...তিনি আমার হাতে দিলেন যে অনির্বাণ দীপ-শিখা সেই দীপ-শিখা হাতে লইয়া আজ বার বৎসর ধরিয়া পথ চলিতেছি। আর অগ্রে চলিতেছেন তিনি পার্থ-সারথি রূপে।এ প্রসঙ্গে আজাহারউদ্দীন লিখেছেন- ' বাড়ির চিলে কোঠায় কালী প্রতিমা স্থাপন করে সকাল-সন্ধ্যা মন্ত্রজপ করতে শুরু করলেন। কোন কোন বার নিরম্বু উপবাস করে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে পূজা গৃহে দিন দুই কাটিয়ে দিতেন।'
আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মিটে নাই, কিন্তু সে এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি। আমি আমার আনন্দ-রস-ঘন স্বরূপকে দেখিয়াছি। কি দেখিয়াছি, কি পাইয়াছি, আজও তাহা বলিবার আদেশ পাই নাই।'
'দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা' অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে প্রকীর্তিতা। মোট কথা দুর্গ নামক দৈত্যকে দমন করে তিনি দুর্গা নাম প্রাপ্ত হন। দুর্গা শব্দের বর্ণবইশ্লেষণে- এই গ্রন্থে বলা হয়েছে- 'দ' অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, 'রেফ' রোগনাশক, 'গ' অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।পৌরাণিক কাহিনিতে- দুর্গা
আদ্যাশক্তি: খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে বেদব্যাস (বেদবিভাজক বেদব্যাস নয়)-কর্তৃক রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে - আদিকালে যখন যোগনিদ্রায় ছিলেন, তখন বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে উৎপন্ন মধু ও কৈটভ [মধুকৈটভ] নামক দুটি ভয়ঙ্কর অসুর ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল। এই যোগনিদ্রায়ই ছিলেন দেবী মহামায়া। এই সময় ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভিমূলে আশ্রয় নিয়ে যোগনিদ্রারূপী এই দেবীকে বন্দনা করেন। এই বন্দনার একাংশে ব্রহ্মা বলেন যে, - তিনি (ব্রহ্মা), বিষ্ণু ও মহাদেব এই দেবীর প্রভাবে শরীর লাভ করেছেন। তিনি মহাদেবের শক্তি হিসেবে বিরাজ করেন। ব্রহ্মার বন্দনায় সন্তুষ্ট হয়ে, যোগমায়ারূপী এই দেবী, চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় ও বক্ষস্থল থেকে বাহির হয়ে, দেবীরূপে আবির্ভূতা হন।নজরুল সঙ্গীতে দুর্গাবিষয়ক গানের শ্রেণিকরণ:
২. আদ্যাদেবী রূপ সতী
বিভিন্ন পুরাণ মতে– এই দেবী দক্ষের কন্যা হিসাবে সতী নামে পরিচিতা। কালিকা পুরাণ মতে– দক্ষ মহামায়াকে [দুর্গা] কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেন। দক্ষের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষকে বলেন, –তিনি অবিলম্বে তাঁর (দক্ষের) পত্নীর গর্ভে তাঁর কন্যারূপ জন্মগ্রহণ করবেন এবং মহাদেব-এর স্ত্রী হবেন। তবে তাঁকে (দুর্গাকে) যথাযথ সমাদর না করলে তিনি দেহত্যাগ করবেন। এরপর দক্ষ অসিক্লী-কে বিবাহ করেন। বীরিণী'র গর্ভে মহামায়া জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষ এঁর নাম রাখেন সতী। [১-৪৪। অষ্টমোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]
৩. মহিষাসুর উপাখ্যান: মার্কেণ্ডয় পুরাণের ৮২তম অধ্যায়ে রয়েছে- মহিষাসুর উপাখ্যান। এই উপাখ্যানে পাওয়া যায়- মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতারিত করে স্বর্গ অধিকার করেছিল। পরাজিত দেবতারা এর প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। তাঁরা সবিস্তারে অসুরেদের অত্যাচারের কথা ব্যক্ত করেন। দেবতাদের এই অভিযোগ শোনার পর- ব্রহ্মাবিষ্ণু মহেশ্বর ক্রোধান্বিত হলে, তাঁদের তেজ প্রকাশিত হয়। এই সময় অন্যান্য দেবতারাও তাঁদের তেজ ত্যাগ করেন। এই সম্মলিত তেজরাশি থেকে দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। দেবতার তেজ থেকে এই দুর্গার শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয়েছিল। এ রূপগুলো হলো– মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙ্গুল, বসুদের তেজে হাতের আঙ্গুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হয়েছিল।
৪. শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ উপখ্যান
মার্কেণ্ডয় পুরাণের মতে- শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুর ইন্দ্রপুরী দখল করে ত্রিলোক অধিকার করে। এরা সূর্য ও চন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এছাড়া কুবের, যম, বরুণ , অগ্নি, ও বায়ুর অধিকার লাভ করে। এরপর দেবতারা মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে এসে- দুর্গার আরাধনা করেন। আরাধনায় তুষ্ট হয়ে এই দেবী প্রথমে মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ ধরে দেবতাদের কাছে আসেন এবং পরে একটি বিশেষ মূর্তি ধারণ করেন। এই মূর্তিতে এঁর চার হাত ও গলায় নরমুণ্ডমালা ছিল। এই মূর্তি মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ মাতঙ্গী'র দেহরূপ থেকে নির্গত হয়েছিল বলে– এর নাম হয়েছিল মাতঙ্গী। এই মূর্তীতে দুর্গার মাথায় একটি মাত্র জটা থাকায় ইনি একজটা নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে, হিমালয়ে গিয়ে দেবতারা দেবীর স্তব করেছিলেন। এই সময় পার্বতী জাহ্নবী নদীতে স্নান করতে অগ্রসর হলে, দেবতাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার স্তব করছো। এই বাক্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে, পার্বতীর শরীরকোষ থেকে দুর্গা দেবী প্রকাশিত হলেন। এই কারণে, দেবীর অপর নাম কৌষিকী। এরপর পার্বতী কৃষ্ণকায় মূর্তি ধারণ করলেন। এই রূপের জন্য তিনি কালিকা নামে অভিহিত হলেন।
মহালয়ার সূচনা হয় পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। মহালয়াতে তিথিতে পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানেরা তাঁদের পূর্বপুরুষের স্মরণ করে, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসেন, প্রয়াত আত্মা যে সমাবেশ হয় বলে এর নাম মহালয়। এই মহালয় থেকে মহালয়া। মহালয়াতে গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করা হয় পূর্বপুরুষের আত্মারবং জগতের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা ও জল ও তিল দিয়ে অঞ্জলি প্রদান করেন । প্রয়াত আত্মাদের শান্তি কামনায় নিবেদিত অনুষ্ঠানকে তর্পণ বলা হয়।
দেবীপক্ষের সূচনা হিসেবে মহালয়াতে অনানুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাকে আহ্বান করা হয়। এই সূত্রে দুর্গার আগমন উপলক্ষে রচিত গানগুলোকে মহালয়ার গান নামে অভিহিত করা হয়। নজরুলের রচিত মহালয়ার আগমনী গানগুলো হলো-
- ওরে আলয়ে আজ মহালয়া (এলো মা আমার মা) [তথ্য]
মন্মমথ রায়ের রচিত 'সতী' নাটকের গান
২. দুরগা বন্দনা: এই জাতীয় গানে দেবী দুর্গাকে বন্দনা করা হয়েছে। এই শ্রেণির গানে দুর্গা-বন্দনা উপস্থাপিত হয়েছে দুটি ধারায়।
৪.পরমভক্তি: এই জাতীয় গানে ভক্ত দেবীর কাছে পরমভক্তিতে সমর্পিত। শত-সহস্র আঘাত, দুঃখ-বেদনার মধ্যেও ভক্ত দেবী-ভক্তি থেকে বিচ্যুত হয় না। যেমন-
৫. প্রার্থনা: সংসারের মোহ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে- নিজের অপারগতা প্রকাশ করে, দেবীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তি প্রার্থনা করা হয়েছে এই জাতীয় গানে। পরম দুঃখকে অবহেলা করে দেবীকে পাওয়ার আনন্দই যেন এই গানের ভক্তিরস। এ ছাড়া এই জাতীয় গানে অতীতের কৃত্কর্মে জন্য অনুতপ্ত হয়ে, দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এই জাতীয় গানে।
৬. অনুযোগ: যাপিত জীবনের বহু দুঃখের কারণ অজ্ঞাত থাকে। এই কারণ অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়ে কখনো কখনো ভক্ত তার আরাধ্য প্রভুর কাছে অনুযোগ প্রকাশ করে থাকে। এই জাতীয় শাক্তসঙ্গীতে এই অনুভাবের উপস্থাপন করা হয়েছে।
৭. আত্মবোধন: এই জাতীয় গানে নিজের উপলব্ধিকে নিজেকে সংশোধনের জন্য নির্দেশিত করে। এই শ্রেণির গানের বাণীর তুই, তোর ইত্যাদি হলো ভক্ত নিজেই। যেমন-
৮. শৈব-সঙ্গীত: শাক্ত সঙ্গীতের মূল দেবী দুর্গা। কিন্তু দুর্গার স্বামী হিসেবে দুর্গার শিবের অংশভাগী। তাই শিব-বন্দনাও শাক্ত-সঙ্গীতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনি-
৯. হাস্যরসাত্মক শাক্তসঙ্গীত: এই জাতীয় গানে- সামাজিক ও পৌরাণিক নানা অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গা করে হাস্যরসোদ্দীপক রচিত কিছু শাক্তসঙ্গীতও রচনা করেন। যেমন-
নজরুলের শাক্তসঙ্গীতে ব্যবহৃত রাগ
শাক্তসঙ্গীতে রাগসমূহ:
নজরুলের রচিত শাক্তসঙ্গীতের সংখ্যা ২৩৮। এর ভিতরে
রাগের নাম পাওয়া যায় মোট ৫২টি এই রাগগুলো হলো-
এরমধ্যে ভৈরবী রাগে ৬টি, দেশ
রাগে ৫টি, বাগেশ্রী রাগে ৪টি, কাফি-সিন্ধুরাগে ৪টি, দরবাড়ী কানড়া, জৌনপুরী ও কৌশিক
কানাড়া রাগে ২টি করে এবং বাকি রাগগুলোতে ১টি করে গান পাওয়া যায়।
নজরুলের শাক্তসঙ্গীতের তাল
নজরুলের রচিত শাক্ত সঙ্গীতের বর্ণানুক্রমিক তালিকা