুমিল্লা'। এই গান
৩টি হলো-
উল্লিখিত তিনটি গানের সাথে তারিখের উল্লেখ নেই। যেহেতু নজরুল
কান্দিরপাড়ে এসেছিলেন ৪ঠা আষাঢ় (১৮ই জুন) এবং ২৪ আষাঢ় (৮ই জুলাই) তিনি কলকাতার
উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাই ধারণা করা যায় যে, এই গানটি এই সময়ের ভিতরেই রচিত।
গানটি
বিষের বাঁশী
কাব্যগ্রন্থে '
বন্দিবন্দনা'
অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। '
বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'য় মাঘ ১৩২৮ প্রকাশিত গানটির সাথে রচনার স্থান উল্লেখ ছিল- কান্দিরপাড়, কুমিল্লা'।
গানটি
বিষের বাঁশী
কাব্যগ্রন্থে '
বিজয়-গান'
নামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। '
বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'য় প্রকাশিত গানটির সাথে রচনার স্থান উল্লেখ ছিল- কান্দিরপাড়, কুমিল্লা'।
সাধনা পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩২৮' সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয়েছিল
'বিজয়-গান' শিরোনামে। গানটির সাথে রচনার স্থান উল্লেখ ছিল 'কান্দিরপাড়,
কুমিল্লা'।
জুলাই ১৯২১
(১৭ আষাঢ়- ১৫
শ্রাবণ ১৩২৮)
কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে থাকার সময়, নজরুল তাঁর বন্ধু মুজাফ্ফর আহমদকে
কিছু টাকা পাঠানোর অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। মুজাফ্ফর আহমদ
এই চিঠি পেয়ে,
২২শে আষাঢ় ১৩২৮ (বুধবার, ৬ই জুলাই ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) ওই বাড়িতে উপস্থিত
হন। ২৩শে আষাঢ় ১৩২৮ (বৃহস্পতিবার, ৭ই জুলাই ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ)
মুজাফ্ফর আহমদ ও নজরুল
সেনগুপ্ত পরিবারের প্রমীলা, কমলা, অঞ্জলি এবং রাখালকে সাথে রথযাত্রা দেখতে বের হন।
এই সময় নজরুল একটি গান রচনা করেন।
নজরুল ২৪ আষাঢ় (শুক্রবার ৮ই জুলাই)
মুজাফ্ফর আহমদের সাথে কলকাতার
উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'
গ্রন্থ থেকে
কলকাতায় ফেরার যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হলো-
মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'য় এই গানটি রচনার
প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লিখেছেন
'১৯২১ সালের বিরাট অসহযোগ আন্দোলন
তখন চলেছিল। তারই জন্যে এই গানটি লেখার অনুরোধ নজরুলকে করা হয়েছিল। সে শুধু
গানটি যে লিখেছিল তা নয়, মিছিলে ও মিটিং-এ গানটি সে গেয়েওছিল। আমি যতটা মনে
করতে পারছি, গান্ধীজীকে লক্ষ্য ক'রে এটাই ছিল নজরুলের লেখা প্রথম গান।
খানিকটা গান্ধীবাদও এই গানের ভিতরে আছে। যেমন, "মুক্তি সে ত নিজের প্রাণে,
নাই ভিখারীর প্রার্থনায়।" কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে সভাপতি চিত্তরঞ্জন দাশও
বলেছিলেন যে, স্বরাজ ? সে তো প্রাণে প্রাণে অনুভব করার ব্যাপার ! সংজ্ঞা
দিয়ে তা কি কখনও বোঝানো যায়? এই গানটির সুর কিন্তু লোকের প্রাণে পৌঁছেছিল।
৭ জুলাই (২৩ আষাঢ়) তারিখে রথযাত্রার সময়ে নজরুল আর আমি যখন শ্রীইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তদের বাড়ীর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ীতে রথ দেখাতে রাস্তায়
বা'র হয়েছিলাম তখন নজরুলকে দেখিয়ে একটি ছোট ছেলে আর একটি ছোট ছেলেকে বলছিল,
"দেখ্, ওই পাগল পথিক যাচ্ছে।"
গানটি 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার 'ভাদ্র ১৩২৮' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
শিরোনাম ছিল: 'গান'। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের
১৬ই শ্রাবণ প্রকাশিত 'বিষের
বাঁশী' গ্রন্থে গানটি
অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গানটির শিরোনাম 'পাগল
পথিক:'।
'নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আমি ৮ই জুলাই (১৯২১) তারিখে
কুমিল্লা ছেড়েছিলেম। ইতোমধ্যেই নজরুল কুমিল্লায় জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল।
রেলওয়ে স্টেশনে অনেকেই তাকে বিদায় দিতে এসেছিলেন । অনুশীলন পার্টির নেতা
শ্রীঅতীন্দ্র রায়-চৌধুরীও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। কুমিল্লা স্টেশনেও থার্ড কিংবা
ইন্টার ক্লাসে চড়া কিছুতেই সম্ভব হলে৷না। চাঁদপুর পর্যস্ত আমাদের ফাস্ট ক্লাসে
যেতে হলো। চাঁদপুর পৌঁছে দেখলাম ষ্টীমার চলে গেছে। হিসাব করে দেখলাম আমাদের
টাকাও কম পড়ে যাবে। সেই রাত্রে আমরা চাঁদপুর ডাক বাংলোয় চলে গেলাম । সেই
রাত্রেই না, পরের দিন ভোরে সে কথা ঠিক মনে নেই,_আমি কলকাতায় আফজালুল হক সাহেবকে
একটা টেলিগ্রাম পাঠালাম যে টাকা কম পড়ে গেছে। আফ্জালুল হক সাহেব যেন চাঁদপুরের
ডাক বাংলোর ঠিকানায় কমপক্ষে বারোটি টাকা টেলিগ্রাফিক মনিঅর্ডারে পাঠিয়ে দেন।
ভাগ্য ভালো যে তখন কুমিল্লার আশরাফ উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি তৎক্ষণাৎ চাঁদপুরেরর শ্রীযুক্ত হরদয়াল নাগকে টেলিগ্রাম করলেন যে ডাক
বাংলোয় নজরুল ইস্লাম ও মুজফ্ফর আহমদ রয়েছেন। তাদের দয়া ক'রে বারোটি টাকা
পৌছিয়ে দিন। নাগ মশায়ের তরফ হতে শ্রীকুলচন্দ্র সিংহ রায় এসে আমাদের বারোটি
টাকা দিয়ে গেলেন।... আমরা কলকাতা এসে পৌঁছালাম।'
কলকাতা ফেরার আগে নজরুলের রচিত
৪টি
কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়।
এর ভিতরে ছায়ানট কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত
২টি কবিতার সাথে রচনার
স্থান ও বৎসরের নাম পাওয়া যায়- 'কুমিল্লা আষাঢ় ১৩২৮'। এই কবিতাগুলো হলো-
নজরুল ইসলাম এবং
মুজাফ্ফর আহমদ ২৬ আষাঢ় (রবিবার ১০ জুলাই) কলকাতা পৌঁছান। এই সময় কলকাতায় এঁরা ৩/৪ সি তালতলা
লেনের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। মুজফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল
ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা হলো-
মুজাফ্ফর আহমদ
তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'য় এই
ছড়াটি রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লিখেছেন-
খুকী ও কাঠবেরালি" নজরুলের একটি শিশু কবিতা। তার
ঝিঙেফুল
নামক পুস্তকে কবিতাটি ছাপা হয়েছে । এর রচনার জায়গা কুমিল্লা। তবে, দৌলতপুর হতে
কুমিল্লায় ফিরে এসে সে কবিতাটি লিখেছিল, কিংবা তার পরের বারে লিখেছিল তা আমার
মনে নেই। এর রচনার পেছনে যে ঘটনা ঘটেছিল নজরুল তা আমাদের বলেছিল। সে একদিন দেখতে
পেল যে শ্রীইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের শিশু কন্যা জটু (ভালো নাম শ্রীমতী অঞ্জলি
সেন) একা একা কাঠবেরালির সঙ্গে কথা বলছে। তা দেখেই সে কবিতাটি লিখে ফেলে। এই
কবিতার 'রাঙা! দা' হচ্ছেন শরীবীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বৌদি তাঁর স্ত্রী, আর
ছোড়দি বীরেন সেনের বোন কমলা দাশগুপ্ত। 'রাঙা দিদি? মানে প্রমীলা সেনগপ্ত, পরে
নজরুল ইসলামের স্ত্রী!...'
...আমাদের ৩/৪-সি তালতলা লেনের বাড়ীটি ছিল চারখানা
ঘরের একটি পুরো দোতালা বাড়ী। তার দোতালায় ছখাননা ঘর
ও নীচের তলায় ছ'খানা ঘর ছিল। পুরো বাড়ীটি ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জিলার
পশ্চিমর্গার নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নাতিরা (দৌহিত্ররা)। তাঁরা নীচের ছখানা
ঘর আমাদের তাড়া দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে নীচেরও একখানা ঘরের তাদের
দরকার হয়। তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পুব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার
দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে
থাকি।...
১১ জুন (শনিবার ২৮শে জ্যৈষ্ঠ ), আলী আকবর একটি নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন।
অনেকের ধারণা, এই চিঠির খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন নজরুল। নজরুল এর প্রতিবাদ করে বিজলী
পত্রিকায় প্রেরণ করেন। এই প্রতিবাদ-লিপিটি ছাপা হয়েছিল বিজলী পত্রিকার '২২ জুলাই
১৯২১' সংখ্যায়।
[কবিবরের প্রতিবাদ]
সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল ভারত জুড়ে। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম তাঁর
বিবাহ-সঙ্কটের ধাক্কা।
সব মিলিয়ে নজরুল একটি অস্থির অবস্থার ভিতরে ছিলেন। এই অবস্থার
ভিতরে তাঁর রচিত মাত্র ১টি কবিতা ও ৩টি গানের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলো হলো-
ছায়ানট-এ অন্তর্ভুক্ত, 'কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশির ডাক শুনেছিস্ ওরে চখা'
[তথ্য]
গানটির সাথে রচনার স্থান ও সময় উল্লেখ আছে-
'কলিকাতা/শ্রাবণ ১৩২৮'। কিন্তু এই
গানটি গ্রন্থভুক্তির
আগেই ভারতী পত্রিকার 'বৈশাখ ১৩২৮'
সংখ্যার ৭০ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছিল।
নিঃসন্দেহে ছায়ানট কাব্যগ্রন্থে
উল্লিখিত তারিখটি ভুলক্রমে লেখা হয়েছিল।
কবিতা:
ছায়ানট
কাব্যগ্রন্থে
অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার সাথে রচনাকাল উল্লেখ আছে-'কলিকাতা, শ্রাবণ ১৩২৮'।
শিরোনাম:
বাদল-দিনে]
ছায়ানট
কাব্যগ্রন্থে
অন্তর্ভুক্ত এই কবিতার সাথে রচনাকাল উল্লেখ আছে-'কলিকাতা, শ্রাবণ ১৩২৮'।
শিরোনাম:
শেষের গান।
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। শ্রাবণ ১৩২৮ (জুলাই ১৯২১)। শিরোনাম: মা
কবিতাটি পরে
ঝিঙেফুল
[১৪ এপ্রিল ১৯২৬, বুধবার ১ বৈশাখ
১৩৩৩] কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এর অনেক পরে ১৯৩৭
খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে (অগ্রহায়ণ-পৌষ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) এইএচএমভি রেকর্ড
কোম্পানি থেকে যখন রেকর্ড নাটক 'মাতৃস্ত্রোত্র' প্রকাশিত হয়, তখন এই কবিতার
শেষাংশে সুরারোপ করে, তা গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই বিচারে বলা যায়,
গানটির বাণী অংশ রচিত হয়েছিল ১৩২৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের শেষে কিম্বা
শ্রাবণ মাসের শুরুতে। সুরারোপে সময় ধরা যেতে পারে ১৯৩৭ ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ
১৩৪৪) মাসের দিকে।
'মা'
শিরোনামে কবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
আগষ্ট ১৯২১ (১৬ শ্রাবণ- ১৫
ভাদ্র ১৩২৮)
ভারতী [শ্রাবণ ১৩২৮ (জুলাই-আগষ্ট ১৯২১)। শিরোনাম:
দুপুর-অভিসার (গৌড় সারঙ্-দাদরা)। পৃষ্ঠা: ৩০৫]
[নমুনা]।
গানটির
রচনাকাল: 'কলকাতা ফাল্গুন ১৩২৭।
গানটি
বিষের বাঁশী
কাব্যগ্রন্থে '
বিজয়-গান' অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। '
বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার'শ্রাবণ ১৩২৮' সংখ্যায় গানটি
প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গানটির সাথে রচনার স্থান উল্লেখ ছিল- কান্দিরপাড়, কুমিল্লা'।
গানটি রচিত হয়েছিল অগ্রহায়ণ মাসে।
গানটি উপাসনা পত্রিকার 'শ্রাবণ ১৩২৮' সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল।
আগষ্ট মাসে নজরুল আর্থিক ও মানসিক, উভয় অবস্থার বিচারে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন।
নানা ধরনের রচনার মধ্যে ডুবে থেকে তিনি
মানসিক যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও, আর্থিক সমস্যা মেটানোর ক্ষেত্রে
কোনো আশাব্যঞ্জক কাজ জুটিয়ে নিতে পারেন নি। এই মাসে রচিত
৫টি কবিতা ও ১টি প্রবন্ধের
সন্ধান পাওয়া যায়। তবে কত তারিখে রচনা করেছিলেন, তার উল্লেখ নেই।
এগুলো হলো-
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
সেপ্টেম্বর
১৯২১
(১৬ ভাদ্র- ১৪
আশ্বিন ১৩২৮)
মোসলেম ভারত।
'ভাদ্র ১৩২৮' সংখ্যায়
ভারতী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৮ (জুলাই-আগষ্ট ১৯২১)। সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
শিরোনাম: দুপুর-অভিসার। (গৌড় সারঙ্-দাদরা)পত্রিকা:
ভারতী [শ্রাবণ ১৩২৮ (জুলাই-আগষ্ট ১৯২১)। পৃষ্ঠা: ৩০৫]
কবিতাটি
নারায়ণ পত্রিকার 'ভাদ্র ১৩২৮' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ১০১৭।
এই মাসে নজরুল এবং মুজাফ্ফর আহমদ
থাকতেন ৩/৪-সি, তালতলা লেনে। সম্ভবত
সেপ্টেম্বর মাসের
আলী আকবর খান নজরুলের সাথে দেখা করার জন্য আসেন। তিনি
এসেছিলেন নজরুলকে অর্থের দ্বারা বশ করে, নার্গিসের সাথে বিবাহটা বজায় রাখার
জন্য। আলী আকবর খান টাকার তোড়া বের করে নজরুলকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলেছিলেন।
নজরুলকে কোনো ভাবেই বশ করতে না পেরে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পুরো
সময় মুজাফ্ফর আহমদ
নীরব দর্শক হয়ে বসেছিলেন। পরের দিন, নজরুল
বিরজাসুন্দরী দেবীকে লিখেছিলেন- 'মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে
গেল'।।
এই মাসে নজরুলের রচিত বেশ কিছু কবিতা গান বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
এগুলো হলো-
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
উল্লেখ্য,
কবি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'খাঁচার পাখি' কবিতা পড়ে ব্যথিত চিত্তে নজরুল
এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য,
কবি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চোখের অসুখের কারণে, সব কিছুই ঝাপসা দেখছিলেন। এই
অবস্থায় সবাই ভেবে নিয়েছিলেন যে, তিনি ক্রমে ক্রমে অন্ধ হয়ে যাবেন। এই বেদনা
থেকে
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
লিখেছিলেন 'খাঁচার পাখি' কবিতা। কবিতাটি মোসলেম ভারত
পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৮ (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৩২১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই
কবিতার প্রত্যুত্তরে নজরুল রচনা করেছিলেন 'দিলদরদী' কবিতা।
সত্যেন্দ্রনাথ এই কবিতা পাঠ করে অভিভূত হন এবং তিনি নজরুলের সাথে দেখা করার
জন্য তাঁর তৎকালীন তালতলা বাসায় আসেন। দুঃখের বিষয় এই সময় নজরুল বাসায়
ছিলেন না।
অক্টোবর ১৯২১
(১৫ আশ্বিন- ১৪ কার্তিক ১৩২৮)
ভারতী।
'বৈশাখ ১৩২৮'। শিরোভাগে রয়েছে- 'মা-মরা খোকার মৃত্যুশয্যায় পিতা গাচ্ছেন। সুর 'বৈকালী মেঠো
বাউল'। পৃষ্ঠা ৭০]
[নমুনা]
গানটি পরে
ছায়ানট
কাব্যগ্রন্থে
পলাতকা
শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। রচনার সাথে ভুলক্রমে
রচনাকাল উল্লেখ করা হয়েছে '...শ্রাবণ, ১৩২৮।'
মোসলেম ভারত পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩২৮। কলিকাতা/শ্রাবণ ১৩২৮'
(জুলাই-আগষ্ট ১৯২১)।
ছায়ানট
কাব্যগ্রন্থে গানটির রচনাকাল উল্লেখ আছে 'কলিকাতা/শ্রাবণ ১৩২৮'। গানটি
ছায়ানট
কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল 'বাদল-দিনে'
শিরোনামে।
যতদূর জানা যায় এই মাসে নজরুল
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র
সাথে
শান্তিনকেতনে
যান। এই সময়
রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের সময় নজরুল
প্রায় নিশ্চুপই ছিলেন। এই সময় তিনি
রবীন্দ্রনাথেকে তাঁর '
আগমনী' কবিতা আবৃত্তি করে
শোনান।
সম্ভবত নজরুলের সাথে
রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল, অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে। সে বছর
৪ তারিখে দুর্গাপূজা উপলক্ষে
শান্তিনকেতনের বিদ্যায়তনে ছুটি শুরু হয়। উল্লেখ্য, সেবার ৭ থেকে ১০ তারিখ (শুক্রবার-সোমবার,
২১-২৪ আশ্বিন ১৩২৮) এর ভিতরে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূজার ছুটির আগেই
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শারোদৎসব কেটেছেঁটে 'ঋণশোধ' নাটক তৈরি করেছিলেন এবং ৩ অক্টোবরের
১৯২১ (সোমবার ১৭ আশ্বিন ১৩২৮) সন্ধ্যায় নাট্যঘরে ওই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই নাটকে
রবীন্দ্রনাথ কবিশেখরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
এরপর ৪ তারিখ ঘোষিত ছুটিতে
রবীন্দ্রনাথ
শান্তিনকেতনে
কাটান। এই সময় উত্তরায়ণের
প্রান্তর-মধ্যস্থিত পর্ণকুটীরে বাস করতেন। এই সময়
রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে
এসেছিলেন অধ্যাপক এডোয়ার্ড টমসন, মাদ্রাজ থেকে কাজিন্স্ দম্পতি, অসুস্থ সুকুমার রায়
ও তার পরিবার। সে সময়ে
সত্যজিৎ রায় (জন্ম ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে) ছিলেন শিশু। আর কলকাতা থেকে দেখা করতে গিয়েছিলেন
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ও নজরুল ইসলাম। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রজীবনী'
তৃতীয় খণ্ড [পৃষ্ঠা ১১০] এবং প্রশান্তকুমার পালের 'রবিজীবনী' অষ্টম খণ্ড [পৃষ্ঠা
১৯৮] গ্রন্থে এই তথ্য পাওয়া যায়। তবে এঁরা কেউই
নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের তারিখ
উল্লেখ করেন নি।
সম্ভবত নজরুলের সাথে
রবীন্দ্রনাথের এই সাক্ষাৎ হয়েছিল ৪ অক্টোবর থেকে অক্টোবরের শেষ
সপ্তাহের ভিতরে। কারণ নজরুল এরপর কুমিল্লা ভ্রমণে গিয়েছিলেন এবং প্রায় এক মাস সেখানে
ছিলেন।
এই সময় নজরুল বেশ আর্থিক কষ্টের ভিতরে ছিলেন। তাছাড়া কুমিল্লা যাওয়ার জন্য অর্থের
জন্যও অর্থের প্রয়োজন ছিলেন। অর্থের এই চাহিদা মেটানোর জন্য তিনি '
রিক্তের
বেদন'
গল্প গ্রন্থের স্বত্ব বিক্রয় করে দিয়েছিলেন মাত্র ১০০ টাকায়।
অক্টোবর মাসে নজরুলের রচিত নতুন ৪টি কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর
ভিতরে দুটি কবিতা (আনোয়ার এবং কামাল পাশা) রচিত হয়েছিল তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলন
ও
খেলাফত আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকাশ করে। এর বাইরে ১টি শিশুতোষ কবিতা ও
একটি গান প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো-
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। 'কার্তিক ১৩২৮'। গানটি পরে '
বিষের বাঁশী'
কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শিরোনাম:
মরণ-বরণ]
নভেম্বর ১৯২১
(১৫ কার্তিক- ১৪ অগ্রহায়ণ ১৩২৮)
নভেম্বর মাসের প্রথম থেকে নজরুল কুমিল্লায় ছিলেন। এবারে তিনি কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের
ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন সেনগুপ্তের বাড়িতে
উঠেন। উল্লেখ্য, বীরেন সেনগুপ্ত তখন কুমিল্লা জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক
ছিলেন। এই সময় আশালতার সাথে নজরুলের পুনরায় দেখা হয়।
প্রায় এক মাসের বেশি নজরুল এই বাড়িতে ছিলেন। এর ভিতরে নজরুল ও আশালতার মধ্যে প্রণয়
গড়ে উঠে।
১৭ই নভেম্বর (বৃহস্পতিবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৩২৮)
প্রিন্স্ অব ওয়েল্সের
বোম্বাই বন্দরে পৌঁছার ভারত-ভ্রমণ
আসার খবরে, সে সময়ের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। এই অবস্থায়
২১শে নভেম্বর
(সোমবার
৫ অগ্রহায়ণ ১৩২৮),
কংগ্রেস-ঘোষিত
সারাদেশ ব্যাপী হরতালের ডাক ফিয়েছিল। এই
হরতাল উপলক্ষে কুমিল্লায়
কংগ্রেস কর্মীরা কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। এই অবস্থায় আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য,
স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা নজরুলকে একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এই গানটি
হল-
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
গানটি রচনার প্রেক্ষাপট ও সময় সম্পর্কে গুলিস্তাঁ-র নজরুল সংখ্যায়- আফতাব-উল্ ইসলাম
লিখেছেন-
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!...'।
ডিসেম্বর ১৯২১
(১৫ অগ্রহায়ণ- ১৬ পৌষ ১৩২৮)
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের শেষে বা ডিসেম্বর মাসের প্রথম
সপ্তাহে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং যথারীতি
মুজাফ্ফর আহমদের
সাথে ৩/৪ সি তালতলা লেনে বাস করতে থাকেন। এই
সময় নজরুল বেকার ছিলেন। কিন্তু অক্টোবর মাসে
রিক্তের
বেদন -এর গ্রন্থ স্বত্ব বিক্রয়ের টাকা তাঁর কাছে
থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ টাকা দিয়ে বেশি চলা অসম্ভব। কিন্তু তাঁর সামনে এমন কোনো
নতুন কাজের সুযোগও ছিল না।
সম্ভবত, ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে
মুজাফ্ফর আহমদ
এবং তাঁর
রাজনৈতিক সহকর্মীরা একত্রিত হয়ে, কমুনিষ্ট পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এই
সহকর্মীদের দলে নজরুলও ছিলেন। পরে মস্কো থেকে এমএন রায়ের দূতের সাথে মুজফ্ফর ও
নজরুলের সাথে দেখা করেছিলেন।
এই মাসের কোন এক সময় ভূপতি মজুমদারের আমন্ত্রণে নজরুল হুগলি বিদ্যামন্দিরের এক
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি গান ও কবিতা আবৃত্তি
করেছিলেন।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে রচনা করেন বিখ্যাত গান-
জানুয়ারি ১৯২২ (১৭ পৌষ - ১৮ মাঘ ১৩২৮)
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গালার
কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য,
ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার
করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। বাসন্তী
দেবী তাঁর পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠানোর জন্য সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে
পাঠান। সেই সূত্রে নজরুল ইসলাম এই কবিতাটি রচনা করে সুকুমাররঞ্জন দাশ-এর হাতে অর্পণ
করেন। তিনি (চিত্তরঞ্জন দাশ) এই গানটি হুগলী জেলে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত
বন্দী এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে গাইতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই কবিতার 'যত সব বন্দী-শালায়'
অংশটি 'বন্দী-শালা' পড়ে হট্টগোল করে। পরে অবশ্য তাঁরা
তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত সরকার
গানটিকে নিষিদ্ধ করেছিল।
'ভাঙার গান' শীর্ষক গানটি সম্পর্কে
কমরেড
মুজাফ্ফর আহমদ
'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন-
"আমার
সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গালার কথা'র জন্য একটি কবিতা
চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। ... অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা
লেখা শুরু ক'রে দিল। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ
কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি
আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল। ... নজরুল 'ভাঙার-গান' লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর
মাসের কোনো এক তারিখে। 'ভাঙার গান' বাঙ্গালার কথা'য় ছাপা হয়েছিল।"
কবিতাকারে এই গানটি প্রকাশিত হয়েছিল
'বাঙ্গালার কথা' পত্রিকার ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ২০ শে জানুয়ারি
(শুক্রবার ৭ মাঘ ১৩২৮)।
গান হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে, কলম্বিয়া
রেকর্ড কোম্পানি থেকে। রেকর্ড নম্বর জি.ই ৭৫০৬। নিতাই ঘটকের পরিচালনায় প্রকাশিত
এই রেকর্ডের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। এরপর
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এই গানটির দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশ করে এইচ.এম.ভি। রেকর্ড নম্বর- এন. ৩১১৫২। এই গানটিরও শিল্পী ছিলেন গিরীন
চক্রবর্তী। গানটি 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।
গানটি 'ভাঙার গান' [শ্রাবণ ১৩৩১] গ্রন্থে
ভাঙার
গান শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বিদ্রোহী কবিতা ও নজরুল ইসলাম
ডিসেম্বর মাসের শেষের
দিকে নজরুল ইসলাম, কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাসায়, তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'
রচনা করেন। কিন্তু বিজলী, মোসলেম ভারত এবং প্রবাসী পত্রিকার মাধ্যমে পৌঁছেছিল
জানুয়ারি মাসে। পরে কবিতাটি
অগ্নি-বীণা
[ অক্টোবর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, কার্তিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দ]
কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
মুজাফ্ফর আহমদ
তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে এই কবিতা রচনা
সম্পর্কে লিখেছেন-
'...তখন নজরুল
আর আমি নীচের তলার পুব
দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নীচেকার দক্ষিণ-পূব কোণের ঘরটি নিয়ে
থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার "বিদ্রোহী"
কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির
কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে
পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি
এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে । পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল।
"বিদ্রোহী" কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।'
বিদ্রোহী কবিতার প্রকাশ
রাত জেগে নজরুল যে কবিতাটি লেখার পর, তা পড়ে শোনানোর জন্য শ্রোতার অপেক্ষায়
ছিলেন।
মুজাফ্ফর আহমদ ছিলেন এই কবিতাটির প্রথম শ্রোতা।
একটু বেলা বাড়ার পর,
আফজাল-উল হক আসেন।
নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। পরে কবিতাটির একটি কপি করে মোসলেম ভারতে প্রকাশের
জন্য
আফজাল-উল হককে দেন। এরপর আসেন অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি
শোনান। মোসলেম ভারতে
কবিতাট প্রকাশের জন্য
আফজাল-উল হককে
দিয়েছেন, এই কথা শোনার পর, অবিনাশচন্দ্র জানান যে, মোসলেম ভারতের প্রকাশ অনিয়মিত। তার বদলে
তিনি নিয়মিত পত্রিকা হিসেবে 'বিজলী'-তে প্রকাশের পরামর্শ দেন। পরে নজরুল এই কবিতার একটি কপি অবিনাশচন্দ্রকেও
দিয়েছিলেন।
ধূমকেতু কবিতার প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় [১১ আগষ্ট ১৯২২ (শুক্রবার, ২৬
শ্রাবণ ১৩২৯), সানাই-এর পোঁ- বিভাগে মুদ্রিত এই কবিতার শেষে বলা হয়, 'এই কবিতাটি
প্রথমে 'মোস্লেম ভারতে' বের হয়। পরে এটা 'বিজলী' 'প্রবাসী' প্রভৃতি পত্রিকায়
উদ্ধৃত হয়।...'।
মোসলেম ভারতের 'কার্তিক ১৩২৮' সংখ্যায়
কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য, মোসলেম ভারত পত্রিকাটি প্রায়ই যথাযথ সময়ে প্রকাশিত হতো না।
নজরুল যখন এই বিদ্রোহী কবিতাটি মোসলেম ভারতের জন্য
আফজাল-উল হককে দেন, তখনও এর
কার্তিক সংখ্যা প্রকাশিত হয় নি। ফলে পৌষ মাসে রচিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল
'কার্তিক ১৩২৮' সংখ্যায়।
'বিজলী' পত্রিকার '২২ পৌষ ১৩২৮'
(শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি
১৯২২) সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
কবিতাটি প্রকাশের পর, পত্রিকার প্রথম বারের সকল
সংখ্যা বিক্রয় হয়ে যায়। ফলে বিজলী পত্রিকা এক সপ্তাহের ভিতরে দ্বিতীয়বার ছাপা
হয়। কথিত আছে বিজলী'র ওই সংখ্যা দুই বারে মুদ্রিত হয়েছিল ঊনত্রিশ হাজার।
বিজলী ও মোসলেম ভারতের
পরে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল প্রবাসী
পত্রিকায় 'মাঘ ১৩২৮' সংখ্যায়। এর পর পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল,
সাধনা পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৯ (এপ্রিল ১৯২২) সংখ্যায়।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে কলিকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস হইতে প্রকাশিত 'অগ্নিবীণা'র দ্বিতীয় সংস্করণেও এই পাচটি
পঙক্তি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সংস্করণে এই পঙক্তিগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে। 'বিদ্রোহী' পাঠে কবি গোলাম মোস্তফা ১৩২৮ মাঘের
'সওগাত' পত্রিকায় লিখেছিলেন 'নিয়ন্ত্রিত'। সাধনা পত্রিকার 'বৈশাখ ১৩২৯' সংখ্যায় 'বিদ্রোহী' ও
'নিয়ন্ত্রিত পুনমুদ্রিত হইয়েছিল।
বিদ্রোহীর পাঠভেদ: 'মোসলেম ভারতে প্রকাশিত 'বিদ্রোহী' কবিতাটির ৯১-
৯৪ সংখ্যক চরণগুলি ছিল নিম্নরূপ ছিল-
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
হাসি হা-হা হা-হা হি-হি হি-হি,
তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃস্রবা বাহন আমার
হাকে চি-হি-হি-হি-চি-হি-হি-হি।
এছাড়া মোসলেম ভারতে প্রকাশিত 'বিদ্রোহী কবিতাতে 'আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার' পংক্তিটির পূর্বে ছিল এই পাচটি
পঙক্তি। এই পঙক্তিগুলো হলো
আমি উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল,
আমি বিবসন, আজ ধরাতল নভ ছেয়েছে আমারি জটাজাল।
আমি ধন্য। আমি ধন্য !!
আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীর, বিদ্রোহী সৈন্য!
আমি ধন্য! আমি ধন্য!!
বিদ্রোহী কবিতার খ্যাতি এবং খ্যাতির বিড়ম্বনা
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর নজরুলের কবি খ্যাতি বেড়ে গিয়েছিল অসম্ভব রকম। ফলে
নজরুলকে খ্যাতির বিড়ম্বনা ভোগ করার পাশাপাশি নজরুল-বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করতে
হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই কবিতার সূত্রে তৈরি হয়েছিল নানা ধরনের গালগল্প।
বিদ্রোহী কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল
মাসিক বসুমতী পত্রিকার কার্তিক ১৩৩১ সংখ্যায়,
বিজলী পত্রিকা গোষ্ঠীর
অবিনাশ ভট্টাচার্যের 'পুরানো কথা' নামক রচনায় লিখেছিলেন-
অবিনাশ ভট্টাচার্যের এই লেখা পড়ে অনেকে ঘটনাটি সত্যাসত্য নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। কারণ, নজরুল রবীন্দ্রনাথক গুরুদেব সম্বোধন করতেন। কিন্তু এই ঘটনায় নজরুল সম্বোধন করেছিলেন 'গুরুজি'।বিদ্রোহী ছাড়া এই মাসে নতুন ১টি কবিতা ও ২টি ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো-
বিজলী পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ২২ পৌষ ১৩২৮ (৬ জানুয়ারি ১৯২২) তারিখে। অবিনাশ ভট্টাচার্যের বর্ণনা অনুসারে জানা যায়- নজরুল রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে গিয়েছিলেন ৭ই জানুয়ারি। মজার বিষয় হলো- রবীন্দ্রনাথ এই দিন জোড়াসাঁকোতে ছিলেন না। প্রশান্তকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবিজীবনী গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে রবীন্দ্রজীবনের যে কালানুক্রমিক বিবরণ দিয়েছেন, তা অনুসরণ করে এই বিষয়ে যে ধারণা পাওয়া যায়, তা হলো-মোট কথা ৭ই জানুয়ারি কলকাতায় নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয় নি। মূলত রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসেছিলে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে। হয়তো নজরুল ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে এই কবিতাটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের পরে। তবে 'রবীন্দ্রজীবনী' ও রবিজীবনীতে এর উল্লেখ নেই।
- ২৮ ডিসেম্বর (১৩ পৌষ)। রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামের জন্য কলকাতা হয়ে শিলাইদহের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
- ৬ জানুয়ারি (২২ পৌষ)। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে কলকাতা হয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। উল্লেখ্য এই দিন 'বিজলী' পত্রিকার '২২ পৌষ ১৩২৮' সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এই দিন তিনি শান্তিনিকেতন থেকে 'রাণু'কে একটি চিঠি লিখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে পৌঁছে তিনি 'পথ' নামক একটি নাটক রচনায় হাত দেন। ৩০শে পৌষ এই নাটকটি তিনি আশ্রমবাসীদের শুনিয়েছিলেন।
বিদ্রোহী কবিতা ও মোহিতলাল মজুমদার
আগেই উল্লেখ করেছি, মোসলেম ভারত পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৭ সংখ্যায় (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর), কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের কবিতার প্রশংসা করেন এবং পত্রিকার সম্পাদককে একটি পত্র লেখেন। পরে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় নজরুলের সাথে মোহিতলাল মজুমদাররের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আগষ্ট মাসের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমভাগে। এই সময় মোহিতলাল নেবুতলার ক্যালকাটা হাইস্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। তাঁর স্কুল ছুটি হওয়ার পর, ৮/এ টার্নার স্ট্রিটের নজরুলের বাসায় আসতেন আড্ডা দেওয়ার জন্য। এই সময় নজরুলের সাথে অন্যান্যদের আড্ডা হতো ৩২, কলেজ স্ট্রিটে, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের গজেন ঘোষের সাহিত্যের আসরে। এছাড়া নজরুল এই সময় বিভিন্ন আসরে গান গাওয়ার জন্যও যেতেন। এসব আসরে মোহিতলাল নিয়মিত যোগ দিতেন। পরে নজরুল এবং মুজফ্ফর যখন ৩/৪ সি তালতলা লেনে থাকা শুরু করেন, তখনও মোহিতলালের আনাগোণা ছিল।
এই সময়ের ভিতরে কোনো কারণে প্রবাসী পত্রিকার সাথে মোহিতলালের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রথম সাক্ষাতের দিনে তিনি নজরুলকে প্রবাসী পত্রিকায় লেখা না পাঠানোর জন্য অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছিলেন। নজরুল বন্ধুত্ব রক্ষার্থে প্রবাসীতে লেখা পাঠানো বন্ধ রেখেছিলেন। সম্ভবত নজরুলের সাথে মোহিতলালের সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাতের সূত্রে। মোহিতলাল নজরুলের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মোহিতলাল অগ্রগামী ছিলেন। এই সূত্রে মোহিতলাল নানা পরামর্শ দিয়ে নিজের শিষ্য করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অনেক সময় জোর জবরদস্তিও করেছেন। তিনি অযাচিতভাবে নজরুলকে ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যে পণ্ডিত করে তোলার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মোহিতলালের এই মাস্টারি ও অভিভাবকত্ব ফলানোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অক্টোবর মাসের মধ্যে উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এই সময় তিনি নজরুলের বাসায় বা কোনো আড্ডাখানায় এলেও উভয়ের মধ্যে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ছাড়া তেমন কোনো আন্তরিক আলাপ হতোই না। এই দূরত্বকে অসীম করে দিয়েছিল- 'বিদ্রোহী' কবিতা।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর মোহিতলাল মজুমদার দাবি করেন যে, নজরুলর তাঁর রচিত 'আমি' নামক একটি গদ্য অনুসরণ করে এই কবিতা রচনা করেছেন, কিন্তু তিনি এর জন্য কোনো ঋণ স্বীকার করেন নি। এ দাবিটি তিনি কোনো পত্রিকায় প্রকাশ না করলেও তাঁর নিজের কিছু লোকের মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। প্রথম দিকে এই কবিতা রচনায় 'মোহিতলালের ঋণ স্বীকার না করা' প্রসঙ্গে বললেও পরে প্রচার করা হয়েছিল যে, নজরুল কবিতাটি চুরি করেছেন। পরবর্তী সময়ে মোহিতলালের এই প্রচার ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল এবং সেই সাথে নজরুলের সাথে বন্ধুত্ব চিরতরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, মানসী পত্রিকার 'পৌষ ১৩২১ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় মোহিতলালের 'আমি' প্রকাশিত হয়েছিল। [পৃষ্ঠা ৫৭২-৫৭৭]। তবে এটি ছিল একটি প্রবন্ধ। মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি'র অফিসে মানসী পত্রিকার 'পৌষ ১৩২১ বঙ্গাব্দ' সংখ্যায় প্রকাশিত, মোহিতলাল তাঁর রচিত 'আমি' প্রবন্ধটি পাঠ করে নজরুলকে শুনিয়েছিলেন।
এই প্রবন্ধটি থেকে নজরুল হয়তো বিদ্রোহী কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কিন্তু নজরুল চুরি করেছিলেন, তা ভাবার কারণ নেই। তাছাড়া মোহিতলালের প্রবন্ধটি পড়ে মুজফ্ফর আহমেদ বা মানসীর পাঠকরা খুব একটা আমল দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না। কারণ মোহিতলালের এই রচনা প্রকাশের পর হৈচৈ হওয়া দূরে থাক, সামান্য আলোচনা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে 'বিদ্রোহী' তৎকালীন বাঙালি কাব্যরসিকদের বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এই কবিতার জন্য বিজলী পত্রিকার প্রথম বারের সকল সংখ্যা বিক্রয় হয়ে গিয়েছিল। এবং এক সপ্তাহের ভিতরে পত্রিকার ঐ সংখ্যা দ্বিতীয়বার ছাপতে হয়। কথিত আছে বিজলী'র ওই সংখ্যা দুই বারে মুদ্রিত হয়েছিল ঊনত্রিশ হাজার। এরপরে 'মোসলেম ভারত'-এও কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকার কাটতির জন্য।
মার্চ ১৯২২ [১৬ ফাল্গুন- ১৭ চৈত্র ১৩২৮]
- অতৃপ্ত কামনা [শ্রাবণ ১৩২৭। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা]
- ঘুমের ঘোরে [ফাল্গুন-চৈত্র ১৩২৬। নূর]
- বাদল-বরিষণ [শ্রাবণ ১৩২৭। মোসলেম ভারত]
- ব্যথার দান [মাঘ ১৩২৬। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা]
- রাজবন্দীর চিঠি [প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালে রচিত]
- হেনা [কার্তিক ১৩২৬। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা]
'...নিজের শরীরও ভালো নয়। মনের অশান্তির আগুন দাবানলের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। অবশ্য ‘আমি নিজেই নিজের ব্যথা করি সৃজন’! হ্যাঁ আমায় আজই কুড়িটি টাকা টেলিগ্রাফ-মানিঅর্ডার করে পাঠাবেন kindly । বড্ড বিপদে পড়েছি। আর কারুর কাছে আমি যাই-ই হই, আপনার কাছেও আমি হয়তো ভালোতে-মন্দতে মিশে তেমনই আছি। এই অসময়ে আমার আর কেউ নেই দেখে আপনারই শরণ নিলুম। আশাকরি বঞ্চিত হব না, তা আপনি যত দুর্দশাগ্রস্ত হোন না কেন। টাকা চাই-ই-চাই, ভাই! নইলে যেতে পারব না! অনেক কষ্ট দিলুম 'আরও দেব।এই মাসে প্রকাশিত কবিতা ও গান
১ মে-২৪ মে ১৯২২ [১৮ বৈশাখ-১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯]
জ্যৈষ্ঠ মাসে কুমিল্লায় থাকাকালে তাঁর রচিত ৩টি নতুন কবিতা গানের সন্ধান পাওয়া যায়। এই রচনাগুলো হলো-
কবিতা:
- বেদনা-অভিমান। রচনা: দৌলতপুর, কুমিল্লা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮। ছায়ানট প্রথম সংস্করণে [আশ্বিন ১৩৩২] অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
- শায়ক-বেঁধা পাখী। রচনা: কুমিল্লা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮। ছায়ানট প্রথম সংস্করণে [আশ্বিন ১৩৩২] অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বঙ্গবাণী পত্রিকার 'আষাঢ় ১৩২৯' সংখ্যায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। [নমুনা]
- হারা-মণি। রচনা: কুমিল্লা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮। ছায়ানট প্রথম সংস্করণে [আশ্বিন ১৩৩২] অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। নারায়ণ পত্রিকার 'কার্তিক ১৩২৮ ' সংখ্যায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ১২১৬-১২১৭। [নমুনা]
এই মাসে প্রকাশিত পূর্বে রচিত রচনা
ঘোর্ ঘোর্ রে ঘোর্ রে আমার [তথ্য]
১৯১৭
খ্রিষ্টাব্দে
মহাত্মা গান্ধী
চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশ প্রেরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সাফল্য লাভ করেন। এই আন্দোলনে সাফল্য লাভ করার
পর, তিনি চরকায় সুতা কেটে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরির পরিকল্পনা করেন।
মহাত্মা গান্ধী
নিজে চরকায় সুতা কাটা শুরু করেন। এই সময় নজরুল
করাচিস্থ ৪৯ নম্বর বাঙালি প্লটনের সদর দফতরে চাকরিরত ছিলেন। বাঙালি পল্টন
থেকে ফেরার পর তিনি গান্ধীজির ভক্ত হয়ে পড়েন। নজরুল গান্ধীজির চরকা আন্দোলনের প্রতি বিশেষ
অনুরক্ত ছিলেন। সম্ভবত ১৯২১-১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চরকা নিয়ে তিনি
এই
গানটি রচনা করেছিলেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসউদ্দীন
আহমদ রাজশাহী কলেজে বিএ (থার্ড ইয়ার)- শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। এই সময় প্রফুল্ল
চন্দ্র রায় রাজশাহীতে আসেন। তিনি ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা দেন। এই সভায় আব্বাসউদ্দীন
এই গানটি পরিবেশন করেছিলেন। আব্বাসউদ্দীন তাঁর 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' [পরিবেশনা
হরফ প্রকাশনী। পৃষ্ঠা: ৪৯] গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন- '...আমি গেয়েছিলেম সে সভায় "ঘোর
ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর"। আজো যেন আমার পিঠে সাবাস্ বলে ধপাস্ ধপাস্ করে কিলের
ব্যথাটা ব্যথা-মধুর হয়ে জেগে আছে!'
নজরুলের ২২ বৎসর অতিক্রান্ত বয়সের শেষ প্রান্তে আর কোনো গান রচনার কথা জানা যায় না। তাঁর ২৩তম জন্মদিন পালিত হয়েছিল কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে।
সূত্র: